মান্দালয় জেল
১২/৮/২৫

শ্রদ্ধাস্পদেষু—

‘মাসিক বসুমতী’তে আপনার “স্মৃতি কথা” তিনবার পড়লুম—বড় সুন্দর লাগল। মনুষ্য-চরিত্রে আপনার গভীর অন্তর্দৃষ্টি; দেশবন্ধুর সহিত ঘনিষ্ট পরিচয় ও আত্মীয়তা এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার অপূর্ব্ব বিশ্লেষণ ক’রে রস ও সত্য উদ্ধার করবার ক্ষমতা— এই উপকরণের দ্বারাই আপনি এত সুন্দর জিনিষ সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

যাহারা তাঁর অন্তরঙ্গ ছিল তাদের মনের মধ্যে কতকগুলি গোপন ব্যথা রয়ে গেল। আপনি সে গোপন ব্যথার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করে শুধু যে সত্য প্রকাশ করবার সহায়তা করেছেন তা’ নয়— আপনি আমাদের মনের বোঝাটাও হাল্‌কা করেছেন। বাস্তবিক “পরাধীন দেশের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এই যে, মুক্তি-সংগ্রামে বিদেশীয়দের অপেক্ষা দেশের লোকদের সঙ্গেই মানুষকে লড়াই করতে হয় বেশী।” এই উক্তির নিষ্ঠুর সত্যতা— তার অনুগ্রহ, কর্মীরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে এবং এখনও বুঝছে।

আপনার সমস্ত লেখার মধ্যে এই কথাগুলি আমার সবচেয়ে ভাল লাগল—“একান্ত প্রিয়, একান্ত আপনার জনের জন্য মানুষের বুকের মধ্যে যেমন জ্বালা করিতে থাকে— এ সেই। আজ আমরা যাহারা তাঁহার আশে পাশে ছিলাম, আমাদের ভয়ানক দুঃখ জানাইবার ভাষাও নাই; পরের কাছে জানাইতে ভালোও লাগে না।” বাস্তবিক, হৃদয়ের নিগূঢ় কথা পরের কাছে কি সহজে বলা যায়? তারা উপহাস করলে হয় তো সে উপহাস সহ্য করা যায়। কিন্তু তারা যদি রসবোধ না করতে পারে তা’ হলে অসহ্য বোধ হয়, মনে হয়, “অরসিকেষু রস-নিবেদনং শিরসি মা লিখ”। আমাদের অন্তরের কথা, অন্তরঙ্গ ভিন্ন আর কে বুঝতে পারে?

Chittaranjan Das
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

আর একটি কথা আপনি লিখেছেন— যা আমার খুব ভাল লেগেছে ।….“আমরা করিতাম দেশবন্ধুর কাজ”। প্রকৃতপক্ষে আমি এমন অনেককে জানি যাঁরা তাঁর মতে বিশ্বাস করতেন না—কিন্তু বোধ হয় তাঁর বিশাল হৃদয়ের মোহনীয় আকর্ষণে তাঁর জন্য তাঁরা কাজ না করেও পারতেন না। আর তিনিও মত নির্ব্বিশেষে সকলকে ভাল-বাসতে পারতেন। সমাজের প্রচলিত মাপকাঠি দিয়ে আমি তাঁকে মনুষ্য চরিত্র বিচার করতে দেখিনি। মানুষের ভালমন্দ স্বীকার করে নিয়েই যে তাকে ভালবাসা উচিত—এই কথায় তিনি বিশ্বাস করতেন এবং এই বিশ্বাসের উপর তাঁর জীবনের ভিত্তি।

 

Basanti Devi
বাসন্তী দেবী, দেশবন্ধুর স্ত্রী

অনেকে মনে করে যে, আমরা অন্ধের মত তাঁকে অনুসরণ করতুম। কিন্তু তাঁর প্রধান চেলাদের সঙ্গে ছিল তাঁর সবচেয়ে ঝগড়া। নিজের কথা বলিতে পারি যে, অসংখ্য বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া হ’ত। কিন্তু আমি জানতুম যে, যত ঝগড়া করিনা কেন—আমার ভক্তি ও নিষ্ঠা অটুট থাকবে—আর তাঁর ভালবাসা থেকে আমি কখনও বঞ্চিত হ’ব না। তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, যত ঝড় ঝঞ্ঝা আসুক না কেন— তিনি আমাকে পাবেন তাঁর পদতলে। আমাদের সকল ঝগড়ার মিটমাট হ’তো মা’র (বাসন্তী দেবীর) মধ্যস্থতায়। কিন্তু হায় “ রাগ করিবার, অভিমান করিবার জায়গাও আজ আমাদের ঘুচে গেছে।”

আপনি এক জায়গায় লিখেছেন—“লোক নাই, অর্থ নাই, হাতে একখানা কাগজ নাই, অতি ছোট যাহারা তাহারাও গালি-গালাজ না করিয়া কথা কহে না, দেশবন্ধুর সে কি অবস্থা!” সেদিনকার কথা এখনও আমার মনে স্পষ্ট অঙ্কিত আছে। আমরা যখন গয়া কংগ্রেসের পর কলিকাতায় ফিরি— তখন নানা প্রকার অসত্যে এবং অর্দ্ধ সত্যে বাঙ্গলার সব খবর কাগজ ভরপুর। আমাদের স্বপক্ষে ত কথা বলেই নাই— এমন কি আমাদের বক্তব্যটিও তাদের কাগজে স্থান দিতে চায় নাই। তখন স্বরাজ্য ভাণ্ডার প্রায় নিঃশেষ। যখন অর্থের খুব প্রয়োজন তখন অর্থ পাওয়া যায় না। যে বাড়ীতে এক সময়ে লোক ধরত না, সেখানে কি বন্ধু, কি শত্রু— কাহারও চরণ ধুলি আর পড়ে না। কাজেই আমরা কয়েকটী প্রাণী মিলে আসব জমাতুম। পরে যখন সেই বাড়ীর পূর্ণ গৌরব ঘুরে এল— বাহিরের লোক এবং পদপ্রার্থীরা যখন এসে আবার সভাস্থল দখল করল— তখন আমরা কাজের কথাও বলবার সময় পাই না। কত পরিশ্রমের ফলে, কি রকম হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ক’রে ভাণ্ডাবে অর্থসঞ্চয় হ’ল, নিজেদের খবর কাগজ প্রকাশিত হ’ল এবং জন মত অনুকূল দিকে ফেরান হ’ল তা বাহিরের লোক জানে না— বোধ হয় কোনও দিন জানবেও না। কিন্তু এই যজ্ঞের যিনি ছিলেন হোতা, ঋত্বিক, প্রধান পুরোহিত, যজ্ঞের পূর্ণ সমাপ্তির আগেই তিনি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন! ভিতরের আগুন এবং বাহিরের কর্ম্মভাব— এই দুয়ের চাপে তাঁর পার্থিব দেহ আর সহ্য করতে পারল না।

Gandhi deshbandhu
গান্ধিজি ও অ্যানি বেসান্তের সঙ্গে দেশবন্ধু

অনেকে মনে করেন যে, তাঁর স্বদেশ সেবাব্রতের উদ্দেশ্য ছিল দেশমাতৃকার চরণে নিজের সর্ব্বস্ব উৎসর্গ করা। কিন্তু আমি জানি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এর চেয়েও মহত্তর। তিনি তাঁর পরিবারকেও দেশমাতৃকার চরণে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। এবং অনেকটা সফলও হ’য়েছিলেন । ১৯২১ খৃঃ ধর-পাকড়ের সময়ে স্থির সঙ্কল্প করেছিলেন যে একে একে তাঁর পরিবারের প্রত্যেককে কারাগৃহে পাঠাবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেও আসবেন। নিজের ছেলেকে জেলে না পাঠালে পরের ছেলেকে তিনি পাঠাতে পারবেন না— এ রকম বিবেচনা তাঁর আদর্শের দিক থেকে খুব নিম্নস্তরের বলে আমার মনে হয়। আমরা জানতুম যে, তিনি শীঘ্রই ধরা পড়বেন, তাই আমরা বলেছিলুম যে তাঁর গ্রেপ্তারের পূর্ব্বে তাঁর পুত্রের যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নাই এবং একজন পুরুষ বর্ত্তমান থাকতে আমরা কোনও মহিলাকে যেতে দিব না। অনেকক্ষণ ধরে তর্ক বিতর্ক চলে, কোনও সিদ্ধান্ত হয় না— আমরা কোনও মতে তাঁর কথা স্বীকার করতে পারিনি। শেষে তিনি বলেন, “এটা আমার আদেশ—পালন করতে হবে।” তারপর প্রতিবাদ জানিয়ে আমরা সে আদেশ শিরোধার্য্য করলুম।

তাঁর জ্যেষ্ঠা করা বিবাহিতা—তাঁর উপর তাঁর অধিকার বা দাবী নাই, সেইজন্য তাঁকে পাঠাতে পারলেন না। কনিষ্ঠা কন্যা তখন বাগদত্তা—তাঁকে পাঠান উচিত কিনা—সে বিষয়ে ভীষণ তর্ক হ’ল, তিনি পাঠাতে চান—কন্যারও যাবার অত্যন্ত ইচ্ছা, কিন্তু অন্যান্য সকলের মত—তাঁকে পাঠান উচিত নয়। কারণ একেই তিনি অসুস্থ, তারপর আবার বাগদত্তা— শীঘ্রই বিবাহ হবার কথা। এ ক্ষেত্রে দেশবন্ধু সাধারণের মত স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। শেষে সিদ্ধান্ত হ’ল সর্ব্ব প্রথমে ভোম্বল যাবে— তারপর বাসন্তী দেবী ও উর্ম্মিলা দেবী যাবেন— এবং তাঁর ডাক যে মুহূর্তে আসবে তখনই যাবার জন্য তিনি প্রস্তুত থাকবেন।

বাহিরের ঘটনা সকলেই জানে। কিন্তু এই ঘটনার মূলে— লোক- চক্ষুর অন্তরালে যে ভাব, যে আদর্শ, যে প্রেরণা নিহিত রয়েছে— তার সন্ধান কয়জন রাখে? তাঁর সাধনা শুধু নিজেকে নয়—তাঁর সাধনা তার সমস্ত পরিবারকে নিয়ে। আমার মনে হয় যে, মহাপুরুষের মহত্ত্ব বড় বড় ঘটনার চেয়ে ছোট ছোট ঘটনার ভিতর দিয়েই বেশী ফুটে উঠে। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসের ‘বসুমতী’তে আমি দেশবন্ধুর সহকর্ম্মী ও অনুগত কর্ম্মীদের লেখা সযত্নে পড়লুম। অধিকাংশ লেখাই ভাসা ভাসা রকমের এবং কতকগুলো বাঁধা শব্দের পুনরুক্তিতেই পরিপূর্ণ, কেবল আপনি একা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার বিশ্লেষণের দ্বারা দেশবন্ধুর চরিত্র অঙ্কিত করবার চেষ্টা করেছেন। তাই আপনার লেখা পড়ে যে কতদূর তৃপ্তি হ’ল তা বলিতে পারি না। ………দেশবন্ধুর শিষ্য ও সহকর্ম্মীদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশী আশা করেছিলুম। তাঁরা বোধ হয় কিছু না লিখলেই ভাল করতেন।

সময়ে সময়ে আমি মনে না করে পারি না যে, দেশবন্ধুর অকাল-মৃত্যু ও দেহত্যাগের জন্য তাঁর দেশবাসীরা ও তাঁর অনুচরবর্গও কতকটা দায়ী। তাঁরা যদি তাঁর কাজের বোঝা কতকটা লাঘব করতেন, তা’হলে বোধ হয় তাঁকে এতটা পরিশ্রম করে আয়ু শেষ করতে হত না। কিন্তু আমাদের এমনই অভ্যাস যে, যাকে একবার নেতৃপদে বরণ করি, তাঁর উপর এত ভার চাপাই ও তাঁর কাছ থেকে এত বেশী দাবী করি যে কোনও মানুষের পক্ষে এত ভার বহন বা এত আশা পূরণ করা সম্ভব নয়। রাজনীতি-সংক্রান্ত সব রকম দারিত্বের বকলমা নেতার হাতে তুলে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে চাই।

যাক্ —কি বলতে আরম্ভ করে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা—শুধু আমরা কেন—এখানে সকলের অনুরোধ ও ইচ্ছা আপনি ‘স্মৃতি কথা’র মত দেশবন্ধু সম্বন্ধে আরও কয়েকটী প্রবন্ধ বা কাহিনী লিখুন। আপনার ভাণ্ডার এত শীঘ্র শূন্য হতে পারে না, অতএব লেখার জন্য উপাদানের অভাব হবে বলে আমি আশঙ্কা করি না। আর আপনি যদি লেখেন, তবে সুদূর মান্দালয় জেলে বসে কয়েকজন বাঙ্গালী রাজবন্দী যে অত্যন্ত আগ্রহের সহিত সে রচনা পাঠ ও উপভোগ করবে কোনও সন্দেহ নাই।

Subhas Chandra Bose

আমি বোধ হয় খুব বেশী দিন এখানে থাকব না। কিন্তু খালাস হবার তেমন আকাঙ্ক্ষা এখন আর নাই। বাহিরে গেলেই যে শ্মশানের শূন্যতা আমাকে ঘিরে বসবে–তার কল্পনা করলেই যেন হৃদয়টা সঙ্কুচিত হ’য়ে পড়ে। এখানে সুখে দুঃখে স্মৃতি ও স্বপ্নের মধ্যে দিন- গুলি এক রকম কেটে যাচ্ছে। পিঞ্জরের গরাদের গায়ে আঘাত করে যে জ্বালা বোধ হয়— সে জ্বালার মধ্যেও যে সুখ পাওয়া যায় না— তা আমি বলতে পারি না। যাঁকে ভালবাসি— যাঁকে অন্তরের সহিত ভালবাসার ফলে আমি আজ এখানে— তাঁকে বাস্তবিক ভালবাসি— এই অনুভূতিটা সেই জ্বালার মধ্যেই পাওয়া যায়। তাই বোধ হয়, বদ্ধ দুয়ারের গরাদের গায়ে আছাড় খেয়ে হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হলেও— তার মধ্যে একটা সুখ, একটা শান্তি—একটা তৃপ্তি পাওয়া যায়। বাহিরের হতাশা, বাহিরের শূন্যতা এবং বাহিরের দায়িত্ব—এখন আর মন যেন চায় না ।

এখানে না এলে বোধ হয় বুঝতুম না সোনার বাঙ্গলাকে কত ভালবাসি। আমার সময়ে সময়ে মনে হয়, বোধ হয় রবিবাবু কারারুদ্ধ অবস্থা কল্পনা করে লিখেছেন—

“সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
                       আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী।”

যখন ক্ষণেকের তরে বাঙ্গলার বিচিত্ররূপ মানস চক্ষের সম্মুখে ভেসে উঠে— তখন মনে হয় এই অনুভূতির জন্য অন্ততঃ এত কষ্ট করে মান্দালয় আসা সার্থক হয়েছে। কে আগে জানত—বাঙ্গলার মাটি, বাঙ্গলার জল—বাঙ্গলার আকাশ, বাঙ্গলার বাতাস—এত মাধুরী আপনার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে।

কেন এ পত্র লিখে ফেল্লুম জানি না। আপনাকে পত্র দিব এ কথা আগে কখনও মনে আসেনি। তবে আপনার লেখা পড়ে কতকগুলো কথা মনে আসতে লিপিবদ্ধ করলুম। যখন লিখে ফেলেছি—তখন পাঠিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আপনি আমাদের সকলের প্রণাম গ্রহণ করিবেন। পত্রের উত্তর ইচ্ছা হয় দেবেন। তবে উত্তর দাবী করবার মত ভরসা রাখিনা, যদি উত্তর দেন এই আশায় ঠিকানা দিলুম—

C/o D.I.G. I.B., C.I.D.
13, Elysium Row
Calcutta,

 
 
 
 
*ঋণ: সুভাষচন্দ্র বসু ‘পত্রাবলী’
* বানান অপরিবর্তিত

ছবি সৌজন্য: Wikipedia, netajisubhasbose.org, Wikimedia commons

সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি হলেন এক উজ্জ্বল ও মহান চরিত্র। উড়িষ্যার কটক শহরে বসু পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। বাবা জানকী নাথ বসু এবং মা প্রভাবতী দেবী। স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত সুভাষ চন্দ্র বসু ছাত্রাবস্থা থেকে ইংরেজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। দেশের স্বাধীনতার কাজে নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। দেশবাসী তাঁকে চেনে নেতাজি নামে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *