আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬]

বিষয় : ধর্ম 

দিনকয়েক আগে সিয়ারাম ফোন করেছিল । শনিবার সকাল সাড়ে সাতটায়। ঘুম ভাঙলেও শীতের সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। শুয়ে শুয়েই কথা হল।

সিয়ারাম সাহ আমার খড়গপুরের সহপাঠী। একটু বেশি বয়সেইতখন ও প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁইকানাডায় অভিবাসী হয়ে যায়। প্রচণ্ড মেধাবী, বিহার বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিকে একদম উপরের দিকে ছিল। ফলে বেশি বয়সে দেশ ছাড়লেও বর্তমানে প্রবাসজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত।

কথায় কথায় জানালো আগামী আগস্ট মাসে দেশে যাচ্ছেঅন্যান্য কাজের সঙ্গে পৈতৃক ভিটেয় একটা শিব মন্দির স্থাপন করবে। আমার তরফে বিশেষ প্রতিক্রিয়া না দেখে (কথা হচ্ছিল ভিডিও কলে) হেসে মন্তব্য করল: “জানি সিদ্ধার্থ্ তুমি নাস্তিক, আমি কিন্তু আজও গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী। এক supreme being আছেন, যিনি আমাদের জীবন চালনা করেন। বহুবার চরম বিপদের মুহূর্তে প্রার্থনা করেছি, এবং অবিশ্বাস্য ফল পেয়েছি।

বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহুদূর। আমার কম্যুনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী বাবা শৈশবেই আমার ধর্ম সম্পর্কিত বিশ্বাস ও চিন্তাধারায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিলেন। বাবা এই নাস্তিকতা আজীবন বজায় রেখেছিলেনজীবনের শেষ সাত মাস ক্যানসারের যন্ত্রণা সহ্য করে গেছেন একবারও ঈশ্বরের নাম না করে।

তাই সিয়ারামের কথা শুনে গেলাম কেবল বিনা তর্কে, বিনা মন্তব্যে। বাবা অবশ্য মাঝে মাঝে ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করতেন। আমি এ বিষয়ে অনেক বেশি সহিষ্ণুঅপরের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করি। আমার জীবনসঙ্গিনী নিয়মিত পুজো করেন, কোনদিনও ঠাট্টা ইয়ার্কি করিনি। দুর্গা পুজোর সামাজিক মেলামেশাটা খুবই উপভোগ করি, কিন্তু অঞ্জলির সময় চুপচাপ পূজামণ্ডপ থেকে বেরিয়ে আসি। মনে হয় আমার অবিশ্বাস ভরা উপস্থিতিতে যথার্থভাবে ভক্তদের অপমানিত করা হবে।

canada
প্রবাসজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত কানাডার অভিবাসী সিয়ারাম

দিনকয়েক আগে ফেসবুকে আমার এক সাম্প্রতিক লেখায় এক ভদ্রলোক মন্তব্য করেছিলেন: “আপনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখেন। কিন্তু আজ অবধি ধর্ম নিয়ে আপনার কোনও লেখা দেখিনি। একটু কিছু লিখবেন? পক্ষে বিপক্ষে কোনও ব্যাপার নয় আমার কাছে। আপনার মানসিক গঠনটা জানতে ইচ্ছে করে খুব।”

উত্তর দিয়েছিলাম আমার অবস্থান জানিয়ে। এই লেখা সেই উত্তরেরই একটি বর্ধিত রূপ বলা যেতে পারে। 

পাঠক প্রশ্ন তুলতে পারেন, ‘মশায় আপনার এই কলামে তো মূলত প্রবাস জীবন নিয়ে লেখেন। এখানে ধর্ম কোথা থেকে আসছে?’ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। সেই আলোচনার প্রেক্ষাপট আংশিকভাবে আমেরিকার ছাত্রজীবনে। 

***

শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকে ছ বছর চাকরি করার পর আমেরিকায় ছাত্র হয়ে দুবছর কাটিয়েছিলাম ৮৪৮৬তে। তার মধ্যে বিবাহিত ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট খালি না থাকায় বিরহ মধুর নমাস অতিবাহিত হয়েছিল এক ছাত্রনিবাসে। 

