তেমন এক নিশিযাপন কপালে আছে ভেবে খোশমেজাজে হাঁটতে শুরু করেছি আবার। সন্ধ্যে নামার আগে বেশ কয়েকটা কাজ আছে। প্রথমত “গোরেমে ওপেন এয়ার মিউজিয়াম”-এর দিকটায় একবার গিয়ে ঘুরে আসব। আজ তো সন্ধে নামতে বেশি দেরি নেই, ভিতরে যেতে পারলেও কিছুই দেখা যাবে না। ও-চত্বরটাতেই আসলে ফ্রেস্কোয় মোড়া গুহা-গির্জাগুলো আছে। সময় নিয়ে প্রত্যেকটা দেখা প্রয়োজন। এরপর কাল আশপাশের দু’ একটা জায়গা দেখতে যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করাও দরকার। জায়গাগুলো ক্রমশ প্রকাশ্য। আর সব শেষে আর একটা যে প্রধান কারণে ক্যাপাডোকিয়ায় আসা- “বেলুন রাইড”। গোটা বিশ্বে যে কয়েকটি জায়গায় এই “হট এয়ার বেলুন রাইড” ভীষণ জনপ্রিয়, তাদের মধ্যে ক্যাপাডোকিয়া দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে রয়েছে। কাজেই মিউজ়িয়ামের জায়গাটা খুঁজে ফেলেই শহরে ফিরে বেলুন ভাড়ার কাজটা মেটাতে হবে। রোজ সকালে সূর্যোদয়ের সময় রাশি রাশি বেলুন পর্যটকদের নিয়ে উড়ে চলে এই ফেয়ারি চিমনি রাজত্বের উপর দিয়ে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য।
মিউজ়িয়াম শহর থেকে খানিকটা বাইরে। তবে খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। একটা বাস নিয়ে চটপট বাজার অঞ্চলে ফিরে এলাম। সারি দিয়ে একের পর এক বেলুন রাইড বুকিং করবার দোকান। একটায় ঢুকে পড়া গেল। এবং সেই থেকেই আমাদের সান্ধ্য বিপর্যয়ের সূত্রপাত। জানা গেল, চিনা নববর্ষের জন্য অত্যধিক পর্যটক এসে পড়ায় বেলুন রাইড ফাঁকা নেই। হুড়মুড় করে বাজার অঞ্চলের প্রায় প্রতিটা দোকানে খোঁজ নিয়েও লাভ হল না। অবশেষে এক হৃদয়বান “আদনান আবি” আমাদের তাঁর ফোন নম্বর দিলেন, এবং বললেন যদি বুকিং বাতিল হয় উনি নিজে ফোন করে জানাবেন।
কী আর করা। ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে একটা গাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে কোনওক্রমে দুটো “দুড়ুম” গলাধঃকরণ করে হোটেলেই ফিরে এলাম দু’জনে।
এদিকে রাত দশটা পার হল। তখনও আদনান আবির সাড়াশব্দ নেই দেখে নিজেই ফোনটা করলাম। দু’বার রিং হওয়ার পর ওদিকের স্বর আরও একটা খারাপ খবর দিল। পরদিন আবহাওয়া খারাপ। তাই সমস্ত বেলুন রাইড বাতিল। পাঠক আপনি আমায় যাই ভাবুন; এ অন্তত একটা গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি, মানে কেবল আমার নয়, কাল সকলের কপালই ফুটো।
সকাল হওয়া পর্যন্ত বিশেষ ঘুম হবে না। বরং ঘরের পাশের ছাদটায় গিয়ে দাঁড়াই। চারিদিকে একটাও আলো নেই। কেবলই আদি প্রস্তর। এই নির্নিমেষ প্রাগৈতিহাসিক নৈসর্গিক যাপনের মাঝে ওই একটাই আক্ষেপ কাঁটার মত আটকে থাকবে।
০২/১১/২০২০, গোরেমে এয়ারপোর্ট
আমাদের ইস্তানবুলের ফ্লাইট প্রায় ঘণ্টা তিনেক দেরি করেছে। ম্যাডাম স্যুটকেসের উপর ঠ্যাং তুলে দিব্যি নাক ডাকছেন। আমার কাজ নেই, তাই এখুনি বাকি কথাগুলো লিখে ফেলা ভাল।
***
গতরাতে আমার বিশেষ ঘুম হয়নি।
ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়ে, মুখহাত ধুয়ে এক কাপ চা ও প্রাতরাশ সারতে আমাদের সাড়ে নটা বেজেছে। গাড়ি আসার আগে আর একটু ওদিকটার ছবি তুলে নেওয়া গেছে। মন মেজাজ একটু খারাপ ঠিকই তবে ক্যাপাডোকিয়ার বাকি দিকগুলো দেখতে পাওয়ার একটা চাপা আনন্দও কাজ করছে।

দশটা না বাজতেই আমাদের গাড়ি উপস্থিত। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমরা রওনা হলাম। প্রথম গন্তব্য ওপেন এয়ার মিউজিয়াম। টিকিট কেটে ঢুকে বেশ অনেকটা অবধি খাড়া উঠে যেতে হয়। এক একটা পদক্ষেপেই এক একটা বিস্ময়ের মত ফ্রেস্কোয় মোড়া গির্জা, পাদ্রীদের থাকার ঘর, বসার ঘর ইত্যাদি পাথর খোদাই করে তৈরি করা আছে। সে পাথর যত নরমই হোক না কেন, বেঁচে থাকার তাগিদ এবং নিজের বিশ্বাসের উপর পরম আস্থা মানুষকে দিয়ে অনেক কিছুই করিয়ে নিতে পারে। সে বিশ্বাস ধর্মেও থাকতে পারে অথবা নিজের কর্মক্ষমতার উপরে। অবিশ্বাস্য কারুশিল্প। মিনিট ত্রিশেক নানান গুহায় ঘুরে আমরা বেরিয়ে এলাম। এর পর আমাদের দুটো বিশেষ জায়গা দেখতে যাওয়ার কথা।
প্রথমটা “কায়মাকলি” নামক একটি ৩০০০ বছরের পুরনো ভূগর্ভস্থ শহর। এ শহরের জন্ম ফিগিয়ানদের হাতে। তারপর সেকেন্দার শাহের গ্রিক সৈন্য ফিগিয়ানদের পরাজিত করলে এ শহর গ্রিক ক্যাপাডোকিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। এমনভাবেই ক্রমশ ফার্সি, সেলচুক তুর্কি এবং অন্যান্যদের হাত ধরে এই পাতালপুরির বিবর্তন। যেটা সবথেকে মজার ব্যাপার সেটা হল, প্রত্যেক যুগেই আক্রমনকারীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সে যুগের সাধারণ মানুষ এই কায়মাকলির মত আরও ৩৫টি ভূগর্ভস্থ শহরকেই নিজেদের ঠিকানা করেছেন। ফলত প্রতি যুগেই শহরটি আরও আরও বর্ধিষ্ণু হয়েছে।

কিন্তু যে শহর পাতালে অবস্থিত, তার বিস্তারের সম্ভাবনা ও জায়গা, দুইয়েরই অভাব। তাই সে ক্রমশ আরো নিম্নবর্তী হয়েছে। তার প্রসারণ হয়েছে আরও গভীর পাতালে। গোটা শহরটির মাত্র তিনটি তলা পর্যটকদের জন্য খোলা। বাকি তলগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থায় থাকায় জনমানবহীন হয়েই থাকে। যেটা আরও বিস্ময়কর, তা হল একটা তল থেকে অন্য তলায় যাওয়ার পথ ও মাথার উপরকার ছাদ অত্যন্ত সরু এবং নিচু। ইতিহাসে কোথাও লেখা নেই যে এ অঞ্চলের মানুষ খর্বকায় ছিলেন। তবে এমন সরু সরু রাস্তা দিয়ে ওঁরা কীভাবে চলা ফেরা করতেন সেই কৌতূহল আমার রয়েই গেছে। একটা জায়গায় বেশ খানিকটা মেঝে ভেঙে যাওয়ায় পুরো তিনটে তলাই পরিষ্কার দেখা যায়। তাছাড়া নানা ব্যবহৃত যন্ত্র, রান্নার জিনিস ইত্যাদি তো রয়েছেই। দোতলায় রয়েছে একটি গির্জা এবং সবথেকে উপরের তলা জুড়ে একটা আস্তাবল। অবশ্যই বোঝা যায় ঘোড়া-সমেত শহরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একেবারে তলা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যে মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তা সব যুগের মানুষই বুঝতেন। এছাড়া একেবারে ওপরতলা থেকে নীচতলা পর্যন্ত পাইপের মতো দুটি লম্বা গর্ত চলে গেছে প্রধান দেওয়ালের গা বেয়ে, তার একটি জলের এবং অন্যটি খাবারদাবার আদানপ্রদানের জন্য।

কেবলমাত্র নিরবচ্ছিন্নভাবে টিঁকে থাকার জন্য যুগ-যুগ ধরে মানুষের কী প্রাণপণ লড়াই! এই অস্তিত্বের সংগ্রামটুকুই আমাদের উত্তরাধিকার।
প্রায় মিনিট চল্লিশ সময় কাটিয়ে আমরা উঠে এলাম। অল্প কিছু খাবার এবং পানীয় জলের ব্যবস্থা করে গাড়ি ছাড়ল আরও মিনিট দশেক পর। পরের লক্ষ্য, খোলা আকাশে নীচে “পিজিয়ন ভ্যালি” । সেটাই সম্ভবত এবারের মতো ক্যাপাডোকিয়ায় আমাদের শেষ গন্তব্য, কারণ রাতের ফ্লাইট ধরতে হবে।
এই অঞ্চলে নবম শতাব্দী থেকে পাথুরে-খাদের গায়ে বহুল পরিমাণে পায়রার বাসযোগ্য খোপ বা বাসা খোদাই করা হয়। সেখান থেকেই উপত্যকার এই নাম। সেই সময়ে এই পায়রার দল বার্তাবাহক হিসাবে কাজ করত এবং তাদের ডিম খারাপ হতে থাকা ফ্রেস্কোর গর্ত-ভরাট করবার উপাদান হিসাবে এবং এদের বিষ্ঠা প্রধানত সার হিসাবে, এমনকি বিস্ফোরক তৈরিতেও ব্যবহৃত হত। বিষ্ঠা থেকে তৈরি সার এ অঞ্চলের আঙুর-আঙিনা এবং খামারের জন্য অত্যন্ত উৎপাদনশীল। সেটাই ক্যাপাডোকিয়া অঞ্চলের সুস্বাদু আঙুর এবং ওয়াইন ঐতিহ্যের উৎস। আজ, এই উপত্যকায় এই পায়রাদের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। যদিও অনেক স্থানীয় সংবেদী মানুষ এদের পোষ্য হিসাবে রেখে তাদের নিজস্ব কলম্বারিয়ামও করেছেন। বর্তমানে আমাদের মতো ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য পিজিয়ন ভ্যালি একটি আদর্শ “ওয়াকিং ট্রেইল”। সম্পূর্ণ ট্রেইলটি প্রায় চার কিলোমিটার লম্বা। গোরেমে থেকে শুরু করে উচ্ছিসার অবধি। আমাদের হাতে যা সময়, আমরা মেরে-কেটে ৫০০ মিটার দেখতে পাব। তাই বা খারাপ কী? ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে পায়রাদের দেখাও মিলতে পারে।

পিজিয়ন ট্রেইলের প্রধান বিশেষত্ব হল, পুরো রাস্তা জুড়েই ক্যাপাডোকিয়ার বিস্তীর্ণ ল্যান্ডস্কেপের একাধিক প্যানোরামা পাওয়া যায়। অর্থাৎ, পদে পদে প্রকৃতি বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা নিমিত্তমাত্র। এই বিশ্বসংসার মানবশূন্য করে চোখের পলকেই নিজের আওতায় ফিরিয়ে নিতে পারে, সে এতটাই শক্তিশালী। এমন মহিমার পূজা করতে ধর্মের প্রয়োজন পড়ে না। মানব-অস্তিত্বের অপ্রাসঙ্গিকতার উপলব্ধিই সে পূজার উপকরণ। তাতেই প্রকৃতি খুশি।
এক-একটি ছবি নিতে নিতে আমরা হেঁটে চলেছি। এক জায়গায় এসে খানিকটা জিরিয়ে নেব বলে দাঁড়িয়েছি। একটু জল খেয়ে নেব আর কী। চোখে পড়ল একটি শুকনো গাছের ডালপালায় কয়েকশো নীল চোখ বাসা বেঁধেছে। এমন একটা কিছুর কথা শুনে এসেছিলাম বটে। এই ট্রেইলে কোথায় অবস্থিত জানা ছিল না। আশাও করিনি দেখতে পাব। এই নীল চোখ আমি চিনি। এটি “মেডুসা আই” বা “এভিল আই”। হ্যাঁ, শাপগ্রস্ত গ্রিক দেবী মেডুসার চোখ, যে দৃষ্টি সকলকে পাথর করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত, এমনই বিশ্বাস । তুরস্ক জুড়ে এ চোখের ছড়াছড়ি, তুর্কি সৌভাগ্যের প্রতীক ও কুশক্তির বিরুদ্ধে তাদের রক্ষাকবচ।

বলা হয়ে থাকে, যে কোনও কারণে যদি এই কবচ ভেঙে যায়, তার অর্থ সেটি আপনাকে একটি অজানা কুশক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এই জিনিসটা তুর্কি সংস্কৃতির অনেকগুলি উপাদানকে একসঙ্গে ধারণ করে আছে — বিশ্বাস, অনুশীলন, মৌখিক ইতিহাস। আর এই গাছটির নাম “এভিল আই ট্রি”। ক্যাপাডোকিয়ার সংরক্ষিত গোপন রক্ষাকবচ! এছাড়াও আশপাশ জুড়ে যে বিস্তির্ণ ভূচিত্র, তার মাঝে ছড়িয়ে আছে কাতারে কাতারে খোদাই করা ফেয়ারি চিমনি। এমনকী চোখের সামনে আমরা একটির আভ্যন্তরীণ নকশাও দেখতে পাচ্ছি। হয় এখনও কেউ বসবাস করেন বা কার্পেট তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া যে প্যানোরামাটি চোখে পড়ছে, তার বিবরণে আমি অপারগ। তবে সে চেষ্টায় অথবা নিশ্চেষ্টায় বারবার ফিরে আসার স্বপ্ন দেখতে বাধা নেই!
***
নিজের মনেই দুজনে কতক্ষণ চোখ মেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছি খেয়াল করিনি। টেলিফোনের আওয়াজে ইহজগতে ফিরে এলাম। আমাদের গাড়ির চালক মহাশয় ফোন করছেন।
“আবি গেলদেমা?” অর্থাৎ “দাদা ফিরছেন?”
ঠিকই তো, ফ্লাইটের সময় হয়ে এসেছে। ওঁর গাড়িকেও যথাস্থানে ছাড়তে হবে। পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে আমাদের গুহায় ফিরে তবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা। পরে বুঝেছি ওই ফোন না এলে আমাদের আজ ফেরা হত না। ভয়াবহ যানজটে ফেঁসেছিলাম।

আধুনিকতা কখনও সখনও আমাদের পায়ে বেড়িও পরায়। তবে সে আধুনিকতাই যে আত্মিক-মুক্তি আমাদের এনে দিয়েছে তাকে শতবার সেলাম ঠুকি। এক পায়ে ইতিহাস, আরেক পায়ে আসছে দিনে স্বপ্ন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আধুনিকতা, সেই তো আমাদের চলার পথের সন্তুলন। প্রতি মুহুর্তের অস্তিত্ব সংকটে বাঁচার পাথেয়। সহস্রাব্দের ইতিহাস, কয়েক লক্ষ্য/কোটি বছরের ভূতাত্বিক জাদু আর মানব অস্তিত্বের-(অ)প্রাসঙ্গিকতার ঘোরটা মনের মাঝেই ধরা থাক আরো কিছু দিন।
ইস্তানবুল ফিরে, কাল রাতেই প্রাগ হয়ে আমাদের ড্রেসডেন ফেরার কথা।
ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।