‘হরি হরায় নমঃ, কৃষ্ণ যাদবায় নম, যাদবায় মাধবায় কেশবায় নমঃ…
সহিসের ছপটির মারে তীরগতিতে জঙ্গলের পথ ধরে ছুটেছিল তাগড়া দুটো ওয়েলার ঘোড়ার গাড়িটা। দরজার দুপাশে বন্দুকধারী দুজন সেপাই। গাড়ির ঝাঁকুনিতে দুলছিল মেঝেয় পড়ে থাকা দেহটা… এই হারিয়ে যাওয়া, পরমুহূর্তেই ফিরে আসা লাব-ডুব চেতন অবচেতনের মাঝখানে ভেসে ওঠা একের পর এক ছবি… কখনও ঝাপসা, কখনও বা স্বচ্ছ…গাঢ়ভাতছালার সেই কুঁড়েঘরটা্… রাধামাধবের যুগলমূর্তির সামনে বসে বিভোর হয়ে কীর্তন গাইছে মা… দোহার ধরেছে বাবা আর ভাইবোনেরা… তন্ময় হয়ে শ্রীখোল বাজাচ্ছে দশ বারো বছরের ছেলেটা… চোখে স্বপ্ন নবদ্বীপ গিয়ে বোষ্টম হবে… “হরি নামে আনন্দ পাবে বল হরিবোল…” দাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে হরির লুটের লাল লাল গুড়ের বাতাসা… ছুটে আসছে ভগবান, মেঘা, পাড়ার ছেলেরা আর ভাই বোনেরা… লুটেপুটে খাচ্ছে সবাই মিলে হুড়োহুড়ি করে… দেয়ালে দাঁড় করানো ঠাকুদ্দা কানাই বাগদীর লাঠি… হাত ছোঁয়ানো মাত্র বিদ্যুতের স্পর্শ সারা শরীরে…পীতাম্বর, নলে, সন্ন্যাসী, প্রেমচাঁদ, ইস্কান্দার, জলিল, ভগবান, কালো, দমন… কোথায় ওরা…পরিহারের গড়…ঠাকুরসাহেব, বীণা… নৌকোয় চড়ে শ্বশুরবাড়ি চলেছে বিজয়া মা ঠাকুরণ… আসান নগরের আখড়া… হাত নেড়ে ডাকছে পাঁচকড়ি সর্দার… গভীর জঙ্গলে ভৈরবের থানে বসে রয়েছেন জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গীবাবা… হেঁকে উঠছেন মেঘের মত গলায়… “তোকে ঘিরে একটা পিশাচবলয় দেখতে পাচ্ছি আমি… সাবধান থাকিস তুই…মা কালী সহায় হন তোর”… পাশে বসে থাবা চাটছে ভীমা… “খুনখারাপিতে আর মন লাগছে না রে বিশে”… করুণ আর্তি মনোহরের গলায়… মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দুর্গা… গর্ভের মধ্যে চিৎকার করছে বেড়ে ওঠা ভ্রুণ…হাত পা ছুঁড়ছে তীব্র যন্ত্রণায়… “আমার বাবা কোথায়!”… কপালে নরম ঠাণ্ডা আঙুলের স্পর্শ… চোখ ভেঙে নেমে আসছে ঘুম… থিরথির করে কাঁপতে কাঁপতে বন্ধ হয়ে গেল অর্ধনির্মিলীত চোখদুটো। ছুটতে ছুটতে জঙ্গলের বাঁকে মিলিয়ে গেল ঘোড়ার গাড়ি।
আজ যারা ওর বাপকে বিশে ডাকাত, বাগদীর ব্যাটা বলে গাল দেয় তারাই সেদিন ওর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে বলবে- রাজা অমরনাথ। নিজে হয়ত সেদিনটা দেখে যেতে পারবেন না কিন্তু দুর্গা, বীণা, বিজয়া, ভগবান ওরা দেখবেই। ভাবতেই রোমাঞ্চে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ঠাকুরসাহেবের।
পরিহার গড়ের অলিন্দে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন অর্জুন সিংহ। বিধ্বস্ত চোখমুখের চেহারা। গত দুদিনে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে বাড়িটার ওপর দিয়ে। সেদিন রাতে খবরটা শোনার পরই তীব্র চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায় দুর্গা। মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরলেই অস্থিরভাবে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। ঘোর উন্মাদিনীর মত দুটো চোখ।
— “কোথায় গেল সে? এই তো ছিল… তোমরা কেউ দেখেছ তাকে?”
সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞেস করছে আকুল গলায়। পরমুহূর্তেই জ্ঞান হারাচ্ছে ফের। অবস্থা দেখে আজ বিকেলে ভিষগাচার্য হেমচন্দ্র বৈদ্যকে পাল্কি পাঠিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল সদর থেকে। অনেকক্ষণ ধরে রোগীকে পরীক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসছিলেন কবিরাজমশাই। সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন ঠাকুরসাহেব।
— “অবস্থা কিরকম বুঝছেন কবিরাজমশাই?” প্রশ্ন করেছিলেন উদ্বেগমাখা গলায়। জবাবে মৃদু হেসেছিলেন ভিষগাচার্য।
— “ আসলে আঘাতটা তো দেহের নয়, মনের। সে অতি জটিল বস্তু। নিজে নিজে সেরে উঠতে না চাইলে তাকে নিরাময় করে সাধ্য কার? তবু ঘরে ফিরে দু একটি ওষধি বানিয়ে দিচ্ছি। পাঠিয়ে দেব বেহারাদের হাত দিয়ে। অনুপান অনুযায়ী নিয়ম মেনে সেবন করতে হবে প্রহরে প্রহরে। এরপর সবই মহামায়ার ইচ্ছে।”
নমস্কার করে ভিষগাচার্যের হাতে নগদ একটি রৌপ্যমুদ্রা দক্ষিণা হিসাবে তুলে দিয়েছিলেন ঠাকুরসাহেব। সেই ওষুধ নিয়ে পাল্কি বেহারারা ফেরেনি এখনও। পায়চারি করতে করতেই দোতলায় দুর্গার ঘরের দিকে তাকালেন অর্জুন। মৃদু আলো ভেসে আসছে শার্সির কাচের ওপার থেকে। অষ্টপ্রহর পালা করে দুর্গার শুশ্রূষার ভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে বিজয়া আর ভোগলের মা। দুজন কাজের দাসীও সবসময় রয়েছে সঙ্গে। চিরকালই বীণার প্রতি টানটা যেন একটু বেশিই ছিল অমরনাথের। বীণাকে “বড়ি মা” বলে ডাকে বিশ্বনাথের শিশুপুত্রটি। এই কদিনে সেই টানটা যেন বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। নিজের মনেই বিষণ্ণভাবে হাসলেন ঠাকুরসাহেব। সারাজীবন কিছুই তো পেল না মেয়েটা। এখন শিবরাত্রির সলতের মত এই একরত্তি শিশুটি… বীণার আশা ভরসার একমাত্র জায়গা… পরিহার গড়ে ভবিষ্যতের একলওতা ওয়ারিশন… খুব যত্নে বড় করে তুলতে হবে চারাগাছটাকে।
এই পাণ্ডববর্জিত গড়ের মধ্যে ওকে আটকে রাখা উচিৎ হবে না কোনওমতেই। পড়হালিখা, তালিম শেখাতে পাঠাতে হবে সদরে নয়ত কোলকেতায়। তালিম নিয়ে এই পরিহারের গড়ে ফিরে আসবে অমরনাথ। গরীব মানুষের ভাল করতে চেয়ে একটা বহোত লম্বা খতরনাক রাস্তায় হেঁটেছিল ওর বাপ। অমরনাথও ওই একই কাজ করবে তবে তালিমের রাস্তায় হেঁটে। আজ যারা ওর বাপকে বিশে ডাকাত, বাগদীর ব্যাটা বলে গাল দেয় তারাই সেদিন ওর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে বলবে- রাজা অমরনাথ। নিজে হয়ত সেদিনটা দেখে যেতে পারবেন না কিন্তু দুর্গা, বীণা, বিজয়া, ভগবান ওরা দেখবেই। ভাবতেই রোমাঞ্চে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ঠাকুরসাহেবের। এসব ভাবনাচিন্তার মাঝখানেই অলিন্দে এসে দাঁড়ালো পাল্কিবাহক দুজন। পিছনে ভগবান। ঠাকুরসাহেবের হাতে একটা কাগজ তুলে দিল বেহারাদের একজন।
— “এতে ওষুধের মাত্রা লিখে দিয়েছেন কোবরেজমশাই। নিয়ম বেঁধে খাওয়াতে বলেছেন।”
— “তোরা এখুনি গিয়ে বিজয়া মায়ের হাতে ওষুধপত্তর আর চিরকুটটা দিয়ে আয়।
— “কী খবর চারদিকে?” প্রশ্ন করলেন অর্জুন সিংহ।
জবাবে বিষণ্ণ চোখে ঠাকুরসাহেবের দিকে তাকাল ভগবান।
— “গাঁয়ে গাঁয়ে অরন্ধন চলছে। একজন প্রজা রায়তের ঘরেও উনুন জ্বলেনি দুদিন হল। বিশের শোকে পাগল হয়ে গেছে সবাই।”
শোনার পর অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন ঠাকুরসাহবে। আরও কাছে এগিয়ে এল ভগবান।
— “শিউলাল, কানহাইয়াদের কাছে শুনলাম আপনি নাকি লোক পাঠিয়েছিলেন সদরে। কোনও খবর পেলেন?”
জবাবে গভীর একটা শ্বাস ফেললেন অর্জুন।
— “ঠিকই শুনেছ তুমি। বিশ্বনাথের খবরটা পাওয়ামাত্র আমার খুব ওয়াফাদার একজনকে পাঠিয়েছিলাম সদরে। সাহবের দপ্তরে বেশ কয়েকজন সায়েবসুবো রাজপুরুষের সঙ্গে পরিচয় আছে। যা শুনলাম তাতে অবস্থা একদমই ভাল নয় বলেই মনে হচ্ছে। প্রাণটা কোনমতে ধুকপুক করে টিকে আছে এই পর্যন্ত। তবে কলকাত্তা থেকে আংরেজ ডাগদারদের নিয়ে আসা হয়েছে। সবাই মিলে চেষ্টা চালাচ্ছে খুব জোর। ডাগদারবাবুরা নাকি দেখে তাজ্জব বনে যাচ্ছেন এতগুলো তীরের চোট আর গুলি খাবার পরও লোকটা জিন্দা রয়েছে কী করে? শুনছি ইলাজ করে সারিয়ে তুলতে পারলে ওকে নাকি কোলকাত্তায় নিয়ে যাওয়া হবে…”
বলে মাথা ঝুঁকিয়ে চুপ করে গেলেন ঠাকুরসাহেব।
— “তারপর কী ঠাকুরসাহেব! তারপর কী?… তীব্র আর্তনাদে ফেটে পড়ল ভগবান, ‘একবার বলুন আমায় তারপর কী?”
মাথা তুলে ভগবানের দুকাঁধে হাত রাখলেন অর্জুন সিংহ
— “শান্ত হও ভগবান। যা সচ আছে তাকে মেনে নিতে হবে।”
— “এ হতে পারেনা। কিছুতেই না…।” বলতে বলতে দমফাটা কান্নায় ঠাকুরসাহেবের বুকে ভেঙ্গে পড়ল ভগবান।
মধ্যরাত্রি। কালীঘাট মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছেন চৌরঙ্গীবাবা। জঙ্গলগিরি ভৈরব। “এটা কি তোর ঠিক বিচার হল মা? তোর দুলহারা বাচ্চা… তোর পহেলা নম্বর পাইক রাজা বিশ্বনাথ। তাকে রক্ষা করতে পারলি না তুই? আব গরীব কা দুখ মে কওন রোয়েগা? কিসকে পাস দওড়কে যায়গা বেসাহারা লাচার লোগ। আব জঙ্গল কাটকে নগরী বাসায়েগা আংরেজ আওর বানিয়া। তালাও বুঝাকে মহেল খাড়া করেগা। তখন কোথায় যাবে ভীমা শের, মগরমাচ্ছি, চিতা ভালু, হিরণ আর ওদের বাচ্চারা? জবাব দে মা। জবাব চাহিয়ে হামে…” গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলেই চলেছেন জঙ্গলগিরি। একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন গর্ভগৃহের মেঝেয়। অনেকক্ষণ বাদে চোখ তুলে তাকালেন মূর্তির দিকে। “সমঝ গয়ে হাম, আমার সওয়ালের জবাব নেই তোর কাছে। যতদিন না সে জবাব আমি পাই ততদিন আমি ফিরব না তোর এই পোড়া বঙ্গালে। শুন সাকতি হায় তো শুন লে তু… যা রহা হুঁ ম্যায়…।” হাহাকার করতে করতে গর্ভগৃহ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন চৌরঙ্গীবাবা।
কলকাত্তা থেকে আংরেজ ডাগদারদের নিয়ে আসা হয়েছে। সবাই মিলে চেষ্টা চালাচ্ছে খুব জোর। ডাগদারবাবুরা নাকি দেখে তাজ্জব বনে যাচ্ছেন এতগুলো তীরের চোট আর গুলি খাবার পরও লোকটা জিন্দা রয়েছে কী করে? শুনছি ইলাজ করে সারিয়ে তুলতে পারলে ওকে নাকি কোলকাত্তায় নিয়ে যাওয়া হবে…
বিকেলবেলা। কালীঘাটে বুড়িগঙ্গার পাড়ে নিজের গদিতে বসে রয়েছে হারাধন সর্দার। চোখ গদির বাইরে গঙ্গার দিকে। গোটা চারেক বড় বড় আট দাঁড়ের নৌকো বাঁধা রয়েছে ঘাটে। মালপত্র ওঠাচ্ছে কর্মচারীরা। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নাওদার হারাধন। আট আটখানা নৌকোর মালিক। বড় বড় তেজারতি কারবারি, আড়তদার আর মহাজন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাকা চুক্তি বন্দোবস্ত রয়েছে ওর। চাল, নুন, পাট, তেল, মশলা, মুলিবাঁশ, সিল্ক, আরও হরেক রকম বেসাতির পশরা নিয়ে কালীঘাট থেকে ব্যাতর, শালিখা,আদিসপ্তগ্রাম, চন্দ্রকেতুগড়, কালনা হয়ে সেই ভাগলপুর, ইলাহাবাদ, দক্ষিণের কালিকট, মাদ্রাজ পর্যন্ত যাতায়াত করে হারাধনের নৌকো। এ কারবারে বেশ নামডাক হয়েছে ওর। হারাধনবাবুর নাওয়ে মাল পাঠানো মানে ষোলোআনা নিশ্চিন্তি। লোকসান গুনেগারের ভয় নেই কোনওভাবেই। এমনটাই কথা চালু রয়েছে কারবারি মহলে।
— “বাবু সন্ধে হল, বাড়ি যাবেন না?” সামনে এসে দাঁড়াল বগলাচরণ। অনেকদিনের পুরনো কর্মচারী। অত্যন্ত বিশ্বস্ত। কারবারের শুরু থেকেই রয়েছে সঙ্গে।
— “মালপত্তর সব তোলা হয়ে গেছে?” জিজ্ঞেস করল হারাধন।
— “হ্যাঁ” ঘাড় নাড়ল বগলা।
— “কাল ভোর ভোর চারখানা নাও ঘাট ছাড়বে। মাল্লাদের সবাইকে কয়ে রেখেছি আমি।”
— “ঠিক আছে, তুই চাবিটা রেখে চলে যা, আমি একটু পরে বেরোচ্ছি” বলল হারাধন।
চলে গেল বগলা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে। সূর্য ডুবছে চেতলার ওপারে। উদাস চোখে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইল হারাধন। এই বুড়িগঙ্গা ধরেই স্যাঙ্গাতদের নিয়ে কাজে যেত বাবা। সুতোনুটি, ব্যায়লা, সালকে… বৈদ্যবাটি, রিষড়ে, শ্রীরামপুর, ফরাসডাঙ্গা ঢুকলেই সঙ্গ নিত কালো কাকা, দমন কাকা। একজোট হয়ে কাজে বেরত সবাই… এই বুড়িগঙ্গার ঘাটেই ষোল মাল্লার বজরায় চড়ে এসে নেমেছিল বিশে কাকা। সর্দারের সর্দার। কালীর পাইক রাজা বিশ্বনাথ। সঙ্গে দেড়শ ডাকাত… অদ্ভুত মানুষজন সব। চাইলে আর দশজন ছাপোষা গেরস্থ যেভাবে বাঁচে সেভাবেই নিত্যদিনের দুঃখ কষ্ট চেটে চেটে বাঁচতেই পারত সবাই। তা না করে অন্যরকম বেতালা বেসুরো রাস্তা বেছে নিয়েছিল একটা। চারপাশে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ, ধর্ম অধর্ম সবকিছু বুঝে নিয়েছিল নিজেদের মত করে। বাবার কথা মনে পড়ছে খুব। বাপের দুচোখের মণি ছিল হারাধন। একটু বেড়ে উঠতেই ওকে ভর্তি করে দিয়েছিল ভবানীপুরে পাদ্রিদের স্কুলে। বিশেকাকাই নাকি এমনটা করতে বলেছিল বাবাকে। শেষ বয়সে ক্ষয়রোগ ধরেছিল।
— “এ রাজরোগ। চিকিচ্ছে শাস্ত্রে এর কোন ওষুধ নেই।” নিদেন দিয়েছিলেন কোবরেজমশাইরা।
ঘরের পাশে আরেকটা ছোট কুঁড়েঘর তুলে নিয়েছিল বাবা। রাতদিন বসে হুঁকো টানত আর কাশত বেদম। দলা দলা কাঁচা রক্ত উঠে আসত কফের সঙ্গে। বিশাল বাঘের মত আড়া শরীরখানা এতটুকু হয়ে গেছিল শুকিয়ে। হারাধন তখন ষোল কি সতেরো। বুড়ি পিসিঠাকুমা গত হয়েছে বছর দুয়েক হল। একদিন রাতে ওকে ডেকেছিল বাবা।
— “আমাকে একটু ওখানটায় নিয়ে চল হারাধন, বাপ আমার” কাঁপা কাঁপা হাত তুলে দেখিয়েছিল হাত বিশেক দূরে অশ্বত্থ গাছটার দিকে। বাপের হাত ধরে নিয়ে গেছিল হারাধন।
— “এইখানটায় খোঁড়।” আঙুল দিয়ে গাছের নিচে একটা জায়গা দেখিয়ে ছিল বাবা।
হাত পাঁচেক মাটি খুঁড়তেই পরপর সাজানো তিনটে পেতলের ঘড়া। কাঁচা টাকা, মোহর আর গয়নাগাটিতে ঠাসা।
— “এগুলো নিয়ে ব্যবসাপাতি শুরু করবি। সৎপথে থাকবি। লাভের টাকা একা একা ভোগ করবি না। গরীবের মঙ্গলেও লাগাবি। অক্ষয় পুন্যি হবে তোর। রাজা বিশ্বনাথ এই মন্তর শিখিয়ে গেছিল আমাকে। আজ তোর কানেও তুলে দিলুম মন্তরটা। বাপের কথাটা আজীবন মনে রাখিস মানিক আমার।”
কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল বাবা। এর মাসখানেকের মধ্যেই মৃত্যু হয় বাবার। ক্যাওড়াতলা শ্মশানে তিনমণ চন্দনকাঠের চিতায় বাবাকে দাহ করেছিল হারাধন। আজ অবধি বাবার শেষ কথাগুলো মেনে চলেছে অক্ষরে অক্ষরে। প্রচুর অনাথ দুঃখী আঁতুড়কে নিয়মিত অর্থসাহায্য করে থাকে ও। কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা থেকে অসহায় সহায় সম্বলহীন বিধবা। অর্থকষ্টে পড়ে কেউ ছুটে এলে তারজন্য হারাধন সর্দারের দরজা সবসময় খোলা। লাভের তহবিল থেকে একটি অংশ তোলা থাকে দরিদ্র, মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য়ের জন্য। শহরজুড়ে বেশ কয়েকটি অন্নসত্র, জলসত্রও খুলেছে হারাধন অতি সম্প্রতি। সরোবরের ধারে কালীমন্দিরটি সংস্কার করেছে। নিজের বাসস্থান সংলগ্ন পল্লিটির নামকরণ করেছে বাবার নামে- মনোহর পুকুর। ঢং ঢং ভেসে আসা কাঁসর ঘণ্টার শব্দ। সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে কালীঘাট মন্দিরে। গঙ্গার ওপারে চেতলার মুসলমানপাড়ার মসজিদ থেকে আজানের আওয়াজ। গদি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মনোহর। কাজ শেষ আজকের মত। ঘরে ফেরার পালা এবার। স্ত্রী- পুত্র পরিবার… প্রিয়জনেরা… ওর অপেক্ষায় রয়েছে সবাই। “বিবেক সদা পরিচ্ছন্ন রাখিয়ো। যাহারা সর্বদা তোমার সদাচরণের নিন্দা করে, তাহারাও যেন তোমার অপবাদে লজ্জিত হয়।” সেই কোন ছোটবেলায় পাঠ করে শোনাতেন মিশনারি ইশকুলের বুড়ো পাদ্রীবাবা। পঙক্তি দুটি বড় প্রিয় হারাধনের। নিজের মনে আওড়াতে আওড়াতে বাড়ির পথে রওনা দিল হারাধন।
*সমাপ্ত*
শোণিতমন্ত্র ধারাবাহিক উপন্য়াসের পুরনো পর্ব পড়তে ক্লিক করুন:
[১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১] [২২] [২৩] [২৪] [২৫] [২৬] [২৭] [২৮] [২৯]
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
প্রত্যেকটি পর্ব পড়েছি। ধারাবাহিক উপন্যাসের টানটান উত্তেজনায় ভরা ঐতিহাসিক এই আখ্যান। ভাল লাগলো।
এটা কি লিখেছো কমরেড? এটা কি কোনো মানুষের লেখা হতে পারে? এ তো ব্ল্যাক হোলের থেকে ছিটকে আসা সমস্ত ডার্ক ম্যাটার এর সম্মিলিত প্রেম। প্রতিটি ছত্রে এক একটি সময় কে ধরা ? এটা কে সত্যি অনবদ্য, অশ্রুতপূর্ব বললে অপমান করা হবে , এই ভালোবাসা, এই মমতা কি মানুষের শরীরে বেঁধে রাখা যায় , তুমি কি রেখেছো , নাকি পুরো ইতিহাস কিছুক্ষনের জন্যে তোমার মধ্যে এসে আমাদের দিয়ে গেলো ? আপ্লুত হওয়া যখন বড়ো কম পড়ে যায় , তখন কি ভাষা দিয়ে তাকে সম্মান করা যায়? বাংলা সাহিত্য বহু পরে এই দলিত সাহিত্য কে চিনবে , এখনো অনেক দেরি , তুমি অনেক এগিয়ে আছো , আমরা ছুঁতে পারলুম না। ভালোবাসা টা ধরে রেখো, আমরা বড়োই কাঙাল। নতজানু হয়ে তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি , যে মানুষগুলোকে কেউ চিনলো না , আমরা যদি কিছুটাও চিনতে পারি তার দীক্ষা দিও আমাদের , কমরেড! আমার প্রণামের কসম, তসলিম এর দিব্বি , জোহারের জোশ , তোমার জন্যে আজও অনেকেই একটু বেশি করে বাঁচতে চাই, দেখতে চাই, কদমবুসি করতে চাই এই মানুষগুলোকে যার প্রতিমা তুমি বানালে।
Simply wonderful