মুখবন্ধ

পাঁচ বছর বয়সে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে লেখা পোস্টকার্ড। বারো বছর বয়সে সন্দেশ-এ  কবিতা বেরনোর পর থেকে সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদারের পত্রিকায় অবারিত কপাট। ১৯৮০-তে বাংলা ছেড়ে ভারতের অচেনা বিস্তারে। ১৯৮৫-তে বিমল করের লেখা নীল পোস্টকার্ড। ২০০৪-এ রাত জেগে মহুলডিহার দিন  উপন্যাস পড়ার পর, নরওয়েজীয় তরুণ কবির কান্না ভেজা চোখ, হাতে উপহার, মধুর বোতল। তিন দশক ধরে বাংলা ভাষার আলিঙ্গন থেকে দূরে ভ্রমণ করার কালে মাতৃভাষার হাত ধরে থাকা। অচেনা গ্রামগঞ্জের পোস্ট অফিস থেকে ডাকে লেখা পাঠানো। কলকাতার গলি থেকে সাঁওতাল পরগনা, ঝাড়খণ্ড থেকে উত্তর ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মারাঠওয়াড়া, বস্তার,গড়চিরোলির বাস্তবে চলে যাওয়া। আর কিছুদিন পরেই যাত্রা আরম্ভ হবে নর্মদার মোহনা থেকে, মহারাষ্ট্র ও মধ্য প্রদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের কাছে। নর্মদা বাঁধের জলমগ্ন গ্রামগঞ্জের হদিশ করতে করতে অমরকণ্টকে নদী উৎসে ফেরা।

স্কুলে ভর্তি না-হওয়া যে ছোট মেয়েটির কাছে থাকত ডায়েরি আর পেনসিল, হাজরা পার্কে খেলতে গিয়ে, রাতে বালিশের পাশেও, তার কলমে পাঁচ দশক পার করা লেখকজীবনের বৃত্তান্ত— ‘লিখতে লিখতে অথৈ দূর।’



সম্পাদকের পোস্টকার্ড

একটা রোদ ছিল। সকালের দিকে ঝলমলে হলুদ। তখন সে আমাদের বাড়ি আসত না। তার রঙে একটু করে কমলা মিশে যেত দুপুরের পর, যখন সে হাজরার মোড় পার হয়ে উল্টো দিকের বাড়িগুলোর কার্নিস টপকে আমাদের জানলার ধারের বিছানায় লুটিয়ে পড়ত। গরমের দিনে কেউ তার খোঁজ করতাম না আমরা। মনের মধ্যে ধরা আছে কেবল শীত-রৌদ্রের স্মৃতি। দুই জানলাপথে এসে পড়া রম্বস আকৃতির দু’ফালি রোদ। তাতে পালা করে, আবার ঠেসাঠেসি করেও বসতাম আমরা। শীতকাতর আমাদের মুখের দিকে না তাকিয়ে রোদ চলে যেত আরও দূরে, বড় রাস্তা ছাড়িয়ে, দমকলের বাড়ি টপকে, কালীঘাট ব্রিজের দিকে, বিষণ্ণতার কমলা রং মাখতে মাখতে। ঐ পশ্চিম আকাশেই রঙের নানা খেলা খেলে অস্ত যেত সূর্য। আজও সেই হলুদ কমলা রঙ, জড়িয়ে আছে আমার শৈশব চেতনায়। আর ঘুমিয়ে আছে, বনান্তরের ঝরা পাতার পিঙ্গল স্তূপের ভিতর ঘুমন্ত ময়াল সাপের মতো, পৃথিবীর দীর্ঘতম রাস্তা হাজরা রোড। যে রাস্তা আমার শৈশবে কখনও ঘুমোত না, বিজন নিশীথিনীর গভীরেও না।

দক্ষিণ কলকাতায় নানা বাসা বদল করতে করতে, কর্নফিল্ড রোড, চন্দ্রমণ্ডল লেন, অনিল রায় রোড ঘুরে বাবা-মা যখন হাজরা রোডের তিনতলার বাসায় এসে পৌঁছলেন, তখন কি জানি, এই বাড়িই হবে আমাদের আগামী দু’দশকের ঠিকানা? দুটো ঘর, মাঝখানে একটা বারান্দা মতো, রান্নাঘর। রাস্তার দিকের ঘরটা ছিল লম্বাটে, একটা ত্রিকোণে গিয়ে শেষ। রাস্তার ধারের দুই জানালার জন্য ওখানেই কাটত আমাদের অনেকটা সময়। পশ্চিমমুখো জানালার সামনে মুখোমুখি পাতা থাকত দুটো কাঠের চেয়ার। বাবা আর মা একসঙ্গে বসে সন্ধেটা কাটাতেন ওখানে। নীচে বয়ে যেত ডবল ডেকার বাস, ট্রাম আর গাড়ির শব্দের, যাতায়াতের কোলাহল মেশা নিরন্তর যাত্রা। পুজোর চারটে দিন আলো, মাইকে ভেসে আসা গান আর ঝলমলে মানুষের বন্যায় সে পথ হয়ে যেত গর্জ্যমান এক নদী।

ও বাড়িতে যখন এসেছিলাম, আমি তিন ছুঁই ছুঁই। হরিণঘাটার দুধ আসত হরিশ মুখার্জি রোডের মোড়ের ডিপো থেকে। নতুন বাড়িতে আসার পর দুধের কার্ড বানাতে দেরি হচ্ছিল আর আমি দুধ ছাড়া খেতে পারতাম না বলে শেষপাতে ভাতের উপর গুঁড়ো দুধ ছড়িয়ে তার উপর গরম জল দিয়ে মা মেখে দিতেন। আর একবার টমেটোর চাটনিতে ফোড়নের সর্ষে দেখে ‘পোকা পোকা’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। হাজরা রোডের বাড়ির এই হল আমার আদিমতম স্মৃতি। কিন্তু আমাকে কেউ পড়াশুনো করতে বলেছে বলে আমার মনে পড়ে না। 

তিন, চার পেরিয়ে পাঁচ ছুঁতে চলেছি। জন্মের সময় আমার কঠিন অসুখ হয়েছিল, ডাক্তারদের অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী — ‘একে বাড়িতেই নিয়ে যান, হাসপাতালে আর কেন’, ইত্যাদির পর বাড়ি ফিরে, বাবার গুঁড়ো করা অ্যালোপাথি ট্যাবলেটে আমার প্রাণরক্ষা হয়। কাজেই নেহাৎ রুগ্ণ শীর্ণ আমি কোনওমতে বেঁচেবর্তে থাকি, এটাই ছিল বাবা-মায়ের মনস্কামনা। পড়াশুনো গৌণ ব্যাপার। লিখতে না পারলেও খবরের কাগজ ও রাস্তার সাইনবোর্ড থেকে অক্ষর পড়তে শিখে গিয়েছিলাম আমি। আর পুরনো এক টিনের সুটকেস ভর্তি বইপত্র ছিল আমার দখলে। যথাক্রমে ছয় ও চার বছরের বড় দুই দাদার বাতিল, মলাট ছেঁড়া, সেলাই ঢিলে হয়ে যাওয়া বইতে ভরা সেই বাক্সটা নিয়ে ওদিকের ঘরের খাটের পায়াতে পিঠ ঠেকিয়ে নিয়মিত পড়াশুনো করতাম, তাকে লোকে যে নামই দিক না কেন। ইতিহাস, ভূগোল, ইংরাজি, বাংলা, অঙ্ক সবই ছিল তাতে। কিন্তু নিজে নিজে পড়ে তো আর পুরো দিন কাটে না, তাই, আপন মনে কথা বলা, কবিতা বলা, গান করা এই সবও আমার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

১৯৫৯-৬০ সালের কলকাতা। টেলিভিশন আসতে আরও দেড় দশক। মোবাইল সুদূর। আমাদের বাড়িতে কালো রঙের গাঁট্টাগোট্টা ল্যান্ড ফোনই এসেছে উনিশশো সত্তরের মাঝামাঝি। যদিও তখন বাংলা সিনেমায় নানা চেহারার টেলিফোন দৃশ্যমান। বাড়িতে একটি মাত্র বৈদ্যুতিন যন্ত্র ছিল, একরত্তি এক ফিলিপ্স রেডিও। তার ভিতর থেকে উঠে আসত রহস্যধ্বনির মতো রবিবার রাতের ছায়াছবির গান, দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর সুগম সঙ্গীত আর বাংলা আধুনিক। জোরে নব ঘোরাতে গিয়ে আমি একবারই রেডিওর নব ভেঙে ফেলেছিলাম আর বাবাকে এসে বলেছিলাম, ‘গান ভেঙে গেছে।’ জানি না সেই আমার প্রথম কাব্যচিন্তার স্ফুরণ কিনা। তবে সেই আমার শেষ বেতার স্পর্শ। যে শিশু গান শুনতে গিয়ে নব উল্টো দিকে ঘুরিয়ে ভেঙে ফেলে, তার হাতে যন্ত্র নিরাপদ নয়।

খালি গলার গানে অবশ্য কোনও বাধা নিষেধ ছিল না। গলা ছিল নতুন আর তেজালো, সুরও মন্দ নয়। তাও নিজের লেখা গান। কবিতাও বলতাম জোরে জোরে। বাবা মা লক্ষ্য করলেন, নড়েচড়ে বসলেন এবং সেইসব কবিতা লেখা হতে লাগল কাগজে। আমাকে অক্ষর লেখা শিখিয়ে দিলে যে আমি নিজেই লিখে ফেলতে পারি, তা বড়দের কারও খেয়াল হয়নি, আমারও না। ঐ সময় একবার আমরা পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। বাবা, মা, দাদারা ছাড়াও নববিবাহিত মামা-মামিমা। মনে পড়ে, রাতের ঘুমের মধ্যেও ঢেউয়ের নিরন্তর আসা যাওয়া; স্নানের বেলা, ঢেউ যখন পিছনে হাঁটে, পায়ের তলা থেকে বালি সরে যেতে থাকে, ছটফটিয়ে জল ছেড়ে উঠে আসতে চায় রাঙা কাঁকড়ার দল। লবণমাখা বাতাস জড়িয়ে যায় সারা দেহে। কলের নীচে স্নান করেও বালি আর লবণ সঙ্গ ছাড়তে চায় না। কলকাতায় ফিরেও বিছানায় ট্রেনের দোল আর সমুদ্রের গান। কলকাতার এত কাছে এমন এক ভৌগোলিক বিস্ময়, বহুবার তা অনুভব করেছি। দিঘা তখনও আমাদের চেতনায় সমুদ্র শহর বলে চিহ্নিত হয়নি। পুরীর সমুদ্রের প্রথম দর্শনে শিশুমনে যে কলরোল জেগে উঠেছিল, তার অভিঘাতে বলা হল কিছু কবিতা। লেখা নয় অবশ্য,মনের মধ্যে নিয়ে ফিরে আসা। যতদূর মনে পড়ে, দাদারা কেউ কলকাতায় এসে খাতায় লিখে দিয়েছিলেন, সমুদ্র সংক্রান্ত কবিতাবলি। খুবই অকিঞ্চিৎকর লেখা। ক্ষুদ্র-র সঙ্গে সমুদ্রের অন্ত্যমিল। এখন ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

হাজরা মোড়ের যে হাতটা কালীঘাট ব্রিজের দিকে গেছে , তার ওপরেই হাজরা পার্কের পাশে আমরা থাকি। দশাসই লম্বাটে একটা বাড়ি, যার নীচে বসে ক্ষীরোদ ঘোষের বাজার। একশোখানার মতো ফ্ল্যাট। নীচে তিনখানা গেট। তিনটে সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। এত গলিঘুঁজি আর বাঁক এক এক তলায়, যে বাইরে থেকে অতিথি এলে পথ হারাবেই। নীচে নেমে মোড় পার হয়ে উল্টোদিকের ফুটপাথে ঢাকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। তার দেওয়ালে খবরকাগজ ও ম্যাগাজিনের দোকান। সন্দেশ, শুকতারা, শিশুসাথী  সব পাওয়া যেত ওখানে। সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় তখন সন্দেশ  পত্রিকার সম্পাদক। সম্ভবত সম্পাদকদের নাম দেখেই বাবা-মায়ের সন্দেশ  পছন্দ হয়েছিল। ১৯৬১ সালের পুজোর আগে মুখে মুখে বলা আমার এক শরৎকালীন কবিতা বাবা হাতে লিখে পাঠিয়ে দিলেন পত্রিকার অফিসে। লিখতে ভোলেননি, কবির বয়স পাঁচ। উত্তরে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে লেখা একখানি পোস্টকার্ড এল। প্রচুর প্রশংসা করে লিখেছেন, অনিতা নিশ্চয়ই বড় হয়ে খুব ভাল লিখবে। তবে সন্দেশ পত্রিকা গ্রাহকদের লেখাই ছাপে কেবল, হাত পাকাবার আসর বিভাগে। সেই আমার জন্য প্রথম সম্পাদকের চিঠি। তাও এক মস্তবড় কবি সম্পাদকের। তখনও গ্রাহক হইনি। কাজেই কবিতাটি ছাপা হল না।

কিন্তু, ১৯৬১-২০১২ পাক্কা ৫১ বছর আমার মা ঐ পোস্টকার্ডটি সামলে রেখেছিলেন, পাছে হারিয়ে ফেললে কবির ভবিষ্যদ্বাণী বিফল হয়। এমনকি একদা যখন আমি বিদেশে, পোস্টকার্ড, আমার কয়েকটা বই ও একবাক্স মিষ্টি নিয়ে মা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখাও করে এসেছিলেন। বাঙালি মায়েরা অপ্রতিরোধ্য! যাবার বেলায় পোস্টকার্ডটি আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। যত্নে রাখিস, এই বলে। আমি এমন যত্নে রেখেছি যে তা হারানোরই সামিল। তবে এখন আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি না হবার আশঙ্কাটা নেই।

কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।

8 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *