১৯১১ সালের একটি ঘটনা। ভারতীয় শিল্পের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য সুদূর ইংল্যান্ড থেকে এক খ্যাতনামা ইংরেজ শিল্পী ভারতবর্ষে এসেছিলেন। অজন্তা, মাউন্ট আবু, রাজস্থানের বিভিন্ন অঞ্চল, বারাণসী হয়ে তিনি জানুয়ারির শেষে কলকাতায় আসেন অবনীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে। সেবার জোড়াসাঁকোয় অবনীন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথের শিল্পসংগ্রহ তাঁকে মুগ্ধ করে। এই মুগ্ধতার মধ্যেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় যাঁর, সেই আলাপের কথা তিনি লিখেছিলেন তাঁর বই ‘মেন অ্যান্ড মেমোরিজ’-এ…

‘জোড়াসাঁকোয় গেলে প্রত্যেকবারই দেখতে পেতাম তাঁদের পিতৃব্যকে। আশ্চর্য সুদর্শন পুরুষ, ধুতি ও চাদরে শোভমান। আমাদের কথাবার্তার মাঝখানে নীরবে বসে থাকতেন। আমি তাঁর ছবি আঁকতে চাইলাম; কারণ তাঁর অবাক করা শারীরিক সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁর অন্তর্লোকের একটু একটু আভাস পাচ্ছিলাম, সেটি পেন্সিল দিয়ে কাগজের উপরে ফোটাবার জন্য অধীর হয়ে উঠছিলাম আমি।’

প্রথম দেখায় এই ছিল রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্যার উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের অনুভূতি। এরপর তিনি রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মর্ডান রিভিউ’-তে দেবেন্দ্রনাথ মিত্র অনুদিত একটি ছোটগল্পের অনুবাদ পড়েছিলেন, যা কিনা রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরিত ছিল। সেই পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল এমন, ‘পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম; জোড়াসাঁকোয় লিখে জানতে চাইলাম এরকম গল্প আর আছে নাকি?’

গল্পটি হল ‘পোস্টমাস্টার’। এরপর ভগিনী নিবেদিতাকৃত ‘কাবুলিওয়ালা’র ইংরেজি অনুবাদটিও ‘মর্ডান রিভিউ’তে পড়ার সৌভাগ্য হয় তাঁর। আর এখান থেকেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই মহারথীর আলাপপর্ব বেড়ে ওঠে। সে বছরই বিলেতে ফেরার আগে, ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে কলকাতা থেকে রোদেনস্টাইন কবিকে একটি চিঠিতে লিখলেন:

‘আপনি জানেন না আপনার সঙ্গে কয়েকটা ঘণ্টা কাটাতে কী তীব্র ভাবে চেয়েছিলাম- কাটাতে না পেরে এক গভীর দুঃখবোধ নিয়ে ফিরে যাচ্ছি আমি। আপনাকে আমি সর্বদা সম্মান করব; আশা করব, মাঝে মধ্যে চিঠি লিখলে আপনি বিরক্ত হবেন না, এবং অনুগ্রহ করে আমাকে স্মরণে রাখবেন। আপনার যেকোনো কবিতা অথবা গল্পের অনুবাদ, যখনই বের হবে, তা পেতে আমিও উৎসুক হয়ে থাকব। প্রায়ই আপনার কথা ভাবব আমি- মনে রাখব, আপনাদের গৃহে আমি স্বাগত ছিলাম, সেই আমার বিরল সৌভাগ্যের কথা।’

Rothenstein and Tagore
উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের সঙ্গে কবি

ইতিহাস বলছে ১৯১০-১১ সাল নাগাদ রোদেনস্টাইন রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি স্কেচ করেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ সালের জুন মাসে লন্ডনে যান এবং রোদেনস্টাইনের সঙ্গে ১৬ জুন দেখা করেন। সেখানে কবি নিজেই তাঁর রচিত ও অনুদিত ‘গীতাঞ্জলি’ রোদেনস্টাইনকে পড়তে অনুরোধ করেন। রোদেনস্টাইন সেগুলি পাঠ করে পাঠিয়ে দেন ব্রিটেনের বিশিষ্ট কবি ইয়েটস এবং অন্যান্য অধ্যাপকদের কাছে। খুব স্বাভাবিক কারণেই ইয়েটসের কবিতাগুলো অত্যন্ত পছন্দ হয় এবং নিজে এর ভূমিকা লিখে কবিতাগুলি নিয়ে একটি বই ছাপাতে উদ্যোগী হন। জুলাই মাসের ৭ তারিখে রোদেনস্টাইনের বাড়িতেই বিশিষ্ট শ্রোতাদের সামনে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ থেকে কয়েকটি কবিতা ইয়েটস পাঠ করেন। ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লন্ডনে রোদেনস্টাইনের বাড়িতে প্রথম দিনের সন্ধ্যাটি সম্পর্কে রোদেনস্টাইন আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন,

‘পুত্র ও দুই বন্ধুসহ তিনি এসে পৌঁছলেন। ঘরে এসে আমাকে একটি খাতা দিলেন।… সেদিন সন্ধ্যায় আমি কবিতাগুলো পড়লাম। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কবিতা — পড়তে পড়তে মনে হল মহত্তম মরমিয়া কবিদের সঙ্গে তুলনীয়।’

এই ঘটনার পর রবীন্দ্রনাথের অনুভূতিটাও দেখে নেওয়া যেতে পারে। ১৯৩২ সালের ২৬ নভেম্বর কবি সেইদিন এবং সেই সময়কালের স্মৃতি রোমন্থন করে রোদেনস্টাইনকে চিঠিতে লেখেন,

‘পরের দিন আপনি এলেন, প্রায় ছুটতে ছুটতে; যা বললেন তা আমার বিশ্বাস করতে সাহস হল না, কিন্তু আপনার সাহিত্য বিচারের ক্ষমতার প্রমাণ দেবার জন্য আপনি তর্জমাগুলির তিনটি নকল তৈরি করে পাঠিয়ে দিলেন স্টপফোর্ড ব্রুক, ব্র্যাডলি ও ইয়েটসের কাছে। ব্র্যাডলি আপনাকে উত্তরে যা লিখলেন তাতে আমার পক্ষে আর বিশ্বাস না করে উপায় রইল না যে কবিতাগুলো ভালোই দাঁড়িয়েছে। স্টপফোর্ড ব্রুকও তাঁর বক্তব্য সমর্থন করলেন। যতদূর আমার মনে পড়ে তিনিও উৎসাহ দিয়ে লিখেছিলেন।’

রোদেনস্টাইনের জন্যই তৎকালীন ইংল্যান্ডের বিদ্বৎসমাজে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বাড়িতেই কবির সঙ্গে আলাপ হয় সিএফ অ্যান্ড্রুজের। সেটা সেই ১৯১২ সালের ৬ জুলাই তারিখে। ১৯১২ সালের ১ নভেম্বর ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’র ইন্ডিয়া সোসাইটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইটির মুখচিত্রতে রোদেনস্টাইনের আঁকা রবীন্দ্রনাথের একটি স্কেচ ব্যবহৃত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন আমেরিকায় এবং রোদেনস্টাইন চিঠিতে জানান, ‘বইটা বেরিয়েছে, সাদা আর সোনালীতে খুব পবিত্র, অপাপবিদ্ধ দেখতে হয়েছে।’

Tagore sketch by Rothenstein
রোদেনস্টাইনের করা রবীন্দ্রনাথের স্কেচ

পরদিন টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্টে এই বইয়ের আলোচনা হলে সেকথা উল্লেখ করে আবার লিখলেন,

‘চিরকালের জন্য পাশ্চাত্য জগতের মনোভাব লাভ করল আপনার সাহিত্য। আপনার এই অসামান্য (বিলেত) ভ্রমণ বাংলার ইতিহাসের জন্য যা করল তা বাংলা হৃদয়ঙ্গম করতে পারছে কি?’

এই চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

‘আমার জীবনকে আপনি আপনার বন্ধুতা দিয়ে প্রসারিত করলেন।… বিদেশে ভ্রমণ করতে এসে আমি যে জীবনের এইরকম এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হব, যা সাময়িক নয়, পল্লবগ্রাহী নয়, তা আমাকে বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতায় অভিভূত করেছে।টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট-এ আমার বইটির উত্তম সমালোচনা বেরিয়েছে জেনে খুবই ভালো লাগছে আমার।… আপনার আশ্বাস ছাড়া আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না যে আমার অনুবাদগুলির কোনো দাম আছে, এবং শেষ মুহূর্ত অব্দি আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম, যদি আপনার অনুমানে কোনো ভুল হয়ে থাকে, আপনি যে এত পরিশ্রম করেছেন তা যদি বৃথা হয়ে যায়। আপনার নির্বাচন যে সকলের সমর্থন পেয়েছে, আপনারা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বিচারকগণ যে আপনার সঙ্গে একমত হয়েছেন, আপনি আপনার বন্ধুর কৃতিত্বে গর্বিত হতে পারছেন, তাতে আমি অত্যন্ত খুশি।’

এভাবেই ধীরে ধীরে রোদেনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। এমনকী ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েও তাঁদের চিঠির আদানপ্রদান ঘটেছে। দীর্ঘ ছ’মাস পর রবীন্দ্রনাথ আবার লন্ডনে ফিরে আসেন ১৯১৩ সালের ১৯ এপ্রিল। দেশে ফিরে আসেন সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ। এরপরই ঘটে সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। রোদেনস্টাইন ১৩ নভেম্বর ১৯১৩-তে কবিকে উচ্ছ্বসিত হয়ে চিঠিতে জানান, আমার অতি প্রিয়তম বন্ধু- টাইমস খুললাম, তার ভিতর থেকে উঠে এল এক অনির্বচনীয় ঘোষণা- রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।’ তারপর নিজের আনন্দ আর ধরে রাখতে পারলেন না এই ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী। লিখলেন,

‘আপনাকে প্রদত্ত এই অসাধারণ শ্রদ্ধার্ঘ্য যে আমাকে কী আনন্দ দিল তা আমি আপনাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কোনো মানুষের জীবৎকালে তাঁর কাছে পৌঁছনো সবচেয়ে বড়ো সম্মানের নিদর্শন এই পুরস্কার। আপনার বিদ্যালয় নিয়ে আর্থিক দুশ্চিন্তাও মিটে গেল সেই সঙ্গে, তাই না? আজকের দিনটি আমরা সবাই ছুটি নিলাম- ইউরোপ আপনাকে যে সম্মানে রাজবেশ পরালো তার জন্য আনন্দ করতে।… প্রিয় বন্ধু, আপনাকে আমার হৃদয় থেকে উৎসারিত সম্পূর্ণ অভিনন্দন পাঠিয়ে দিলাম।’

Sketch by Rothenstein
রদেনস্টাইনের করা স্কেচ

কবিও এর প্রত্যুত্তরে ১৮ তারিখ চিঠিতে লিখলেন, ‘আমাকে যে নোবেল পুরস্কারের মতো একটি বিশাল সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে, এই সংবাদ পাওয়ামাত্রই আমার আপনার কথা মনে পড়ল- ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাসহ। আমি নিশ্চিত যে আমার বন্ধুদের মধ্যে আপনিই এই সংবাদে সকলের চেয়ে বেশি আনন্দিত হবেন।’

এই ছিল প্রাচ্যের কবি ও পাশ্চাত্যের চিত্রশিল্পীর বন্ধুত্বের সূচনাপর্ব। আর এই সূচনাপর্বের মাধ্যমেই প্রাচ্যের কবিকে পাশ্চাত্যের বিদগ্ধ সুশীল সমাজ চিনেছিলেন, যার মূল সেতুর নামটি উইলিয়াম রোদেনস্টাইন। তাঁর আগে কবিকে এইভাবে পাশ্চাত্যভূমিতে পরিচয় করানোর আন্তরিক দায়িত্ব আর কেউ নেননি।

*ছবিঋণ: লেখক
*গ্রন্থঋণ – 
১) দ্য মিরিয়াড মাইন্ডেড ম্যান
২) সিক্স পোট্রেটস অফ টেগোর
৩) ভক্ত ও কবি
৪) ইমপার্ফেক্ট এনকাউন্টার
৫) সিলেক্টেড লেটার্স
৬) রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা

Pitam Sengupta

প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *