একটা বাড়িতে ডাকাতি বা চুরির পর পুলিশ এসে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে কী কী খোয়া গিয়েছে। তার থেকে হিসেব পাওয়া যায় বাড়িতে কী কী ছিল। ঠিক তেমনই, একটা যুগে কী কী মূল্যবান সামগ্রী ছিল, তার হিসেব পেতে হলে দেখতে হবে বর্তমান সময়ে কী কী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, অর্থাৎ কী খুইয়ে বসেছি আমরা। আমার মতে আমাদের ঊনিশ-বিশ শতকের বাংলা থিয়েটারের হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের হিসেবনিকেশে সবচেয়ে বড় আইটেম হল সাধারণ রঙ্গালয়।
আমাদের সময়কালের সূচনাতে সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবর্ষ (১৯৭২) পালন করেছি আমরা বেশ গর্বভরেই। তখন কে জানত আর মাত্র আড়াই দশক পরে তার গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটবে! জাতির সংস্কৃতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়! সেই সময়কার নব্য সরকার বা নব্য বাবুরা বুঝতেই পারলেন না কী ক্ষতিটাই না হয়ে গেল। সাধারণ মানুষের সুস্থ বিনোদনের চাহিদা বা আকর্ষণের কারণ বা তার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার মত বোধবুদ্ধি ছিল না বাবুদের। আর নব্বইয়ের নব্য নাট্যজনেরা? তাঁরা ভাবলেন এবার ফাঁকা মাঠে খেল দেখাবেন। সর-দুধ-ক্ষীর যা আছে সব চেটেপুটে খাবেন তাঁরাই।

অথচ পরিস্থিতি কী ছিল তখন?
সত্তরের দশকেও হাতিবাগানে তিন-তিনটে নতুন রঙ্গালয় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল– রঙ্গনা (১৯৭০), সারকারিনা (১৯৭৬), বিজন থিয়েটার (১৯৭৯)। স্টার, বিশ্বরূপা, রংমহল তো ছিলই – তাহলে নতুন হলের প্রয়োজন পড়ল কেন? নাট্যশিল্পী, প্রযোজক এবং নাট্যদর্শকদের চাহিদা ছিল বলেই না! আসলে ক্রমবর্ধমান থিয়েটার তো তার ‘স্পেস’ খুঁজে বেড়াচ্ছে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় – বসন্ত চৌধুরী এবং রবি ঘোষ খুঁজে পেলেন শিয়ালদহ-সংলগ্ন ক্লেমব্রাউন ইনস্টিটিউট ও নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট। দু’টোই ছিল রেলের। রাজাবাজারে প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মেমোরিয়াল হলে ‘প্রতাপ মঞ্চ’ নাম দিয়ে অসীম চক্রবর্তী-কেতকী দত্তরা শুরু করলেন সেদিনকার বিতর্কিত নাটক ‘বারবধূ’। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র এবং এন বিশ্বনাথনকে নিয়ে শ্যামল সেন চেষ্টা চালালেন রামমোহন লাইব্রেরির মঞ্চে। মানিকতলা খালপাড়ের একদা-পরিত্যক্ত কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ নাট্যদর্শকদের নজর কাড়ল একের পর এক সফল প্রযোজনার কারণে। এখানেই ‘নামজীবন’ নাটক নিয়ে পাবলিক থিয়েটারে প্রথম আবির্ভাব ঘটল নাটককার-পরিচালক-অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের, হরিদাস সান্যালের প্রযোজনায়।
শ্যামবাজার পাঁচমাথা মোড়ের একদিকে বাজারের ঠিক পিছনে ভবদুলাল স্ট্রিটে নতুন তৈরি বাসুদেব মঞ্চে দেখলাম শ্যামল সেন-অনুপকুমারের প্রযোজনা, প্রযোজক সেই হরিদাস সান্যাল। টালা ব্রিজের নিচে চিৎপুর ইয়ার্ডের রেলওয়ে ইনস্টিটিউট রাতারাতি রূপান্তরিত হল শ্যামাপ্রসাদ মঞ্চে, সেখানে অভিনয় শুরু করলেন কমল মিত্র-বিকাশ রায়রা। অনুপকুমার আবার ‘নূরজাহান’ নিয়ে মঞ্চাবতরণ করলেন ঐতিহ্যবাহী ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে। গোয়াবাগানের বয়েজ ওন লাইব্রেরির ছোট্ট মঞ্চে পর্যন্ত থিয়েটার চালু হল। দক্ষিণ কলকাতায় তপন থিয়েটারের অসামান্য সাফল্যের পর তরুণকুমার ও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠা করলেন উত্তম মঞ্চ। রবি ঘোষ আবার এখানে এলেন কাজ করতে। আর চক্রবেড়িয়ার নিজ নাট্যগৃহ থিয়েটার সেন্টার-এ তাঁর সাধের থিয়েটার চালিয়ে গেলেন তরুণ রায় বা ধনঞ্জয় বৈরাগী।
সাধারণ রঙ্গালয় মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিল উঠে দাঁড়াবার। শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না চারপাশের উদাসীনতা উপেক্ষা ও বিরোধিতার ফলে। সত্তরের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বাম-আন্দোলন এবং বামেরা রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার ফলে শাসকের নেকনজরটি পড়ল গিয়ে থিয়েটারের সমান্তরাল লাইনটির ওপর।কারণ আর্থিক দিক থেকে অভাবক্লিষ্ট এই অংশটিকে ‘দিও কিঞ্চিৎ না করিও বঞ্চিৎ’ নীতি বা কৌশলের দ্বারা বশ করা সহজতর। আর আমরা, ‘রাজনীতি’-সচেতন বলব না, ‘পার্টি’-সচেতন বামপন্থী মনোভাবাপন্ন নাট্যদল ও নাট্যজনেরা ভেবে দেখার চেষ্টাও করিনি কী ভাবে অসংগঠিত পরিকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে নানাবিধ সরকারি ও পুরকরে কিংবা মামলায় জর্জরিত হয়ে সহায়সম্বলহীন সাধারণ রঙ্গালয় তখন সমূহ পতনের মুখে দাঁড়িয়ে।
জনগণের অর্থে নাম কেনার উদ্দেশ্যে বা গ্ল্যামারের সঙ্গে কাঁধ ঘষাঘষি করার মোহে সত্যজিৎ রায়, শ্যাম বেনেগাল, সন্দীপ রায়, জোছন দস্তিদারদের ডেকে ডেকে ছবি করার টাকা জোগাল ডান-বাম সরকার, অথচ সাধারণ রঙ্গালয়ের ক্ষেত্রে লবডংকা। কারণ সব রাজনৈতিক দলই সারসত্য বুঝে গিয়েছিল যে, ভোট-রাজনীতিতে এরা কখনওই সংখ্যায়, বশ্যতায়, বা যোগ্যতায় সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারবে না। তাই চরম উপেক্ষার শিকার হল সাধারণ রঙ্গালয়। অনেক অসাধারণ ক্ষমতা ও প্রতিভাসম্পন্ন নির্দেশক নাটককার এবং অভিনেতা অভিনেত্রীবৃন্দ তার সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও।

সত্তরের দশকে আমরা লক্ষ করব গ্রুপ থিয়েটারের চূড়ান্ত ব্যপ্তি ও বিস্তার। দেখব সাধারণ রঙ্গালয়, গণনাট্য সঙ্ঘ ছাড়িয়ে শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত-অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বাহিত গ্রুপ থিয়েটারের বেগবান ধারাটি (উৎপল দত্ত অবশ্য ‘গ্রুপ থিয়েটার’ তকমা বা সংজ্ঞায় বিশ্বাস করতেন না) ক্রমশ স্রোতস্বিনী হয়ে প্লাবিত করেছে, উর্বরা করে তুলেছে বঙ্গনাট্যের ক্ষেত্রটিকে। এই সময়ের অনেক কালোত্তীর্ণ প্রযোজনার তারিফ আজও শুনতে পাওয়া যায় সমঝদার নাট্যরসিকদের মুখে মুখে। অনেকগুলির অভিনয়-সংখ্যা শুনলে আজ রূপকথা মনে হবে। একদিকে শেকসপিয়ার, সোফোক্লেস, মলিয়ের, চেকভ, গোর্কি, বার্নার্ড-শ, লো্রকা, পিরানদেল্লো, শন ও’কেসি, জন মিলিংটন সিঞ্চ, আর্থার মিলার, ইউজিন ও’নীল, জঁ পল সার্ত্র, আলবেয়ার কামু, টেনেসি উইলিয়ামস, বের্টোল্ট ব্রেখট, আরবুজভ, আর্নল্ড অয়েস্কার, হ্যারল্ড পিন্টার, ইওনেস্কো, ভ্যাম্পিলব, এডওয়ার্ড অলবি, ডুরেনমাট, দারিও ফো; অন্যদিকে দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশ চন্দ্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অমৃতলাল বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় থেকে শুরু করে বিজন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ী, উৎপল দত্ত, বাদল সরকার, বুদ্ধদেব বসু, বীরু মুখোপাধ্যায়, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়, অমর গঙ্গোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, উমানাথ ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, অমল রায়, চন্দন সেন, নভেন্দু সেন, দেবাশিস মজুমদার, ইন্দ্রাশিস লাহিড়ী– দেশি-বিদেশি নাটক-নাটককারের বিপুল সম্ভার।
সাধারণ রঙ্গালয় মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিল উঠে দাঁড়াবার। শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না চারপাশের উদাসীনতা উপেক্ষা ও বিরোধিতার ফলে। সত্তরের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বাম-আন্দোলন এবং বামেরা রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার ফলে শাসকের নেকনজরটি পড়ল গিয়ে থিয়েটারের সমান্তরাল লাইনটির ওপর।কারণ আর্থিক দিক থেকে অভাবক্লিষ্ট এই অংশটিকে ‘দিও কিঞ্চিৎ না করিও বঞ্ছিৎ’ নীতি বা কৌশলের দ্বারা বশ করা সহজতর। আর আমরা, ‘রাজনীতি’-সচেতন বলব না, ‘পার্টি’-সচেতন বামপন্থী মনোভাবাপন্ন নাট্যদল ও নাট্যজনেরা ভেবে দেখার চেষ্টাও করিনি কীভাবে অসংগঠিত পরিকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে নানাবিধ সরকারি ও পুরকরে কিংবা মামলায় জর্জরিত হয়ে সহায়সম্বলহীন সাধারণ রঙ্গালয় তখন সমূহ পতনের মুখে দাঁড়িয়ে।
সেই সময়কার মাত্র পাঁচটি নাট্যদল — বহুরূপী, এলটিজি / পি এল টি, নান্দীকার, গন্ধর্ব, রূপকার-এর সদস্য-অভিনেতাদের তালিকায় একবার চোখ বুলিয়ে গেলেই বোঝা যায় দলগুলির ক্ষমতার ধার ও ভার কতটা ছিল। একাল-সেকাল নিয়ে প্রবীণ-অর্বাচীনের সেই চিরকালীন বিতর্কে আমি প্রবেশ করতে চাইব না, সবটা মিলিয়ে আমাদের সময়কার থিয়েটারের ক্যানভাসটা কত বড় ছিল সেটা বোঝানোই আমার উদ্দেশ্য। কর্মচঞ্চল সৃষ্টিশীল বাংলা থিয়েটারের দৃষ্টান্ত অনুপ্রাণিত করেছিল সেই সময়ের হিন্দি থিয়েটারকেও। রাজ্যের নাট্যচর্চা ও সৃজনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল হিন্দি নাট্যসংস্থা অনামিকা, আদাকার, পদাতিক এবং রঙ্গকর্মী-র। শ্যামানন্দ জালান, প্রতিভা অগ্রবাল থেকে শুরু করে ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত অনেকেই ছিলেন আমাদের কলকাতা থিয়েটারের গর্ব। ওই সময়টাতেই তাঁরা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন। কলকাতার ইংরাজি ভাষার থিয়েটারও তখন টগবগে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জন (১৯৭১) বাংলা-বাঙালির ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সত্তরের দশকেই দুই বাংলার থিয়েটারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি হল। বেসরকারি স্তরে অবাধ যাতায়াত এবং বিনিময়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত হল।

আমাদের মহলাকক্ষগুলি ছিল এক একটি নাট্য-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রতিটি রিহার্সাল ছিল তত্ত্ব ও প্রয়োগ সংক্রান্ত ক্লাস। নাট্য-পরিচালককে সর্বার্থে একজন শিক্ষকও হতে হত। চেখভের নাটক হবে? বেশ খানিকটা চেখভ-চর্চা শুরু হল গ্রুপে। চেকভ, তাঁর নাটক, সাহিত্যকর্ম এবং জীবন সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা তৈরি হয়ে যেত সবার। হিটলারের উত্থান এবং তার ইউরোপ-আগ্রাসন নিয়ে ব্রেখটের নাটক হবে? তখন জানতে হবে জার্মানিতে হিটলারের ক্ষমতা দখলের ইতিহাস। একের পর এক ইউরোপীয় দেশগুলিকে পদানত করার ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ করতে হলে পড়তে হবে তাঁর ‘রাজর্ষি’ এবং নাটকটির কবি-কৃত ইংরাজি অনুবাদ The Sacrifice। জানতে হবে ত্রিপুরার রাজন্যদের ইতিহাস। অর্থাৎ লেখাপড়াটা করতে হবে, জানতে হবে, শিখতে হবে অল্পবিস্তর সবাইকেই। নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং সময়ানুবর্তিতা মেনে সব রিহার্সালে সবাইকে থাকতে হবে। সেই নাটকে অভিনয় করলেও, না-করলেও। কারণ সেটাই তো বিনিপয়সার টিউটোরিয়াল। (ঈশ্বরের অপার করুণা, সেই সময় মোবাইল ছিল না।) এই বোকা-বোকা নিয়মগুলি তৈরি করেছিলেন আমাদের শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত ছাড়াও বিশ্বনাট্যের তাবড় নাট্যবিদ ও প্রয়োগকর্তারা। নাট্যনির্মাণ, চরিত্রনির্মাণ, মহলা ইত্যাদি বিষয়গুলির ওপর অযথাই জোর দিয়েছিলেন তাঁরা। বিশেষ করে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত অপেশাদার থিয়েটারের জন্য এগুলোর প্রয়োজন হয়ত একটু বেশিই ছিল।

এমন উটকো প্রশ্ন কেউ করত না, ক’টা রিহার্সাল দিতে হবে আমাকে? কাউকে বলতে শুনিনি, নাটক একবার নেমে গেলে প্রতিটি অভিনয়ের আগে রিহার্সালের দরকার কী? এখন নাকি সবাই পেশাদার। ক্ষেত্র প্রস্তুত নয়, আর আমি পেশাদার হয়ে গেলাম? পেশাদার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার, নিরন্তর বিজ্ঞানসম্মত অনুশীলনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করার অনুকূল পরিস্থিতি আছে নাকি এখানে? দু’টো পয়সা নিয়ে কাজ করলেই পেশাদার হয়ে যাওয়া যায়? পয়সাটা যে দিচ্ছে সে-তো তার ঘরের কাউকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে তোমাকে দিচ্ছে। ওটা তো কারচুপির পয়সা। যারা পয়সা চাইছে বা নিচ্ছে, দু’একজন ছাড়া কার নামে একটা টিকিটও বেশি বিক্রি হয়? কত হাতি গেল তল, আর যে-কেউ চাইলেই হতে পারবে পেশাদার ? মোদ্দা ব্যাপার হল– গ্রুপে ধারাবাহিক কাজের মধ্য দিয়ে আগের মত অভিনেতা তৈরি হচ্ছে না। অভাব মেটাতে খোলা বাজার থেকে অভিনেতা ভাড়া করতে হচ্ছে। কারবাইডে পাকা অভিনেতাও ঝোপ বুঝে টাকার কোপ মারছে। উপরি-রোজগারের একটা মোহ আছে না! গরিবের ঘরে নাটক করতে এসে যেসব সুযোগ-সুবিধা-বায়নাক্কা দাবি করেন তাঁরা, একবার চেয়ে দেখুন না ভাই সিনেমা-সিরিয়ালে! আমাদের ছিল অভাবের থিয়েটার। অভাবের মোকাবিলা করতে হত অন্য ভাবে। সেভাবেই শুরু হয়েছিল এই থিয়েটারটা, কিন্তু হঠাৎ করে সব এলোমেলো হয়ে গেল। নানা কারণে, কিছু না-ভেবে না-জেনে ‘লাইনে’ ঢুকে পড়ল অনেকে এবং সেখানেই বাধল বিপত্তি।
এক এক সময় ভাবি, এই দ্রুত অধঃপতন কি শুধু থিয়েটারেই। চারদিকে তাকালে মনে হয় তা বোধহয় নয়, আমাদের চারপাশটাই তলিয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে আমরাও। আমরা যখন থিয়েটারে এসেছি তখন লক্ষ করেছি পরিবেশ আমাদের সহায়তা করছে– নতুন থিয়েটার, নতুন সিনেমা, নতুন সঙ্গীত, নতুন ভাবনার চিত্রকলা– সবদিকেই একটা নতুন কিছু করার উৎসাহ উদ্দীপনা । নাট্যক্ষেত্রে নাট্যকর্মীদের যাপনচিত্র অন্যদের থেকে একটু ভিন্ন মনে হত, কারণ তাঁদের সামনে প্রতিবন্ধকতা পাহাড়প্রমাণ। বন্ধু প্রভাত কুমার দাস শম্ভু মিত্র সম্পর্কে তাঁর একটি লেখায় লিখছেন, ‘ভালো করে ভালো নাটক করতে চান তাঁরা। নাটকের দল বলতে নিছক কোনও প্রমোদ-অভ্যাস বা সময়-কাটানো নয়, সেই আনন্দময় কর্মক্ষেত্রটি আসলে ‘শিল্পের শ্রীক্ষেত্র’ হিসাবেই পরিগণিত হয়ে উঠবে এই ছিল তাঁদের বিশ্বাস। প্রথম থেকেই তাঁরা সচেতনভাবে নতুন ধরনের একটা নাট্যশিল্প গড়তে চেয়েছেন যাতে ‘বড় ছোট সবাই মিলেমিশে একটা যৌথ জিনিস’ প্রকাশ করা সম্ভব হয়, নতুন একটা আন্দোলন সম্পর্কে নিজেদের দৃঢ়তা সঞ্চয় না করতে পারলে কোনও সংগঠিত কর্ম সম্পাদন সম্ভম নয়।’ ১৮৯৮ সালে জীর্ণ পুরাতন রুশ থিয়েটারকে বর্জন করে নতুন থিয়েটারের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন মস্কো আর্ট থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা কনস্তান্তিন স্তানিস্লাভস্কি এবং নেমিরোভিচ- দানচেঙ্কো, তাঁরাও ব্যবহার করেছিলেন এই ‘শিল্পের মন্দির’ শব্দবন্ধটি । শেষ করার আগে আমি শুধু শম্ভু মিত্রের কথা থেকে দু-একটি উদ্ধৃতি দেব । আপনারাই বিচার করবেন আমাদের থিয়েটার কী ছিল (কিংবা আমাদের থিয়েটারের কী সম্ভাবনা ছিল), আর কী হইয়াছে ।
শম্ভু মিত্র উবাচ:
১ আমরা ভয়ানক নতুন একটা কাজ করতে চলেছি । নাটকের আন্দোলন যে করতে নেমেছে মনে থাকে যেন সে এক প্রচণ্ড দুরূহ artistic কাজ করতে নেমেছে, আমাদের মধ্যে fanatic zeal না-থাকে তো আমরা doomed.খালি আমরা doomed হলে ভাবনা ছিল না। আন্দোলনও doomed।
২ এই আন্দোলন আমাদের বাঁচার পদ্ধতি বদলে দেবে। দল ছাড়া নাটক হয় না, এই এক প্রচণ্ড সুবিধা এবং মুশকিল। সুবিধা এই জন্যে যে, ঠিক মতো দল গড়তে পারলে আমরা তাঁর মধ্যে collectively এবং co-operatively বাঁচতে শিখব।
৩ এতগুলো incomparable human material নিয়ে আমরা কিছু করতে পারব না ?
৪ কোনো জিনিস শুরু থেকে গড়তে গেলে প্রায় একটা ‘ফ্যানাটিক’ উৎসাহ থাকা চাই । নইলে গড়ে তোলা যায় না। এবং গড়ে উঠবার পর সেই ফ্যানাটিক ভাবকে সংযত না করলে দল ফেটে যেতে বাধ্য। দল নয়, দলের কাজকর্মও একটু রক্ষণশীল, একটু পুরাতনপন্থী হতে বাধ্য। তাই এই ভারসাম্য বজায় রাখা একটা প্রচণ্ড কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এবং এর জন্যে দলের মধ্যে নানান vested interest জমে ওঠে, এই interestটা বেশিরভাগ prestige-এর, position-এর। ফলে সেই অবস্থাটা বদলাবার সম্ভাবনা এলে তাদের গায়ে লাগে, একটা ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে লোকগুলো যদি মোটের মাথায় সৎ হয় তাহলে আবার একরকম করে বোঝাবুঝি হয়, নতুন অবস্থার মধ্যে মানিয়ে নিয়ে আবার আত্মীয়তা হয়।
এই সময় আমাদের থিয়েটার বিজ্ঞান, স্তানিস্লাভস্কি, ব্রেখট, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত প্রমুখদের ভুল প্রমাণ করে এগিয়ে চলেছে– ১৫ দিন ভাঙা রিহার্সাল দিয়ে নাটক নামছে, একজন অভিনেতা একসঙ্গে ১৫টা নাটকে অভিনয় করছেন, একজন নাটককার গিরিশবাবুদের মত বছরে পাঁচ থেকে দশখানা নাটক লিখছেন, কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ধারে-কাছে না থেকেও আমরা ‘কমার্শিয়াল’ হবার স্বপ্ন দেখছি এবং প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ফেসবুক এবং পত্র-পত্রিকাতে প্রশংসার ছড়াছড়ি, আর সাধারণ রঙ্গালয়-বঞ্চিত, ‘সিরিয়াল’-ক্লান্ত বাঙালি আমাদের নাটক দেখে বলছে– আহা, এমন জিনিস আগে কখনও হয়নিকো। এবং আমরা, থিয়েটারের মানুষরা তাই বিশ্বাসও করে ফেলছি।
খ্যাতনামা নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অন্য থিয়েটার নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা। একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত। 'নাটক নিয়ে' এবং 'থিয়েটার যা দেখা তা নিয়ে লেখা' ওঁর দুটো জনপ্রিয় বই।