হঠাৎ সামনে এসে হাজির পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা একটা লম্বা ছুটি। হ্যাঁ, মনের কোণে করোনার ভয় আছে। টেনশন আছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ঘরকন্নার কাজ ইত্যাদি মিলিয়ে খানিক চাপও আছে। কিন্তু কিছুটা অবসর ও অবকাশ তো পাওয়া গেছেই। সপ্তাহের শেষই হোক অথবা প্ল্যান করে নেওয়া আরেকটু লম্বা ছুটিই হোক, অপ্রত্যাশিতভাবে কোনও ছুটিই সহসা আর জীবনে আসে না আজকাল। রেইনি ডে হয় না। বনধ হয় না। ছাত্র ধর্মঘট, আমাদের স্কুল-কলেজের দিনগুলোতে যার বাঁধাধরা আগমন ছিল ফি বছর, সেও আজ আর নেই। অতএব ছুটি যা পাওয়া যায় তা বেশিরভাগই আগে থেকে ছক কষা ছুটি। কী কী করব, কোথায় কোথায় যাব, কার কার সঙ্গে কীভাবে দেখা করব সবই আগে থেকে ভাবা থাকে। তার বাইরে খুব একটা কিছু আর করা হয়ে ওঠে না। আর সেই ছকে বাঁধা ছুটিতে নিজের কথা ভাবা, নিজস্ব শখ-আহ্লাদ, মি-টাইম ইত্যাদি নিয়ে চর্চার সুযোগ মেলা দুস্কর। লকডাউনের এই একুশ দিনে অনেকেরই কিন্তু অবস্থাটা খানিকটা একইরকম। ফেসবুকের পাতা ওল্টালেই দেখা যাচ্ছে কোথাও দুঁদে কর্পোরেট ক্যানভাস-রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে বসেছেন, তো কোথাও আবার ব্যস্ত ফ্যাশন ডিজাইনার কাজ নেই তো খৈ ভাজি বলে একের পর এক অসাধারণ সব রান্না-বান্না করে চলেছেন। নাচের জগতে বেশ শক্তপোক্ত জায়গা করে নেওয়া কেউ আবার নতুন করে ঝালাতে বসেছেন গানের গলা, কেউ মুখ গুঁজেছেন বইতে আর কেউ আবার নিজের ঘরের আনাচে কানাচেই খুঁজে পেয়েছেন মনের মতো কাজ। সে ঘরের চেনা কোণগুলোকে একটু এদিক ওদিক করে সাজিয়ে তোলাই হোক আর ছাদে বারান্দায় টবে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের পরিচর্যাই হোক।

dolon dashbhaumik facebook
দোলনের ছাদের বাগান

যেমন দোলন। পেশাগতভাবে নামি পি আর সংস্থার ডিরেক্টর দোলন দাসভৌমিক বসুর নেশা একটাই, সবুজের সঙ্গে বন্ধুতা। কাজের দিনে কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ চষে বেরনো, আজ শিলিগুড়ি কাল বর্ধমান তো পরশু দিল্লি করে বেড়ানো এই মেয়ে এখন পুরোপুরি ঘরবন্দি। কিন্তু এই বন্দিদশাকে একেবারেই নেতিবাচকভাবে নিতে রাজি ননা তিনি। এমনিতে সপ্তাহে সপ্তাহে মালি আসেন ঠিক-ই কিন্তু নিজের গাছের যত্ন-আত্তি নিজেই করতে ভালোবাসেন দোলন। আর এই তো সুযোগ! বাইরে বেরনোর কোনও দায় নেই। তাই খুরপি হাতে যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে সোজা ছাদে। সবুজের মাঝে নিজেরই হাতে গড়া এক রূপকথার রাজ্যে। সঙ্গী, দুই পোষ্য, নিমো আর কোকো।। লকডাউনের বাজারে মাঝেমধ্যে অবশ্য হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে উপরি পাওনা ব্যস্ত স্বামী অরিন্দমকে। দোলনের ছোটবেলা কেটেছে কলকাতার বাইরে। দিল্লিতে কোয়ার্টারের বড় বাগানে দোলনের মা নিজে হাতে ফলাতেন লেবু, লাউ, কুমড়ো। নিজে হাতেই তৈরি করতেন জৈব সার, বাজারের সবজি থেকে সংগ্রহ করতেন বীজ! প্রতিবছর গরমের ছুটিতে কলকাতা এসে ফেরার পথে মেয়েকে নিয়ে আগাম চলে যেতেন শিয়ালদার গাছের বাজারে। পছন্দ মত গাছ ট্রেনে তুলে তবে শান্তি। তাঁকে দেখে বড় হওয়া মেয়ে যে সবুজের মধ্যেই প্রাণের আরাম খুঁজে পাবে এ আর নতুন কথা কী!

বিয়ের পর গাছের শখটা আরও বেড়েছে। শ্বশুরবাড়ির তিনতলার ছাদে সকাল থেকে সন্ধে, প্রচুর রোদ। সেখানেই চলছে গাছ নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা। দোলনের ফেভারিট অবশ্য বনসাই আর নানান ফুলের গাছ। সত্তর আশিরকমের জবাই ফুটিয়েছেন টবের মাটিতে। তবে লকডাউনের  ছুটিতে হাত দিয়েছেন কোকোপিট্ দিয়ে জল ধরে রেখে কম মাটিতেও ফুল ফোটানোর পরিকল্পনায়। বললেন, এতে খরচ আহামরি বেশি নয় কিন্তু সুবিধে অনেক। বেশি গরমেও গাছেরা অনেক আরামে থাকে। আবার বার বার জল দেওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। এই ছুটিতে আস্তে আস্তে গাছগুলোকে মাটি থেকে সরিয়ে কোকোপিট্ দিয়ে টবে বসানর কাজ শুরু করেছেন দোলন। পাশাপাশি চলছে গার্ডেনিং নিয়ে পড়াশোনা। কীভাবে ভার্টিকাল গার্ডেনিং করে ঘরের কোণেই নতুন দৃষ্টিকোণ রচনা করা যায়, কোন গাছ ঘরে রাখলে এয়ার পিউরিফায়ারের কাজ করে, কম রোদ্দুরেও কার দিব্বি চলে যায়, কীভাবে কলার খোসা, পেঁয়াজের খোসা থেকে গাছের খাবার বানিয়ে অর্গানিক ফার্মিং করা যায় প্ল্যানিং চলছে তারও। আর এরই সঙ্গে চলছে পরিবারের রান্না, ডাস্টিং, টুকটাক ঘরকন্না আর কোকো নিমোদের পাশাপাশি সাধের মাছ, পাখিদের দেখভাল।

তানিয়ার বারান্দার সাজসজ্জা

ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা তানিয়া কিন্তু অতটাও অবসর পাননি। একে তো ঘরের কাজের সাহায্যকারী সক্কলকে ছুটি দিয়ে দিতে হয়েছে, তার ওপর স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকেই চালু হয়ে গেছে ছাত্র-ছাত্রীদের ‘স্কুল ফ্রম হোম’ আর দিদিমনির ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। প্রথম সপ্তাহটায় মনে হচ্ছিল রাতারাতি যেন কাজের একটা সুনামি কোত্থেকে ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছে। ছকবাঁধা জীবনে অভ্যস্ত তানিয়া বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে সবকিছু সামলাবেন। কোন কাজটা কীভাবে করলে সুবিধে হয়। তারপরে সেই সুনামির ঝড় একটু সামলে উঠে নিজের ছোট্ট বারান্দাটাকে একটু দেখার সুযোগ পেলেন। মানিপ্লান্টগুলোকে, সাকুলেন্টগুলোকে পরিষ্কার করে, টবগুলো মুছে ছোট ছোট মার্বেল স্ল্যাবগুলোকে পরিষ্কার করে একটু নতুন করে সাজিয়ে ফেললেন। নানা ধরনের কাচের বোতল, পাথরের ঘর সাজানোর টুকিটাকি, কিছু নতুন কিছু পুরনো জিনিস দিয়ে সাজিয়ে ফেলার পর যেন এক লহমায় ভোল পালটে গেল চেনা বারান্দার। ছোট টুলটা পেতে এক কাপ কফি আর প্রিয় বই নিয়ে বসতেই কখন যেন হুশ করে সময় কেটে গেল। দুই ছেলে-মেয়ে, আদি আর অর্ণার ডাকে হুঁশ ফিরতে দেখলেন শেষ বিকেলের আলো পিছলে যাচ্ছে তার সেরামিক টবের গায়ে।

interior design library photo anuradha
অনুরাধার লাইব্রেরি

চারপাশের ঘটনায় মাঝে মাঝে মনটা বেশ খারাপ লাগে। মনে হয় কতটা সুস্থ আর সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ দিয়ে যেতে পারব আমরা আমাদের সন্তানদের? মনখারাপটাকে সরিয়ে রাখতেই নিজের ছোট্ট জগৎটাকে সাজানোর কাজে মন দিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতার বাইপাসের অভিদীপ্তার বাসিন্দা, পেশায় ফার্মা কন্সাল্ট্যাণ্ট, ডঃ অনুরাধা চ্যাটার্জি। লকডাউনের সুযোগে পুরোনো পর্দাতেই নতুন করে সেলাইয়ের ফোঁড় তুলতে শুরু করেছেন তিনি। ভাবছেন হাতের কাজ শেষ হলে ওগুলো দিয়েই কুশন কভার বানাবেন। একটু কিছু নতুনত্ব হবে বেশ। ঘরেও ছোটোখাটো অদলবদল করেছেন এই কদিনে।আরামকেদারাটাকে সরিয়ে এনে পেতেছেন খানিকটা ব্যালকনি ঘেঁষে। গরমের বিকেলগুলোতে বসে একটু আকাশ দেখার আশায়। আবার এই সামান্য রদবদলেই ঘরটাও যেন বেশ বড় বড় লাগছে সবমিলিয়ে’। বাড়িতেই একটা বেশ ঈর্ষনীয় লাইব্রেরি তৈরি করেছেন অনুরাধা। ছেলে অর্ক, স্বামী ইন্দ্রায়ণ সবারই বই পড়ার নেশা। সেই লাইব্রেরিটাকেই আরেকটু অর্গানাইজ করতে এই হঠাৎ পাওয়া ছুটিটা বেশ কাজে লেগে গেল অনুরাধার। একইসঙ্গে হাত লাগিয়েছেন বারান্দার গাছেদের যত্নে। এসময় বাইরে গিয়ে খাবার কিনে আনা তো সম্ভব নয়। তাই সবজির অবশিষ্ট বেটে নিজেই ঘরে বানাচ্ছেন সার। চৈত্র পড়তে না পড়তে বেল, জুঁই গাছে ফুলও এসেছে ইতিমধ্যেই। সেই ফুলের গন্ধ নিয়ে চৈতালি বিকেলের হালকা হাওয়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় অনুরাধাকে। মনে হয় ফিসফিস করে  যেন বলে গেল, একটা দুঃসময় এসেছে, কেটেও যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

এক সময় বাংলা খবরের চ্যানেলে প্রোডাকশনের পেশায় যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করে আর দুই সন্তানের দেখভাল করেই হুশ করে কেটে যায় সংযুক্তার দিন। অবসর সময়ে ভালোবাসেন পরিবারের সকলের সঙ্গে বেড়াতে যেতে।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *