তখনও কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরবার ঢালাও চল হয়নি এ দেশে। ঠাকুরবাড়ির হাত ধরে সবে সবে শুরু। বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ আইন আর মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন বটে, কিন্তু বাংলাদেশে তার পরিপূর্ণ সুফল ভোগ করার মতো অনুকূল সামাজিক অবস্থা তৈরি হয়নি। কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরে তখনও অবাধে চলছে গৌরিদান। অকালবৈধব্যের যন্ত্রণা সইতে না-পেরে উপোসী নিপীড়িত মেয়েদের দল নাম লেখাতে বাধ্য হচ্ছে গণিকাবৃত্তিতে। মেয়েদের মানুষ বলে গণ্য করারই দায় বোধ করছেন না সমাজের অধিকাংশ পুরুষ, এমনকি নারীও। কাজেই নারীবাদ বলে কোনও মতবাদ যে দূরতম দিগন্তেও ছিল না, সে কথা বোধ করি না বললেও চলে।

বিশ শতকের সূচনালগ্নে নারীর এহেন চূড়ান্ত অবমাননাকর অবস্থা বড় বেজেছিল এক নারীর বুকে। শপথ করেছিলেন, নারীদের উন্নতিকল্পে আমৃত্যু কাজ করে যাবেন। সেই শপথের মান রাখতে গিয়ে চোখে ঠুলি পরা সমাজের হাজার বাধা, লক্ষ কুসংস্কার, অযুত শেকল তাঁর পা টেনে ধরেছে। তাঁকে রক্তাক্ত করেছে বারবার। তিনি ছিলেন মুসলমানের মেয়ে। তাই ধর্মান্ধতার জিগির তুলে তাঁর পথরোধ করার অজস্র চেষ্টা করেছে অন্ধ মোড়লের দল। কিন্তু থামাতে পারেনি তাঁর স্পর্ধিত জয়যাত্রা, তাঁর অনমনীয় কর্মধারা। বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হুসেন যেমন গতিতে কলম চালিয়েছেন, তেমনই দুর্বার গতিতে চলেছে তাঁর সমাজ-সংস্কার, শিক্ষার প্রসার, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর অধুনা বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবাঁধ গ্রামে এক মুসলমান দম্পতির ঘরে জন্ম নেন রোকেয়া। বাবা জাহিরুদ্দিন আবু আলি হায়দর সাবের ছিলেন সরকারি চাকুরে। জমিজমারও অভাব ছিল না। আরবি থেকে উর্দু-ফার্সি, ইংরেজি থেকে হিন্দি সবেতে পারদর্শী ছিলেন জাহিরুদ্দিন। তাঁর চার স্ত্রীয়ের মধ্যে রাহাতুন্নেসা চৌধুরানির গর্ভে জন্মায় তিন পুত্র ও দুই কন্যা। রোকেয়া তাঁদেরই একজন। রাহাতুন্নেসা গোপনে চেয়েছিলেন তাঁর মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে। কিন্তু বিদ্বান বাবা সমাজের নিয়মেই চলতে চাইলেন। তিন ছেলেকে ইশকুলে পাঠালেও দুই মেয়েকে বাড়িতেই বন্দি রাখলেন। কিন্তু উড়ান যার মনের ডানায়, লোহার শেকল তার কী করবে? দাদাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে হাত করে বাড়িতে বসেই পাঠশালার পাঠ শুরু করে দিলেন রোকেয়া। ইংরেজি আর বাংলার অক্ষরজ্ঞান, ফার্স্ট বুক, হাতের লেখা মকশো করা, অন্দরমহলেই রপ্ত করে ফেললেন। দাদারা অবাক! বোনকে উৎসাহ দিতে লাগলেন লুকিয়ে চুরিয়ে – লিখে যা তুই! কাকপক্ষীতেও টের পাবে না! ইতিমধ্যে বাবা জোগাড় করে আনলেন এক আরবি শেখানোর মাস্টার। মেয়েদের কোরান পড়াতে হবে যে! কাজেই ঘরে বসে তিন ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠতে লাগলেন রোকেয়া। আর পড়তে পড়তেই টের পেতে থাকলেন অশিক্ষা আর দাসত্বের কোন অতলে পড়ে রয়েছেন মেয়েরা, বিশেষত মুসলমান মেয়েরা। পুরুষের হাতের পুতুল হয়ে কালো পর্দার অন্তরালে জীবন কাটানোর জন্যই যে মেয়েদের জন্ম, এ কথা বোঝাবার লোকের সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না। কাজেই হাত গুটিয়ে বসে থাকার আর সময় নেই।

ইতিমধ্যে আঠারো বছর বয়সে (১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ) ৩৮ বছর বয়সী বাহাদুর শেখাওয়াত হুসেনের ঘরণী হলেন রোকেয়া। ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শেখাওয়াত ছিলেন উর্দুতে পণ্ডিত। এবং উদারমনস্ক। স্ত্রীয়ের বিদ্যাচর্চায় আগ্রহ দেখে তিনি তাঁকে এগিয়ে দিলেন সেই পথেই। বাধা না-হয়ে, হয়ে উঠলেন রোকেয়ার পালের হাওয়া। ১৯০২ থেকে পুরোদস্তুর সাহিত্যচর্চা এবং সমাজ সংস্কারের কাজে মনোনিবেশ করলেন রোকেয়া। পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত, অপাংক্তেয় যে সামাজিক জীবটি সমাজের অর্ধেক আকাশ হয়েও সদা-অন্ধকারে নিমজ্জিত, তাদের জন্য শিক্ষার মশাল জ্বালাবার ব্রত নিলেন। মেয়েদের ন্যূনতম শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যাতিরেকে যে নারীমুক্তি আন্দোলন অসম্ভব, যে দাবি আজও মানবীবিদ্যার গবেষক-অধ্যাপকদের জোর গলায় বলে চলতে হয়, সে কথা আজ থেকে একশো-সোয়াশো বছর আগে উপলব্ধি করে সেই লক্ষ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছিলেন রংপুর থেকে ভাগ্যের ফেরে কলকাতায় আসা তরুণী মেয়েটি। ছোট ছোট প্রবন্ধ দিয়ে লেখার কাজ শুরু করে ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গদ্য সংকলন মতিচুর। সেখানে সৌর জগৎ থেকে শুরু করে মারি কোরেলির উপন্যাসের অনুবাদ, সবই ঠাঁই পেয়েছিল। নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছিল মেয়েদের লেখাপড়ায়।

কিন্তু ১৯০৫ সালে ইংরেজি ভাষায় যে বইটি রচনা করলেন রোকেয়া, তার তুল্য চমকপ্রদ গদ্য সে যুগ তো বটেই, এ যুগেও খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। বইয়ের নাম, ‘সুলতানা’জ ড্রিম’। প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন’ পত্রিকায়। পরে বই আকারে বেরোয়। গল্পের মুখ্য চরিত্র সুলতানার স্বপ্নের মাধ্যমে রোকেয়া রচনা করেন এক নারীতান্ত্রিক ইউটোপিয়ান সমাজ, যার নাম ‘লেডিল্যান্ড।’ সেখানে পুরুষেরা পর্দানশীন। নারীরা মুক্ত, স্বাধীন। গল্পের ছত্রে ছত্রে অত্যুন্নত, সেকালে প্রায় অকল্পনীয় সব প্রযুক্তির অনুপুঙ্খ বর্ণনা রচনাটিকে বাংলার প্রথম কল্পবিজ্ঞান-উপন্যাসের মর্যাদা এনে দিতে পারত অনায়াসেই। কিন্তু আত্মবিস্মৃত বাঙালি সে কথা মনে রাখতেও ভুলে গেল। কবীর সুমন অপরূপ এক গানে তাঁকে শ্রদ্ধ্যার্ঘ জানালেও বাঙালির মরমে তো দূর কর্ণেও পশিল না সে সুর। তারা ভুলে গেল, ১৯০৫ সালে ভাগলপুরে বসে এক নারী লিখে চলেছেন সৌর-শক্তির কথা, উড়ন্ত গাড়ির কথা, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রের কথা, কায়িক শ্রমহীন কৃষিকাজের কথা। ভুলে গেল সেই অসামান্য কৌতুকপ্রিয় হাস্যোজ্জ্বল লেখনীকে, যিনি বিশ শতকের গোড়ায় দাঁড়িয়ে অনায়াসে লিখতে পেরেছিলেন, পুরুষের মস্তিষ্ক নারীর চেয়ে বড় বলেই যদি তারা বেশি বুদ্ধিমান হয়, তাহলে হস্তি নিশ্চয় পুরুষের চেয়েও বুদ্ধিমান, কারণ তার মস্তিষ্ক পুরুষের চেয়েও অনেক বড়! কিন্তু তবু তো সে হস্তিনীকে পর্দানশীন করে রাখে না, তাকে পদানত করে না!

রোকেয়াকে নিয়ে কবীর সুমনের সেই গান।

রোকেয়ার এই সুঠাম গদ্য, স্পর্ধিত রূপকের ব্যবহারে তাক-লাগানো বক্তব্য অবশ্যই অগণিত কটাক্ষের লক্ষ্য হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে দমিয়ে রাখতে রাখতে পারেনি। কলম নামিয়ে রাখেননি রোকেয়া। সওগাত, মহম্মদি, নবপ্রভা, মহিলা, ভারতমহিলা, আল-এসলাম, নওরোজ, মাহে নাও, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার মতো অজস্র পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর লেখা। ১৯০৯ সালে স্বামীকে হারালেন। আত্মীয়-পরিজনেরা তাঁকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্য উঠে পড়ে লাগল। একের পর এক ব্যক্তিগত আক্রমণেও অদম্য রোকেয়া ভাগলপুরেই মাত্র পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন স্বামীর নামাঙ্কিত মেয়েদের স্কুল – শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল। যদিও বছর দুয়েকের মধ্যেই পারিবারিক অশান্তির জেরে তাঁকে স্কুল উঠিয়ে নিয়ে চলে আসতে হল কলকাতার ওয়ালিউল্লা লেনের একফালি কামরায়। ২৪ বছর স্বাধীন ভাবে সেই স্কুল চালিয়েছেন রোকেয়া স্বয়ং। একের পর এক বাসা বদল করে আজ তার স্থায়ী ঠিকানা লর্ড সিনহা রোড। অনেক কটাক্ষ, অনেক লড়াই, অনেক নিন্দার সাক্ষী রোকেয়ার এই স্বপ্নের বিদ্যা নিকেতন আজও সযত্নে লালন করে চলেছে তাঁর স্বপ্নকে।

স্কুল চালানোর পাশাপাশি অবশ্য নিরন্তর কলমও চালিয়ে গিয়েছেন রোকেয়া। কারণ মেয়েদের শিক্ষার পথ যে কুসংস্কার, পর্দাপ্রথা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আকীর্ণ, তাকে নির্মূল করতে হলে কলমকেই যে তলোয়ার করতে হবে, সে কথা রোকেয়া বিলক্ষণ বুঝেছিলেন। তাই গল্পে, প্রবন্ধে, উপন্যাসে, ব্যঙ্গরচনায় তীব্র কষাঘাত করে গিয়েছেন তদানীন্তন সমাজকে, তার অন্ধত্বকে, পুরুষের প্রতি তার অন্যায় পক্ষপাতকে। ‘মানসিক দাসত্ব’ – এই শব্দবন্ধ সৃষ্টি করে নারীর উপর নিরন্তর ঘটে চলা শোষণ-নিপীড়ন-অত্যাচারের সরাসরি মোকাবিলা করতে চেয়েছেন আজীবন। ১৯১৬ সালে নারীর অধিকার, বিশেষত মুসলমান নারীর অধিকরা নিয়ে সরব হওয়ার উদ্দেশে স্থাপনা করলেন আঞ্জুমান-এ-খাওয়াতিন-এ –ইসলাম। ১৯২৬-এ বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশনাল কনফারেন্সের চেয়ারপার্সন মনোনীত হলেন। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়েই নির্ভীক কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তাঁর, তথা সমগ্র বাংলাদেশের নারী-জীবনের সারসত্য। বললেন, “আজ এই মঞ্চে আমাকে আহ্বান করে যে সম্মান আপনারা দেখিয়েছেন, তার জন্য আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনাদের মনোনয়নে গলদ রয়েছে। আমি সমাজের সেই অংশের প্রতিভূ, যারা জীবনের অধিকাংশ সময়ই শোষণের কালকুঠরিতে বন্দি থাকে। পর্দা দিয়ে যাদের আড়াল করে সরিয়ে রাখা হয় মূলস্রোত থেকে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে জীবনের বিরাট একটা সময় আমি কোনও মানুষের সঙ্গে না-মিশে, কথা না-বলে কাটিয়েছি। তাই আজ চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হয়ে কী করতে হবে, সে বিষয়ে আমার কোনও স্পষ্ট ধারণাই তৈরি হয়নি। আজ আমি হাসব না কাঁদব, তা-ই বুঝতে পারছি না।”

এই আত্মবীক্ষণের মধ্যে দিয়ে সমাজচেতনার উন্মেষ, নিজেকে উপলক্ষ্য করে সামাজিক গোঁড়ামি ও জুলুমের প্রতি শাণিত ব্যঙ্গ, সংখ্যালঘুর পাশাপাশি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও এই একই রকম সহজ অনায়াস প্রকাশভঙ্গিমা, রোকেয়াকে করে তোলে চির-অনন্যা, অপরিচিতা, অদ্বিতীয়া! ১৯৩২ সালে মৃত্যুকালেও ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনায় মগ্ন ছিলেন তিনি। বাংলায় তথা ভারতে নারীবাদের পথিকৃৎ হিসেবে রোকেয়ার নাম যে পাথরে খোদাই করা শিলালিপির মতো অটুট তা নিয়ে বোধহয় বিতর্কের খুব একটা অবকাশ নেই। কেবল প্রশ্ন একটাই। রোকেয়া এবং তাঁর উত্তরসূরীদের অনিঃশেষ আত্মত্যাগের একশো বছর পরেও কেন নির্ভয়া আর প্রিয়াঙ্কাদের জন্য মোমবাতি হাতে পথে নামতে হয় আমাদের? অর্চনাদের পাশেই কেন আয়েষারা থাকতে পারে না? সুলতানার স্বপ্ন কেন এতটা অবাস্তব আজও?

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *