গুয়াহাটি থেকে জাতীয় সড়ক ধরে পূর্বদিকে এগোতে থাকলে শহরের প্রান্তসীমায় অবস্থিত খানাপাড়া থেকে রাস্তার দু’ পাশের বিচিত্র দৃশ্য বৈষম্য অবশ্যই আপনার চোখে পড়বে। বাঁদিকে ছোটো ছোটো বাড়ি। বাঁশবন-গাছগাছালি। আর  অন্যপাশে ঝকঝকে দোকানপাট, পেট্রোল স্টেশন, রেস্তোরাঁ আরও কত কিছু। দিনের আলোয় পার্থক্যটা তেমন নজরে না এলেও সূর্যাস্তের পরে বেশ প্রকট হয়ে পড়ে। বাঁদিক প্রায় অন্ধকার। দূরে কোথাও টিমটিম করে আলো জ্বলছে। আর ডানদিক আলোয় ঝলমল করছে। দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে চোখ রাখলেই বুঝতে পারবেন রাস্তার ডান পাশ মেঘালয়। আর বাঁদিকটা অসম। জোরাবট মোড় পর্যন্ত এমন বৈচিত্র রীতিমতো উপভোগ্য। 

এবার ডানদিকের রাস্তায় নংপো-বরাপানি হয়ে শিলঙ। গুয়াহাটি থেকে বেরিয়ে খানাপাড়া-জোরাবট হয়ে নংপো পেরিয়ে বরাপানি ছুঁয়ে শিলং পৌঁছোলেই মেঘালয় সফরের প্রথম পর্ব সমাপ্ত। 

এখানে এসেই সকলে আগামী কয়েকদিনের ছোটাছুটির হিসেব কষতে বসেন। অনেকে আবার শিলঙ আসার আগেই ছক কেটে আসেন কবে যাবেন চেরাপুঞ্জি (বা সোহরা) অথবা শিলঙ পয়েন্ট-এ কখন গেলে ভালো হয়। মওসমাই গুহা থেকে শুরু করে মওসিনরাম-এর জাকরেম উষ্ণ প্রস্রবণ কিছুই বাদ পড়ে না। এইসব জায়গায় ঘুরে বেড়াবার ফাঁকে সময়-সুযোগ পেলে  শিলঙ শহরের বিখ্যাত পুলিশ বাজারে একটা চক্কর লাগাতেও ভুল হয় না। স্থানীয়দের নিত্যকার আড্ডা-কেন্দ্র পুলিশ বাজারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাম্বুল চিবিয়ে গপ্পো না মারলেও শিলঙ এসে মার্কেটিং না করে খালি হাতে কী করে ফিরে যাবেন?   

রবীন্দ্র অনুরাগীরা অবিশ্যি এর মধ্যেই সময় করে নিয়ে শহরের মধ্যেই রিল বং এলাকার ব্রুকসাইড বাংলো এবং জিৎভূমি বাড়ি দুটি দেখে আসবেন। প্রথমবার শিলং সফরের সময় (১৯১৯) ব্রুকসাইড বাংলোয় বসেই লিখেছিলেন শেষের কবিতা-র প্রাথমিক খসড়া। আর ১৯২৩-এ দ্বিতীয়বার শিলং ভ্রমণের সময় তাঁর বাসস্থান ছিল, জিৎভূমি। এই বাড়িতে বসেই লিখেছিলেন রক্তকরবী নাটকের খসড়া।  

শিলং থেকে সোহরা যাওয়ার পথের দু’ ধারের পাহাড়-অরণ্য-ঝরনা সমৃদ্ধ প্রকৃতির অপরূপ   সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পর্যটকের চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানকার পাহাড়ের শান্ত নির্জন আবহে বাতাস যেন কথা কয়। আকাশে ভাসে সদাসচল মেঘের দল। সূর্যকরোজ্জ্বল দিনেও আলো-আঁধারির লুকোচুরি। হঠাৎ হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি। বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে প্রকৃতির প্রাচুর্য অবলোকনে মন এতই বিভোর হয়ে যায় যে চোখেই পড়ে না ঐতিহ্য সম্পন্ন ওয়েলশ গির্জার সমারোহ। এবং অবশ্যই নজর এড়িয়ে যায় বাঁশের ধাঁচা। হঠাৎ করে দুই পাহাড়ের মাঝের সমভূমিতে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি বা চারটি বাঁশ। বাঁশগুলির গোড়া মাটিতে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে পোঁতা থাকলেও মাথাগুলো কিন্তু ঝুঁকে পড়ে একসূত্রে বাঁধা। আরও ভালো করে নজর করলে দেখা যায় সেই ঝুঁটি বাঁধা বাঁশের ধাঁচা থেকে একটা কপিকলের মধ্যে দিয়ে দুটি তারের দড়ি ঝুলছে। কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে চোখে পড়বে একটি তারের সঙ্গে লটকে রয়েছে একটা ঝুড়ি। অন্যটি চলে গেছে মাটির গভীরে। আর ঝুড়িটির ঠিক নিচেই রয়েছে একটি গর্ত। গর্তের আশপাশে ছড়িয়ে আছে ছোটো ছোটো  কয়লার স্তূপ। সবমিলিয়ে এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। পাহাড়ের পাদদেশে পড়ে থাকা স্বল্প আয়তনের সমভূমিতে এমন একটি কাঠামো নিঃসন্দেহে কৌতূহল সৃষ্টি করে। সময় এবং উৎসাহ থাকলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। বহিরাগত মানুষের আগমনে জমির ওপরের গুটিকয়েক মানুষ চট করে আড়ালে আবডালে লুকিয়ে পড়লেও কর্তব্যের প্রয়োজনে অথবা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আচমকাই গর্তের কিনারায় ফিরে আসেন। হ্যাঁচকা টানে ঝুড়িটাকে মাটির নিচে পাঠানো শুরু হয়। ফলে, কপিকলের অন্য পাশের দড়িটি উপরে উঠতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উপরে উঠে আসে এক ঝুড়ি কয়লা অথবা একটা খর্বকায় মানুষ। বয়স কত হবে? বালক। অথবা সদ্য কৈশোরে পৌঁছনো কালিঝুলি মাখা এক শীর্ণ পরিশ্রান্ত মানুষ। কৌতূহল নিরসনে বহিরাগতকে একটু সময় খরচ করতে হবে। কিন্তু তার সময় কোথায়?

Amitabha Ray Author

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *