পিকনিক শব্দটিকে বাংলায় বনভোজন, চড়িভাতি, চড়ুইভাতি, পৌষালি ইত্যাদি নানা নামে ডাকা হয়। তবে বাংলায় প্রতিটি শব্দের ব্যঞ্জনা ভিন্ন ভিন্ন। বনভোজনের আক্ষরিক মানে কিন্তু বনে ভোজন, আবার রবীন্দ্রনাথের ‘চড়িভাতি’ কবিতায় পাওয়া যায়— “একটি দিনের মুছল স্মৃতি, ঘুচল চড়িভাতি,/ পোড়াকাঠের ছাই পড়ে রয়, নামে আঁধার রাতি।” এই চড়িভাতি বা চড়ুইভাতি আবার বনভোজন হয়ে যাচ্ছে কবি গোলাম মোস্তফার কবিতায়।

কেউ বা বসে হলদি বাটে কেউ বা রাঁধে ভাত,
কেউ বা বলে ধুত্তোরি ছাই পুড়েই গেল হাত।

আমাদের দেশে চড়ুইভাতি কবে শুরু হয়েছে তার কোনও ইতিহাস পাওয়া যায় না। পরম্পরা এবং পুরাণ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়, তবে সে সবের ঐতিহাসিক ভিত্তি বেশ দুর্বল। অনেকে মনে করেন, ইংরেজরা ভারতে আসার পর থেকে যথার্থ অর্থে পিকনিক বা বনভোজন শুরু হয়। কেউ কেউ বলেন, পিকনিক আসলে ফরাসিদের আবিষ্কার। টনি উইলিসের বইতে সপ্তদশ শতকে পিকনিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইংরেজি ‘পিক’ শব্দ এসেছে কথ্য ‘পেক’ শব্দ থেকে যার অর্থ খুঁটে খাওয়া। আর ’নিক’-এর মানে তুচ্ছ বা মূল্যহীন বস্তু। পিকনিকের বাংলা তাই চড়ুইভাতি। 

কিন্তু বনভোজন কেন? ‘বন’ এখানে বাহির। ঘরের খেয়ে বহু লোক যেমন বনের মোষ যেমন তাড়ায়, এখানে সেই রকম ‘বন’ শব্দের ব্যবহার। বাড়ির বাইরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া, তবে তা রেস্তোরাঁয় হলে চলবে না। ইউরোপে সাধারণত পিকনিক হয় গ্রীষ্মকালে, প্রচণ্ড ঠান্ডায় পিকনিক হয় না। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে, বাংলায় বললে আরও যথার্থ হয়, বনভোজন বা চড়িভাতি হয় শীতকালে। উপমহাদেশের গরমে বাইরে বেরিয়ে পিকনিক করা বেশ অসুবিধেজনক। নদীর পাড়ে কিংবা কোনও উদ্যানে এই বনভোজন হয়। আর সেই পিকনিক যদি জলাশয় বা হ্রদ, পর্বত, উদ্যান এই তিনের মিশেল অধিকরণে হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই।

এমনই পিকনিকের একটি উদাহরণ পাওয়া যায় মহাভারতে। স্থান রৈবতক। গুজরাতে জুনাগঢ় শহরের আধ মাইল পূর্বে প্রাচীন সুদর্শন হ্রদের তীরে পৌরাণিক রৈবতক। কাশীরাম দাস লিখছেন, “রৈবতক যত গিরি গিরি মুনি শিল। কামগিরি খণ্ডগিরি গিরিরাজ নীল।।” এ হেন গিরি সমাকীর্ণ অরণ্য ও হ্রদের কাছাকাছি পিকনিক হচ্ছে। এই পর্বতটি ছিল সে সময় অনর্ত রাজবংশের অধীনে। সেখানে বাস করেন দেবতারা। দ্বারকার মানুষ সেখানে নিয়মিত আসেন এবং উৎসব, আনন্দ করেন। তাঁরা ধর্মীয় আচার হিসাবেই বনভোজনও করে থাকেন। এই রৈবতক পর্বত এখনকার গিরনার পাহাড়। এখানেই কৃষ্ণ তাঁর অগণিত স্ত্রীদের সঙ্গে বনভোজন করতেন। ভবিষ্যপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও বরাহপুরাণ অনুসারে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তরুণী পত্নীরা এই স্থানে কৃষ্ণপুত্র শাম্বের প্রতি অনুরক্ত হন। হ্রদে স্নান, পাহাড়ে ভ্রমণ, পানভোজন ইত্যাদির মধ্যেই একজন কৃষ্ণপত্নী, তাঁর নাম নন্দিনী, তিনি শাম্বের পত্নী লক্ষ্মণার মতো বেশভূষা ধারণ করে শাম্বের সামনে এলেন। লক্ষ্মণা আবার দুর্যোধনের কন্যা। নন্দিনী লক্ষ্মণার মতো সেজেগুজে ছদ্মবেশে শাম্বকে আলিঙ্গন করলেন। বনভোজনের আনন্দ আর নিছক আনন্দ থাকল না। সেই খবর ঢেঁকি চড়ে চলে এল ভগবান কৃষ্ণের কাছে। কে নিয়ে এলেন? সেই বীণাবাদক নারদ! মহাভারত অনুযায়ী, এই সংবাদ শুনে কৃষ্ণ নিজের পুত্রকে কুষ্ঠরোগের অভিশাপ দিলেন আর তরুণী পত্নীদের বললেন, স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁরা দস্যুদের দ্বারা লাঞ্ছিত হবেন। সূর্যের উপাসনা করে দুর্যোধনের জামাইয়ের রোগ সেরেছিল, কিন্তু ওই কৃষ্ণপত্নীদের লাঞ্ছনামুক্তি ঘটেনি। 

‘বন’ এখানে বাহির। ঘরের খেয়ে বহু লোক যেমন বনের মোষ যেমন তাড়ায়, এখানে সেই রকম ‘বন’ শব্দের ব্যবহার। বাড়ির বাইরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া, তবে তা রেস্তোরাঁয় হলে চলবে না। ইউরোপে সাধারণত পিকনিক হয় গ্রীষ্মকালে, প্রচণ্ড ঠান্ডায় পিকনিক হয় না। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে, বাংলায় বললে আরও যথার্থ হয়, বনভোজন বা চড়িভাতি হয় শীতকালে। উপমহাদেশের গরমে বাইরে বেরিয়ে পিকনিক করা বেশ অসুবিধেজনক।

চড়ুইভাতির এমন করুণ পরিণতি নিশ্চয় কাম্য হতে পারে না। ঊনবিংশ শতকের বাংলা অভিধানসমূহে কিন্তু বনভোজন বা চড়ুইভাতির উল্লেখ নেই। বিংশ শতকের শুরুতে সুবল মিত্র তাঁর অভিধানে দু’টি শব্দকেই স্থান দিয়েছিলেন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন বা হরিচরণের অভিধানে শব্দ দু’টিকে পাওয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু তাদের অর্থ দু’টি ডিকশনারিতেই ‘পিকনিক’ বলা হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘শব্দসংগ্রহ’ নামক সঙ্কলনে ‘চড়ুইভাতি’ শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু ‘বনভোজন’ শব্দটি সেখানে অনুপস্থিত। নগেন্দ্রনাথ বসুর অভিমত হল, বনভোজন আমাদের দেশে ধর্মীয় আচার হিসাবেই প্রচলিত। ওলাবিবির পূজা দিয়ে বনভোজনের রীতি ছিল এ দেশের নিয়মিত বাৎসরিক অনুষ্ঠান। 

ওলাবিবি কে? তিনি মুসলমানের ওলাবিবি হলেও হিন্দুর ওলাইচণ্ডী। ওলাবিবির আগমন ভাল কথা নয়। তিনি জনপদে প্রবেশ করলে কলেরা-ওলাওঠা হবেই। যে কোনও প্রকার মহামারীর জননী তিনি। তাই তাঁকে পুজো দিয়ে দূরে দূরে রাখতে হয়। ওলা বিবি, কোথাও বনবিবিকে খাবারের অগ্রভাগ উৎসর্গ করে গ্রামের লোক খাদ্যগ্রহণ করতেন। আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে অবধি বাগানে কিংবা পুকুরের ধারে ওলাবিবিকে অর্চনা করে গোটা গ্রামের লোক বনভোজন সারতেন। এক থালা খেয়ে এবং এক থালা বাড়ি নিয়ে এসে সেই উদযাপন শেষ হত। খাবার নয়, তা ছিল প্রসাদ। সাধারণত পৌষমাসে ধান ওঠার পর এই পিকনিক হত। সেই জন্য গ্রামেগঞ্জে পিকনিকের অন্য নাম পৌষালি, পুষালি, পোষালি। 

নবাব-মহারাজাদের পিকনিক অবশ্য অন্য ধাঁচের ছিল। কলকাতার গার্ডেনরিচ অঞ্চলে জোরদার বনভোজন হত। আবার পিকনিক গার্ডেন কিংবা দমদমের পিকনিকও সুবিদিত। ১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিয়া আসা যাক।” গার্ডেনরিচ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে মেটিয়াবুরুজে একটা সময় বাঙালিবাবুরা পিকনিক করতে যেতেন। এই অঞ্চল ছিল অভিজাতদের বাগানবাড়িতে পূর্ণ। গভর্নর জেনারেল বা বড় লাটের বাগানবাড়ি থেকে বর্ধমানের ক্ষত্র রাজা মহাতব চাঁদের প্রমোদ উদ্যান ছিল এই অঞ্চলে। পরে অবশ্য সে সবের পরিবর্তন হতে থাকে। যে বছর ওয়াজিদ আলি শাহ ইন্তেকাল করলেন তারপর থেকে এই তল্লাটে ফিস্টের আয়োজন দ্রুত বৃদ্ধি পেতে লাগল। অভিজাত বাঙালিবাবু, গোরা সাহেব আর কিছু নাবিক মিলে সেই সব পিকনিক শেষমেশ মোচ্ছবের আকার ধারণ করত। মদ, মাংস আর মেয়েমানুষ নিয়ে গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িতে চলত সারা দিন ধরে হুল্লোড়। কখনও গজ়ল, কখনও বা ইউরোপীয় সঙ্গীত সেই আসরে মূর্চ্ছনা তুলত। 

এছাড়া শোভাবাজার রাজবাড়িতেও বসত আসর। তাকে অবশ্য পিকনিক না বলে গ্র্যান্ড ফিস্ট বলাই সঙ্গত। মেটিয়াবুরুজে ওয়াজিদ আলি শাহের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যেমন পিকনিক-উৎসব চালু হল, তার ঠিক একশো বছরেরও বেশি আগে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজের পতন ও তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শোভাবাজারে আরম্ভ হয়েছিল ইংরেজ সাহেব ও ব্রিটিশ রাজভক্ত বাঙালি বাবুদের পিকনিক। মেনু হিসাবে গোরু, শুয়োর, মদ্য সবকিছুই থাকত সেখানে।

নবাব-মহারাজাদের পিকনিক অবশ্য অন্য ধাঁচের ছিল। কলকাতার গার্ডেনরিচ অঞ্চলে জোরদার বনভোজন হত। আবার পিকনিক গার্ডেন কিংবা দমদমের পিকনিকও সুবিদিত। ১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিয়া আসা যাক।” গার্ডেনরিচ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে মেটিয়াবুরুজে একটা সময় বাঙালিবাবুরা পিকনিক করতে যেতেন। এই অঞ্চল ছিল অভিজাতদের বাগানবাড়িতে পূর্ণ। গভর্নর জেনারেল বা বড় লাটের বাগানবাড়ি থেকে বর্ধমানের ক্ষত্র রাজা মহাতব চাঁদের প্রমোদ উদ্যান ছিল এই অঞ্চলে।

তবে ছোটবেলায় গ্রামে-গঞ্জে যে সব বাচ্চারা চড়ুইভাতিতে মাতে, রবি ঠাকুরের ভাষায় চড়িভাতি, তাতে কিন্তু নিজের নিজের বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসে ভাগ করে খাওয়া হত। একটু বড় যারা, অথচ ছোট (মানে ওই দশ-বারো বছর বয়সী) তারা বাড়ি থেকে চাল-ডাল-ডিম-আলু ও মশলা নিয়ে আসত। পাঁচ বাড়ির ডাল চাল ও বাসনকোসন নিয়ে কাঁচা হাতের রান্না হত। তাতে স্বাদ কী হত, বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু রান্নার এবং ‘বড়’ হওয়ার আনন্দ খাবারের স্বাদকে ছাপিয়ে যেত। একই চিত্র আমরা আমেরিকায় দেখতে পাই। সেখানে এই পিকনিককে বলা হচ্ছে potluck। নিজেরা নিজেরা খাবার এনে ভাগাভাগি করে পার্কে বসে খাওয়া হয়। 

বনভোজন বা পিকনিকের সঙ্গে ধর্মীয় আচারের যেমন যোগ আছে তেমনি যুদ্ধ-বিপ্লবের সঙ্গে তার সংযোগ নেহাত কম নেই। ফরাসি বিপ্লবের পর জাতীয় উদ্যানগুলি সাধারণ জনগণের পিকনিকের জন্য প্রথম খুলে দেওয়া হয়। ঊনবিংশ শতকে দেখতে পাই, লন্ডনের অভিজাতরা মিলে পিকনিক সোসাইটি তৈরি করছেন।

পিকনিক ভাল। কিন্তু একটানা পিকনিক কদ্দিন চলে? চলতেই পারে, সেটা যদি হয় মানবজন্ম। একজন দার্শনিকের পর্ণকুটিরে গিয়েছিলেন কয়েকজন মানুষ, যাঁরা সেই অঞ্চলে পিকনিক করতে গিয়েছিলেন। আগ্রহের বশে দার্শনিকের ঘরে গিয়ে তাঁরা অবাক। দেখেন সামান্য একটি জলের কুঁজো, শতরঞ্জি আর সামান্য কিছু বাসন সেই আবাসে। ‘এত অল্প জিনিস নিয়ে চলে কী করে আপনার?’ এমন প্রশ্নের জবাবে সেই চিন্তাবিদ বলেন, আপনাদের কাছেও তো স্বল্প জিনিসপত্র। তাঁরা জানালেন যে তাঁরা তো পিকনিকে এসেছেন, আবার ফিরে যাবেন। দার্শনিক চটজলদি বলে উঠলেন, তিনিও পিকনিকে এসেছেন, একদিন ফিরে যাবেন মহাকালের কাছে।

শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *