হোমস্টের সামনের ছড়ানো লনটায় বসে ব্রেকফাস্ট করছিলাম। সাহান কয়েকবার এসে তাড়া দিয়ে গেছে। পথের দূরত্ব নেহাত কম না, ১২০ কিলোমিটার। সফরসূচী অনুযায়ী, একটামাত্র রাত অনুরাধাপুরার জন্য বরাদ্দ। প্রাচীন শহরটার সমৃদ্ধ ইতিহাসের পাতা উল্টোতে দুপুরটুকুই যা সময় পাওয়া যাবে।
কালপিটিয়া থেকে বেরোতে বেরোতে বেলা দশটা বাজল। দীর্ঘ যাত্রাপথের অনেকটাই চলেছি নীল লগুনের বিস্তৃত জলরাশির পাশ দিয়ে। এখানকার লোকেরা লগুনকে বলে কালাপুয়া। সমান্তরালে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের ঠাসবুনট। পালাভিয়া হয়ে পুত্তালাম পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার রাস্তার এমনই নয়নাভিরাম শোভা।
পুত্তালাম বেশ বড় জনপদ। দোকান-বাজার নিয়ে জমজমাট। জলের ধার ঘেঁষে বসার চেয়ারগুলো সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। সোজা রাস্তা গেছে মান্নার হয়ে নর্দান প্রভিন্সের প্রধান শহর জাফনার দিকে। ডানদিকের পথ ধরলাম। মাঝে মাঝে হাল্কা চড়াই-উতরাই পথের বুকে ঢেউ তুলেছে। ব্ল্যাক-ট্রি লেক রোডে এসে পড়লাম।

পিচপালিশ রাস্তার দুপাশে নিবিড় জঙ্গলের বেষ্টনী। সাহান বলল, “রাতে অনেক সময় বুনো হাতির পাল এসে রাস্তা আটকে দেয়”। এক সুবিশাল হ্রদের কাছে অল্পক্ষণের পথবিরতি। নাম ব্ল্যাক-ট্রি লেক হলেও, জলের মধ্যে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ গাছের দল। পাখিদের ওড়াউড়ি, ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য উপভোগ করে এগিয়ে চললাম।
কখনও সখনও জঙ্গল পাতলা হলে একটা-দুটো গ্রামের উপস্থিতি। সুবিস্তৃত ধানখেত, কলাবাগান যেন এক টুকরো গ্রাম বাংলা। মূল সড়ক থেকে বাঁদিকে ঢুকে যাওয়া একটা রাস্তা দেখিয়ে সাহান বলল, “এই রাস্তা ধরে প্রায় আট কিলোমিটার গেলে উইলপাট্টু ন্যাশনাল পার্ক।” একটা ছোট্ট না পাওয়ার ব্যথা; এ যাত্রায় অদেখাই রয়ে গেল।
অরণ্যের ছবি আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেছে। নচিয়াগামায় শহুরে ব্যস্ততা চলছে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে জল আর কিছু শুকনো খাবার কিনে নেওয়া হল। সাহানের কথায়, “আর বেশি দূর নয়”। মেরেকেটে ২০ কিলোমিটার। রাস্তায় খানাখন্দ নেই বলে বেশি সময় লাগল না। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ ঢুকে পড়লাম শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজধানী, নর্থ সেন্ট্রাল প্রভিন্সের মুখ্য শহর অনুরাধাপুরায়।
শহরে ঢোকার মুখেই এক ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁর সামনে এসে সাহান গাড়ি থামাল। বোর্ডে লেখা আছে ‘ম্যাঙ্গো ম্যাঙ্গো’, তার নীচে ছোট হরফে লেখা ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’। বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খাদ্যমূল্য বেশ চড়া। বললাম, “এখানে নয়, আরেকটু সস্তার কোনও জায়গায় নিয়ে চলো”। সাহানের বক্তব্য অনুযায়ী, এখান থেকে মনাস্ট্রি কমপ্লেক্স খুব কাছে। আশেপাশে আর কোনও রেস্তোরাঁ নেই। খাওয়ার জন্য যদি এখন শহরের মূল কেন্দ্রে ঢুকতে হয়, তাহলে যাওয়া-আসা মিলিয়ে অনেকটা সময় নষ্ট হবে।

ভারতীয় রেস্তোরাঁটির মেনু কার্ডে আলাদা আলাদা ভাবে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের খাবারের নামের তালিকা রয়েছে। দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির খাদ্য তালিকা স্বাভাবিকভাবেই বেশ লম্বা। বাংলা বিভাগে দুটো নাম আছে…রোহু ফিশ্ কালহিয়া আর ঝিঙ্গা পোস্ত। চমক আর খুশি, দুটোই একসঙ্গে উপলব্ধি করলাম। বাঙালির জাতীয় আবেগ, মাছের ঝোলে হাবুডুবু খাওয়া আর পোস্ত পেলে সোনায় সোহাগা। যদিও কালহিয়া মানে যে কালিয়া, সেটা বুঝতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। কিন্তু, ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল না। বাঙালি পোস্ত-কালিয়া তো দূরস্থান, ইডলি-ধোসা, পালক-পনীর এসব নামগুলো কার্ডে জ্বলজ্বল করলেও অর্ডার করতে গিয়ে জানা গেল ‘নট এ্যাভেলেবেল নাও, ওনলি শ্রীলঙ্কান থালি’। সব আশায় চিরতার জল।
থালিটা নেহাত মন্দ নয়…ভাত, মটর ডাল, আলু আর বিনসের তরকারি, পাঁপড়, স্যালাড আর পোল সম্বল (পোল সম্বল সম্পর্কে স্বর্ণলঙ্কা প্রথম পর্বে বিশদে উল্লেখ করেছি)। মটর ডাল আর সবজি স্বাদে-গন্ধে টিপিক্যাল শ্রীলঙ্কান। আমিষ পদে মিলেছে স্থানীয় তালাপাথ মাছের ঝোল…দারচিনির গন্ধে ভরপুর, তীব্র টক আর ঝালের যুগলবন্দী। খরচ যতটা ভেবেছিলাম, তেমন কিছুই নয়। ৩০০ এল.কে.আর. অর্থাৎ ১১৭ টাকায় ভরপেট মাছ-ভাতের থালি খাওয়া, তাও আবার ঝকঝকে ঠান্ডা ঘরে বসে (২০১৯ সালে ১ এল.কে.আর. সমান ভারতীয় মূল্যে ৩৯ পয়সা)।
চার কিলোমিটার এগিয়ে মনাস্ট্রি কমপ্লেক্সের প্রবেশদ্বার। টিকিটমূল্য ২৫ ডলার। টিকিটঘরের ভদ্রলোক আপাদমস্তক জরিপ করে বললেন, “ইন্ডিয়ান?” মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই পাসপোর্ট চাইলেন। তখনও জানা ছিল না, এ দেশে পুরাতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্গত ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের টিকিটে ৫০% ছাড় দেওয়া হয়। পাসপোর্ট দেখানোর পর সাড়ে বারো ডলারে টিকিট পেয়ে গেলাম।

টিকিট কাউন্টারের পাশে অনেকগুলো সাইকেল জড়ো করে রাখা আছে। বিশাল এই ঐতিহাসিক চত্বর ঘুরে দেখার জন্য এগুলো ভাড়া দেওয়া হয়। উল্টোদিকেই একটা পুরাতাত্ত্বিক মিউজিয়াম। প্রাচীন অনুরাধাপুরা থেকে সংগৃহীত প্রাচীন মূর্তি, শিলালিপি এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। সংস্কারের কাজ চলছে, সাময়িকভাবে বন্ধ আছে।
শ্রীলঙ্কার প্রাচীন ইতিহাসে অনুরাধাপুরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আনুমানিক প্রায় ৩০০০ বছরের পুরনো এই শহর প্রাচীন উন্নত সভ্যতার এক নিদর্শন। কৃষিকাজ, শিল্প-সংস্কৃতি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতিসাধন হয়েছিল। তবে অনুরাধাপুরা নিয়ে আলোচনা করার আগে প্রাচীন শ্রীলঙ্কার কথা একটু বলি।
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে, প্রস্তরযুগেও এই দ্বীপে মানববসতি গড়ে উঠেছিল। সুতরাং, এই দেশের প্রাচীনত্বের শিকড় অনেক গভীরে। ভারতবর্ষের মূল ভূখন্ড থেকে শ্রীলঙ্কা পক প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এই প্রণালীর মধ্যে ছোট ছোট অনেক দ্বীপমালা ও প্রবালশৈল মাথা তুলে আছে। এই দ্বীপমালা আসলে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার পর সুপ্রাচীন কোনও পর্বতশ্রেণীর অবশিষ্টাংশ মাত্র। এদের মাধ্যমেই পুরাকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা শ্রীলঙ্কার পক্ষে সহজ হয়েছিল। যার উদাহরণ আমরা পুরাণকাহিনী রামায়ণে পাই।
প্রাচীনকালে শ্রীলঙ্কার অধিবাসীরা ছিল ‘বেড্ডা’। অনেকে মনে করেন তামিল শব্দ ‘বেড়ণ’ (যার অর্থ শিকারী) থেকে ‘বেড্ডা’ কথাটি এসেছে। আবার অন্য মতে, সংস্কৃত ‘ব্যাধ’ শব্দ থেকেই এর উৎপত্তি। তবে শুধু শিকার নয়, কৃষিকাজও তারা জানত। এদের সমাজ ছিল প্রাচীন গোষ্ঠী সমাজ। এ দেশে বসবাসকারী বেড্ডারা এখনও সংখ্যায় বেশ কয়েক হাজার। পুরনো সামাজিক নিয়ম-প্রথা, আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি আজও এদের মধ্যে টিঁকে আছে।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে রচিত ইতিহাস গ্রন্থ মহাবংশে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে উত্তর ভারত তথা বাংলা থেকে এক দল লোক রাজপুত্র বিজয়সিংহের নেতৃত্বে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে জলপথে এই দ্বীপে আসে। উন্নততর অস্ত্র ও ক্ষমতার বলে বেড্ডাদের পরাস্ত করে বিজয়সিংহের দখলদারিত্ব কায়েম হয়। শুরু হয় সিংহ বংশের শাসনকাল। অনেকের মতে, সিংহ উপাধি থেকেই দেশটির নাম সিংহল হয়েছিল। আর বিজয়সিংহের বংশধরেরা সিংহলী নামে পরিচিত হয়।
চার কিলোমিটার এগিয়ে মনাস্ট্রি কমপ্লেক্সের প্রবেশদ্বার। টিকিটমূল্য ২৫ ডলার। টিকিটঘরের ভদ্রলোক আপাদমস্তক জরিপ করে বললেন, “ইন্ডিয়ান?” মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই পাসপোর্ট চাইলেন। তখনও জানা ছিল না, এ দেশে পুরাতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্গত ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের টিকিটে ৫০% ছাড় দেওয়া হয়।
বিজয়সিংহের রাজধানী অনুরাধাপুরায় না হলেও, তার পরবর্তী প্রজন্ম রাজধানী সরিয়ে আনে অনুরাধাপুরায়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে এগারো খ্রিষ্টাব্দের গোড়া পর্যন্ত অনুরাধাপুরাই ছিল সিংহলের রাজধানী। এই নগরটি সেই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক ও নগরসভ্যতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে কলিঙ্গরাজ সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সঙ্ঘমিত্রা বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সিংহল আসেন এবং এই অনুরাধাপুরা থেকেই শুরু হয় তাদের প্রচারের জয়যাত্রা। স্থানীয় শাসকরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হতে থাকেন। ক্রমেই অনুরাধাপুরা বৌদ্ধধর্মের অন্যতম পীঠস্থান হিসাবে গড়ে ওঠে এবং বৌদ্ধবিশ্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে এই প্রাচীন শহর। ৪০ বর্গকিলোমিটারব্যাপী শহরটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শতাধিক বিহার, স্তূপ এবং গুম্ফা। ইতিহাস ও শিল্পকলার দিক দিয়ে অনুরাধাপুরা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার দ্রষ্টব্য শহরগুলির মধ্যে অন্যতম। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন এই রাজধানী শহরটিকে ইউনেসকো ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃৃতি দিয়েছে।

সাহান একজন গাইড এনেছে, নাম অনিল গামিনী। সে তো ৬০০০ এল.কে.আর. (ভারতীয় মুদ্রায় ২৩৪০ টাকা) হেঁকে বসল। অনেক দরদামের পর সেটা নেমে দাঁড়াল ২৫০০ এল.কে.আর. (৯৭৫ টাকা)। অনিল আমাদের গাড়িতে উঠে পড়ল। বেশ স্মার্ট। জানতে চাইল, ভারতের কোন শহর থেকে এসেছি। ‘কলকাতা’ বলতে ঠিক সনাক্ত করতে পারল না প্রথমে। ‘সিটি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর!’…তাতেও তার ভ্রু জোড়ার ভাঁজখানা সোজা হল না। শেষে ‘সৌরভ গাঙ্গুলী’র নাম নিতেই হেসে বলল, “ওক্কে! আন্ডারস্টুড!”
চলার পথে একটা বিশাল লেক দেখিয়ে অনিল বলল, “বাসওয়াকুলাম ট্যাঙ্ক, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে শ্রীলঙ্কার প্রথম মনুষ্যনির্মিত জলাধার যার আসল নাম অভয়াভাপি। প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কার সেচ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। বেশ কিছু ঝিল ও সরোবর আজও ব্যবহারযোগ্য। ৬০-৬৫টি ঝিল আছে অনুরাধাপুরায়। শহরের মাঝখানে আছে থিস্সা ওয়েয়া লেক। সিংহলা ভাষায় ‘ওয়েয়া’ শব্দের অর্থ হ্রদ বা জলাশয়। এখানে হ্রদের সংখ্যা এতই বেশি যে, অনুরাধাপুরাকে ‘হ্রদের শহর’ বলা যেতে পারে।”

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু থামল অনিল। চার কিলোমিটার চলার পর গাড়ি থেকে নেমে অনিলকে অনুসরণ করতে লাগলাম। প্যাচপ্যাচে গরম। বট-অশত্থ ঘিরে রেখেছে গোটা এলাকা। ধারাবিবরণী আবার শুরু হল, “ অভয়াগিরি বৌদ্ধবিহারকে নালন্দা-বিক্রমশিলার সমসাময়িক বলে মনে করা হয়। প্রায় ৫০০০ হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এখানে থাকত।” এই বিশাল বৌদ্ধবিহার ভ্রমণের শুরুতেই দেখলাম ডাইনিং হল, রান্নাঘর, স্টোররুম, জল নিকাশি ব্যবস্থা। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম ২৫ ফুট লম্বা ৫ ফুট চওড়া রাইসবোল দেখে। সন্ন্যাসীদের খাওয়ার ভাত থাকত এই পাত্রে। তুলনামূলকভাবে কারিবোল কিছুটা ছোট। আরেক বিস্ময়কর দ্রষ্টব্য হল পাথরের গ্রাইন্ডার।
মাঝদুপুরের চড়া রোদে শরীর তেতে-পুড়ে যাচ্ছে। মার্চের গরমে এত বড় চত্বর পায়ে হেঁটে বেড়ানো বেশ ক্লান্তিকর। মাঝে মাঝে কোনও বটবৃক্ষের ছায়ায় ক্ষণিকের শীতল আরাম। একে একে দেখা হল সন্ন্যাসীদের শয়নকক্ষ, উপাসনাস্থল, সভাকক্ষ। বোর্ডে লেখা না থাকলে কিছু পাথরের বেদী আর পিলার থেকে কিছুই অনুধাবন করা সম্ভব নয়। প্রাচীন বুদ্ধের মূর্তি, শিলালিপি দেখে চলে এলাম এলিফ্যান্ট পন্ডের কাছে। সুবিশাল জলাশয়। চারপাশ পাথরে বাঁধানো। ১৮০০ বছর আগে তৈরি এলিফ্যান্ট পন্ড থেকে এখনও দুটো পাইপলাইনের মাধ্যমে শহরে জল সরবরাহ করা হয়।

অনিল এবারে রত্নপ্রাসাদের দিকে নিয়ে চলল। পথের একপাশে মাটির মধ্যে কিছুটা চেপে বসে আছে পাথরের স্ল্যাব। তার মধ্যে ছোট ছোট খোপ। অনিল জানাল, এটা জেমস্ বক্স, খোপগুলোর মধ্যে মূল্যবান রত্ন রেখে উপরে অবিকল একটা পাথরের স্ল্যাব চাপা দিয়ে মাটির তলায় পুঁতে রাখা হতো।
সাততলা রত্নপ্রাসাদটি অষ্টম শতকে তৈরি হয়। কিন্তু, দশম শতকে আগুনে পুড়ে যায়। প্রসাদের সিলিং ও দেওয়ালের রঙিন কাচ আমদানি করা হয়েছিল চিন দেশ থেকে। আজ শুধু কিছু সিঁড়ি আর থাম প্রাসাদের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। এই স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য শৈলী হল ‘গার্ডস্টোন’ এবং ‘মুনস্টোন’। প্রবেশদ্বার বা সিঁড়ির পাশেই আছে গার্ডস্টোন…গ্রানাইটের তৈরি স্তম্ভাকৃতি পাথর, যার ভূমিকা রক্ষকের মতো। সিঁড়ির ঠিক সামনে মাটিতে রয়েছে অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাথরের ওপর নক্শাকাটা মুনস্টোন, যা প্রবেশদ্বারের সামনে অনেকটা কার্পেট হিসেবে গণ্য হত। হাতি, ঘোড়া, ষাঁড়, হাঁস, সিংহ প্রভৃতি খোদাই করা মুনস্টোনের কারুকার্য এককথায় অনবদ্য।
এসব দেখতে দেখতে কখন গাড়ির কাছে চলে এসেছি টের পাইনি। এবার মনাস্ট্রি কমপ্লেক্সের অন্যদিকে যেতে হবে। পিচগলা দুপুরে রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। গাড়ি ছুটে চলল পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
বিঃ দ্রঃ – অনুরাধাপুরার বাকি গল্পটুকু তোলা রইল পরের পর্বের জন্য।
ছবি লেখকের তোলা।
ঋণস্বীকার – পৃথিবীর ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ/ ফিওদর করোভকিন/প্রগতি প্রকাশন/ মস্কো
দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, প্রতিদিন, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো আর ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি।