আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭]

এ এক অদ্ভূত শুরু আর শেষের গল্প। একটি গল্প তো নয়, গল্পেরা। একটি গল্পে এক দলিত ছেলে গিয়ে পৌঁছয় রাজবাড়িতে, আর একটি গল্পে ব্রাহ্মণ ছেলেটি হয়ে ওঠে দলিত বাবা মায়ের নয়নের মণি। আরও একটি গল্পে বিত্তবান বাড়ির কন্যা, বধূ হয়ে ওঠে দলিত কর্মকাণ্ডের অপরিহার্য অংশ। 

এগুলো সব শুরুর কথা। আর শেষ? গল্পগুলির শেষ কোথায়? শেষেরা অবাক করা, দুঃখ দেওয়াও। যে গল্পে দলিত ধীবরপুত্র ইতিহাসের খেলায় গিয়ে পৌঁছন রাজসিংহাসনে, তিনি তৈরি করেন নানা বর্ণের ইতিহাস। তার অনেক গল্প, অনেক পর্ব ধরে পড়েছি আমরা। তিনি ছত্রপতি সাহু। আর একজনের গল্পের শুরু হয়েছে ঠিক আগের পর্বে। যশবন্ত রাও। ব্রাহ্মণ বিধবার সন্তান, জ্যোতিবা সাবিত্রীর আশ্রয়ে বৈধব্যের সম্মান বাঁচিয়ে যার জন্ম। বিধবা মা মারা যান, পিতার পরিচয় অজানা। দত্তক নেন জ্যোতিবা, সাবিত্রী।

ফুলে দম্পতির মানসপুত্রের শেষটা কিন্তু ছত্রপতি সাহুর মত রাজকীয় হয় না। যশবন্তের মৃত্যুর সঙ্গে অদ্ভূতভাবে ইতিহাসের গহ্বরে তলিয়ে যায় সেই উত্তরাধিকার। সেই খননে দায় নিয়েছে এই বর্তমান – সে কথা বলেছি কিছুদিন আগেই। তবে বলা হয়নি আর একজনের কথা। তবে বলতে হবে। না বললে আবারও ইতিহাস আঙুল তুলবে আমাদের দিকে। মানবীবিদ্যার ইতিহাস। যেভাবে প্রথম দলিত অধ্যয়নের পাঠ দিয়েছে জ্যোতিবার ‘গুলামগিরি’, সেভাবেই এই গল্পে থাকবে প্রথম মানবীবিদ্যার গ্রন্থ। সেই গ্রন্থও, যশবন্তের বংশসূত্রের মতোই প্রায় একশো বছর লুকিয়ে পড়েছিল ইতিহাসের গর্ভে। 

কোনও হদিশ ছিল না। যশবন্তের গবেষকের নাম তাও মনে রাখছি, রাখার চেষ্টা করছি আমরা কিন্তু সেই বই যে কে খুঁজে পেয়েছিল, নামটা জানা যায় না। ইতিহাসকে ফিরিয়ে দিতে, ইতিহাসে আবার হারিয়ে যায় সেই নাম। কিন্তু আমাদের দিয়ে যায় তারাবাঈ শিন্ডের নাম– যার লেখা ‘স্ত্রী পুরুষ তুলনা’-কে ভারতবর্ষে লিখিত প্রথম মানবীবিদ্যার গ্রন্থ শুধু নয়, বিশ্বেরও প্রথম লিখিত মানবীবিদ্যার প্রামান্য গ্রন্থের মধ্যে ধরা হয়। শুরু হোক তারাবাঈ শিন্ডের গল্প। 

Tarabai Shinde Book
মানবীবিদ্যার আকর গ্রন্থ: রচয়িতা তারাবাঈ শিন্ডে

শুরু হবে কোথা থেকে? 

সেই দিন থেকে, যখন তারাবাঈ ও তার স্বামী আসে জ্যোতিবা, সাবিত্রীর কাছে। তখন তারা অবশ্য বেশ ছোট, বয়স তেরো চোদ্দোর বেশি নয়। সময়রেখায় তারা বেশ এগিয়ে তাই, নয়তো তাদের দিব্যি মিলিয়ে দেওয়া যেত। ইতিহাসের দূরবীনে চোখ রাখলে এই তো দিব্যি দেখা যাচ্ছে তেরো বছরের জ্যোতিবা, ন’বছরের সাবিত্রীকে। সদ্যবিবাহিত জ্যোতিবা ইংরেজী শেখাবার চেষ্টা করছেন তার বালিকাবধূকে। তবে সে তো আরও কিছুদিন আগের কথা। সন-তারিখের নিরিখে তখন ১৮৪৮ সাল আর আমাদের যখন তারাবাঈ আর তার স্বামীর সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তখন সময় আরও প্রায় তিন দশক এগিয়ে এসেছে। জ্যোতিবা-সাবিত্রীর চুলে রুপোলি রেখারা উঁকিঝুঁকি মারছে, তাঁদের জীবনে দত্তকপুত্র হয়ে প্রবেশ করেছেন যশবন্ত। 

ইতিহাসের সমাপতন। জ্যোতিবা-সাবিত্রীর জীবনে প্রায় একইসঙ্গে প্রবেশ করে যশবন্ত, তারাবাঈ – যদিও যশবন্তের থেকে প্রায় দশবছরের বড় ছিলেন তারাবাঈ। এইটুকুই যা অমিল। মিলই ছিল বেশি।

রক্তের ঘনত্ব সম্পর্কে অনেক প্রবাদ শোনা যায়। যশবন্ত, তারাবাঈ দু’জনেই প্রবাদকে ভুল প্রমাণ করেন। জ্যোতিবা-সাবিত্রীর জীবনের অংশ, আদর্শের অংশ হয়ে ওঠেন তাঁরা, এবং ক্রমশ অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন। যে সময় তাঁরা জ্যোতিবা-সাবিত্রীর জীবনে আসেন, সেইসময় প্রকাশিত হয়ে গেছে জ্যোতিবার গুলামগিরি, সংলাপের ধারায় লেখা গুলামগিরির উপর ভিত্তি করে লেখা হচ্ছে ‘নৌটঙ্কী’। অনেকটা আমাদের যাত্রাপালার চেহারার এই নাটকের কেন্দ্রে থাকত সামাজিক ঘটনা, দলিতদের অবস্থান। এই নৌটঙ্কীর গল্পও খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের বেশ কিছুটা আগের এক পর্বের কথনে। আর এও উল্লেখ করা ছিল যে, কী অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল এই নৌটঙ্কী।

Jyotiba Pule and Yashwant
দত্তকপুত্র যশবন্তের সঙ্গে জ্যোতিবা

মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে চলছে নৌটঙ্কী। চলেছে জ্যোতিবা, সাবিত্রী, আর তার সঙ্গে চলেছে ছোট্ট যশবন্তও। আর তারাবাঈ? যে হতে চলেছে আমাদের আরও অনেক কথনের কেন্দ্রবিন্দু, যার সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানব আমরা– সে তখন কী করছে? তারও তো সমান উৎসাহ, জ্যোতিবা সাবিত্রীর কর্মকাণ্ডে! সেও কি ঘুরছে মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে? নাকি তার কর্মকান্ড অন্য কোথায়, যেখান থেকে সে হয়ে উঠবে প্রথম নারীবারী রচনার জন্মদাত্রী? 

এবারও পর্বের শেষে লুকিয়ে থাকুক পরের পর্বের সূচনা। ঠিক যেভাবে শেষ আর শুরুর  কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের এবারের ইতিহাস চলন, অনেকটা সেভাবেই হতে থাকুক নির্মাণ বিনির্মাণ।

*ছবি সৌজন্য: Popularbio, Indiamart
* তথ্যঋণ: 
১. ‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্‌ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬
২. ‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২
৩. ‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্‌’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯
৪. ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্‌ অফ্‌ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১

Isha Dasgupta Author

ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *