আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩]

আপ রুচি খানা

এই পর্বও আমেরিকার ছাত্রজীবনের (১৯৮৪-৮৬) কিছু ঘটনা নিয়ে। 

বেশ অন্যরকম একটা ব্যাপার হল একদিন। রবি বিশ্বনাথের (আই আই টি ম্যাড্রাসের এক প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন অতি দুষ্টু তামিল ছেলে) বাড়ি থেকে একটা বেশ বড় পার্সেল এল। পার্সেলটাতে ছিল পাঁচ ছ রকমের আচার। আর একটা ক্যাসেট টেপ।

সেই আমলে অত প্রাইভেসির রমরমা ছিল না ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে। অনেকেই বন্ধুদের সঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত জীবনের কথা শেয়ার করত।

জয়দীপ যেমন বলেছিল ও বেশ কড়া পারিবারিক শাসনে বড় হয়েছে। ওর মা লক্ষ্ণৌয়ের মেয়ে হয়েও গোঁড়া হিন্দু। ফোন করা তখন আমেরিকাতেও খুবই ব্যয়সাধ্য ছিল মিনিটে এক ডলার করে লাগত। তাই দেশে ফোন করা বা দেশ থেকে ফোন পাওয়া একটা ব্যাপার ছিল। একদিন জয়দীপের ঘরে ক’জনে মিলে আড্ডা দিচ্ছি ওর মায়ের ফোন এল। স্পিকার ফোনের চল ছিল না সেকালে, তবে আন্তর্জাতিক কলে মানুষ এত জোরে কথা বলত যে আশপাশের মানুষ প্রায় সব কথাই শুনতে পেত। আজকের দিন হলে হয়তো বন্ধুরা জয়দীপকে একান্তে কথা বলতে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যেত। আমরা কিন্তু ঘরেই রয়ে গেলাম, অবচেতন মনে হয়তো সবারই একটু বাড়ির স্বাদ পাবার বাসনা ছিল।

ফোন করা তখন আমেরিকাতেও খুবই ব্যয়সাধ্য ছিল মিনিটে এক ডলার করে লাগত। তাই দেশে ফোন করা বা দেশ থেকে ফোন পাওয়া একটা ব্যাপার ছিল। একদিন জয়দীপের ঘরে ক’জনে মিলে আড্ডা দিচ্ছি ওর মায়ের ফোন এল। স্পিকার ফোনের চল ছিল না সেকালে, তবে আন্তর্জাতিক কলে মানুষ এত জোরে কথা বলত যে আশপাশের মানুষ প্রায় সব কথাই শুনতে পেত।

সেই কথোপকথনের কিছু অংশ মনে আছে। রাজনৈতিক সচেতনতা মেনে কিছু কথা লিখলাম নাতবে একাংশ বলাই যায়। ভদ্রমহিলা মাতৃসুলভ মেজাজে প্রশ্ন করলেন: কী খেলে আজ? জয়দীপ মাকে চটাবার জন্য বিফ এবং পোর্কের কয়েকটি পদের নাম করল। প্রত্যাশিতভাবে শুরু হল একতরফা ঝাড়, হিন্দুর ছেলে হয়ে ঐসব কুখাদ্য খাওয়া কত বড় অপরাধ সেই বিষয়ে এক দীর্ঘ লেকচার! জয়দীপ যাকে বলে straight face করে শুনে যাচ্ছে বাকিরা অনেক কষ্টে হাসি সম্বরণ করছি।

Beef steak

আমার পোর্ক নিয়ে কোনও শুচিবাই ছিল না। খড়গপুর ক্যাম্পাসের কাছে Waldorf নামে একটা চিনে রেঁস্তোরা ছিল (আমরা বলতাম Waldies)— সেখানে জমিয়ে চিলি পোর্ক খেতাম মাঝেমধ্যে। মা নিউ মার্কেট থেকে মাঝে মাঝে হ্যাম কিনে আনতেন। সেদিন রীতিমত হইচই পড়ে যেত বাড়িতে। 

প্রায়ই সপ্তাহান্ত কলকাতায় কাটিয়ে রবিবার বিকেলে স্টিল এক্সপ্রেসে খড়গপুর ফিরতাম। ট্রেন লেট করলে হলের ডিনার মিস করে যেতাম, তাই স্টেশনে রাখা সাইকেল নিয়ে সোজা চলে যেতাম এই Waldiesএ। মোটামুটি পাঁচ টাকাতে পেট ভরে খাওয়া হয়ে যেত যদিও পাঁচ টাকার মূল্য ৭০-এর দশকে বর্তমানের তুলনায় অনেকটাই বেশি ছিল। 

দেশে থাকতে অজান্তে নিজামে হয়তো বিফও খেয়েছি, কিন্তু জেনেবুঝে কখনও খাইনি। বাড়ির সামনে দিয়ে দেখতাম জীর্ণ শীর্ণ চেহারার গোরুর পালকে কসাইখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই দৃশ্যের কথা ভেবে আর গোরু খাওয়ার প্রবৃত্তি হত না। 

আমেরিকায় উৎকৃষ্ট মানের গরু-শুয়োর খেয়ে সেই কুণ্ঠাবোধ অল্প কদিনেই উবে গিয়েছিল। তবে বাড়ির অতীব সুস্বাদু পাঁঠার মাংসের ঝোল ভাত খাওয়ার টাটকা স্মৃতি থেকে থেকে বেদনা দিত। 

Goat Meat Curry
বাড়ির অতীব সুস্বাদু পাঁঠার মাংসের ঝোল ভাত খাওয়ার টাটকা স্মৃতি

এই বিফের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে আমাদের জীবনে। কোনও সময় সেই কাহিনি শোনাব।

বলে রাখি, কিছু সংস্কার চট করে যায় না। ম্যাকডনাল্ডে বিফ বার্গার খাই, রেঁস্তোরাতেও গোমাংস খাই। কিন্তু বাড়িতে কখনও গোমাংস রান্না হয়নি। প্রথম প্রজন্মের ভারতীয় অভিবাসীদের অধিকাংশই মনে হয় বাড়িতে বিফ রেঁধে খান না। 

***

শুরু করেছিলাম রবির পার্সেলের কথা দিয়ে। 

আচারের শিশি ছাড়াও ক্যাসেট টেপটা বেশ কৌতূহল উদ্রেক করেছিল ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে। প্রায় এক ঘণ্টার টেপটাতে ছিল রবির বাবা-মায়ের পুত্রকে উদ্দেশ করে একতরফা কথা, বেশিটাই মিস্টার বিশ্বনাথের। 

পড়াশোনা মন দিয়ে করা ছাড়াও চোস্ত ইংরেজিতে উষা উত্থুপের তুতো ভাই মিস্টার বিশ্বনাথন পুত্রকে রান্না করে দেশি খাবার খেতে উৎসাহিত করেছিলেন। বলেছিলেন: “cooking is nothing but intelligent experimentation!”

সাহেবি খানা খেতে খেতে পেটে চড়া পড়ে যাওয়া ভারতীয় ছাত্রদের কথাটা বেশ মনে ধরেছিল। 

Homemade Daal sambar

ক্যাফেটারিয়াতে ডিনার খেয়ে নিতে হত সন্ধে সাতটার মধ্যে। পড়াশোনা চলত রাত দুটো তিনটে অবধি। ফলে মাঝরাত্তিরে প্রচণ্ড খিদে পেত। একই পরিস্থিতি অবশ্য খড়গপুরেও ছিল, হলের ভেতরে শৈলেশের ক্যান্টিনে গভীর রাতেও কিছু না কিছু পাওয়া যেত। আমেরিকাতে সেই সুবিধা ছিল না, তাই বিস্কুট বা টোস্ট খেয়েই খুন্নিবৃত্তি করতে হত।

মিস্টার বিশ্বনাথের অনুপ্রেরণা আমাদের মধ্যরাতের খাওয়ায় বেশ একটা ছোটখাটো বিপ্লব আনল। একটা বড় ডেকচিতে সবাই মিলে ভাত বানাতাম। একটি অন্ধ্রের ছেলে মোটামুটি ডাল বানাতে পারত। সঙ্গে থাকত দেশ থেকে পাঠানো আচার লংকার, লেবুর, আমের। পাঁচ ছ’জন মিলে থালাভর্তি ভাত নিয়ে কমন রুমে টিভি দেখতে দেখতে জমিয়ে খেতাম।

ব্যাপারটা সাহেবদের মধ্যে রটে গিয়েছিল। অবাক চোখে উঁকি মেরে অনেকেই দেখে যেত (ওদের কাছে) এই অবিশ্বাস্য পরিমাণ ভাত খাওয়া।

ক্যাফেটারিয়াতে ডিনার খেয়ে নিতে হত সন্ধে সাতটার মধ্যে। পড়াশোনা চলত রাত দুটো তিনটে অবধি। ফলে মাঝরাত্তিরে প্রচণ্ড খিদে পেত। একই পরিস্থিতি অবশ্য খড়গপুরেও ছিল, হলের ভেতরে শৈলেশের ক্যান্টিনে গভীর রাতেও কিছু না কিছু পাওয়া যেত।

দেশে থাকতে আচারের সেরকম ভক্ত ছিলাম না। যৌবনকালে ভালো না লাগা বা অপরিচিত খাদ্য বা পানীয় কোন অদ্ভূত রসায়নে পছন্দ হয়ে যায় পরবর্তীকালে! পৃথিবীর অন্য প্রান্তে গিয়ে আচারের মাহাত্ম্য বুঝলাম! আজও খিচুড়ির সঙ্গে আচার দারুণ লাগে! বিশ্বায়নের দৌলতে ক্যানবেরার মতো ছোট শহরেও ভারতীয় দোকানগুলিতে হরেক রকমের আচার পাওয়া যায়। 

আমাদের এক ব্যাচমেটের কথা বলে এই পর্বের ইতি টানব। উত্তর কলকাতার ছেলে, মদ সিগারেট তো কোন ছাড়, ছাত্রজীবনে চা কফি অবধি খেত না। পাশ করার বছরখানেক বাদে আমেরিকা পাড়ি দেয়। কিছুদিন আগে এক কমন বন্ধুর মারফত জানলাম, সে নাকি এখন ভীষণরকম পানাশক্ত । (শিব্রামের মত Pun-আশক্ত নয়!) মাতাল হয়ে নাকি মারপিটও করেছে কোথাও!

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

ছবি সৌজন্য: Needpix, Flickr, Wikimedia

Siddhartha Dey

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *