রোমানিয়া- ১৪৫৬- ১৪৭৬

মিখাইল সালটিকভ সেড্রিন ছিলেন উনবিংশ শতকের নাম করা এক ব্যঙ্গ-লেখক। ১৯৩২ সালে সোভিয়েত সরকার লেনিনগ্রাদের সেন্ট পিটার্সবার্গের জাতীয় লাইব্রেরিটি তাঁর নামাঙ্কিত করে দেন। এই গ্রন্থাগার পৃথিবীর সেরা গ্রন্থাগারগুলির অন্যতম। প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া পুঁথি থেকে একেবারে আধুনিক বই, সব কিছুর জন্য এ এক সোনার খনি। আর এখানেই এক প্রবল বর্ষার দিনে আমাদের পূর্ব পরিচিত এক ভদ্রলোক পাগলের মতো উলটে যাচ্ছিলেন পাতার পর পাতা। রেমন্ড ম্যাকনেলি। তাঁর হাতের পুঁথির লেখাগুলো যেন তিনি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ভাবতেই পারেননি রোমানিয়া থেকে এত দূরে, খোদ রাশিয়ায়, রাশিয়ান ভাষায় তিনি ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় পেয়ে যাবেন। 

Leningrad Library
লেনিনগ্রাদের এই গ্রন্থাগারেই পাওয়া গিয়েছিল ড্রাকুলার নামাঙ্কিত পুথি


আপাতদৃষ্টিতে কীটদষ্ট পুঁথিটির কোনও নাম নেই। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ এটাকে চেনেন একটা সংখ্যা দিয়ে- এম এস ১১/১০৮৮… ব্যাস। একটা ছোট কার্ডে শুধু লেখা আছে‒ ১৪০০ সালের শেষ দিকে লেখা এই পুঁথি উদ্ধার করা হয়েছে রাশিয়ারই কিরিলভ-বেলোজ়ারস্কি মঠ থেকে। ঐতিহাসিক নিকোলাস কারামজ়িন গবেষণা করে দেখিয়েছেন, এই পুঁথি ১৪৯০ সালে এফোরসিন নামে এক রাশিয়ান সাধুর লেখা। তিনি আবার এটি অনুবাদ করেছেন  ১৪৮৬ সালে রোমানিয়ায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ফেডোর কুরিস্টিনের এক বর্ণনা থেকে। কুরিস্টিন বেশ কিছুদিন হাঙ্গেরিতেও রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছিলেন। কোনও অজ্ঞাত কারণে ১৪৬২ থেকে ১৪৭৪ পর্যন্ত তাঁকে বন্দিও থাকতে হয়েছিল। 

সেই সময় একদিন এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। লোকটি পরিচয় দেয় “আমি ভ্লাদ ড্রাকুলার ছেলে” বলে। কুরিস্টিন নামটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। পরে খোঁজখবর নিতে গিয়ে তিনি যে সব তথ্য পান, তা চমকে দেবার মতো। যারা ভ্লাদ ড্রাকুলাকে চিনত, বা তাঁর কথা শুনেছে, তাদের মুখ থেকে শুনে তিনি এই কাহিনি লেখেন। ১৪৫৬ সালে ড্রাকুলা সিংহাসনে বসার পর এই আখ্যানের শুরু।

***

ওয়ালাচিয়ার রাজধানী টারগোভিস্টের প্রায় গোটাটাই ছিল অভিজাত অমাত্যদের হাতে। তাঁদের চটিয়ে কুটোটিও নড়ানো যেত না। রাজা যেই হোন না কেন, সেই রাজা কতদিন রাজত্ব করবেন, তা ঠিক হত তিনি এই অভিজাতদের ঠিকঠাক মেনে চলছেন কিনা, তার উপরে। রাজা একটু বেগড়বাঁই করলেই তাঁর বিপক্ষে গিয়ে শত্রুর সঙ্গে হাত মেলানো থেকে শুরু করে গুপ্তহত্যা, কিছুই বাদ দিতেন না এই অমাত্যের দল। বিশাল সম্পত্তির অধিকারী এই অমাত্যদের হাত থেকে স্বয়ং ড্রাকুলও নিস্তার পাননি। সত্যি বলতে কি, রোমান সম্রাটের কাছে ড্রাকুলের বিরুদ্ধে নিয়মিত খবর দেওয়া বা হুনিয়াদিকে উস্কানোর পিছনে এদেরই হাত ছিল। রোমানিয়ায় এদের বলা হত “বয়ার”।

শুধু টাকাপয়সাই নয়, বয়ারদের প্রত্যেকের কাছে সৈন্যসামন্তও থাকত, বিপদে কাজে লাগানোর জন্য। ড্রাকুলা সিংহাসনে বসার আগেই ঠিক করে নিয়েছিলেন, এই বয়ারদের শায়েস্তা করতে হবে, আর সেটা একেবারে প্রথম রাতেই। জুন মাসের সেইদিন, যেদিন হ্যালির ধূমকেতু দেখা গেল, আর ড্রাকুলা রাজা হলেন, সেদিন রাতেই এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। ড্রাকুলা নিয়ে যে ক’টা প্রাচীন পুঁথি পাওয়া যায়, তার সব কটাতেই এই ঘটনার উল্লেখ আছে। 

targoviste Vlad the dracula court
টারগোভিস্টে এখনও ড্রাকুলার সেই রাজবাড়ির অংশ দেখতে পাওয়া যায়


ড্রাকুলার অভিষেকে শহরের প্রায় সব অভিজাতরাই সপরিবার উপস্থিত ছিলেন। সংখ্যায় বেশ কয়েকশো। সঙ্গে পাঁচজন বিশপ, বিভিন্ন গির্জার পাদরিরা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত আর স্বয়ং আর্চবিশপ। চারিদিকে খাদ্য আর পানীয়ের অঢেল ব্যবস্থা। তীব্র চিৎকারে গান গাইছে কেউ কেউ। হাসির আওয়াজ, গেলাসের টুংটাং শব্দে কান পাতা দায়। ড্রাকুলা খুব ধীরে ধীরে বয়ারদের মুখের দিকে চাইলেন। তিনি জানতেন এরাই এককালে তাঁর বাবা আর ভাইকে হত্যা করিয়েছে। সুযোগ পেলে তাঁকেও মারবে। তাঁর মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। তিনি সব বয়ারদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে আমার অনুগত অমাত্যরা, আপনাদের জীবনকালে এই রাজ্যে আপনারা কতজন রাজাকে দেখেছেন?” প্রথমে হালকা হাসির একটা বাতাস বয়ে গেল সভাঘরে। সবাই চুপ। এবার ড্রাকুলা একটু জোর দিয়ে বললেন, “না, বলুন আপনারা। আমি জানতে চাই
 

এবার সবাই যেন প্রশ্নের গুরুত্ব বুঝলেন। সবাই রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে। আচমকা এই প্রশ্ন কেন? একজন গলা খাঁকরে বললেন “সাত জন মহারাজ।“ কেউ বলল “দশ”, কেউ “বারো”, কেউ “সতেরো”, এক বৃদ্ধ অমাত্য বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন , “মহারাজ, আমার জীবনে আমি আজ অবধি তিরিশ জন রাজাকে দেখেছি। আমার চেয়ে বেশি কেউ দেখেনি।” সবচেয়ে তরুণ অমাত্যটিও লাজুক মুখে জানাল, সে-ও সাতজন রাজাকে দেখেছে। যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে বললেও তাঁরা যেন বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, রাজা আসে, রাজা যায়। আমরা থেকে যাব, চিরকালের মতো। 

Vlad the impeller
এভাবেই শূলে চড়িয়ে শত্রু ও অমাত্যদের শাস্তি দিতেন ভ্লাড। তাঁ তাঁর নাম হয় ভ্লাড দ্য ইমপেলার


ড্রাকুলার চোখ ঝলসে উঠল। তিনি তিনবার হাততালি দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে কয়েক হাজার সৈনিক ঢুকে পড়ল সভাঘরে। স্ত্রী, পুত্র, কন্যসহ বন্দি করল প্রায় পাঁচশো অভিজাত অমাত্যকে। সেই রাতেই প্রাসাদের বাইরে পোঁতা হল লোহার বড় বড় শূল। ডগা তীক্ষ্ণ। চকচক করছে। সেই শূলে জ্যান্ত গেঁথে দেওয়া হতে লাগল সপরিবার অমাত্যদের। তাঁদের চিৎকারে রাতের আকাশ যেন থরথর কাঁপতে লাগল। প্রাসাদের উঠোন থেকে বয়ে এসে রক্তের নদী ভাসিয়ে দিল টারগোভিস্টের রাস্তা। যে ক’জন অমাত্য বেঁচে রইলেন, তাঁরা হয় দেশ ছেড়ে পালালেন, নয়তো শপথ নিলেন ড্রাকুলার আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবেন চিরকাল। আর সেই রাত থেকে ড্রাকুলার নতুন নাম হল “শূলে চড়ানো ভ্লাদ” বা “ভ্লাদ দ্য ইম্পেলার”। যে নামকে ভবিষ্যতে সার্থক করে তুলবেন ড্রাকুলা নিজেই।

***

টারগোভিস্টে এখনও ড্রাকুলার সেই রাজবাড়ির ভাঙাচোরা অংশ দেখতে পাওয়া যায়। পাশেই সিন্দেরিয়া ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে রাজ্যবাসীর গতিবিধির ওপর নজর রাখত ড্রাকুলার সেনাবাহিনী। মূল পোর্টিকোতে দাঁড়ালে দেখা যাবে গোটা শহরটাকে। সেখান থেকে সরু ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেই সেই কুখ্যাত সভাঘর। পাশে মদ রাখার সেলার। অভিষেকের রাতে এখান থেকেই মদের পাত্র সরবরাহ করা হয়েছিল  অভিজাতদের। 

আর তার পিছনে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে ছোট একটা ঘর। গুমঘর। অপরাধীদের মুখ থেকে কথা বার করতে এই ঘরেই নারকীয় অত্যাচার চলত। মাঝের সেই সভাঘরে নাকি বিরাট এক সিংহাসনে ড্রাকুলা বসতেন। বিচার করতেন। অমাত্যদের মারার পর ড্রাকুলা আরও বেশি নিষ্ঠুর, আরও বেশি নির্ভয় হয়ে গেলেন। রোমান সম্রাট বা তুর্কি সুলতান, কারও অধীনে না থেকে একনায়ক হয়ে ওঠার পথে পা বাড়ালেন তিনি। আর সে কাজে সফল হতে তিনি এমন এক পদক্ষেপ করলেন, যা সেই অবস্থায় গোটা ইউরোপের কোনও রাজা বা সামন্ত করতে সাহস পায়নি।

*ছবি সৌজন্য: wikipedia, military.com, pinterest
*আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩]

তথ্যঋণ:

১। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ইন সার্চ অফ ড্রাকুলা: দ্য হিস্ট্রি অফ ড্রাকুলা অ্যান্ড ভ্যামপায়ারস (১৯৯৪), হটন মিলিফিন কোং
২। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ড্রাকুলা: আ বায়োগ্রাফি অফ ভ্লাড দ্য ইমপেলর (১৯৭৩), হথর্ন
৩। লেদারডেল, ক্লাইভ, ড্রাকুলা, দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য লেজেন্ড: আ স্টাডি অফ ব্র্যাম স্টোকার্স গথিক মাস্টারপিস (১৯৮৫), উইলিংবরো নর্থহ্যামপ্টনশায়ার, ইউকে
৪। রিকার্ডো, মার্টিন, ভ্যাম্পায়ার্স আনআর্থড (১৯৮৩), গারল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক
৫। ট্রেপ্টো, কার্ট এডিটেড ড্রাকুলা এসেজ অন দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ ভ্লাড টেপেস (১৯৯১), কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস

জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *