আঠেরোর দশকে নাট্যকার তথা বাংলা থিয়েটারের জগতের প্রাণ পুরুষ ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। বাংলা নাট্যমঞ্চের যুগস্রষ্টা নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের লেখা ও পরিচালনা বাংলা থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করেছে। গিরিশচন্দ্র ঘোষের জন্ম হয় ১৮৪৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বাগবাজারে। তাঁর বাবা নীলকমল ও মা রাইমনির অষ্টম সন্তান ছিলেন গিরিশ।
গিরিশের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় স্থানীয় এক স্কুলে, পরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি বিদ্যালয় ও হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ডিগ্রিসর্বস্ব পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত তিনি সে অর্থে কোনওদিনই ছিলেন না। ১৮৬২ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন তিনি। পরবর্তীকালে ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইংরেজি ভাষা ও হিন্দু পুরাণ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর তিনি ‘অ্যাটকিন্সন টিলকন’কোম্পানির হিসাবরক্ষণ বিভাগে কিছুদিনের জন্য যোগ দেন। ১৮৭৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান লিগ’-এর হেড ক্লার্ক ও ক্যাশিয়ার পদে নিযুক্ত হন ও পরে পার্কার কোম্পানির হিসাবরক্ষকের পদে যোগ দেন।
কাজের পাশাপাশি চলতে থাকে তার নাট্যচর্চা ও নাট্যজগতে আনাগোনা। ১৮৬৭ সালে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের গীতিকার হিসাবে নাট্যজগৎতে প্রথম যুক্ত হন। দু’বছর পরে ‘সধবার একাদশী’তে অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করেন। ১৮৭৭ সালে স্বরচিত ‘আগমনী’ নাটক ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’-এ অভিনীত হয়। পরে তিনি এই রঙ্গালয়ের ম্যানেজার নিযুক্ত হন (১৮৮০)। ১৮৮৩ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত তিনি স্টার, এমারেল্ড, মিনার্ভা, ক্লাসিক ও কোহিনুরে বহু নাটক পরিচালনা করেন। ১৯০৮ সালে মিনার্ভা থিয়েটারের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

কলকাতায় ন্যাশানাল থিয়েটার নামে তাঁর একটি নাট্য সংস্থা ছিল। ১৮৭২ সালে তিনিই প্রথম বাংলা পেশাদার নাট্য কোম্পানি ‘ন্যাশানাল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৭ সালে মেঘনাদবধ কাব্যে রামচন্দ্র ও মেঘনাদ উভয় ক্ষেত্রে অভিনয়ের জন্য সাধারণী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁকে ‘বঙ্গের গ্যারিক’ আখ্যায় ভূষিত করেন।
সঙ্গীতজ্ঞ,কবি, নাট্য নির্দেশনা এবং অভিনয় ছাড়াও তাঁর অন্যতম প্রতিভার মধ্যে ছিল খুব দ্রুত অভিনব চিন্তা করার ক্ষমতা। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছয় দৃশ্যের নাটক ‘বিল্বমঙ্গল’ লিখেছিলেন মাত্র ২৮ ঘণ্টায়। ‘সধবার একাদশী’র জন্য ২৬ টা গানও লিখেছিলেন মাত্র এক রাতে। তিনি প্রায় ৮০টি পৌরাণিক,ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে নাটক রচনা ও পরিচালনা করেছেন।

তবে সামাজিক নাটক লেখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তৎকালীন সমাজের কঠিন রূপ নাটকের আঙ্গিকে তুলে ধরতেন তাঁর সুদক্ষ পরিচালনার মাধ্যমে। গিরিশচন্দ্রের হাত ধরে বাংলা থিয়েটারের স্বর্ণযুগ ফিরে এসেছিল। স্যার এডুইন আর্নল্ডের বিখ্যাত কাব্য Light of Asia গ্রন্থটিকে অবলম্বন করে গিরিশ ঘোষ রচনা করেছিলেন ‘বুদ্ধদেব চরিত’ নাটকটি । নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার সময় ঘটনাচক্রে বৌদ্ধ নেতা শ্রী অনাগরিক ধর্মপাল দর্শক আসনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন আর্নল্ড এর Light of Asia যেমন বিশ্বব্যাপী বুদ্ধের নাম এবং অমর কাহিনি পৌঁছে দিয়েছে, গিরিশ ঘোষের বুদ্ধদেব চরিত ও বাঙালির মধ্যে বুদ্ধের প্রতি নতুন ভাবে আগ্রহ সৃষ্টি করবে।
নাট্য জগতে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অন্যতম প্রিয় স্নেহভাজন শিষ্যা ছিলেন বিনোদিনী দাসী বা নটী বিনোদিনী। ১৮৮৩ সাল নাগাদ গিরিশ ঘোষ স্টার থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন। স্টার থিয়েটার তৈরির সময় গিরিশচন্দ্রকে প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন গুর্মুখ রায়। পরিবর্তে তিনি বিনোদিনী দাসীকে রক্ষিতা হিসেবে চেয়েছিলেন। বিনোদিনীর ইচ্ছা ছিল যে নতুন থিয়েটার তৈরি হবে তা বিনোদিনীর নামে বি-থিয়েটার হবে।কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষের তৈরি এই নতুন থিয়েটারের নামকরণ হয় স্টার থিয়েটার নামে। গুরুর প্রতি অভিমানে-ক্ষোভে এর দু’বছর পরেই ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিনোদিনী দাসী রঙ্গমঞ্চ ত্যাগ করেন।

ব্যাক্তিগত জীবনে গিরিশচন্দ্র ছিলেন ঘোরতর ঈশ্বর বিরোধী।পারিবারিক জীবনে নানা আঘাত ও অনেকগুলি মৃত্যুসংবাদই তাঁর ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারানোর কারণ। ২৩ বছর বয়সে গিরিশচন্দ্রের একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে,কিন্তু দুই মাসের মধ্যে তার মৃত্যু হয়।এ ঘটনার কিছুদিন পরে,১৮৬৮ সালে বোন কৃষ্ণকামিনী ও তার কিছু সময় পরে ভাই কানাইলালের অকালমৃত্যু ঘটে।এরপর পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও কন্যা সরোজিনী জন্মগ্রহণ করলে পরিবারে খানিক শান্তি ফিরে আসে।
গিরিশচন্দ্রের ৩০ বছর বয়সে ফের তাঁর পরিবারে মৃত্যুর ছায়া নেমে আসে। স্ত্রীর অসুস্থতা, সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের মৃত্যু,কনিষ্ঠ ভাই ক্ষীরোদচন্দ্রের মৃত্যু,বোন কৃষ্ণভাবিনীর অকালপ্রয়াণ ও অবশেষে স্ত্রীবিয়োগ মানসিকভাবে তাঁকে বিপর্যস্ত করে দেয়।
গিরিশচন্দ্রের জীবনে পরিবর্তন আসে তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের পর। অসুস্থ অচেতন অবস্থায় তিনি প্রথমবার জীবনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করেন। এরপর থেকেই একে একে তিনি পৌরাণিক নাটকে অভিনয় ও নির্দেশনার কাজ শুরু করেন। সীতার বনবাস, লক্ষণ বর্জন নাটক নির্দেশনার পর ১৮৮৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নাট্যসম্রাজ্ঞী নটী বিনোদিনীকে নিয়ে তিনি স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস স্বয়ং এই নাটক দেখতে এসেছিলেন। সেই প্রথম রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাত হয় গিরিশচন্দ্র ঘোষের।
এরপর গিরিশচন্দ্র ও বিনোদিনী উভয়ই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে গিরিশ ছিলেন কুখ্যাত মদ্যপ ও স্বেচ্ছাচারী, বেপরোয়া, সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধাচারী, বিশৃঙ্খল জীবনাচরণে অভ্যস্ত এক বিদ্রোহী প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের এক অনুগত শিষ্য হয়েছিলেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ হয়ে পড়েন। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে, কীভাবে রামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসার পর গিরিশের নৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠতম শিষ্যদের একজন হয়ে ওঠেন।
কাজী নজরুল ইসলাম গিরিশচন্দ্রের ‘ভক্ত ধ্রুব’ উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত করেন। ১৯৫৬ সালে মধু বসুর পরিচালনায় গিরিশচন্দ্রের জীবন অবলম্বনে নির্মিত ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। জন্ম মাসেই ১৯১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এ মহান অভিনেতা ,নাট্যকার,নির্দেশক কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
*ছবি সৌজন্য: wikipedia, facebook, banglarmukh
তথ্যঋণ: আন্তর্জাল