তখনও তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি।‌ বিদেশে অবশ্য তাঁর গীতাঞ্জলি নিয়ে চর্চা চলছে। শুধু ইউরোপ নয়, সাগর পেরিয়ে মার্কিনদেশেও সে চর্চা অব্যাহত। ১৯১২-এর ডিসেম্বর মাসে শিকাগোর পোয়েট্রিপত্রিকায় তাঁর একগুচ্ছ কবিতা ছাপানো হল। সঙ্গে লেখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ মহাকবি।’

প্রতিভাবান এক মার্কিন কবি এই কবিতাগুলি ছাপানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ওই বছরই রবীন্দ্রনাথ যখন বিলেত যান, গীতাঞ্জলির অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হন বহু ইংরেজি কবি। ইয়েট্স ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সেই সময় এই তরুণ মার্কিন কবি ইয়েটসের সেক্রেটারি ছিলেন। ফলে তিনিও রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পড়ে ফেলেন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হন। বলা যেতে পারে ভক্ত হয়ে ওঠেন।

এতটাই ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন ২৭ বছরের সেই মার্কিন যুবক কবি, যার কথা রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণে পাওয়া যায় এমন

বাবার কাছে নিত্য নূতন লোকের আনাগোনা চলছে। আমি ও কালীমোহনবাবু এদিকে আমাদের উদ্বৃত্ত সময়টুকু কাটাচ্ছি য়েটস ও এজরা পাউণ্ডের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে। পাউণ্ড একেবারে আলাদা জাতের লোক– যাকে বলা যায় অনন্য। তাঁর কাছে কাব্যরচনা ছিল এক মহৎ ব্যাপার। তিনি যে কাব্যরচনা চিরাচরিত পথ ছেড়ে নিজের স্বতন্ত্র পথ তৈরি করে নিতে পেরেছেন এই নিয়ে তাঁর মনে একটা অহমিকাবোধ সদা জাগ্রত ছিল।’ 

শুধু কি এই? না, রথীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, ‘পাউণ্ডের প্রকৃতিতে ও আচরণে বেশ একটা নাটকীয়তা ছিল।.. তিনি যে মার্কিন মুলুকের লোক, এ কথা চেপে যেতে পারলেই তিনি খুশি হতেন।… পাউণ্ড এই সময় বাবার বিশেষ অনুরাগী ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন।’

Ezra Pound
তরুণ মার্কিন কবি এজ়রা পাউন্ড

হ্যাঁ, সেই তরুণ মার্কিন কবি এজ়রা পাউন্ডের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের খতিয়ান এবারে আমার লেখার বিষয়। আমাদের কবির জীবনে তিনি যেন হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন।’

পাউন্ড যৌবনে মার্কিনদেশ ত্যাগ করেন স্বেচ্ছায়। আর তিনি কখনও স্বদেশে ফিরে যাননি। বিশ শতকের গোড়ার আধুনিক কবিতা’র ধারণা যারা গোটা বিশ্বের সাহিত্যসমাজে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁদের পুরোধা কবি এজ়রা পাউন্ড। পাউন্ডের রবীন্দ্রভক্তির কথা রোদেনস্টাইন বেশ কৌতুক করে বলেছিলেন,

তরুণ কবিরা এসে রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসতেন; সবচেয়ে assiduous ভাবে বসতেন এজরা পাউণ্ড।’

ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হবার পর এজ়রা পাউন্ড মার্কিনদেশে রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রচারের জন্য বিশেষ উৎসাহী হলেন। কতটা সৎ ছিলেন এজ়রা পাউন্ড, তার একটি নমুনা পাওয়া যায় পোয়েট্রিপত্রিকার সম্পাদক হ্যারিয়েট মনরোকে লেখা একটি চিঠিতে। 

আমি খুব চেষ্টা করছি সুমহৎ বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি কবিতা সংগ্রহ করবার।… আমার নির্বাচন থেকে এই কবির সাম্রাজ্যের বিশালতা, তাঁর বৈচিত্র্য কিছুই বোঝা যাবে না বলে মনে হয়,…. কবিতাগুলির তলায় দয়া করে লিখে দেবেন রচনাস্বত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।…কী যত্ন নিয়ে যে এই কবিতাগুলি নির্বাচন করেছি, সাজিয়েছি তা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না; সমস্ত বইটা একটা অচ্ছেদ্য ও স্বয়ংসম্পূর্ণ একক, তার ভেতর থেকে টুকরো টুকরো কবিতা বের করে আনতে খুব কষ্ট হয়েছে আমার।’ 

উল্লেখযোগ্য ঘটনা যে আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই প্রথম প্রকাশ হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথকে ইয়েটসের ফ্ল্যাটে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখেছিলেন যা বিশ্বভারতী কোয়ার্টার্লি’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালেই শেষ জন্মোৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। কী লিখেছেন দেখা যাক: 

শ্রীযুক্ত ইয়েটসের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম তিনি একজন মহৎ কবির আবির্ভাব নিয়ে অত্যন্ত উত্তেজিত– এমন একজন, যিনি আমাদের সকলের চেয়ে মহত্তর’।… রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার চেহারার ব্যাপারটা এমন যে, তাঁকেই পড়তে হবে একা একা, নিঃশব্দে। জোরে পড়লেও ভালই হবে, কারণ কবিতাগুলি এই আপাতসরল ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন একজন মহান সংগীতগুণী– যিনি এমন এক সংগীতে দক্ষ যা আমাদের নিজস্ব সংগীতের তুলনায় অনেক বেশি সূক্ষ্ম মাধুর্যমন্ডিত।’

Rabindranath Tagore
রবীন্দ্রনাথও পাউন্ডের কবিতা পড়তে ভালবাসতেন

হয়তো এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ তরুণ কবিকে ১৯১৩ সালের লিখেছিলেন

প্রিয় মিস্টার এজরা পাউন্ড,

আপনাকে আমার সাম্প্রতিক কিছু অনুবাদ কবিতা পাঠিয়েছি। পাঠিয়ে খুব ভাল লাগছে আমার। আপনি যেহেতু মূল কবিতাগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ ও সঙ্গীতে আকৃষ্ট হয়েছেন, অনুবাদে তার কতখানি এসেছে তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারা হয়তো আপনার পক্ষে কঠিন হবে না।’

এজরা পাউন্ড যেমন রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভক্ত ছিলেন, ঠিক তেমনিই রবীন্দ্রনাথও পাউন্ডের কবিতা পড়তে ভালবাসতেন।‌ এর সাক্ষ্য মেলে ১৯৩২ সালে আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে।‌ এজরা পাউন্ডের একটি কবিতা নিয়ে এই প্রবন্ধে কবি লিখেছেন

নন্দনতত্ত্ব সম্বন্ধে এজরা পৌন্ডের একটি কবিতা আছে। বিষয়টি এই যে, একটি মেয়ে চলছিল রাস্তা দিয়ে। একটা ছোটো ছেলে, তালি দেওয়া কাপড় পরা, তার মন উঠল জেগে; সে থাকতে পারল না, বলে উঠল, ‘দেখ্ চেয়ে রে, কী সুন্দর!’ এই ঘটনার তিন বৎসর পরে ঐ ছেলেটার সঙ্গে আবার দেখা। সে বছর জালে সার্ডিন মাছ পড়েছিল বিস্তর। বড় বড় কাঠের বাক্সে ওর দাদাখুড়োরা মাছ সাজাচ্ছিল… হাটে বিক্রি করতে পাঠাবে। ছেলেটা মাছ ঘাঁটাঘাঁটি করে লাফালাফি করতে লাগল। বুড়োটা ধমক দিয়ে বলল, ‘স্থির হয়ে বোস্। তখন সে সেই সাজানো মাছ গুলোর উপর হাত বুলোতে বুলোতে তৃপ্তির সঙ্গে ঠিক সেই একই কথা আপন মনে বলে উঠল কী সুন্দর!’

সুন্দরী মেয়েকেও দেখো, সার্ডিন মাছকেও, একই ভাষায় বলতে কুণ্ঠিত হয়ো না, ‘কী সুন্দর!’ এ দেখা নৈর্ব্যক্তিক — নিছক দেখা, এর পঙক্তিতে চটিজুতোর দোকানকেও থেকে বাদ দেওয়া যায় না।…’

কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে এজ়রা পাউন্ডের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এই মুগ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এমনকী নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর তিনি রবীন্দ্রনাথকে কোনও সৌজন্যবার্তা পর্যন্ত পাঠাননি। তবে সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন হয়ে গেছিল, এমনটাও বলা যায় না। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে পাউন্ড প্রায় নীরব হয়ে গিয়েছিলেন, তা জানা যায় না।

Ezra Pound book
পাউন্ডের লেখা বই

যদিও ১৯৩০ সালের ২৮ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আপনি আবার ইয়োরোপে এলে আমাকে জানাবেন।’ এবং রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোপ গেলে হঠাৎ হোটেলে চলে এসে দেখাও করে যান এজ়রা পাউন্ড। 

আজও শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে রবীন্দ্রনাথকে উপহার দেওয়া এজ়রা পাউন্ডের লেখা ‘Ripostles of Ezra Pound’ বইটি দেখা যায়, যার পুস্তানিতে লেখাও আছে

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। প্রগাঢ়তম মুগ্ধতার সঙ্গে। এজরা পাউন্ড।’

গ্রন্থ ও তথ্যঋণ:

১) The date for the “Tagore Evening” is given in the autobiography of Tagore’s son Rathindranath (Rathindranath Tagore, On the Edges of Time, Bombay. 1958). 

২) Among those present were Ernest Rhys, Alice Meynell, May Sinclair, Charles Trevelyan, F. Andrews, H. W. Nevinson, and A. H. Fox-Strangways.

৩) Ezra Pound, “Rabindranath Tagore,” Fortnightly Review, LXXXXIX, 573 (March,1913), and online here in the New Series. 

৪) William Rothenstein, Men and Memories: 1900-1922 (London, 1932) 

৫) In August of 1912, Rothenstein proposed that the India Society publish a volume of Tagore’s poetry. The India Society accepted and asked Yeats to write the introduction. Pound must have recently learned about the projected edition. 

৬) D. D. Paige, ed., The Letters of Ezra Pound: 1907-1941 (New York, 1950)

৭) Harriet Monroe, A Poet’s Life (New York, 1938) 

৮) পিতৃস্মৃতি : রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

৯) Poet’s to a Poet. By Bikash Chakraborty.

১০) রবীন্দ্র রচনাবলী ১৪ খণ্ড।

Pitam Sengupta

প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *