এমনও সময় গেছে জয়কুমার বৈদ্যের জীবনে, যখন স্কুলের মাইনে না দিতে পারার জন্য পরীক্ষার রেজাল্ট আটকে দেওয়া হয়েছে| ওঁর মা বহু কষ্ট করে অর্থ জোগাড় করে পড়াশোনা চালানোর চেষ্টা করেছেন ছেলের| অনেকেই সেই সময় পরামর্শ দিয়েছিলেন ছেলেকে পড়াশোনা না করিয়ে ড্রাইভারের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিতে| কিন্তু জয়কুমার বা ওঁর মা সেই সব কথায় কান দেননি| আজ তাই জয়কুমার আমেরিকার ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন বিজ্ঞানী| তবে মুম্বাইয়ের বস্তিতে থাকার অভিজ্ঞতা কোনও দিন ভুলতে পারবেন না জয়কুমার| এবং সেই দরিদ্র ছেলে এই মুহূর্তে ন্যানো টেকনলজি‚ ন্যানো অক্সিলেটর এবং ন্যানোস্কেল ডিভাইজ অ্যাপ্লিকেশন এবং আর্কিটেকচর নিয়ে গবেষণা করছেন|
জীবনে সফল হওয়ার স্বপ্ন জয়কুমার দেখেছিলেন মুম্বাইয়ের কুর্লা অঞ্চলের বস্তির একটা ৮ বাই ১০ স্কোয়ার ফিটের বাড়িতে বসে| তবে এই গল্পের সত্যিকারের ‘হিরো’ হলেন ওঁর মা নলিনী| শ্বশুরবাড়ি থেকে নলিনীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়| পরে স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়| ছোট ছেলেকে নিয়ে নলিনী তাঁর মায়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন| নলিনীর মা অফিসের এক জন কেরানি ছিলেন| কোনও রকমে সংসার চলে যাচ্ছিল ওঁদের| কিন্তু ২০০৩ সালে অসুস্থ হওয়ার ফলে চাকরি যায় তাঁর| ফলে ময়দানে নামতে হয় নলিনীকে|
উনি ছোটখাটো কাজ করে কোনও ক্রমে সংসার চালাতেন| অন্য দিকে নিয়মিত নলিনীকে আদালতেও ছোটাছুটি করতে হত বিবাহ বিচ্ছদের মামলা লড়ার জন্য| এই ভাবে ন’বছর কাটে| এমনও সময় গেছে যখন জয়কুমার শুধু মাত্র বাসি পচা বড়াপাও‚ সিঙারা‚ পাউঁরুটি আর চা খেয়ে দিন গুজরান করেছেন|
বহু বছর কষ্ট করার পর অবশেষে স্থানীয় এক মন্দির জয়কুমার আর নলিনীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়| মন্দির ট্রাস্টের দয়াতেই স্কুল এবং কলেজ পাশ করেন জয়কুমার| অনেকেই হয়তো ভাবছেন ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন কী করে দেখলেন জয়কুমার? এক বার এক বন্ধুর বাড়িতে ডিসকভারি চ্যানেলে একটা অনুষ্ঠান দেখেন জয়কুমার| দেখেন মহাকাশ সম্পর্কিত একটি সিনেমাও| সেই দিনই বিজ্ঞানী হওয়ার বীজ রোপণ হয় ওঁর মধ্যে| এ ছাড়াও জয়কুমারের মনে আছে যখন গ্রহণ হত তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা বিজ্ঞানসম্মত উত্তর না দিয়ে জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর ঝুঁকত| জয়কুমার এই সবে বিশ্বাস না করে বিজ্ঞানসম্মত উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতেন| তখনই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন জয়কুমার|
ছেলের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে নলিনী জয়কুমারকে উৎসাহ দিতেন| এই সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে জয়কুমার বলেন ‘এক মাত্র মা আমাকে সারা জীবন উৎসাহ দিয়ে গেছেন| মায়ের কারণে আমি হার মানিনি| অনেক বার মনে হয়েছে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই| তাতে অন্তত এক জনের খাওয়ার খরচ বাঁচতো| কিন্তু মায়ের কথা ভেবে তা পারিনি| মা আমার প্রেরণা| মায়ের জন্য আমি সফল হতে চাই এবং অন্যদের সাহায্য করতে চাই|’ আগামী দু’বছরে উনি ওঁর মাকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চান|
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় জয়কুমার একটা টিভি মেরামতের দোকানে কাজ নেন| এ ছাড়াও কুর্লা অঞ্চলের একটা কাপড়ের দোকানেও কাজ করতেন| মাসে মাত্র চার হাজার টাকা রোজগার ছিল তখন| ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় রোবোটিক্সে উনি তিনটে জাতীয় এবং চারটে রাজ্য স্তরে পুরস্কার জেতেন| এর ফলে উনি লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোতে একটা ইনটার্নসিপের সুযোগ পান| স্নাতোক হওয়ার পর জয়কুমার টাটা ইনস্টিউট-এ রিসার্চ করার সুযোগ পান| তখন ওঁর মাসিক রোজগার দাঁড়ায় তিরিশ হাজার টাকা| উনি তা দিয়ে বাড়ি মেরামত করেন এবং মাকে একটা এয়ারকন্ডিশন কিনে দেন|
গত তিন বছর ধরে আমেরিকায় আছেন জয়কুমার| ইতিমধ্যেই ওঁর দু’টো গবেষণাপত্র নামকরা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকায় ছাপা হয়েছে| জয়কুমার চান ভবিষ্যতে ভারত, হার্ডওয়্যার টেকনোলজিতে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠুক |
এই মুহুর্তে জয়কুমার যত টাকা বৃত্তি পান| তার মধ্যে নিজের জন্য সামান্য কিছু রেখে বাকিটা মাকে পাঠিয়ে দেন| ‘আমার গবেষণা শেষ হয়ে গেলে কিছু দিন চাকরি করতে চাই| তার পর দেশে ফিরে গিয়ে নিজের কারখানা খোলার ইচ্ছা আছে| আর চাই মেধাবী দুঃস্থ বাচ্চাদের সাহায্য করতে|’ আপাতত স্বপ্ন এখানেই থিতু হয়েছে।