আমেরিকাকে উঠতে বসতে যতই গালমন্দ করি না কেন, বলতে দ্বিধা নেই, চন্দনা আসার পরে সেই এক কামরার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপার্টমেন্টে কাটানো বছর দেড়েক ছিল আমাদের জীবনের এক অতি মধুর অধ্যায়। স্থানীয় চার্চ থেকে ধার নেওয়া যৎসামান্য আসবাব ছাড়া আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে ছিল অল্প কিছু বাসনপত্র। যা টাকা অ্যাসিস্টান্টশিপ বাবদ পেতাম, খেতে আর ফ্ল্যাটভাড়া দিতেই চলে যেত। এম.বি.এ. পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে দারিদ্রসীমা বা poverty line সম্পর্কে অল্প জ্ঞানলাভ হয়েছিল সেই সময়েসেই সীমা নির্ধারণের সমস্ত নিরিখেই আমরা ছিলাম দারিদ্রসীমার বহু নীচে। 

এক বন্ধু দয়া করে একটি সাদাকালো টেলিভিশন ব্যবহার করতে দিয়েছিল। একটি শক্তপোক্ত প্যাকিং বাক্সের ওপর একটা চাদর পেতে চন্দনা ওটি রাখার ব্যবস্থা করেছিল। সেই সামান্য মেয়েলি ছোঁওয়াতেই আমাদের ছোট্ট নীড়টির চেহারা পাল্টে গিয়েছিল যেন। 

Nusli Wadia
নাসলি ওয়াডিয়া

সেই সময়ে আমেরিকান সংবাদমাধ্যমে দেশের খবর প্রায় থাকতই না। তাই একদিন টেলিভিশনে এক অতি সুদর্শন ভারতীয় শিল্পপতির সাক্ষাৎকার বেশ কৌতূহল নিয়ে দেখছিলাম। ভদ্রলোকের নাম নাসলি ওয়াডিয়া। প্রসঙ্গটা আজ আর মনে নেইওঁকে হিন্দুধর্ম বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করা হয়েছিল। এ লেখায় আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, ধর্ম সম্পর্কে জীবনের সেই পর্যায়ে বিশেষ উৎসাহ ছিল না। কিন্তু ওঁর সপ্রতিভ উত্তরটা মনে গেঁথে গিয়েছিলহিন্দুধর্ম প্রচলিত অর্থে ঠিক ধর্ম নয়, জীবনদর্শন মাত্র। বিজ্ঞজনেরা মানবেন কিনা জানি না, উত্তরটা কিন্তু আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল।

কিছুদিন আগে হঠাৎ এই নাসলি ওয়াদিয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য পেলাম ইন্টারনেটে অন্য এক বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়ে। নাসলি পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্নার নিজের নাতি। মা দিনা জিন্নার একমাত্র সন্তানবাবা পার্শি শিল্পপতি নেভিল। এই বিয়ে জিন্নার একদম নাপসন্দ ছিল, কোনওদিনই মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু দিনা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। দেশভাগ হওয়ার পর ভারতেই রয়ে গিয়েছেন।  কাকতালীয়ভাবে ওঁর জন্মদিন ১৫ই অগস্ট। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ৯৮ বছর বয়সে মৃত্যু হয় দিনার।

Muhammad Ali Jinnah Family Photograph
স্ত্রী কন্যার সঙ্গে মহম্মদ আলি জিন্না

আশ্চর্য ব্যাপার হল, আমার মনে ধর্ম সম্পর্কে সামান্য হলেও প্রাথমিক উৎসাহ জাগান মুসলমান মা এবং পার্শি বাবার সন্তান এই নাসলি! জীবনের সেই সময় অবধি হিন্দুধর্মের নানা আচারবিচার যেটুকু দেখেছি তাতে আকৃষ্ট হওয়া দূরের কথা, বিতৃষ্ণার ভাবই বেশি ছিল। ক্যাথলিক ইস্কুলের বাধ্যতামূলক সকাল বিকেল প্রার্থনাতেও মনোভাবের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। হাজারখানেক বছর আগের একেবারে অন্য যুগের কোনও ধর্মগ্রন্থের বা ধর্মগুরুর নির্দেশের প্রাসঙ্গিকতার ব্যাপারে আমার বরাবরই অবজ্ঞামিশ্রিত সন্দেহ ছিল। দেবদেবীর মূর্তির সামনে ছলছল চোখে হাত জোড় করে পুজো দেওয়া দেখে, বা কিছু mythical চরিত্রের প্রশস্তি গান শুনে হাসিই পেত। 

কিন্তু নাসলির কথায় মনে হয়েছিল, ধর্ম ব্যাপারটাকে যদি জীবনদর্শন হিসাবে দেখা যায়, তাহলে অবচেতনে হলেও একটা ধর্ম পালন করে এসেছি আমি। গড়পড়তা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারেও তো বেশ কিছু অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ, ন্যায়অন্যায়ের বিচার থাকে, আমি তো সেই পরিবেশেই বড় হয়েছি। সততা, ত্যাগ, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ, পরিবারের প্রতি ভালবাসা, শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা, অজান্তেই এই সব মূল্যবোধ জীবনদর্শনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল জ্ঞানোদয়ের কাল থেকেই। অন্যায় করেছি, পথচ্যুত হয়েছি জীবনের পথে থেকে থেকে, কিন্তু বিবেকের জ্বালাতেও পুড়েছি, শুদ্ধ হয়েছি।

Muhammad Ali Jinnah with his daughter
কিশোরী দিনার সঙ্গে বাবা জিন্না

তারপরে অনেকগুলো দশক কেটে গেছে। উপলব্ধি হয়েছে মানুষের জীবনদর্শন জমা জলের মত স্থির নয়, জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, ঘাত প্রতিঘাতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে অর্থের, বৈভবের প্রতি একটা উদাসীনতা এসেছে। ঈর্ষা এবং পরশ্রীকাতরতার বোধগুলি অনেকটাই দমন করতে শিখেছি। অস্ট্রেলিয়ার মঙ্গলরাষ্ট্র ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন কাটিয়ে দুর্বল, দরিদ্র, অসুস্থ মানুষের প্রতি এখন আমি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। পশ্চিমী সমাজের মানবসেবার প্রতি নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়েছি। 

তবে জীবনে এক একটা মুহূর্ত আসে, প্রায়শ আচমকাই যখন একটা আপাত অকিঞ্চিৎকর ঘটনা বা অভিজ্ঞতা জীবনের ঠিক মোড় না ঘোরালেও গভীর ছাপ ফেলে যায়।

এমনই একটা ঘটনা ঘটেছিল আমার জীবনে ২০০৪ সালে। দেশে কদিনের ছুটি কাটিয়ে ক্যানবেরাতে ফিরছি। দাদা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিচ্ছিল। হঠাৎ বলল “জানি তুই এইসবে বিশ্বাস করিস না, তবু আমার একটা রিকুয়েস্ট রাখিস, এই ছবিটা ওয়ালেটে রেখে দিস। অনেক বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে আমায় ছবিটা।দাদার কথা ফেলিনি, বহু ব্যবহারে কিছুটা জীর্ণ হলেও ছবিটি আজও আমার ব্যাগে আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। দাদা ২০১৫ সালে প্রয়াত, যখনই ওয়ালেট ব্যবহার করি সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়।

IMG_0370

ছবির উল্টো দিকে একটি উপদেশবাণী :

“ধার্মিক হইতে চাহিলে প্রতিদিন রাত্রিতে শয়ন করিবার সময় প্রতিদিনের কর্মের হিসাবনিকাশ করবি, অর্থাৎ ভাল কর্ম কি করিয়াছিস এবং মন্দ কর্ম কি করিয়াছিস তাহা চিন্তা করিয়া, মন্দ কর্ম আর করিতে না হয় তজ্জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবি।

এই উপদেশ মানার চেষ্টা করে গেছি সেই থেকে। জাগতিক সাফল্য হয়তো পাইনি, কিন্তু মানসিক শান্তি পেয়েছি। যথার্থভাবে ধার্মিক হয়তো হয়ে উঠতে পারিনি, তবে চেষ্টা করে গেছি। এই চেষ্টার সঙ্গে মনে হয় হিন্দুমুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ কোনও ধর্মেরই বিরোধ নেই, যেমন নেই উপরোক্ত মূল্যবোধগুলির সঙ্গে।

 

 

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৬ জুন,২০২৩

ছবি সৌজন্য: লেখক, Pixabay

Siddhartha Dey

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

One Response

  1. আমার মনেহয় বেশিরভাগ মানুষ যে পরিবেশ আর মানুষজনের  মাঝে  বড় হয় সেখানকার প্রভাবই ছাপ ফেলে তার ভবিষ্যৎ জীবনে।  চেতনে বা অবচেতনে মানুষ তা অনুসরণ করে চলে। সে টা ধৰ্ম বা জীবনদর্শন যাই হোক না কেন?  এর বাইরে খুব কম মানুষ বেরিয়ে আসতে পারে। 
    প্রবাসের লেখাগুলি পড়ি ।খুবই সুখপাঠ্য। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *