সাহেবি ক্ষুরে মাথা কামিয়ে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের কাছে দাসখত দিয়েছি, অথচ শেকসপিয়ারের নাটক করব না, তাও কি হয়? 

বাঙালি যে তল্লাটেই থাকুক না কেন, মাঝেমাঝেই তাকে শেকসপিয়ারের কাছে হাত পাততে হয়। মুশকিলটা হল, আমাদের বেশির ভাগ আগ্রহ ঘুরপাক খায় তথাকথিত গ্রেট ট্র্যাজেডিচতুষ্টয় নিয়ে – অর্থাৎ ‘ম্যাকবেথ’, ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’, ‘কিং লিয়ার’ ঘিরে। কদাচিৎ দু-চারটে কমেডি নিয়ে নাড়াচাড়া হয়। ‘মিডসামার নাইটস ড্রিম’ নিয়ে রংবাহারে কারবার চলে – কোনওটা লোক হাসায়, কোনওটা দিব্যি উতরে যায়। তবে কলকাতায় পাবলিক থিয়েটারের রমরমার দিনে ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’ নামে একটা বক্সঅফিস কাঁপানো নাটক হয়েছিল, তার আড়ালে ছিল ‘টেমিং অফ দ্য শ্রু’র উদার অনুপ্রেরণা। 

অথচ শেকসপিয়ারের যে ট্র্যাজেডি সেই সাহেবি আমল থেকে আমরা ইসকুল-কলেজে ক্রমাগত পড়ে চলেছি, কথায় কথায় ‘জুলিয়াস সিজারে’র লাইন কোট করে চলেছি (‘কাউয়ার্ডস ডাই মেনি টাইমস বিফোর দেয়ার অ্যাকচুয়াল ডেথস’; ‘এট টু ব্রুটে – দেন ফল সিজার’; ‘ফ্রেন্ডস, রোমানস, কান্ট্রিমেন, লেন্ড মি ইয়োর ইয়ার্স’ – এসব আকছার বলে চলেছি আমরা) – সেই ‘জুলিয়াস সিজারে’র কটা প্রযোজনা দেখেছি বাংলায়? হাতে গোনা। ‘জুলিয়াস সিজার’ যে স্রেফ রোমান প্লে নয়, তা যে আমাদের উপমহাদেশীয় রাজনীতির আরশিনগর হয়ে উঠতে পারে, এদিকে আমাদের নজর পড়ল কই? পাকিস্তানে না হয় থিয়েটারের বাড় বন্ধ হয়ে গেছে, ভারত-বাংলাদেশে থিয়েটারের এত বাড়বাড়ন্ত সত্ত্বেও কেন ‘জুলিয়াস সিজারে’র ডাক পড়ে না, কে জানে! অতঃপর চট্টগ্রামের খানদানি নাটকের দল গণায়ন যখন ‘জুলিয়াস সিজার’ নিয়ে বড়দিনের ছুটিতে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিলেন, আমাদের কৌতূহল বাঁধ মানল না। বড়দিনের দুপুরে উত্তরপাড়া গণভবনে উজিয়ে গিয়ে দু ঘণ্টা ধরে নাটকটা দেখতে দেখতে মালুম হচ্ছিল কত ভুল করেছি আমরা!

Julius Caesar play in Bengali
ষড়যন্ত্রীদের কথার প্যাঁচে ভুলে বুক ঠুকে ক্যাপিট্যালে গেলেন সিজার।

‘জুলিয়াস সিজারে’র গল্পটা মনে আছে তো? পম্পির বিদ্রোহ দমন করে সিজার (যীশু দাশ) ফিরেছেন রোমে। এখন তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ। এইবারে যদি নিজেকে মহারাজাধিরাজ ঘোষণা করে বসেন সিজার, তবে আর দেখতে হবে না! ট্যাঁ ফোঁ করলেই গর্দান যাবে! এইসব ভেবে সিজারের বাড়া ভাতে ছাই দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন সেনেটর ক্যাসিয়াস (বিশ্বজিৎ দাশগুপ্ত এপি)। পাশে পেয়ে গেলেন রোমান সেনেটের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীকে। শেষমেশ দলে এলেন ব্রুটাস (অনির্বাণ ভট্টাচার্য)। পনেরোই মার্চ সকালে সিজার ক্যাপিট্যালে যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। জনপ্রতিনধিদের প্রকাশ্য অধিবেশনে যোগ দেবেন। গণৎকারের (সায়হাম মাহমুদ) সাবধানবাণী, ঘরনি ক্যালফার্নিয়ার (অমিতা বড়ুয়া) দুঃস্বপ্ন তাঁকে একটু থমকে দিলেও ষড়যন্ত্রীদের কথার প্যাঁচে ভুলে বুক ঠুকে ক্যাপিট্যালে গেলেন সিজার। আর এক ঘর সাংসদের সামনে তাঁকে কুপিয়ে কুপিয়ে মারলেন ক্যাসিয়াস এন্ড কোং। এই ঘাতকদের দলে ব্রুটাসও বাদ রইলেন না। মরদেহ নিয়ে এক প্রস্ত হুলুস্থুলু হল। আম আদমির মনমর্জির দখল নিতে কোমর বাঁধলেন ব্রুটাস। তাঁর টক্কর নিলেন সিজারপন্থী অ্যান্টনিয়াস ওরফে অ্যান্টনি (বাপ্পা চৌধুরী)। সিজারের খুল-এ-আম কতলের বদলা নিতে অ্যান্টনি আর অক্টাভিয়াস সিজারের (শাহ মো, মাহফুজার রহমান) যৌথ বাহিনী কীভাবে জান কবুল লড়াইয়ে নামল এ নিয়েই নাটকের শেষাংশ। 

বাংলাদেশের বুকে গুপ্তহত্যার এমন এক সিলসিলা ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অগাস্ট থেকে শুরু হয়েছিল, যে এমন নাটককে মঞ্চে আনার জন্য কোনও উপলক্ষ দরকার পড়ত না সেই সময়। ‘জুলিয়াস সিজারে’র নাটমঞ্চ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের রাজভবন। দিনকাল পালটেছে। গণতন্ত্রের ভিত এখন খুব মজবুত এমন বলা যাবে না, তবু একচেটিয়া স্বৈরাচারের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও ‘জুলিয়াস সিজার’ প্রযোজনার জন্য যে বুকের পাটা লাগে সেটা ইদানীং দেখাতে পারেননি ঢাকার নামজাদা কোনও দল। দেখালেন চট্টগ্রামের গণায়ন। ম. সাইফুল আলম চৌধুরীর বাংলা তরজমাতে ভর করে ‘জুলিয়াস সিজারে’র এক উচ্চাশী প্রযোজনা করলেন তাঁরা। নির্দেশনা দিলেন অসীম দাশ। 


আরও পড়ুন: ছোটদের গল্প- তিতিরের তুরুপের তাস


নয়া দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার কৃতী প্রাক্তনী অসীম এর আগেও রোমান প্লে নিয়ে কাজ করেছেন। যেমন আলব্যের কাম্যুর ‘ক্যালিগুলা’। তাতে খবরদারি আর পাগলামির জোড়কলম ছিল। শেকসপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ তাঁকে খোলা মাঠ দিল। দরকার ছিল এক ঝাঁক পোড়খাওয়া অভিনেতা-অভিনেত্রী। প্রথমটা পেলেন, দ্বিতীয়টা পেলেন না। কুছ পরোয়া নেই। কলেজ-ইউনিভার্সিটির উজ্জ্বল এক দল তরুণ পাশে এসে দাঁড়ালেন। এর সঙ্গে জুড়ে গেল চট্টগ্রামের নাগরিকদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। নর্ডিক, প্রোটা-অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড – নানান রকমের নানা ছাঁদের চেহারা এক জোট হল ‘জুলিয়াস সিজারে’র মঞ্চে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, জুলিয়াস সিজারের আমলের রোম বুঝি এমনই নৃতাত্ত্বিক জাদুঘর হয়ে উঠেছিল। তা বলে শুধুই দর্শনধারী হলে চিঁড়ে ভিজত না, গণায়ণের কুশীলবদের অনেকেই গুণবান-গুণবতী বলে ‘জুলিয়াস সিজারে’র মতো ওজনদার নাটক হইহই করে হয়ে গেল উত্তরপাড়া গণভবনে। সাবাসির বান ডেকে গেল গঙ্গাপাড়ের শহরে।

Julius Caesar by Ganayan Chittagong
অসীম এর আগেও রোমান প্লে নিয়ে কাজ করেছেন।

ইদানীংকার সংস্কারের পর উত্তরপাড়া গণভবনের ধ্বনিপ্রক্ষেপণব্যবস্থা এতই ভালো হয়েছে যে সংলাপ শুনতে কোনও অসুবিধে হয় না। তার ওপর বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রাম হল সেই শহর যেখানকার বাচিক অভিনয় ঢাকা-রাজশাহী-যশোরকে বলে বলে দশ গোল দিতে পারে। এ যাত্রাতে তার ব্যতিক্রম ঘটল না। গণায়নের দলনায়ক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী অভিনয়ের কথা ভেবে অনুবাদ করেছেন বলে কুশীলবদের মুখে সেসব খুলল ভালো। জুলিয়াস সিজার যিনি সাজলেন সেই যীশু দাশ তো বেশ জাঁদরেল গড়নের। ভারিক্কি গেরামিভারী চালের অভিনয়। ক্যাসিয়াস-বেশী বিশ্বজিৎ দাশগুপ্ত আরেক কাঠি দড়। সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দেবার উপযোগী। জুডাসের ভূমিকায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য চাইলে আরেকটু ভাঙচুর আনতে পারেন তাঁর চরিত্রায়ণে। অ্যান্টনি সেজেছেন বাপ্পা চৌধুরী। তুলনায় নড়বড়ে লাগছিল, কিন্তু ফোরাম সিনে একেবারে বিস্ফোরকের মতো ফেটে পড়লেন। কারও কারও অনভিজ্ঞতার মাশুলও গুনতে হল মাঝে মাঝে। তা বলে তাল কেটে গেল, লয় পড়ে গেল, এমন নয়।

নয়া দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার কৃতী প্রাক্তনী অসীম এর আগেও রোমান প্লে নিয়ে কাজ করেছেন। যেমন আলব্যের কাম্যুর ‘ক্যালিগুলা’। তাতে খবরদারি আর পাগলামির জোড়কলম ছিল। শেকসপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ তাঁকে খোলা মাঠ দিল। দরকার ছিল এক ঝাঁক পোড়খাওয়া অভিনেতা-অভিনেত্রী। প্রথমটা পেলেন, দ্বিতীয়টা পেলেন না। কুছ পরোয়া নেই। কলেজ-ইউনিভার্সিটির উজ্জ্বল এক দল তরুণ পাশে এসে দাঁড়ালেন। এর সঙ্গে জুড়ে গেল চট্টগ্রামের নাগরিকদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য।

এহ বাহ্য। গণায়নের ‘জুলিয়াস সিজার’ মনে রয়ে গেল তার নির্মাণ কুশলতার জন্য। উত্তরপাড়া গণভবনের প্রসেনিয়ামের আশেপাশে অনেকটা জায়গা। আইল দিয়ে ছুটে আসা যায়। প্রসেনিয়ামের দু পাশে প্রবেশ-প্রস্থানপথ কাজে লাগানো যায়। সব কিছু কাজে লাগিয়ে এমন প্রবলভাবে প্রযোজনাকে বাঁধলেন নির্দেশক অসীম দাশ যে চেয়ারে হেলান দিয়ে নাটক দেখার আরাম আমাদের ঘুচে গেল। আমরাও ঢুকে পড়লাম নাটকের ভেতরে। কয়েক বছর আগে লন্ডনের ন্যাশনাল থিয়েটারে কতক এভাবে ‘জুলিয়াস সিজার’ হয়েছিল। ইউটিউবে দেখেছি স্টেজের ওপর ভর দিয়ে নাটক দেখছেন দর্শকরা। দেখেছি কী অনায়াসে আধুনিক পৃথিবীর গণনায়কদের মতো স্যুটেড-বুটেড হয়ে মঞ্চে আনাগোনা করছেন ইংরেজ কুশীলবের দল। গণায়নের কুশীলবদেরও কতক ওভাবেই কাপড় পরালেন অসীম। শুধু গায়ের ওপর রোমান টোগার মতো করে একটা চাদর ঝুলিয়ে দিলেন। সংকরায়নের এই তুখোড় প্রয়োগে সেকাল-একালের সেতু রচনা হয়ে গেল। সাবেক সমরাস্ত্র নয়, প্রয়োগ হল পিস্তল। আবার যুদ্ধের দৃশ্যে মঞ্চ আবছায়ায় ঢেকে দিয়ে স্রেফ টর্চের আলো দিয়ে মেশিনগানের সার্চলাইটের বিভ্রম তৈরি করলেন অসীম। আবহে ইয়োরোপিয়ান সুর বাজল বেশি। আলোক ও আবহের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে সমগ্র প্রযোজনাকে যে নিপুণ ছন্দে বেঁধে ফেললেন অসীম, তা বাহবা দেবার মতো। 

আরও বাহবা দিই গণায়নের থিঙ্ক ট্যাঙ্ককে। প্রযোজনাপত্রীতে গুপ্তহত্যার কড়া নিন্দা করার পাশাপাশি তারা লিখেছেন – ‘অগণতান্ত্রিকতা, অনিয়মতান্ত্রিকতা কখনও জনগণকে আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে না।’ এমন কথা এমন সপাটে বলার মধ্যেই ‘জুলিয়াস সিজারে’র জোরের দিক। অসীম দাশের নেতৃত্বে তাঁরা অসাধ্য সাধন করেছেন, এ কথা হলফ করে বলতে পারি। 

ছবি সৌজন্য: অংশুমান ভৌমিক

anshuman bhowmick

অংশুমান ভৌমিকের জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। ছেলেবেলা কাটিয়েছেন মামারবাড়ি নবদ্বীপে। গত চার দশক কলকাতার বাসিন্দা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজির এমএ হলেও বাবার 'দেশ' বরিশাল আর মায়ের 'দেশ' নদিয়ার মধ্যে দোদুল্যমান তাঁর অস্তিত্ব। পেশায় শিক্ষক, নেশায় কালচারাল কমেন্টেটর। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি করছেন দু'দশকের বেশি। দেশবিদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বারো। 'দ্য টেলিগ্রাফ' ও কৃত্তিবাস-এর নাট্যসমালোচক হিসেবে ইদানীং থিতু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *