চারিদিকে শুধু জল আর জল। দোতলা বাড়ি জলের তলায়। বাড়ি তেতলা হলে শুধু গলাটুকু বাইরে। দোতলা তেতলা এখানে আর কোথায়। যা দেখা যাচ্ছে তা অনেক দূরে দূরে। ও…ই দূর গঞ্জে।
এ তো নিকষ্য গেরাম। কুঁড়েঘরে খড়ের ছাউনি। দু’চারটে ইঁটের গাঁথনির কোঠা আছে। মাথায় টিনের বা টালির ছাউনি। সব ডুবে আছে। চারদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের বাঁধ ভেঙেছে। দুরন্ত বেগে উল্টে পাল্টে বইছে মাটিধোওয়া ঘোলাটে জল। আজু রহমান দুটো গোরুকে নিয়ে সাঁতার কেটে চলেছে বিডিও অফিসের দিকে। ওদিকে যেতে পারলে একটু উঁচু ডাঙা পাবে। পাশেই হাইস্কুল। তিনটে ছেলেমেয়ে বৃষ্টি নামতেই ওখানে গিয়ে উঠেছে ক’দিন আগে। তখনও জল বাড়েনি এখানে। বরপেটা থেকে তাদের গাঁ প্রায় দশ কিলোমিটার ভেতরে। আজু সাঁতারে ভীষণ পটু ছোটবেলা থেকেই। ওরা আগে থাকত ধুবড়িতে, তার আগে অনেকদিন ছিল গোয়ালপাড়ায়।
হে…ই বাপ… কলকলে জলের টান গোরুগুলোকে হড়কে নিয়ে যাচ্ছে পেছনপানে ড্যামের দিকে। নাকানি চোবানি খাচ্ছে। ড্যামে গিয়ে পড়লে আর দেখতে হবে না। কোথায় তলিয়ে যাবে, কে জানে। আজুর একহাতে গোরুদুটোর গলার দড়ি ধরা আছে। আর এক হাতে সাঁতার কেটে চলেছে। ডাঙা পাবে আরও অন্তত তিন কিলোমিটার গেলে। একে তো নাগাড়ে বৃষ্টি, তায় লেগেছে হড়পার বান। কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি ! যেন কোটি কোটি সৈন্য জলের তির ছুড়ছে মাটির দিকে।
আজুর একহাতে দুটো গোরুরই গলার দড়ি ধরা। সে গোরু দুটোর মুখ ঘুরিয়ে দিল দক্ষিণে । হ্যাঁ… এবার দক্ষিণ বরাবর জলের টানে ভেসে যাবে আপনা আপনি। ভেসে থাকার জন্য ওদের কসরত করতে হয় না। এমনিই ভেসে যায়। আজুর হাতে ধরা আছে দড়ি।
***
আজুদের গোটা পরিবার সীমানা পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিল সেই কবে। সাল তারিখ কিছু জানা নেই। তার তখন জন্মই হয়নি। এখানে কীসব কাগজপত্র তৈরি হয়েছিল নাগরিক প্রমাণপত্র হিসেবে। আজুর ভালভাবে জানা নেই। বাপ-মা আর ওপরের দুই ভাই পরপর মরল তিন বছরের মধ্যে। মা যখন মারা গেল কী একটা জ্বরে ভুগে ভুগে, তার একমাস আগে আজুর শাদি হয়েছে। বাবার একটুকরো জমি ছিল। ধান জমি। তিন ভাই সেখানেই চাষ করত। কোনও ঝামেলা হয়নি কোনওদিন। দু’ভাই মরে যাবার পর আজু একা হয়ে গেল। তারপর পরপর তিনটে ছেলেমেয়ে হল। তাদের পরিচয়পত্র-টত্র কিছু নেই। ঘরে একটা টিনের বাক্স আছে। বাবা বলত, তাতে নাকি কীসব কাগজপত্র আছে। আজু কোনওদিন খুলেও দেখেনি। তার দাদারা জানত এসব। তারা তো এখন নেই। আজুরা নাকি আসলে অন্য দেশের লোক। ওই বর্ডারের ওপারের বাংলাদেশের লোক। সেখানে আজু কোনওদিন পা-ই দেয়নি। সে দেশ কোনওদিন চোখেও দেখেনি। এখন সবার মুখে শুনছে, তারা যে আসলে ইন্ডিয়ারই লোক তার প্রমাণ দিতে হবে। না হলে এদেশে আর থাকতে দেওয়া হবে না তাদের। পঞ্চায়েত থেকে তাদের গাঁয়ের ঘরে ঘরে নোটিস ধরিয়ে দিয়ে গেছে। কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ কর তোমরা এদেশি না ভিনদেশি।
ব্রহ্মপুত্রের বাঁধ ভেঙেছে। দুরন্ত বেগে উল্টে পাল্টে বইছে মাটিধোয়া ঘোলাটে জল। আজু রহমান দুটো গোরুকে নিয়ে সাঁতার কেটে চলেছে বিডিও অফিসের দিকে। ওদিকে যেতে পারলে একটু উঁচু ডাঙা পাবে।
যদিও আজুর দম প্রচুর, তবু একটানা সাঁতরাতে বা শুধু টানের মুখে ভেসে থাকতে থাকতে কেমন হাঁফ ধরে গা শিরশির করে। তা ছাড়া গোরু দুটোরও খানিক জিরেন দরকার। এই উঁচু উঁচু নারকেল গাছগুলোর বুক পর্যন্ত জল। কোনটা পুকুর, কোনটা বাজার কিছু ঠাহর করা যায় না। এই যে জলের একটু ওপরে বেশ খানিকটা ছড়িয়ে জেগে আছে বটগাছের শরীর। আজু চিনতে পারল—- এটা কুর্মীতলার বুড়োবট। গোরু দুটোকে টেনে এনে বটের ডালে কষে বেঁধে দিল, যাতে ওরা একটু জিরেন পায়। নিজে একটা ডালে চেপে বসল।
এ জায়গাটায় ছড়ানো বটের ডালপালার ঠেকায় জলের টান বেশ কম। জল ঘুরছে গাছের এ পাশে ও পাশে । কিছুক্ষণ অন্তর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ লাগছে গোরুদুটোর গায়ে। তাতে কোনও কষ্ট নেই ওদের। জলে পা ডুবিয়ে গাছের ডালে বসে আছে আজু। ও…ই দেখ, একটা জলঢোঁড়া হিলহিলিয়ে উঠছে বটের ডাল বেয়ে। তা উঠুক, আজু ভাবে। ওদেরও তো বাঁচতে হবে। তবে জাত সাপ হলে বড় ভয় লাগে। যদিও আজু অনেক জাতসাপ ধরেছে তাদের ঘরের আশপাশ থেকে। একটাকেও মারেনি। জঙ্গলে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। ওরা তো কারও ক্ষতি করে না। ভীষণ ভিতু। যখন খুব ভয় পায় তখন ছোবল মারে।
প্রায় পনেরো মিনিট কেটে গেল। এবার ফের রওয়ানা দিতে হয়। গোরুদুটোর দড়ি খুলে হাতে নিল। তারপর জলে ভেসে পড়ল আবার। বটের আওতা ছাড়াতেই ফের স্রোতের টান। ভেসে চলল সরসর করে। পায়ের আঙুলে কী একটা কামড়াল। উঃহু, কামড়ে ধরে আছে। আজু বুঝতে পারল কাঁকড়া দাঁড়া বসিয়েছে। কোনও রকমে ছাড়াল একটা হাত নীচের দিকে নিয়ে গিয়ে।
জলের টানে ভাসতে ভাসতেই আজুর মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরপাক খায়। এনআরসি, না কী বলছে সব, তার কাগজপত্তর ঠিকঠাক আছে তো! টিনের বাক্স খুলে তার বৌ বার করেছিল একদিন। সবার জন্ম তারিখের কাগজ আছে। বাবা-মার নামও আছে। তার বৌয়েরও আছে। খুব বুদ্ধি তার বৌ আনোয়ারার। বাপের বাড়ি থেকে আনিয়ে রেখেছে মাস ছয়েক আগে। তবে আর ভয় কিসের। তারা এনআরসি ফর্দে ঢুকবেই। আর এসব কাগজ যদি সরকারের অফিসাররা না মানে ….! তার বাচ্চাদের নামধাম যদি সরকারের খাতায় না মেলে, তখন কী হবে ! আজুর মাথা ঘোলা জলে পাক খেতে থাকে।
মা যখন মারা গেল কী একটা জ্বরে ভুগে ভুগে, তার একমাস আগে আজুর শাদি হয়েছে। বাবার একটুকরো জমি ছিল। ধান জমি। তিন ভাই সেখানেই চাষ করত।
এখন বেলা প্রায় একটা হবে। মাথার ওপর গনগনে সুয্যি থাকার কথা। আকাশ একেবারে ধোঁয়াটে মেঘে লেপা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। টিনের দেওয়ালওয়ালা ক্যাম্প হয়েছে দলগোমায়। বাচ্চাগুলোকে যদি ওখানে পাঠিয়ে দেয়! কেঁদে কেঁদে তো সারা হবে বেচারfরা…। তার চেয়ে ভাল সবাই মিলে বরাকের জলে ডুবে মরা।
ওই ওটা বোধহয় কোর্টবাড়ি। জলে গলা পর্যন্ত ডুবে আছে। থামগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে। দুটো মরা কুকুরের লাশ ভেসে যাচ্ছে… জলের ঘোর টানে আজুর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। পেট ফুলে ঢাক হয়ে আছে। এখনও বোধ হচ্ছে এক কিলোমিটারের মতো জল টানতে হবে।
***
আনোয়ারার আগের বর তালাক দিয়েছিল। নিকা হালালা হয়েছিল। তালাকের নতুন আইনকানুন তখন হয়নি। তারপর একদিন করিমগঞ্জের বাজারে আচমকা দেখা হয় আজুর সঙ্গে। দু’জনের নিকা হয়ে গেল একদিন হুট করে। আনোয়ারার কোনও বিটি ছাওয়াল ছিল না আগের পক্ষের। আনোয়ারাকে আজু একদিনের জন্যেও ছেড়ছাড় করেনি। আজুকে সে নতুন জীবন দিয়েছিল। মুশকিল হল, তারা একে মুসলমান, তায় আবার একাত্তরের পরের লোক। তার বাবাই তো এখানে একাত্তরের পরে এসেছিল। যদি এনআরসি-তে নাম না ওঠে কী হবে ! গেলে তারা সবাই মিলে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাবে। তারপর কি তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে? সেখানেও তো তারা আসলে পরদেশি। সে দেশ নেবে কেন তাদের? জন্মভূমি থেকেই যদি ভাগিয়ে দেওয়া হয়! কিন্তু টিনের বাক্সে তার বাবা তো কাগজপত্র তোয়ের করে রেখে গেছে! তাদের চলে যেতে হবেই বা কেন?
ওই যে শিবমন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে। শিবঠাকুর এখন প্রায় বারোফুট জলের তলায়। বড়মাঠের গাজনের পরব হয় চোত মাসে। ছেলেপুলে নিয়ে প্রত্যেকবার আজু-আনোয়ারা খুব আনন্দ করে এখানে এসে। নাই-বা হল হিঁদু, বাঙালি তো বটে! কী আশ্চর্য, মন্দিরের চূড়াটা ছোঁয়া গেল একহাত দিয়ে! শিবমন্দির পার হয়ে গেল আজু গোরুদুটোকে নিয়ে। আর একটু ভেসে থাক বাবারা। এই তো এসে গেল প্রায়। আর আধ কিলোমিটার।
বর্ষা হোক, দুর্যোগ হোক, দুষ্ট লোকের দুষ্ট প্রবিত্তি যায় না কখনও। কাম প্রবিত্তি মরে না কারও কারও। এই যেমন নিশীথ। নিশীথ দাস। সেও কিন্তু বাঙালি। এখানে আছে পাঁচপুরুষ ধরে। জমি জিরেত করেছে বিস্তর। পয়সার গরম খুব। আনোয়ারার পেছনে লেগে আছে অনেকদিন ধরে। এই যেদিন বানের জল উঠে এসেছে চৌকাঠের ধারে, সেদিনও ডাকাডাকি করছিল জানলা দিয়ে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কি প্রবিত্তি বোঝ। মেয়েমানুষের গায়ের গন্ধ এত মধুর! আনোয়ারা আর কতবার শিকার হবে? নিকা হালালের লোকটাও সুবিধের ছিল না। একমাস ধরে আনোয়ারাকে ছিঁড়ে খেয়েছে।
আজুরা নাকি আসলে অন্য দেশের লোক। ওই বর্ডারের ওপারের বাংলাদেশের লোক। সেখানে আজু কোনও দিন পা-ই দেয়নি। সে দেশ কোনও দিন চোখেও দেখেনি।
এই যাঃ, সামনে পড়েছে একটা ঘূর্ণী। অনেকটা জায়গা জুড়ে। বনবন করে জল ঘুরছে। বরাক আর ব্রহ্মপুত্র দু’দিকের বাঁধের টান লেগেছে এক জায়গায়। দুই টানে দিশাহারা জল ঘুরপাক খাচ্ছে ভীষণ জোরে, এগোবার পথ না পেয়ে। ওর মধ্যে গিয়ে পড়লে আর দেখতে হবে না। কোন পাতালে টেনে নিয়ে যাবে কে জানে। কোনও ওস্তাদ সাঁতারুও বাঁচার উপায় পাবে না। এখন আড়াআড়ি সাঁতার টানতে হবে বাঁ হাতে বরাকের দিকে। তারপর আবার সিধে টান। পথটা অনেকটা ঘুর হয়ে গেল। গোরু দুটো হাঁফিয়ে পড়ছে। তার নিজেরও দম ফুরিয়ে আসছে। এখন আর একবার একটু জিরেন দিতে পারলে হত। এই যে… বাঁ পাশে ঘুরতে আট দশটা বাঁশের আগা দেখতে পেল আজু। ভাবল, এইখেনে একটু ঠেকা দিই। জলের মধ্যে হিলহিল করে সাপ যাচ্ছে এদিক এদিক। তার মধ্যে জাতসাপও আছে, আজু বুঝতে পারল। ওরাও একটু ডাঙা খুঁজছে। একনাগাড়ে কাঁহাতক জলে থাকা যায়। আজু আবার গোরুর দড়ি বাঁধল জলে বেরিয়ে থাকা বাঁশের আগার দিকে।
***
চল্লিশ বছরের ওপর একদেশে থাকার পর তারা কী করে পরদেশি হয়, মাথায় আসে না আজুর। ঘূর্ণি এড়িয়ে ঘুরে যেতে গিয়ে আরও আধ কিলোমিটার বেড়ে গেল। রাস্তাটা প্রায় মেরে এনেছিল। এখন আবার বেড়ে গেল। কলজের হাওয়া যে ফুরিয়ে আসছে…
হ্যাঁ, ঘুরণটার পাশ কাটানো গেছে কোনওরকমে। কাটাবার পর একটু সুবিধে হল। এপাশে জলের টান আরও খর। হুড়মুড় করে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আর মেলা পথ বাকি নেই। আবার বৃষ্টি পড়তে লাগল। কী জ্বালা।এই ভর দুপুরে অন্ধকার করে এসেছে। এর মধ্যেও আজুর মনে পড়ল— জলের তলায় ডোবা ঘরের মধ্যে টিনের তোরঙে তার আর আনোয়ারার ভোটার কার্ড আছে। অংলং-এ এসডিও অফিসে গিয়ে ফটো তোলা হয়েছিল। জল নামলে ওই বাক্স খুলতে হবে।
জলের মধ্যে দুটো বড় মাছ ঘাই মারল। বোয়াল মনে হল। এদিকটায় কাছেই নদী। ওখান থেকে প্রচুর মাছ ভেসে আসছে। জলের ধাক্কায় বাস্তুহারা হয়েও মহানন্দে সাঁতরাচ্ছে জলে। ওদের কেউ বিদেশি বলবে? মাছের মতো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে আজুর।
ওই যে… ওই ওখানে ঘোলাটে আকাশের নীচে আবছা দেখা যাচ্ছে ডাঙা। বর্ষাধোয়া কালচে গাছপালা। জলে ভেজা হলুদরঙা ইস্কুল বাড়ি। আজুর দু’পাশ দিয়ে প্রবল বেগে ভেসে চলেছে গাদা গাদা মোটা মোটা লতাপাতা। আরও আধঘণ্টার মতো জল টানার পর আজু পায়ের নীচে কাদা পেল। গোরু দুটোর এখন বুকের নীচে জল….
আজু কাদা চপচপে চরে এসে উঠল। উঠে গোরুর সারা গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল। তাতে যদি একটু তাজা হয়। বড্ড কষ্ট গেছে বেচারিদের। মাখমের মতো নরম এঁটেল মাটির কাদা। এক পা কোনও গতিকে তুললে আর এক পা বসে যাচ্ছে। তেমনি হড়হড়ে আঠালো। দড়ি ছেড়ে দিয়ে গোরুগুলোকে পেছনদিক থেকে ঠেলা মেরে তুলতে লাগল। এখন বৃষ্টিটা একটু ধরেছে এই রক্ষে। পাড়ের ওপরটায় জনমনিষ্যি নজরে আসছে না। বৃষ্টির ঝাপটায় সব গুটিয়ে গেছে ঘরের কোণে। কাউকে দেখা গেলে দুটো বাঁশের লগা ফেলে দিতে বলত। লগা দুটো কাদায় পুঁতে দিয়ে চাড় মেরে মেরে উঠে আসত।
মুশকিল হল, তারা একে মুসলমান, তায় আবার একাত্তরের পরের লোক। তার বাবাই তো এখানে একাত্তরের পরে এসেছিল। যদি এনআরসি-তে নাম না ওঠে কী হবে !
আচ্ছা, তারা যদি ডিটেনশন ক্যাম্পে যায়, তার গোরু দুটোকে নিয়ে যেতে দেবে তো? আজুকে ছেড়ে ওরা কোথায় থাকবে? কেই বা ওদের খাওয়াবে! আজুর মাথায় নানা চিন্তা পাক খেতে থাকে। সে যাই হোক, আজু প্রাণান্তকর চেষ্টায় গোরু দুটোকে নিয়ে উঁচু ঘাসজমির নীচে গিয়ে পৌঁছল। এখন ওপরটায় গিয়ে উঠতে পারলে হয়। ওই ওখানটায় মাটির ঢাল আছে। ওখান দিয়েই উঠতে হবে। উঠতে গিয়ে হড়হড়িয়ে আবার নীচে না পিছলে যায়। তাহলে এতক্ষণের খাটনি মাটি। কপালজোরে সেটা অবশ্য হল না। আজু গোরু-সমেত ওপরের ঘাস জমিতে উঠে এল। আর এট্টুখানি হাঁটলেই ওই হলুদরঙা ইস্কুলবাড়ি।
ওখানে উঠে আবার একটু দাঁড়াল আজু। গোরুদুটোর হাঁফ ধরেছে বোধহয়। ওদের বুকের দু’পাশে হাল্কা মালিশ করতে লাগল। ওদের গলায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে দাঁডিয়ে। গলা উঁচু করে আদর খাচ্ছে ওরা।
***
গোরু দুটোকে একটা ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে ইস্কুলবাড়িতে গিয়ে ঢুকল আজু। এখানে প্রচুর ঘাস। গোরুদুটো খেতে পারবে। খিদেয় ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ছে শরীর। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি। শুধু ডাঙা পাবার চিন্তা ছিল মাথায়। শরীরের চিন্তা উড়ে গিয়েছিল। তাকে দেখে আনোয়ারা আর তার ছেলেমেয়েরা ছুটে এল। আনোয়ারা একটা গামছা দিল গা মোছার জন্য। এখানে সবাইকে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছে। আজুও আর দেরি না করে বসে গেল খেতে ভিজে কাপড়েই।
পাশেই বিডিও অফিস। সেখানে বিরাট লাইন। দু’জন অফিসার গম্ভীর মুখে বসে সেই সকাল থেকে কাগজপত্র পরীক্ষা করছে। গেজেটে পেন্সিল বুলিয়ে দেখছে এনআরসি খাতায় কার নাম আছে, কার নেই। একটা নিম গাছের আড়ালে অফিসের জানলা। নিমডালের আড়ালে ওই খোলা জানলা দিয়ে সব দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টিটা ধরেছে এখন। একটু আলোও ফুটছে যেন আকাশে। এখানে কোনও বসার জায়গা নেই। যে তিনটে বেঞ্চি আছে তাতে লোক ভর্তি।
আজু গোগ্রাসে খিচুড়ি খেতে লাগল ওসব দিকে মন না দিয়ে। খাবার পরে মেঝেয় বসল ওরা সকলে। রাজ্যের ঘুম এসে ভর করল আজুর দু’চোখে। এলিয়ে পড়ল শরীর। ঘণ্টাখানেক পরে আনোয়ারা ঠেলা মেরে তুলল আজুকে। ‘এই শুনছ…. বিডিও অফিসে ডাকছে এখানকার সবাইকে। কাগজপত্র মেলাতে চাইছে। আজকেই নাকি শেষদিন। রাত দশটা পয্যন্ত কাজ চলবে। সবাই ওখানে গিয়ে লাইন মেরেছে। আমাদের কী হবে গো ! তুমি তো কাগজপত্র আনতে পারনি কিছু… আমাদের কি তা’লে দলগোমার ক্যাম্পে চালান করবে!’
এপাশে জলের টান আরও খর। হুড়মুড় করে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আর মেলা পথ বাকি নেই। আবার বৃষ্টি পড়তে লাগল। কী জ্বালা। এই ভর দুপুরে অন্ধকার করে এসেছে।
আজু ঘুম থেকে উঠে থম মেরে বসে থাকল। বেলা প্রায় চারটে বাজে। বৃষ্টি ধরে গেছে। কালো মেঘে চিড় ধরেছে। আলো উঁকি মারছে একটু একটু। দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল আজু। গোরু দুটো বসে বসে জাবর কাটছে নিশ্চিন্তে। অনেকটা ঘাস খেয়ে নিয়েছে নিশ্চই এর মধ্যে। আজু ভাবল তারও যদি এমন জীবন হত… ! জলের তলায় ডুবে আছে ঘর। সেখানে আছে টিনের তোরঙ। খুললে পাওয়া যাবে সাত রাজার ধন এক মানিক… পরিচয়পত্তর।
আজুর আবার ঢুলুনি আসে। ভাবে, জলের ছালায় সে সব কি আর আছে? থাকলেও কি আর চেনা যাবে সে সব? তবু ওগুলোকে তুলে আনার জন্য আর একবার ঝাঁপাতে হবে। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে বাঁচার জন্য।
রাত দশটা পর্যন্ত কাজ চলবে বিডিও অফিসে। বিবি-বাচ্চাদের শুকনো ডাঙায় রেখে আজু বিকেল সাড়ে চারটেয় হড়পার বানের জলে আবার ঝাঁপ মারল ছ’কিলোমিটার উজিয়ে তার ডুবে থাকা ঘরের টিনের তোরঙ থেকে গোটা পরিবারের বংশলতিকা ছেঁচে আনবার জন্য।
দেখে সোয়াস্তি এল, তার গোরু দুটো নিশ্চিন্ত মনে জাবর কাটছে।
*ছবি সৌজন্য – Pinterest
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণায় জন্ম ১৯৫৩ সালে। কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। প্রথাগত পড়াশোনা থেকে চিরকালই পলাতক। লেখালেখির সঙ্গে জড়িত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। ফিলহাল ডিজিটাল বা সোশ্যাল মিডিয়ায় মনোনিবিষ্ট। চাকরি ঘুরে ফিরে বিভিন্ন জায়গায়।