তাঁরা সবাই ভারতে থেকেও অন্য গ্রহের জীব। পারস্পরিক পিঠচাপড়ানির মাধ্যমে রোজগারের রাস্তা খোলা রাখেন সবসময়। খুব দরকার না হলে শাসকদের বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন না কখনও। ম্যাচের ধারাবিবরণী যাঁরা দেন, তাঁরাও কারও কড়া সমালোচনা করেন না। সম্প্রচার সংস্থার বারণ। সমালোচনা করলে বাজার খারাপ হয়ে যাবে খেলাটার। তাই ভুলেও সমালোচনা নয়। সব দারুণ, ফ্যান্টাস্টিক বলে চালিয়ে যান। ধারাভাষ্যকারের সমর্থক হয়ে ওঠা সেই চিত্ৎকৃত উল্লাসের পাশে ব্যাকগ্রাউন্ডে জনতার জয়ধ্বনির পুরোনো রেকর্ড না হয় বাজিয়ে দেওয়া যাবে।

হু হু বাবা, এঁরা হলেন ক্রিকেটার। ক্রিকেট খেলেন। ক্রিকেট মানে হল ভারতীয়দের আর একটা ধর্ম। 

তাই রাজধানীর রাস্তায় অলিম্পিকে পদকজয়ী সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া, এশিয়ান গেমস চ্যাম্পিয়ন বিনেশ ফোগাটকে পুলিশ চূড়ান্ত হেনস্থা করলেও একেবারে চুপটি করে বসে থাকেন। ফেলুদার গল্পের লালমোহনবাবুর ভঙ্গিতে নিজেই নিজের মুখে আঙুল দিয়ে বলেন, কোনও কথা নয়। 

Indian wrestlers protesting against sexual harassment
পুলিশের হাতে চূড়ান্ত হেনস্থা হতে হল কুস্তিগীরদের।

ঘটনা অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পরে ১৯৮৩ সালের বিশ্বজয়ী ক্রিকেটাররা সবাই মিলে একটা বিবৃতি দিলেন দেখলাম। ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের বিবৃতি একটা। তার মধ্যে আর এক বিশ্রী কেলেঙ্কারি। সেই বিশ্বজয়ী টিমের অন্যতম তারা রজার বিনি বলে দিলেন, এই মন্তব্যে তাঁর কোনও সায় নেই। মানে তাঁকে না জানিয়েই এই বিবৃতিতে তাঁর সই করানো হয়েছে। বিনি এখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট। অমিত শাহের বাধ্য। অমিত-পুত্র জয় তাঁর সচিব। তিনি পশ্চাদপসরণ করলেন, বোঝাই যাচ্ছে। বোঝা গেল না, বিনির উল্টো বিবৃতি নিয়ে কপিল-গাভাসকরের মতো লোক টুঁ শব্দটিও করলেন না। এটা তো তাঁদেরও অপমান ছিল। এবং এই বিবৃতি এত নিরামিষ যে না দিলেও চলত।

পৃথিবীর সব কিছু নিয়ে কথা বলব। আবহাওয়া, তুরস্ক, ইউক্রেন…। কিন্তু কুস্তিগিরদের ওপর কুৎসিত আক্রমণ নিয়ে একটা কথাও বলব না। বললেই যদি মোদি ও ক্ষমতাসীন নেতারা চটে যান। সুনীল গাভাসকর কত রকম কথা বলে মনে করিয়ে দেন ফুটবলের পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কী তীক্ষ্ণ রসবোধ। তিনিও এ নিয়ে আলাদা করে কিছু বলতে যাবেন না, শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়-ধোনি-বিরাটরাও বলতে যাবেন না। না, না, না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না। তুমিও যাবে না, আমিও যাব না। তুমিও বলবে না, আমিও বলব না। এই আইপিএল, এই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে বেশ ভালো আছি। এখন ধর্ম হল, কুস্তি নিয়ে একেবারে চুপ করে থাকা।

