আগের পর্ব পড়তে: 
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ১
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ২
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৩
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ৪

হিন্দি ফিল্মে প্লে-ব্যাক গান পরিবেশন করার দক্ষতা লতা মঙ্গেশকর আয়ত্ত করেছিলেন সেই চল্লিশের দশক থেকেই প্রতিটি গানের ভাব বুঝে, তার সঠিক মূল্যায়নে পটু লতা আমজনতার হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছিলেন তাঁর গাওয়া কিছু অনন্যসাধারণ নাগমার মাধ্যমে। তাঁর কণ্ঠের নিখুঁত স্বরক্ষেপণ, মসৃণ ওঠানামা, শব্দের অনায়াস জীবন্ত হয়ে ওঠা যে কোনও মানুষের পক্ষে করা সম্ভব, তিনি না থাকলে এই সত্যটা বিশ্বের কাছে অজানাই থেকে যেত। লতা মঙ্গেশকর সুরের আকাশে সেই ধ্রুবতারা, যিনি গানের মাধ্যমে তাঁর সমগ্র সাংগীতিক চেতনাকে উন্মুক্ত করেছিলেন। কণ্ঠের মাদকতা জন্মসূত্রে পেয়েছিলেন তিনি। সেই জাদুতে আচ্ছন্ন হয়ে রইল আপামর ভারতবাসী দীর্ঘ কয়েক দশক জুড়ে।

হিন্দি প্লে-ব্যাক গানের জগতে তাঁর আগমন বয়ে নিয়ে এসেছিল এক অনাবিল আনন্দের স্রোত যা আজও আমাদের মনকে আবিষ্ট করে রেখেছে এক নির্মল ভালোলাগার মায়াজালে। ১৯৪৮ সালটা লতা মঙ্গেশকরের জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রখ্যাত সঙ্গীতসাধক ও সুরকার অনিল বিশ্বাস লতার কণ্ঠমাধুর্যে মোহিত হয়ে সুযোগ দিলেন অম্বিকা ফিল্মসের ছবি ‘আনোখা পেয়ার’–এ। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ট্র্যাজেডি কিং দিলীপকুমার, নার্গিস, নলিনী জয়ন্ত, উমা দত্ত, কেশরবাঈ প্রমুখ। এমআই ধরমাসে পরিচালিত এই ফিচারে আমরা পেয়েছিলাম লতার কণ্ঠে এগারোটি চমকপ্রদ গান যার মধ্যে অধিকাংশই জনসমক্ষে সাড়া ফেলেছিল। 

Lata Mangeshkar
১৯৪৮ সালটা লতার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ

এই ছবির গান লতাকে দু’বার গাইতে হয়েছিল– একবার ফিল্মের জন্য ও আর একবার রেকর্ডের জন্য। ‘ইয়াদ রখনা চাঁদ তারোঁ’, ‘মেরে লিয়ে ও গম-এ-ইন্তেজার’, ‘এক দিল কা লগানা বাকি থা’ ও মুকেশের সঙ্গে ডুয়েট ‘অব ইয়াদ না কর ভুল যা’ ছায়াছবিতে গেয়েছিলেন মীনা কাপুর। ৭৮-পাক রেকর্ডে লতা কণ্ঠে পরিবেশিত এই গানগুলি সঙ্গীতপ্রেমী জনতার হৃদয়ে এক চিরকালীন ছাপ রেখে গেছে। আজও গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহকদের লিস্টে এই ফিল্মের শেল্যক–এর চাহিদা আকাশচুম্বী। এই ছবির একটি গানে ব্যর্থ প্রেমের আর্তি ফুটিয়ে তুলেছিলেন বিদগ্ধ গীতিকার ব্যহজাদ লখনৌয়ি এবং লতার মধুময় স্বরক্ষেপণে তা পরিণত হয়েছিল এক চিরকালীন ‘দর্দ–ভরা’ গীতে। গানটি এরকম: 

‘মেরে লিয়ে ও গম-এ-ইন্তেজার ছোড় গয়ে
গয়ে তো এক আনোখি বাহার ছোড় গয়ে।
হজ়ার কুছ হো মেরা দিল পলট নহি সকতা,
উনহি কি হুঁ যো মুঝে বেকরার ছোড় গয়ে।’ 

সেই আমলের জনপ্রিয় পরিচালক ও গীতিকার জিয়া সরহদির লেখা লিরিক: 

“জীবন সপনা টুট গ্যয়া,
এক মুসাফির আয়া,
আকে দিল কি দুনিয়া লুট গ্যয়া।
মন নগরী মেরি সুনি পড়ি থি
আশা কে দ্বারে পে কবসে খড়ি থি,
হাত মেঁ পি-কা আঁচল সজনি
আতে আতে ছুট গ্যয়া” 

আজও এ গান তার অনন্যতার জন্য শ্রোতাদের মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। সর্বোপরি ‘আনোখা পেয়ার’ ফিচারে অনিল বিশ্বাসের মন কেড়ে নেওয়া সুরবিন্যাস ও লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠ লালিত্যের যে সংযোগ ঘটেছিল তার আমেজ আজও রয়ে গিয়েছে সমগ্র দেশবাসীর মননে ও সাংগীতিক বোধে।

অনিল বিশ্বাসের সান্নিধ্যে লতা শিখেছিলেন শ্বাসনিয়ন্ত্রণ, যা একজন গায়িকার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনিলদার পরামর্শে লতা মাঝেমধ্যে মাইক থেকে মুখ সরিয়ে ডেলিভারি করতেন, যাতে শ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দ (Hissing) গানের মেজাজ নষ্ট না করে দেয়। শিখেছিলেন গান গাইতে গাইতে কি করে ভয়েস ফেড ইন-ফেড আউট করতে হয়। তাই এত দিন ধরে, এত সময় নিয়ে যে অকম্পিত কণ্ঠে তিনি গেয়ে গেলেন, স্বরভঙ্গ, ট্রেমেলো, বেসুরো স্বর তাঁকে সামান্য স্পর্শ করেনি। কারণ অসম্ভব সংযম ও তৈয়ারি তাঁর সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল। নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন কঠোর সাধনার মধ্যে দিয়ে। লতা মঙ্গেশকরের সুরেলা কণ্ঠের নিবেদন সাত দশক ধরে ভারতীয় সিনেমার দর্শক ও গানের শ্রোতার মধ্যে এনে দিয়েছিল এক প্রশান্তি। বেশ কয়েকটি প্রজন্ম মজে ছিল ও আছে তাঁর গানে। লতার গানে রয়েছে এক মরমিয়া প্রেমের আবেশ, যা মনকে শীতল করে।

Lata Mangeshkar 2
লতার গানে রয়েছে এক মরমিয়া প্রেমের আবেশ, যা মনকে শীতল করে

এক একটি যুগের সাংগীতিক নিবেদন এক এক প্রজন্মের নস্টালজিয়া নিয়ে আমাদের মনপ্রাণ ভরিয়ে তোলে। সেই প্রজন্মের মানুষ নিজেকে খুঁজে পেতে পছন্দ করেন লতার গানে। লতার হাত ধরে অনেকাংশে বদলে গেছিল হিন্দি ছবির সঙ্গীত উপস্থাপনের ধারাও। তাঁর কণ্ঠ শুনলেই বোঝা যায় পূর্বসূরিদের থেকে ঠিক কোথায় আলাদা ছিলেন তিনি। মহিলা-কণ্ঠে এক ভিন্ন গায়নশৈলীর প্রচলন করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সেলুলয়েডে তিনি আনলেন এক অনন্ত বিপ্লব যা সমস্ত পুরনো হিসেব পালটে দিয়েছিল। সেই বিপ্লবের জোয়ারে বহু নায়িকা ম্যাটিনি আইডল হয়ে উঠলেন, তেমনই লতা হয়ে উঠলেন সেই আইডলদের নেপথ্য অনুঘটক। 

লতা মঙ্গেশকর মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এ সমগ্র সংসার ঈশ্বরের, তিনি সকলকে কোনও না কোনও দায়িত্ব পালনের জন্য পাঠিয়েছেন। যাকে যে কাজের জন্য নির্ধারণ করেছেন, তা খুব যত্ন সহকারে হাসি মুখে করে যাওয়া প্রত্যেকের কর্তব্য। তিনি বলেছিলেন, 

‘আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর চেয়েছেন সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আমি সেবাব্রতে যুক্ত থাকি। আমি আমার সফলতা সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে, যাঁর কৃপা আর বাবা-মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া এ কঠোর পরিশ্রম আমার পক্ষে সম্ভব হত না’। 

Lata
পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নেই, যেখানে লতার কোকিলকণ্ঠ পৌঁছয়নি

লতা মঙ্গেশকর মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নিজের স্বরের মাধ্যমে সুমধুর করেছিলেন। পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নেই, যেখানে লতার কোকিলকণ্ঠ পৌঁছোয়নি। তাঁর সঙ্গীত মানুষকে নতুন জীবন দিয়েছে। লড়াই, সংঘর্ষ, জীবনের নানা ওঠাপড়া, সব কিছুতেই লতার গান মানুষকে প্রেরণা দিয়েছে। ভাষা, সীমা, প্রান্ত সব বাঁধন ভেঙে দিয়ে সপ্তসুরের আলাদা বর্ণময় সুমধুর বাতাবরণ তৈরি করেছিলেন তিনি।

লতা মঙ্গেশকর একটা যুগের চিহ্ন। তিনি সেই যুগের প্রতিনিধি যে সময় প্রত্যেক ভারতবাসী তাঁর সৃষ্টিশীলতাতেই রচনা করে নিয়েছিল নিজের পরিচয়পত্র। স্বাধীনতা উত্তর সময়কালে হিন্দি সঙ্গীত ও সিনেমা তখন একটু একটু করে খুঁজে পাচ্ছে আধুনিকতার নতুন উজ্জ্বল আলো। সে বড় সহজ কাজ ছিল না। অনুশীলন, সাধনা তখন নিছক শব্দমন্ত্র হয়ে ওঠেনি। সেই সময় সুরের সাধনাই করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর খ্যাতি, স্বীকৃতি পেরিয়েও থেকে যায় সৃষ্টির এক ঐশ্বর্যময় অনুসন্ধান, সংগীতের সাগরবেলায় ঝিনুক খোঁজার ছলে আজীবন সেই মুক্তোটিরই সন্ধান করেছেন লতা। উস্তাদ আমান আলি খান ভিন্ডিবাজারওয়ালের সাক্ষাৎ শিষ্যা তিনি, শাস্ত্রীয় সংগীতে তাঁর দখল তুলনারহিত। ঈশ্বরদত্ত প্রতিভার অধিকারী তিনি ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তারপরেও এসে যায় সেই সাধনার কথা। হিন্দি প্লে-ব্যাক গানের গায়নরীতির যে আধুনিকতা, তার এক দিকের কান্ডারী যদি মহম্মদ রফি বা কিশোরকুমার হন, তবে অন্যদিকে অমোঘ উপস্থিতি লতা মঙ্গেশকরের। 

 

পড়ুন: বাংলালাইভের বিশেষ ক্রোড়পত্র: সুরের সুরধুনী

 

জীবনে প্রচুর সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন সুরসম্রাজ্ঞী। পেয়েছেন যশ ও খ্যাতি। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার অজস্র সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের ভালোবাসা। লতা মঙ্গেশকরের জীবনযাত্রা ছিল একেবারেই সহজ–সরল, অনাড়ম্বর। হিন্দি ছবির প্লে-ব্যাকে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন সুরের রানি। লতার প্লে-ব্যাকে মোহিত হয়ে যেতেন প্রেক্ষাগৃহের দর্শক। তিনি যে শুধুমাত্র প্রাচ্যের সঙ্গীতশৈলীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, তা নয়। পাশ্চাত্য সংগীতেরও নানা শিখর তিনি ছুঁয়েছিলেন নানা গানে। কণ্ঠই ছিল তাঁর পরিচয়। ফিল্মে শিশুকণ্ঠের গান, বিরহ ও উচ্ছাসের গান, প্রেমের গান, ভক্তিমূলক গান– যাই হোক না কেন, সিকোয়েন্স যে রকম সেই চাহিদাই পুরোপুরি মিটিয়ে প্রার্থিত ভাবটি অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন লতা। ভারতের নাইটিঙ্গেল তিনি। তাঁর সুরেলা কণ্ঠের জাদু আর মাদকতায় প্রায় পাঁচটি প্রজন্মকে তিনি একা মাতিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিয়মিত কঠিন রেওয়াজে তাঁর সুরেলা কণ্ঠ এক সর্বোত্তম পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছিল। 

দীর্ঘ নয় দশকের জীবনে সুরের যে শিক্ষাটি তিনি অর্জন করেছিলেন তা যেমন প্রতিভার ফসল , তেমনই তাকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন কঠোর শৃঙ্খলায়। বাহুল্যবর্জন এবং পরিমিতিবোধ ছিল তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞান। তিনি যতই উৎকর্ষের শিখরের দিকে এগিয়ে গেছেন সারা দেশ দিয়েছে তাঁকে নানা সম্মাননা। তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি জনগনকর্ণে চিরস্থায়ী আসন। (চলবে)

 

পরবর্তী পর্ব ১৯ এপ্রিল ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Tfipost, Facebook

বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *