আমরা যখন ছোট, তখন যেন বৃষ্টি মানেই আনন্দ!
কেন যে আনন্দ তা জানি না।
আকাশের মুখ গম্ভীর। আলো কম। গরম বেশি। স্যাঁতস্যাঁত করছে চারদিক। ঘ্যানঘ্যানে পরিবেশ।
তবুও নাকি সে সব খুব আনন্দের দিন।
ছোট বড় মাঝারি কাগজের নৌকো বানানোর দিন আর কপাল ভালো থাকলে উইকলি টেস্ট বাতিল হওয়ার দিন।
গেছে সবই। সেই মানুষজন, সেই ঘরবসত। রয়ে গেছে শুধু জগজিৎ সিংয়ের গলায় ‘উয়ো কাগজ় কী কশতি’ ….
শৈশবের সেই বৃষ্টি দাও ফিরিয়ে আমাকে,
সেই কাগজের নৌকো, সেই জলেভেজা দিন….
***
বৈঠকখানা রোডের বাড়িতে লম্বা কালো ছাতা, কেসি পাল বা মহেন্দ্র দত্তর, দরজার খিলের পাশে দাড়িয়ে থাকত। আর ছিল ডাকব্যাকের লম্বা ভারী গামবুট। বৃন্দাবন লেনের সেই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালেই ছপাৎ ছপাৎ জলের শব্দ, আর রিক্সার টুংটাং ঘন ঘন। সবাই এখন বড্ড বেশি নস্টালজিয়ায় ভোগে… আমিও।

লোডশেডিং এর কষ্ট, প্যাচপ্যাচে পচা ভাদ্র, কমরেড জ্যোতি বসুকে গাল দেওয়ার দিন সব সেপিয়া টোনে পুরনো দিনের লাইটরুম এফেক্টে একদম দক্ষ শিল্পীর হাতের কাজ হয়ে ওঠে যেন। সে রকমই একটা লাল ছাতার গল্প লিখব বলে বসেওছিলাম। মনে পড়ে গেল সেই যে ছোট্ট গোটানো ছাতা, প্রথমবার দেখা। একমুহূর্তে ছোটবেলাটা ফোর এক্স স্পিডে রিওয়াইন্ড করে গেল।
কালো লম্বা ছাতার বদলে একদিন দেখি মা অফিস থেকে একটা চোখ বড় করা জিনিস ব্যাগ থেকে বার করলেন ৷ প্রথমে আস্তে করে টান দিতেই উপরের খোলসটা বেরিয়ে এল ৷ তারপর পাশ থেকে পটাশ করে বোতাম খুলল। একটু ঝেড়ে, একটু নেড়ে টান দিতেই একটা লম্বা ডান্ডা, আর মাথায় ঠিক তালগাছের মতন… না না, ফুলের গোছা যেন! তারপর হাত ঢুকিয়ে ক্লিক করতেই কী সুন্দর ছাতা হয়ে গেল। বিস্ময় আর কাটে না। মায়ের বন্ধু, শিখা মাসির বর সুবীর মেসো মার্চেন্ট নেভিতে কাজ করতেন। উনি এনেছেন বিদেশ থেকে। আর শিখা মাসি গিফট করেছে মা-কে।
উফ সেই ছাতার যে কী কদর ছিল, সে গল্প আর এক দিন হবে।
***
ফাস্ট ফরওয়ার্ড টু কলেজ। প্রথম বছর, দার্জিলিংয়ের মেয়ে কুমকুমের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। অদিতিও বন্ধু হল। কুমকুমের কাছে বেশ একখানা জবরদস্ত ছাতা। ও সেটা রোজ কলেজে আনে। রোদে-জলে-বৃষ্টিতে বের করে। আমাদেরও যে ফোল্ডিং ছাতা ছিল না, এমন নয়। কিন্তু ওরটা দেখলেই বোঝা যায়, এক্কেবারে কুলীন গোত্রের। আমাদেরগুলোর মতন ঝড়ে যায় উড়ে যায়, পলকা পিলে রোগে ভোগে টাইপ এর নয়। তারপর জানা গেল ওরটা বিদেশি, দার্জিলিংয়ে পাওয়া যায়। চিনে জিনিস তখনও বিলেতি বলেই মান্য হত। আর মানেরও এতটা অধঃপতন হয়নি। মাসিমণি গরমের ছুটিতে আসবেন, আবদার হলো ছাতা আনার। মানিকতলার সেই বাড়িটা মোটামুটি আমাদের দখলেই থাকত। মাসিমণি দু’টো ছাতা এনেছেন, একটা আমার আর একটা অদিতির। একটা লাল, একটা নীল। অদিতি নিল নীল আর আমার বোল্ড আর ব্রাইট লাল।

সেই লাল ছাতা প্রথম প্রেমের মতন থেকে গেল সঙ্গ সঙ্গেই, আজও। লাল ছাতা মাথায় কোনও মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখলেই মনে হয় দারুন সাহসি, সব দুর্যোগ মাথায় নিয়েও দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে পারে, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে যেন না করি ভয়’ গাইতে গাইতে।
***
আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল পিছু পিছু। ভাদ্রের আর্দ্রতা ভেঙে স্বস্তি নামল শহরে। ঠিক অফিসটাইম, দৌড়ে ঘরে ফেরার পালা। তাই পথে সারি সারি কালো ছাতাদের ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি পরে গেল। তার মাঝেই কে যেন দাঁড়িয়েছিল রেলিংটায় ভর দিয়ে। অফিস ফিরতির পথে একবার একটু দেখা। কালো কালো ছাতার মাঝখানে একটা লাল ছাতা। মনোক্রোমের মনোটোন ভাঙার চেষ্টায় লাল ছাতা একবার এদিক আর একবার ওদিক। ভারী ভারী কালো ছাতাদের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে স্বতন্ত্রভাবে এগিয়ে আসছে। একা। দূর থেকেই চেনা যায় তাকে। এক মাথা বৃষ্টি, খানাখন্দ ভরা পথঘাট, অনেক কালো ছাতাদের ধাক্কা খেয়েও অবলীলায় অনায়াসে এগিয়ে আসছে।

আচমকাই কান্ট্রি সিঙ্গার ফেইথ হিলের ‘রেড আমব্রেলা’ গানটা মনে এল। প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগের মুহূর্তের পালস রেটের সাথে তাল মিলিয়ে আপটেম্পো…
Sometimes life can get a little dark
I’m sure I’ve got bruises on my heart
Here come the black clouds full of pain
Yeah, you can break away without the chains
Your love is like a red umbrella
Walk the streets like Cinderella….
অসম্ভব রোমান্টিক একটা মুহূর্ত। তারপরেই এক্কেবারে অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স সেই লাল ছাতার ইতিহাস।
শুধু সিন্ডেরেলা নয়। তার জন্য তো রাজকুমার আছে। ওই লাল ছাতার আড়ালে সত্যি সত্যি লুকিয়ে আছে অনেক জীবন্ত কষ্ট। সেই সব গল্প, সব থেকে পুরনো গল্প। সব থেকে পুরনো পেশার গল্প এই লালের লালিমায়।
লাল ছাতা এক প্রতীক। লাল ছাতা জীবনের সব প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে চাওয়ার তীব্র ঘোষণা। মানবিকতার কাছে এক মুঠো ভিক্ষে নয়। লাল ছাতা এক আন্দোলন। বাঁচতে চাওয়ার ভীষণ দাবি।
***
১ ডিসেম্বর ২০০১ সালে ইটালিতে লাল ছাতাটি প্রথম ব্যবহার করা হয় ৪৯তম ভেনিস বিয়েনেল আর্টে যৌনকর্মী সংহতির প্রতীক হিসাবে। ইতালীয় যৌনকর্মীরা ভেনিসের রাস্তাগুলোতে “প্রস্টিটিউট প্যাভিলিয়ন” এবং ‘কোড রেড’-এর অংশ হিসাবে লাল ছাতা নিয়ে মিছিল করেছিলেন। স্লোভেনীয় শিল্পী তাদেজ় পোগাকার রেড আর্টের ইনস্টলেশন করেন সেখানে। জন্ম হয় পরিবর্তন আন্দোলনের। অমানবিক, অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করতে যৌনকর্মীরা রাস্তায় নামেন বিক্ষোভে। রেড আমব্রেলা মার্চ আজও অমানবিক, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ। চার বছর পরে লাল ছাতাটি ইউরোপের যৌনকর্মীদের অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক যে কমিটি তৈরি হয়েছিল, সেখানে পাকাপাকি ঠাঁই করে নেয়। বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে। সেই থেকে লাল ছাতা সারা দুনিয়ার যৌনকর্মী অধিকারের আন্তর্জাতিক আইকন। তাদের শক্তির প্রতীক।

তবে এর পাশাপাশি আমেরিকার গ্যারি লিওন রিডওয়ের কথা না বললে বৃত্তটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গ্যারি ছিল একজন আমেরিকান সিরিয়াল কিলার, যে গ্রিন রিভার কিলার নামে পরিচিত। ৪৯টি আলাদা আলাদা খুনের জন্য সে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। আমেরিকার ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বাধিক খুনের রেকর্ড গ্যারির ঝুলিতে। ‘৮০-‘৯০-এর দশকে ওয়াশিংটনে অজস্র কিশোরী এবং প্রাপ্তবয়স্কাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কাছের গ্রিন রিভার বা বনে জঙ্গলে ফেলে দিত সে। গ্যারির অধিকাংশ শিকারই ছিলেন পেশায় যৌনকর্মী এবং নাবালিকা। কখনও বা ঘরপালানো একাকিনী দুর্বল অসহায় মেয়েরা। ২০০১ সালের ৩০ নভেম্বর, রিডওয়ে ধরা পড়ে।

মামলা চলাকালীন ক্ষমার আবেদনের দর কষাকষি শুরু হয়। রিডওয়ে জানান, খুন হওয়া ৪৯ টি লাশ কোথায় রেখেছে সে, বলে দেবে। এই কড়ারেই তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেওয়া হয়। ২০০৩-এর ১৭ ডিসেম্বরের কিং কাউন্টি সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক রিডওয়ের শাস্তি ঘোষণা করেন – প্যারোল ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেই থেকে প্রতি বছরই ১৭ ডিসেম্বর ‘দ্য রেড আমব্রেলা ডে’ আন্তর্জাতিক যৌনকর্মী সুরক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
***
এমনি করে জানতে জানতে, শিখতে শিখতে ছোটবেলা, মেয়েবেলার সেই নরম মিষ্টি রোমান্টিক লাল ছাতাটাও একদিন বড় হয়ে গেল। পোড় খেতে খেতে শক্তপোক্ত হয়ে একদিন এভাবেই প্রতিবাদী হয়ে উঠল।
ফেইথ হিলের গানের কথায় সুরে…
So let it rain
It’s pourin’ all around
Let it fall
No it ain’t gonna drown me
After all
I’m gonna be okay
So let it rain
You can wear your sorrow like an old raincoat
You can save your tears in a bottle made of gold
But the glitter on the sidewalk always shines…..
মৌসুমীর জন্ম কলকাতায় হলেও গত তিন দশক ধরে নিউ ইয়র্কই তাঁর বাসস্থান এবং কর্মস্থান। এক্কেবারে বিশুদ্ধ ক্যালইয়র্কার। শুঁটকি মাছ থেকে চন্ডীপাঠ, Grateful Deads থেকে সুপ্রীতি ঘোষ আর এই diasporic dichotomy-র জাগলিংয়ে হাত পাকাতে পাকাতেই দিন কাবার। ভালোবাসেন বই পড়তে, ছবি আঁকতে, রান্না করতে, আড্ডা মারতে আর ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে। তবে সবচেয়ে ভালোবাসেন সক্কলকে নিয়ে জমিয়ে বাঁচতে!
Superawesome…..love you
Chamatkar Mousumi…
Phiriye file onek kichu
Janlam onek kichu
Khub bhalo laglo
দারুন লাগলো!
খুব ভাল লাগল মৌসুমিদি I
Darun laglo!
Very good article. We throwly enjoyed. We need to communicate, so Poushali knows our no,if you want to talk call us we will appreciate it. We live in Houston.
টিপটিপ বর্ষার দিন না হলেও পড়ে ফেললাম নির্ভীক লাল ছাতার গপ্পো। বলিষ্ঠ লেখা।মনে পড়িয়ে দেয় অনেককিছু আবার জেনে নিলামও অনেককিছু।
Very well written. I enjoyed reading the article.