আমাদের দেশের খেলার জগতে আসল প্রতিবাদী কে, সরকারি পুরস্কারের তোয়াক্কা করেন না কারা, তা বোঝার জন্য এই সময়টা সেরা সময়। 

কুস্তিগিররা লড়ছেন তাঁদের মেয়েদের সম্মান বাঁচাতে। এর মধ্যেও রজ্জুতে সর্পভ্রম করে অনেকে ভাবছেন, ধর্ষক বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে কথা বলা মানে মোদি বা বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলা। পদকজয়ী কুস্তিগির যোগেশ্বর দত্তকে দেখুন। তিনিও অলিম্পিক পদক জিতেছেন বজরং, সাক্ষীর মতো। তবে বিজেপিতে তো, তাই বলছেন, বিরোধী নেতাদের চক্রান্তেই কুস্তিগিররা এমন ‘বাজে কাজ’ করছেন। চেনা চেনা কথা লাগছে? আসলে ঠিক এই কথাটা ব্রিজভূষণই বলেছিলেন।

রাজধানীর পথে এক সাধারণ কিশোরীকে বারবার কোপ দিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে, পরে পাথর দিয়ে থেঁতলে মারা হয়েছে। নামী মেয়ে কুস্তিগিরদের ওপর আক্রমণ কি ওই পর্যায়েই নয়? খেলার লোকদের দেখে অবশ্য তা বুঝবেন না।

সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই সাক্ষীদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন ভারতের খেলায় সর্বকালের সেরা হওয়ার সেরা দুই দাবিদার, দুই অলিম্পিক সোনাজয়ী নীরজ চোপড়া এবং অভিনব বিন্দ্রা। সোচ্চার ফুটবল অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীও। কিন্তু ভাইচুং ভুটিয়া বাস্তবে রাজনীতি করলেও কিছু বলেননি কুস্তিগিররা মার খাওয়ার পর। ওগো পিভি সিন্ধু, ওগো সাইনা নেহওয়াল—আপনারাও ক্রিকেটারদের মতো একেবারে নীরবতার বর্মে নিজেদের ঢেকে রেখেছেন কী কারণে? কীসের লোভে? আপনার শহরের আর এক ‘এস’ সানিয়া মির্জা তো আগেই মুখ খুলেছিলেন সাক্ষীদের সমর্থন করে। রানি রামপালও প্রতিবাদ করেছিলেন আগে। অবশ্য সানিয়া এবার রাজপথে দিল্লি পুলিশের কেচ্ছার পর কিছু বলেননি। তিনি শেষ বলেছিলেন ২৮ এপ্রিল। সিন্ধু, সাইনারা নিজেদের এখন অক্ষয়কুমারের পর্যায়ে নিয়েই চলে গিয়েছেন শাসক বন্দনার ব্যাপারে। তাঁরা নিজেদের ক্রিকেটারদের পর্যায়েই ভাবেন। আমরা একটু উঁচুতে, অন্য খেলোয়াড়দের মতো নই।

wrestlers protest at jantar Mantar
বিনেশ ফোগাট, বজরং পুনিয়া ও সাক্ষী মালিক।

ওঁদের ভুলে না হয় পিটি উষাকে ধরা যাক। পুরোনো আমলের কিংবদন্তি। আবেগে, ভাবনায় অন্যরকম প্রত্যাশিত। তিনি এখন বিজেপি নেতাদের হাত ধরে ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থার প্রধান হয়েছেন। তিনি তো আরও লজ্জাহীনা, প্রকাশ্যেই কুস্তিগিরদের তোপ দেগেছেন। বলেছেন, কুস্তিগিররা দেশের মুখ ডোবাচ্ছে। নাও ঠ্যালা, কে যে দেশের মুখ ডোবাচ্ছে, কে জানে! উষার সঙ্গে আইওএতে আছেন বঙ্গসন্তান কল্যাণ চৌবে। এআইএফএফ প্রেসিডেন্ট এখন। তিনি বিজেপিরই নেতা। বিজেপিরই হাত ধরে ক্ষমতায়। তাই চুপ চুপ লক্ষীটি।

 

বিজেপি-তৃণমূলের একবার এর হাত, একবার ওর হাত ধরা সৌরভ গঙ্গো যেমন মাঝে নয়াদিল্লিতে একটা কী বিবৃতি দিলেন কুস্তিগিরদের নিয়ে, কিছুই বোঝা গেল না। শুধু ‘আশা করি, সমস্যা মিটবে কুস্তিতে’ বলে ছেড়ে দিলেন। অথচ এমনিতে কী চমৎকার কথা বলেন তিনি। আগেও, যখন সাক্ষীরা যন্তর মন্তরে, তখন ক্রিকেটারদের মধ্যে মুখ খুলেছিলেন শুধু কপিল দেব, হরভজন সিং, ইরফান পাঠান। পরে অনিল কুম্বলে। তাঁরাই দেখা যাচ্ছে বাপের ব্যাটা। আর কেউ না। আর কেউ না।

এই যে রাত তিনটে পর্যন্ত আইপিএলে কোটি কোটি টাকার অক্রিকেটীয় উৎসব হল, তাতে তো জনতাই সামিল হলেন উদ্বাহু হয়ে। টিভি দেখতে দেখতেও কোটি মানুষের কারও মনে হয়েছে, এই সাক্ষী-বিনেশরা তো কদিন আগে দেশের ‘রাষ্ট্রদূত’ হয়ে গিয়েছিলেন অলিম্পিক পদক জিতে। তবু এভাবে রাস্তায় তাঁরা পুলিশের হাতে মার খেলেন কেন? এখন না হয় বিরোধীরা তাঁদের পাশে। কিন্তু এঁরা যে প্রথম লড়াই চালাচ্ছিলেন নিজেরা। তখন তাঁদের সঙ্গে কেউ ছিলেন না। খেলার কাউকে গিয়েও তাঁদের পাশে বসতে দেখা যায়নি।

শুকপাখি এসে যদি আজ রাতে ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর সঙ্গে গল্প জোড়ে কুস্তিগিরদের লাঞ্ছনা নিয়ে, তা হলে কী বলবে? বলবে, ধর্ম নিয়ে খেয়োখেয়িতে বারোটা বাজতে চলা দেশটায় নতুন ধর্ম একটাই। চোখ বুঁজে নিঃসাড়ে সব কিছু দেখে যাওয়া। ক্রিকেটাররা যা করছেন। ক্রিকেটই তো অনেকদিন ধরে দেশের নতুন ধর্ম। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বারবার হেরে সিংহরা আসলে বেড়ালছানা, বলছেন। তাতে কী হল?

লেখকের ফেসবুক পোস্ট #লেখালেখাখেলা থেকে সংগৃহীত।

 

ছবি সৌজন্য: Wikipedia

Rupayan

লেখক উত্তরবঙ্গের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক উত্তরবঙ্গ সংবাদের কার্যকরী সম্পাদক। এর আগে এই সময় সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। ছিলেন ক্রীড়া সম্পাদকও। অতীতে যুক্ত ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার সঙ্গে। আনন্দবাজার পত্রিকায় বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন দীর্ঘদিন। বাঙালির সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফুটবলের যোগসূত্র ঘটানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা তাঁর। পাঁচটি ফুটবল বিশ্বকাপ, তিনটি অলিম্পিক, একটি ইউরো কাপ ফুটবল, দুটি হকি বিশ্বকাপ, একটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ-সহ অসংখ্য ঘরোয়া টুর্নামেন্ট কভার করলেও প্রথমদিন থেকে লিখে থাকেন নানা বিষয়ে। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সংস্কৃতি, গানবাজনা, সিনেমা, খাবার, ভ্রমণ। এখন বলতে গেলে লেখার দুনিয়ায় খেলা বাদে সর্বত্র বিচরণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *