‘দেখে এলেম তারে’… নাহ, স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা নয়, স্বপ্নের গ্রাম, খোয়াবগাঁ। অনেক দিন ধরেই নেটে তার ছবি দেখা যাচ্ছিল, বছর দেড়েক আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এগারো জনের একটা দল চারদিনের জন্য ঝাড়গ্রাম ও তৎসংলগ্ন এলাকা বেড়াতে গিয়ে ঠিক করলাম খোয়াবগাঁ যাবই। কিন্তু আমাদের বাহন উইঙ্গার গাড়িতে চড়ে যখন খোঁজ করলাম, স্থানীয় লোকজন বলতেই পারলেন না জায়গাটা কোথায়। একজনের কথামতো সোজা চলে এসে দেখি মিনি চিড়িয়াখানা! সেখানে এক যুবক বললেন, আপনারা ভুল পথে এসেছেন। গাড়ি ব্যাক করে পুলিশ লাইনের বাঁ পাশ বরাবর সোজা চলে যান”। সেই পথে কিছুদূর এগোতেই পাকা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে গাড়ি মাটির রাস্তায় পড়ল। দু’পাশে কাজু আর আকাশমণির ঘন জঙ্গল। একজন বয়স্কা মহিলা কাঠ কুড়োচ্ছিলেন। —ও মাসি, এ পথে খোয়াবগাঁ যাওয়া যাবে?” তিনি আঙুল দিয়ে সোজা পথের দিকে দেখিয়ে দিলেন। —আমরা  ঠিক  যাচ্ছি তো?” —তোমাদের যেতে বলছি, যাও না!” মাসির মিষ্টি ধমকে এমন একটা আন্তরিকতা ছিল যে আমরা বুঝে গেলাম, আমরা ঠিক পথেই যাচ্ছি। দুপাশের গাছেরা মাথার উপরে পরস্পর জড়াজড়ি করে যেন কুঞ্জ পথ তৈরি করেছে। স্বপ্নিল সেই পথে কিছুটা গিয়েই ছোট এক জনবসতি দেখা গেল। এই সেই খোয়াবগাঁ! 
Khoyab Gram
তেরটি লোধা, শবর আদিবাসী পরিবারের মোট ৭৫ জন লোকের বাস এই গ্রামে। আগে এই গ্রামের নাম ছিল লালবাজার। ২০১৮ সালে শিল্পী মৃণাল মণ্ডল ও তাঁর চালচিত্র একাডেমির কয়েকজনের সহায়তায় গ্রামের মাটির দেওয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অপরূপ সব শিল্পকর্ম। এক একটি দেওয়াল যেন এক একটি ছবির ক্যানভাস। কী নেই সেখানে! গ্রামীণ জীবন, মা-শিশু, গরু-বাছুর, পাখপাখালি, রাসযাত্রা, জগন্নাথদেবের রথ, ষাঁড়ের খেলা, করোনা সচেতনতা ইত্যাদি নানারকম ছবি মাটির দেওয়ালগুলো জুড়ে আঁকা হয়েছে। বিচিত্র বর্ণিল সেইসব ছবি অবাক হয়ে, মোহিত হয়ে দেখতে হয়। শিল্পী মৃণাল মণ্ডলের উদ্যোগে স্থানীয় মানুষজন, গ্রামের কিশোর ছেলেমেয়েরা আঁকা শিখে বাড়ির দেওয়ালে এঁকেছেন এমন সব সুন্দর ছবি। এছাড়াও গ্রামের মানুষকে নানান শিল্পকর্মের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে চালচিত্র একাডেমি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নানারকম হাতের কাজ, যেমন সেলাই মেশিনের কাজ, ইকো প্রিন্টিং, মাটির পুতুল তৈরি করা, ফেলে দেওয়া কাঠের টুকরো দিয়ে কাটুম-কুটুম পুতুল তৈরি করা, কাঁথা সেলাই, নকশা ইত্যাদি শিখিয়ে রোজগারের পথ করে দিচ্ছেন তাঁরা। গ্রামবাসীরাও উৎসাহের সঙ্গে স্বয়ম্ভর হয়ে উন্নত জীবনযাপনের চেষ্টা করছেন। সরকারের নজরে আসায় কিছু সরকারি প্রকল্পেরও সুবিধা পাচ্ছেন গ্রামের মানুষ।
 
 
শিক্ষাবিদ শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্বপ্নের লালবাজার গ্রামের নাম রাখেন খোয়াবগাঁ। একানকার অধিবাসীরা আগে জঙ্গলের কাঠ কেটে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। শিল্পী মৃণাল মণ্ডল তাঁদের বোঝালেন, এভাবে সমানে কাঠ কেটে ফেললে একসময় জঙ্গল সাফ হয়ে যাবে। গ্রামবাসীদের বিকল্প রোজগারের রাস্তা দেখালেন তিনি। এখন তাঁরা কাজু চাষ, মাছ ধরা, সর্বোপরি চালচিত্র একাডেমির শেখানো হাতের কাজের জিনিস তৈরি করে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করছেন। বাংলার বুকে ‘খোয়াবগাঁ’ এখন এক আদর্শ শিল্পগ্রাম। পর্যটকেরা দলবেঁধে এই গ্রাম দেখতে যান।
Khoyab Gram Wall painting
গ্রামের মাটির দেওয়ালে ফুটিয়ে তোলা সেইসব অপরূপ শিল্পকর্ম

আমরা গ্রামে ঢুকেই দেখি সামনে বড় বোর্ড। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ছবি তোলা যাবে না। এমনি ছবি তুলতে পাঁচশো আর ভিডিও করতে হাজার টাকা দিতে হবে। আমাদের মধ্যে অনেকেই টাকার অংকটা বেশি বললেন। আমি তাঁদের বোঝালাম নিশ্চয়ই এই টাকা ব্যবহার করা হবে এখানকার মানুষের কল্যাণের জন্য। তখন তাঁরা রাজি হলেন। এমনিতেই গ্রামের গাছপালা ছাওয়া মাটির বাড়ির দেওয়ালে এত সুন্দর আঁকা দেখে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল, আমরা কে টাকা নেবে সেই খোঁজ করছিলাম। গ্রামের মানুষ কাজে গিয়েছেন। মহিলাদের জিজ্ঞাসা করাতে কয়েকটা বাড়ি পরে একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন। বললেন, ওখানে ছেলেমেয়েরা আছে। ওরা ব্যবস্থা করে দেবে। সেখানে যেতেই হৈ হৈ করে কিশোর কিশোরীর দল চলে এল। টাকার রিসিট বই, লিফলেট সব এনে ফেলল তারা। —সে কী রে, তোরা টাকা নিবি?” আমরা ইতস্তত করছি। কয়েকজন বয়স্ক লোক এলেন। বললেন —আপনারা নিশ্চিন্তে এদের হাতে টাকা দিন। বিকেলবেলায় চালচিত্রের বাবুরা এলে এরা গুনে এই টাকা তাদের হাতে দেবে। সব টাকা এখানকার জন্যিই ব্যয় হবে।” ছেলেমেয়েরা নীচে কার্বন কপি রেখে নিজেদের হাতে রিসিট লিখে সই করে আমাদের দিল। —আমাদের বাচ্চারা এখন লেখাপড়া শিখছে”, তাঁরা হাসিমুখে জানালেন। নিজেদের মতো করে এই উত্তরণের গল্প বলছিলেন তাঁরা। জানলাম, এ গ্রামেরই একজন ষষ্ঠীচরণ আইচ প্রথমে আঁকা ও হাতের কাজ শিখে তাঁদের উৎসাহিত করেন।

ছেলেমেয়েরা আমাদের নিয়ে বিভিন্ন দেওয়ালের আঁকা ছবি দেখাতে লাগল। তাদের কে কোনটা এসেছে তাও কলকল করে বলতে লাগল। বড় ভালো লাগল এদের সংসর্গ। আর কী সুন্দর সব ছবি! হনুমান গাছের ডালে ঝুলছে, হাঁস-মুরগির ছবি, টিকিওয়ালা বামুন লাঠি ভর করে হেঁটে যাচ্ছেন, লাউ মাচানের নীচ দিয়ে গিয়ে দেখলাম লাল কাপড় নিয়ে মানুষ আর ষাঁড়ের লড়াইয়ের ছবি, কোথাও করোনা সচেতনতার ছবি… তবে সবচেয়ে ভালো লাগল গ্রামের নাম ‘খোয়াবগাঁ’ লিখে গোল করে আঁকা শিশুদের হাসিমুখ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এমনই হাসিমুখে এগিয়ে যায়। আমি ওদের হাতে দুশো টাকা দিলাম। —এটা তোদের হিসেবের খাতায় লিখতে হবে না, তোদের আলাদা করে দিলাম। তোরা দশজন, প্রত্যেকে কত করে নিবি?” —কুড়ি টাকা।” সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে উত্তর। —ঠিক, এটা দিয়ে তোরা রংপেনসিল বা তোদের যা মনে হয় কিনতে পারিস।”

এবার আমরা মহিলারা গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে গল্প করতে গেলাম। যেটা ভালো লাগল গ্রামটি খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তাঁরা আমাদের ঘরে নিয়ে গিয়ে নিজেদের তৈরি কাঠের পুতুল, মাটির হাতি-ঘোড়া, কাঁথাশিল্প ইত্যাদি দেখালেন। হাসিমুখে জানালেন এখন তাঁদের ছেলেরা সকালে গরম ভাত খেয়ে কাজে যায়। আগে শুকনো মুড়ি খেয়ে যেত। ফেরার সময় মনে মনে ভাবলাম এমন শিল্প আন্দোলন কেন গ্রামে গ্রামে হয় না! ঝাড়গ্রামে কানফাটানো মাইকের আওয়াজে ভোট প্রচার শুনে এলাম অথচ চার পাঁচ কিলোমিটার দূরের এই খোয়াবগাঁয়ে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিজেদের জগৎ গড়ে তুলেছেন একদল মানুষ। লিফলেটে দেখলাম শিল্পী মৃণাল মণ্ডল ও চালচিত্র একাডেমির অন্যান্য শিল্পীরা আবেদন করেছেন যে এই পিছিয়ে পড়া মানুষদের  জন্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। পাড়ায় পাড়ায় যেন এমন শিল্প আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ ব্যাপারে চালচিত্র একাডেমির সঙ্গে যোগাযোগের ফোন নম্বরও দিয়েছেন তাঁরা,
সেগুলি হল 9433245574/9831134650/9933750139.
 
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে দেখেছিলাম অযোধ্যা পাহাড়ের কাঁটাডিহি গ্রামে সহরিয়া পরবে গ্রামবাসীরা তাঁদের মাটির বাড়ি সুন্দরভাবে প্রাকৃতিক রং দিয়ে চিত্রিত করছেন, সেসব ছবির ভিতর এমনকি নিখুঁত জ্যামিতিক নকশাও আছে। শহুরে মানুষেরা এমন সব কুশলী শিল্পচেতনার খবর রাখেন না।
 
 
ছবি সৌজন্য: লেখক
Shikha Sengupta Author

শিখা সেনগুপ্ত বিজ্ঞানের স্নাতক। ছোটবেলা থেকেই বইপড়ার নেশা, book worm বলা যায়। কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি শুরু। অফিস জীবনেও আনন্দবাজার সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিশেষ কলাম ও ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি ব্যাংক থেকে অবসরের পরে প্রথম শ্রেণীর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, দেশ, ভ্রমণ ও আনন্দবাজারে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *