ফিরে আসি ১৯৯০ সালে। জনি লিভার তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, বিশ্ব পরিক্রমা করছেন, কিন্তু দুটো ব্যাপার তখনও ছিল। এক, জনি লিভারকে দেখে কিন্তু একটা বৃহত্তর ভারতীয় প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হয়নি স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে আসার জন্য। দুই, জনি লিভারের একটা বড়, সম্ভবত প্রধান অস্ত্র ছিল মিমিক্রি। সত্যি বলতে কি, মিমিক্রিকে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানরা খানিকটা নিচু চোখেই দেখেন। যে কারণেই হোক, বিশ শতকের শেষ দশকে স্ট্যান্ড-আপ কমেডির ক্ষেত্রে একটু ভাটা পড়ে।

Johny Lever
প্রথম যৌবনে জনি লিভার, তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ছবি সৌজন্য: wikipedia

এবার এগিয়ে যাই ১০-১২টা বছর। ২০০৫ সালে ভারতীয় টেলিভিশনে প্রথমবার সম্প্রচারিত হয় ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ’। এখন ভাবলে নভজ্যোৎ সিধুর হাত ছোড়া, অর্চনা পূরণসিংহের হাসি, হয়তো একটু মোটা দাগের মনে হয়, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য, যে ভারতের নবীন প্রজন্মকে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে উদ্বুদ্ধ করার পিছনে এই শো-টির ভূমিকা ছিল প্রায় বৈপ্লবিক। সুনীল পাল, রাজু শ্রীবাস্তব, কপিল শর্মারা সত্যিই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পথপ্রদর্শক। এই শোয়ের তাৎক্ষণিক প্রভাব ছিল মূলত দুটো। প্রথমত, এই প্ল্যাটফর্মে পরিচিতি পাওয়া কমেডিয়ানরা সিনেমায়, টিভিতে নাম করতে শুরু করেন। যেমন রাজু শ্রীবাস্তব। দ্বিতীয়ত, এই শোয়ের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, অনেকে শুরু করেন নিজেদের কমেডি শো। বাঙালিদের কাছে পরিচিত এর দুটি বৃহত্তম উদাহরণ, কপিল শর্মার কমেডি নাইটস এবং বাঙালির অতি প্রিয় মীর সঞ্চালিত মীরাক্কেল। বাংলার কমেডির বিবর্তন এই লেখার উপজীব্য নয়, তাই মীরকে নিয়ে পরে আরো বিশদে আলোচনার ইচ্ছা রইল।

stand up comedy

এই সময়ের চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রযুক্তিগত যে প্রথম বিপ্লব ভারতের কমেডিকে এক ধাক্কায় পৌঁছে দেয় ঘরে ঘরে, তার নাম সোশ্যাল মিডিয়া। তৎকালীন ইউটিউব এবং ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে রাতারাতি বিখ্যাত হতে শুরু করেন বিশ্বকল্যাণ রথ, তন্ময় ভাট, কনন গিল, অদিতি মিত্তল, কেনি সেবাস্টিয়ানরা। তবে শুধু প্রচারের কারণে নয়, ইউটিউব, এবং পরবর্তীকালে আমাজ়ন প্রাইম, নেটফ্লিক্সের মতো ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মগুলি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অন্য একটি কারণে। কিন্তু সে কথায় যাওয়ার আগে আর একজনের নাম এখানে করা খুব জরুরি। তিনি অমর আগরওয়াল। আমেরিকা ফেরত এই ধনী স্ট্যান্ড-আপ প্রেমী মুম্বইতে শুরু করেন ‘ক্যানভাস লাফিং ক্লাব’। নতুন স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানরা এখানে আধুনিক দর্শকদের সামনে পারফর্ম করার সুযোগ পেতেন প্রতিনিয়ত। কমেডির জগতে এর নাম ‘ওপেন মাইক।’ নতুন কমেডিয়ানদের পক্ষে এই অভিজ্ঞতা ও পরিচিতির মূল্য অপরিসীম। পরবর্তীকালে এরকম বহু সংস্থা তৈরি হলেও ক্যানভাস এ বিষয়ে প্রায় পথিকৃৎ এবং, বিশ্ব, কনন, তন্ময়, ইত্যাদি বহু কমেডিয়ানের মঞ্চস্থ কমেডিতে পদার্পণ এখান থেকেই।

Raju Srivastav
দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান লাফটার চ্যালেঞ্জ জিতে রাজু শ্রীবাস্তব ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েন। ছবি সৌজন্য: economictimes

আরও একটা জিনিস এখানে মনে রাখা জরুরি। স্ট্যান্ড-আপ কমেডির পরিণত হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত — তার দর্শকদের পরিণত হওয়া। আধুনিক স্ট্যান্ড আপে কমেডিয়ানের একটা প্রধান অস্ত্র নিজেকে এবং দর্শকদের নিয়ে ব্যক্তিগত রসিকতা করা। তাই নিজেকে নিয়ে রসিকতা নিতে এবং তার ভিতরের মজাটা উপভোগ করতে পারাটা দর্শকদের অবশ্যকর্তব্য। দর্শকদের সেই শিক্ষাও সুগম হয় এই ওপেন মাইকে, বিভিন্ন কমেডিয়ানদের উপস্থাপনা দেখার সুবাদে।

এবার আসি কমেডির ক্ষেত্রে ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মগুলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটিতে — সেটি অর্থনৈতিক। দীর্ঘদিন ভারতে নবীন প্রজন্ম স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে আসতে আকৃষ্ট হয়নি, তার একটা বড় কারণ উপার্জনের অনিশ্চয়তা। কিন্তু ইউটিউবে বিনা লগ্নিতে যে কেউ খুলতে পারেন নিজের চ্যানেল, এবং জনপ্রিয় হলে সেই লাইক বা হিটের পথেই লক্ষ্মীলাভ। আবার সেই জনপ্রিয়তার মাধ্যমেই খুলতে পারে প্রাইম বা নেটফ্লিক্সের শোয়ের দরজা, যেখানে টাকার অঙ্কটাও অনেক বেশি। প্রাইমের ‘কমিকস্তান’ বলে প্রতিযোগিতায় পুরস্কার ছিল দশ লক্ষ টাকা, এবং প্রতিযোগীদের অনেকেই তার আগে ছিলেন শখের কমেডিয়ান। অবশ্য এই প্রচারের ফলে এখন মঞ্চেও ছবিটা অনেক পাল্টেছে। একটি এক ঘণ্টার কমেডি শোয়ে টিকিটের দাম ৫০০-১০০০ টাকা। নামীদামিদের ক্ষেত্রে অঙ্কটা ৩০০০-৪০০০ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। শোয়ে দর্শকসংখ্যা ৫০ থেকে শুরু করে হতে পারে ২৫০-৩০০ পর্যন্ত। হল, আলো, শব্দ, বিজ্ঞাপন, এজেন্টের কমিশন ইত্যাদি বাদ দিয়ে শো পিছু একজন মোটামুটি সফল কমেডিয়ানের আয় অন্তত ৫০০০০-৬০০০০ টাকা। মাসে তিন চারটে শো করলেও লাখ দুয়েকের মতো মাসিক রোজগার। এই সব কারণে এখন নবীন প্রজন্মের একটা বড় অংশ শখে নয়, পুরোদস্তুর পেশাদারিভাবে ঢুকছেন এই ক্ষেত্রে। এবং এই কারণেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে কমেডির বিভিন্ন শাখায়, বিভিন্ন ধরনের কমেডিয়ান খুঁজে পাচ্ছেন তাঁদের নিজস্ব কণ্ঠ।

Aditi Mittal and Kaneez Surka
অদিতি মিত্তল এবং কনিজ় সুরকা মহিলা স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ছবি সৌজন্য: dnaindia

একদিকে অ্যানেকডোট্যাল কমেডির ক্ষেত্রে যেমন জাকির খান গল্প বলার ছলে জয় করে নিচ্ছেন দর্শকমন; অন্যদিকে ইম্প্রোভ কমেডির ক্ষেত্রে কনিজ় সুর্কা গড়ে তুলছেন তাঁর উপস্থাপনা বা ‘রুটিন’, দর্শকদের সাহায্য নিয়ে; একদিকে কেনি সেবাস্টিয়্যানের গান আর গিটারের সঙ্গত সমৃদ্ধ করছে স্কিট কমেডিকে, আবার অন্যদিকে অবজারভেশনাল কমেডি, যা কিনা এই ধারাগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরনো, সেখানে বিশ্বকল্যাণ রথ, কনন গিল, তন্ময় ভাট, প্রমুখ যেমন পরিণত করে চলেছেন নিজেদের, তেমনই উঠে আসছেন অভিষেক উপমন্যু, রাহুল দুয়া, নিশান্ত সুরি, আকাশ গুপ্তার মতো বহু অসম্ভব প্রতিভাধর নতুন মুখ। আর রাজনৈতিক বা পলিটিক্যাল কমেডির কথা তো আলাদা করে বলতেই হয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক পটভূমিকায় তা নিয়ে হাস্যকৌতুক করতে যতখানি বুদ্ধি লাগে, ততখানিই লাগে সাহস। বরুণ গ্রোভার, কুণাল কামরা ইত্যাদি ভারতের প্রথম সারির পলিটিক্যাল কমেডিয়ানদের বক্তব্যের সঙ্গে আপনি একমত হোন বা নাই হোন, তাঁদের বক্তব্য উপেক্ষা করা অসম্ভব।

দীর্ঘদিন ভারতে নবীন প্রজন্ম স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতে আসতে আকৃষ্ট হয়নি, তার একটা বড় কারণ উপার্জনের অনিশ্চয়তা। কিন্তু ইউটিউবে বিনা লগ্নিতে যে কেউ খুলতে পারেন নিজের চ্যানেল, এবং জনপ্রিয় হলে সেই লাইক বা হিটের পথেই লক্ষ্মীলাভ। আবার সেই জনপ্রিয়তার মাধ্যমেই খুলতে পারে প্রাইম বা নেটফ্লিক্সের শোয়ের দরজা, যেখানে টাকার অঙ্কটাও অনেক বেশি।

এর আরও একটা প্রশংসনীয় দিক আছে। অদিতি মিত্তলের মতো ভারতীয় স্ট্যান্ড-আপ কমেডির ক্ষেত্রে যাঁরা প্রথম মহিলা, তাঁদের সম্ভবত একটা আদ্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক তৃতীয় বিশ্বের সমাজে নিজেদের কণ্ঠ তুলে ধরতে অনেক বেশি জোর দিতে হয় যৌনতাভিত্তিক কন্টেন্ট, বা ইভটিজিং, গার্হস্থ্য হিংসা ইত্যাদি বিষয়ে। আশার কথা এই, যে এখন বহু পুরুষ কমেডিয়ান যেমন অত্যন্ত সহজভাবে এই বিষয়গুলি তুলে আনছেন নিজেদের রুটিনে, তেমনই অদিতি মিত্তল, নীতি পাল্টা, উরুজ আশফাক ইত্যাদিরা নারীনির্ভর ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে বিচরণ করছেন স্বচ্ছন্দে, যা সমৃদ্ধ করছে তাদের রুটিন।

সুতরাং ভারতের স্ট্যান্ড-আপ কমেডির কূলে আপাতত ভরা জোয়ার। এখন এই জোয়ারের পর কি শুধু পড়ে থাকবে পাড়ের ভাঙা বালি, নাকি রেখে যাবে ঝিনুকে লুকনো কালজয়ী দুষ্প্রাপ্য মুক্তো, সে উত্তর রয়েছে কেবল মহাকালের কাছে।

 

তথ্যসূত্র : এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা,
উইকিপিডিয়া, কমেডিয়ান্স ইন কারস,
নেটফ্লিক্স, অ্যামাজ়ন প্রাইম, ইউটিউব, ট্রান্সফিন।

পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিতিবিরক্ত হতে হতেও আইটি শিল্পতালুকে মজদুরি করতে বাধ্য হন। কিন্তু সবচেয়ে পছন্দের কাজ হাতে মোবাইলটি নিয়ে আলসেমি করে শুয়ে থাকা। চেহারাছবি নিরীহ হলেও হেব্বি ভালোবাসেন অ্যাকশন ফিলিম, সুপারহিরো আর সাই ফাই। সঙ্গে চাই সুরেশের রাবড়ি, চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা-পান্তুয়া, কেষ্টনগরের সরভাজা ইত্যাদি নানাবিধ মিষ্টান্ন।

One Response

  1. অনেক তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ লেখাটির দুটি পর্ব। অনেক কিছু জানা গেল। কিন্তু বাংলা কমেডি শো নিয়ে কেবল মীরাক্কেলের নাম করে “পরে বিশদ আলোচনা করা যাবে” বলে ছেড়ে দিলেন।তা না হয় হোল। কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বা জহর রায়ের নাম উচ্চারণই করলেন না কেন, বুঝলাম না। এঁ্ররা দুজন এককভাবে বা কখনও কখনও যুগলে প্রচুর কমেডি শো করেছেন। যার জনপ্রিয়তা ছিল প্রশ্নাতীত। তবে কি সেগুলো ইদানিংকার স্ট্যান্ডআপ কমেডির গোত্রভুক্ত নয়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *