বাঙালি চিরকাল রাজনীতি সচেতন জাতি। এর নিদর্শন বহু পুরনো কাল থেকেই আছে। সমাজ–অর্থনীতি, পরিবেশ–পরিস্থিতি, সময়ের পরিবর্তন ইত্যাদি অনুযায়ী রাজনৈতিক ভাবনা ও তার প্রয়োগের রূপ স্বাভাবিকভাবেই পালটেছে, কিন্তু সচেতনতা থেকে গেছে পুরোপুরি মাত্রায়। ভারতবর্ষ হল পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। ফলে এ দেশে ‘ভোট‘ (vote) বা ‘নির্বাচন‘-এর গুরুত্ব কতখানি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না— যাকে ঘিরে, যত দিন যাচ্ছে উন্মাদনা ক্রমশ কোথায় পৌঁছচ্ছে, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
এর পাশাপাশি বাঙালি আবার বরাবর রঙ্গপ্রিয়। বৈঠকি গল্পগাছা থেকে শুরু করে, শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতি, সর্বত্র রসবোধের উপস্থিতি এই বাংলায়। ইদানীং এই রসবোধের প্রকাশ একটু পড়তির দিকে হলেও, এককালে তা দারুণভাবেই দেখা যেত। নাটক, সিনেমা, সাহিত্য সবকিছুর মধ্যে রঙ্গব্যঙ্গের প্রকাশ ঘটত অহরহ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা নিছক চটুলতা ছিল না— সমাজ–রাজনীতি, মানুষের রুচির নানারকম বিচ্যুতির প্রতি কটাক্ষ থাকত ব্যঙ্গের মোড়কে, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত অনেককিছু।
আরও পড়ুন- ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যে রবীন্দ্র-নজরুল বন্ধন : কিছু অনুমান ও অনুভূতি
আগেই বলা হয়েছে, সাংবিধানিকভাবে সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষে নির্বাচন তথা ভোটের গুরুত্ব কতটা। দিন এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে যা ক্রমশ ক্ষমতাপ্রাপ্তির সেরা লোভনীয় লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। ফলে, রকমারি প্রচার–পথে সেই আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নবস্তুটি পাওয়ার জন্যে চলেছে প্রতিযোগিতা, যার পদ্ধতি অনেক সময়েই ঠিক অভিপ্রেত জায়গায় থাকছে না। যাই হোক, স্বাধীন ভারতে ১৯৫২ সাল থেকে মানুষ ভোটের সঙ্গে পরিচিত হয়। তখন থেকেই দেশের সমস্ত নাগরিকের ভোটদানের মধ্যে দিয়ে নির্বাচিত হন রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসক–বিরোধী গোষ্ঠী। এছাড়া, পুরসভা, পঞ্চায়েত গঠনেও নির্বাচন–প্রক্রিয়া চালু আছে। কিন্তু, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই ভোটের সঙ্গে পরিচিত বাংলার মানুষ। সেই উনিশ শতকের শেষ থেকে যার শুরু। ফলে, বাঙালির নানা সৃষ্টিকাজে ভোটও অন্যতম একটি বিষয় হয়ে উঠেছে তখন থেকেই। বিভিন্ন ব্যঙ্গধর্মী রচনায় ভোট–কে বিষয় করা হয়েছে। যা আশ্চর্যের, সেই তিন শতক আগে ভোট নিয়ে যা ভাবনা ও প্রতিক্রিয়া, আজকে পৌঁছেও তার সঙ্গে এক অদ্ভুত মিল চোখে পড়ে! তবে স্বাধীন ভারতের মতো তখন সব মানুষের অবাধ ভোটাধিকার ছিল না। একইসঙ্গে ভোটে দাঁড়ানো নিয়েও ছিল নানা বিধিনিষেধ। যেমন, কে কোন শ্রেণীভুক্ত, কার প্রদত্ত ট্যাক্সের পরিমাণ কত, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কে কত সম্পত্তির মালিক ইত্যাদি আরও নানা কিছুর ওপর নির্ধারিত হত নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ও ভোটদাতার অধিকার। সবাইকার এ অধিকার ছিল না তখন। অবশ্য, যত সময় এগিয়েছে, এ ব্যাপারে অনেকটাই শিথিলতা এসেছে। কিন্তু, তা কখনোই স্বাধীন ভারতের মতো সব নাগরিকের অবাধ ভোটদানের অধিকার হয়নি। এবার আসা যাক, উনিশ শতকের সেই ভোট বিষয়ক গানটির কথায়।

আজ থেকে ১৩৬ বছর আগে, ১৮৮৭ সালে (১২৯৪ বঙ্গাব্দ) ‘সঙ্গীতকল্পতরু’ নামে বাংলা গানের এক অসামান্য সংগীত সংকলন–গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। যুগ্মভাবে যেটি সম্পাদনা করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ) ও বৈষ্ণবচরণ বসাক। একজন উচ্চ মার্গের কণ্ঠশিল্পী ও দক্ষ বাদ্যযন্ত্রীর পাশাপাশি স্বামী বিবেকানন্দের সংগীতজ্ঞান কত গভীর ছিল, এই একটি বই–ই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তথ্য অনুযায়ী বইটি সম্পূর্ণই স্বামীজীর মস্তিষ্কপ্রসূত। অন্য সম্পাদকের ভূমিকা প্রায় নগণ্য। বইতে মোট গানের সংখ্যা ৬৪৭, যেগুলি গানের রীতি ও ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট অধ্যায়ে সংকলিত হয়েছে। এরকমই ‘বিবিধ সঙ্গীত‘ অধ্যায়ে থাকা একটি গানের বিষয়— ভোট। প্রশ্ন হচ্ছে, উনিশ শতকের শেষভাগে প্রকাশিত একটি গানের বইতে ভোট নিয়ে কোনও গান থাকছে কীভাবে?

১৮৭৬ সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখরা মিলে তৈরি করলেন ‘Indian Association’ বা ‘ভারত সভা’। ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই সংগঠনের অনেকগুলি দাবির মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড, মিউনিসিপ্যালিটি, লোকাল বোর্ড প্রভৃতির গঠনে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার। অর্থাৎ, এগুলি নিয়ন্ত্রণের ভার থাকবে ভারতীয়দের ওপর। এই সময় ভাইসরয় ছিলেন লর্ড লিটন। তিনি এইসব দাবিকে সেভাবে আমল দিলেন না। কিন্তু ভারত সভা তাঁদের দাবি থেকে সরলেন না। এভাবে চার বছর কাটার পর, ১৮৮০ সালে ভাইসরয় হয়ে এলেন উদারচেতা লর্ড রিপন। এঁকে বলা হয় ‘ভারতবন্ধু‘। রিপন এসে ভারত সভার দাবির বিষয়টি খতিয়ে দেখে, তিনটি প্রস্তাব দিলেন― ১) স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হবে নির্বাচনের ভিত্তিতে, ২) ক্ষমতা সম্প্রসারিত করার সুযোগ থাকবে এবং ৩) প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেরাই তাদের চেয়ারম্যান বেছে নিতে পারবে। ভাইসরয়ের অনুমোদিত এই প্রস্তাব অনুযায়ী ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের হাতে দেওয়া স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল ১৮৮১ সালের অক্টোবর ও ১৮৮২ সালের মে মাসে। এর ফলে, বাংলার বিভিন্ন শহরে, মফস্বলে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড, মিউনিসিপ্যালিটি গড়ে উঠতে লাগল। যার জন্যে নির্বাচন শুরু হল। প্রসঙ্গত, তখন থেকে পরাধীন ভারতের সময় জুড়ে আরও নানা ক্ষেত্রে পরবর্তীতে যেসব নির্বাচন হয়েছিল, তা হত তিন বছর অন্তর। ব্যস, এর পর থেকেই ‘নেতা‘, ‘কমিশনার‘, ‘ভোট‘ ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেলেন বাংলার মানুষ। ভারতীয়–নিয়ন্ত্রিত এইসব প্রতিষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের উৎসাহ প্রবলভাবে বাড়তে লাগল। ভোট দেওয়া ও ভোটে দাঁড়ানো, সবই রইল ভারতীয়দের হাতে। তবে, আগেই বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ ছিল।

এইবার পরিষ্কার, কেন ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত ‘সঙ্গীতকল্পতরু’ গ্রন্থে ভোট নিয়ে একটি গান রয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, ১৮৮২–র পরে কোনও সময়ে গানটি তৈরি হয়েছে। কারণ, তখন থেকেই তো ভোটের শুরু। গানটি বাউল অঙ্গের। বইতে গীতিকারের নাম ‘অজ্ঞাত‘ বলা হয়েছে। অনুমান করা যায়, গানটি কোনও বাউল বা চারণকবির রচনা। গানটির সম্পূর্ণ বাণীর দিকে তাকালে দেখা যায়, যেখান থেকে উঠে আসছে সেইসময়কার সদ্যোজাত ভোট ও তার পরিণামকে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়ার ধরন। যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ―
‘ও চাঁদ, ফাঁকি দিয়ে ভোট নেবে ভেবেছ আবার?
চিনেছে তোমায় সব রেটপেয়ার―
যেমন করেছি বোকামী, দেছ, আক্কেল সেলামি,
বেলতলাতে ন্যাড়ে যায় হে কবার?
দেশের ভাল হবে বলে, মিলিয়া সকলে,
আদর করে কল্লেম কমিশনার;
তার রাখলে খুব ধর্ম্ম, কল্লে উচিত কর্ম্ম,
এমন ফিকির আঁটছ গলায় ছুরি দিবার,
রইলে মনের মত হয়ে, থাকতেম সব সয়ে,
রাখতে পাল্লে কই তেমন পসার?
কিসের অহঙ্কারে মত্ত? ক দিন এ ইন্দ্রত্ব?
তিন বছর ত বই আর রবে না পাওয়ার!
তোমার নয় হে পিতৃশ্রাদ্ধ, যে করবে যা বরাদ্দ,
কথা কবার কারো নাই অধিকার;
যখন সাধারণের টাকা, সকলকে চাই ডাকা
একলা হরির খুড়ো কে তুমি তায়?
তখন কাচা দিয়ে গলে, “আমায় ভোট দাও” বলে
দ্বারস্থ হয়েছ দ্বারে সবার,
এখন বিচি গেছে উলে, সকল গেছ ভুলে,
দেখলে যেন চিনতে পার না আর।
করে গরীবকে পেষণ, শুষ্ককে শোষণ,
সেই রক্ত উঠা ধনের এই কি ব্যাভার!
ওহে তিলকাঞ্চন হলে, অনাসে যা চলে,
কর বৃষোৎসর্গ! পেয়ে পরের ভাঁড়ার।‘

খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসছে গানটি থেকে। এর পর যত দিন এগিয়েছে, পরাধীন ভারতে কলকাতা কর্পোরেশন এসেছে ভারতীয়দের হাতে, বাংলার শাসনে তৈরি হয়েছে ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত “Bengal Legislative Assembly”(বঙ্গীয় আইন পরিষদ) ইত্যাদি। অবশ্যই মূল রাশ ছিল ব্রিটিশ সরকারের জিম্মায়। তবুও এইসব প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ভোট হয়েছে এবং এরকম বিভিন্ন ভোট নিয়ে নানা সময়ে অনেক গুণীজনের কবিতা, গান, প্রহসন ইত্যাদিতে ব্যঙ্গের ছোঁয়াসহ এসেছে ভোটের প্রসঙ্গ। যাতে মূলত প্রতিভাত হয়েছে নির্বাচন নিয়ে নানারকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া। যেগুলি আজকে এসেও বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে শুধু তাই নয়, যতদিন গেছে ভোটকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার প্রদর্শন ও উগ্রতার ধরন উত্তরোত্তর বেড়েছে। এটাই লক্ষ্যণীয় , শিক্ষণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ।
তথ্যঋণ :
১) ‘সঙ্গীতকল্পতরু‘― শ্রীনরেন্দ্রনাথ দত্ত(স্বামী বিবেকানন্দ) ও শ্রীবৈষ্ণবচরণ বসাক(প্রাসঙ্গিক তথ্য ও আলোচনা― ড. সর্বানন্দ চৌধুরী, রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অব কালচার, ১ এপ্রিল ২০০০)
২) ‘রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথা‘(ভাষান্তর― নলিনীমোহন দাশগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, মার্চ ১৯৮৯)
৩) ‘বাংলার বিধানসভার একশো বছর‘― সত্যব্রত দত্ত (প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, আগস্ট ২০১৩)
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia, Wikimedia commons
জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।