সেই শুরু। মাঝে মাঝে আসাটা আর মাঝে মাঝে রইল না অল্পদিনের মধ্যেই। লাঠিবাজি, সড়কি, ল্যাজার লড়াই আর কুস্তির দাঁওপ্যাঁচ…আখাড়ার ধুলোমাটির নেশা লেগে গেল বিশুর। বিশেষ করে ঠাকুরদার লাঠিটা হাতে থাকলে কী যেন একটা ভর করত ওর ওপর। বংশে পাইক লেঠেলের ধারাটা ছিলই। আখড়ার ধুলোমাটিতে সেই বিদ্যেয় শান পড়তে লাগল দিনেদিনে। পাঁচু সর্দারের বাঘা বাঘা লেঠেলদের আখড়ার মাটি ধরিয়ে দিতে লাগলো বিশুর লাঠি। দেখতে দেখতে পাঁচুর ডান হাত হয়ে উঠতে লাগল বিশু। ওর দাপটে উৎসাহ পেয়ে দলে দলে পাঁচকড়ি সর্দারের আখড়ায় এসে যোগ দিতে শুরু করল গড়ভাতছালা গাঁয়ের ছেলেরা। বিশুর সমবয়েসি হাড়ি, বাগদী, দুলে, গোয়ালা আর মুসলমান পাড়ার ছেলেপুলে সব। দলের মধ্যে বড় একটা দল গড়ে উঠল, যারা স্রেফ বিশুর অনুগত। মেঘা আর ভগবান তো সঙ্গে ছিলই। ওদের গায়ে গায়ে লেগে এল বৈদ্যনাথ ঘোষ ওরফে বোদে গয়লা, এল প্রেমচাঁদ ডোম, পীতু হাড়ি, কেষ্ট সর্দার, নলে বাউরি…আরও অনেকে।

জমিদারবাবুদের তলবে বড় বড় কাজে বিশু আর দলবলকে নিয়ে যেতে শুরু করল পাঁচু। কিন্তু কিছুদিন বাদেই তাল কাটতে শুরু করল বিশুর। জমিদার আর নীলকর সায়েবদের টাকা খেয়ে প্রজা রায়তকে উৎখাত করা, লাঠির মুখে গরীব চাষির ক্ষেতকে ক্ষেত জ্বালিয়ে সেই জমি নীলকর সাহেবদের হাতে তুলে দেওয়া, একদম মন সায় দিতনা ওর। রাতবিরেতে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ত দাওয়ায়। বিছানা ছেড়ে উঠে আসত মা, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কাঁদত। চাপাগলায় বোঝাত ছেলেকে।

“ও লাঠিবাজির কারবার ছেড়ে দে বিশে, বাপ আমারএ সব্বোনেশে নেশা। কানাই সর্দারের রক্তের ধারা, অনেক কষ্টে সেই শিরা কেটে বেরিয়ে এসেছিল তোর বাপ। তুইও ফিরে আয় মানিক আমার। পাপের টাকার দরকার নেই। রাধামাধবের নাম আর ছটাকখানেক জমির দুটো খুদকুঁড়ো, এতেই চলে যাবে আমাদের।”

জবাবে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কাঁদত বিশু। প্রতিজ্ঞা করত বারবার। কালই ওই পাপ কারবারের মুখে লাথি মেরে বেরিয়ে আসবে। ঠিকই বলছে মা। গরীব পিটিয়ে রোজগার করা টাকার দরকার নেই বিশুর। কিন্তু সেটা কাজে করা সম্ভব হচ্ছিলনা কিছুতেই।

কারণ তরুবালা। পাঁচকড়ি সর্দারের মেয়ে। বছর ষোল। গাঁয়ের মাঝে চলনদীঘির গভীর কালো জলের মত একজোড়া চোখঘোর বর্ষায় চূর্ণী যেমন দু পাড়ের জমিকে নিজের মধ্যে টেনে নেয় ঠিক সেইভাবে বিশুকে টানছিল তরুবালা। পাঁচকড়ির ডানহাত হিসেবে সর্দারের বাড়িতে যাতায়াত ছিলই বিশুর। সেই সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল তারপর ঝড়ো হাওয়ার মত কেটে যাওয়া একটা বছর। সবার নজরএড়িয়ে হারিয়ে যাওয়া, হাতে হাত ধরে বাঁধের আড়ালে, পোড়া দেউলের অন্ধকারে, পাটক্ষেতের গভীরে। সে এক পাগলপারা প্রেম, শরীরে শরীরে পদ্মবিলে দুধগোখরো সাপ সাপিনীর শঙ্খ লাগার মত। এরকমই একদিন গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে নির্জন চূর্ণীর পাড়ে বিশাল পাকুড়গাছটার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসা তরুবালা। কোলে মাথা রেখে শুয়ে বিশু। আবেশে চোখদুটো বোজা। একমাথা ঝাঁকড়া চুলে বিলি কেটে যাচ্ছে সরু সরু আর তুলতুলে নরম আঙুলগুলো।  ঠিক তখনই কানের কাছে

“এরকমই চিরকালটা চলবে বাগদীর পো?” চুলে হাত বোলাতে বোলাতেই ফস করে প্রশ্নটা করে বসল তরুবালা।

“কীরকম?” চোখ খুলে পাল্টা প্রশ্ন করল বিশু।

সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল তরুবালার মুখখানা- “আমাকে নিয়ে কিছু ভেবেছ?”

“কী ভাবব?” কোল ছেড়ে উঠে বসল বিশু।

“শান্তিপুরের জগন্নাথ সর্দার। বাবার পুরনো স্যাঙ্গাত। আমাদের পালটিঘর ওর ছেলে নরহরির সঙ্গে বিয়ের কথা আমার। সেই ছোটবেলা থেকে পাকা কথা দিয়ে রেখেছে আমার বাপ। আজ থেকে সাতদিন বাদে আমাকে আশীর্বাদ করতে আসবে ওরা।”

শোনামাত্র চূর্ণীর পাড় কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো বিশু। “ধুৎ পাগলি, ওসব কিছু হবেনা। আমার সঙ্গেই বিয়ে হবে তোর। আমি কালই কথা বলব সর্দারের সঙ্গে।”

শোনামাত্র আঁতকে উঠেছিল তরুবালা। “খবদ্দার! ও কাজটিও কত্তে যেওনা বাগদীর পো। আমার বাপকে চেননা তুমি। ছাইয়ে পেতে জিওল মাছের মত কুটে ফেলবে তোমায়।”

“বলছি তো ওসব কিছু হবেনা। দেখে নিস তুই।” অদ্ভুত একটা বিশ্বাস বিশুর চোখে। যেন ওর সঙ্গে তরুবালার বিয়ে হওয়াটা হাওয়াবাতাস চলার মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার একটা। তরুবালার চোখে তীব্র সংশয় তখনও। হাত ধরে টেনে তুলে আলতো করে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল বিশু।

“আমার ওপর ভরসা আছে তো?”

“আছে।” বিশুর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল তরুবালা।

পরদিন সকালে নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসেছিল পাঁচকড়ি সর্দার। পাশে ভাগ্নে মেগাই। কচি ডাবের শাঁস আর মুড়ির বাটি রেখে গেছে পাঁচকড়ির বউ। খাচ্ছিল দুজনে মিলে। ভুরুজোড়া ঈষৎ কুঁচকে রয়েছে পাঁচকড়ির। বিশে তো এখনও এল না। রানাঘাটের উত্তরে এক জমিদার বাড়ির থেকে তলব এসেছে। বিশে আর মেগাইকে নিয়ে যেতে হবে সেখানেঅনেকটা পথ। দেরি হচ্ছে কেন হতভাগাটার? অন্যমনস্কভাবে বাটি থেকে একমুঠো মুড়ি তুলে নিলো পাঁচকড়ি। ঠিক তখনই খিড়কির বাইরে “সর্দার” ডাক। একগাল হেসে নিয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালো বিশু।

“এত দেরি করলি কেন হতভাগা? রানাঘাট, অনেকটা পথ…চল চলবেরতে হবে এক্ষুনি” বলতে বলতে মুড়ির বাটিটা দাওয়ায় রেখে উঠে দাঁড়াল পাঁচকড়ি।

“সে তো যাবই, কিন্তু তার আগে একটা আর্জি আছে সর্দার।” পাঁচকড়ির দিকে তাকিয়ে বললে বিশু।

“কী বলবি তাড়াতাড়ি বল।” হাল্কা বিরক্তি পাঁচকড়ির গলায়।

“তরুকে বিয়ে করব আমি।” শান্ত গলায় বলল বিশু।

এই মুহূর্তে ঘরের দাওয়ায় একটা বাজ পড়লেও বোধহয় এর থেকে বেশি আশ্চর্য হত না পাঁচকড়ি। ভিতর থেকে আগুনের হলকার মত উঠে আসা দাউ দাউ রাগটাকে সামলাতে সময় লাগল বেশ কিছুক্ষণ। “তুই জানিস শান্তিপুরের জগা সর্দারের ছেলের সঙ্গে তরুর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সেই ছোটবেলা থেকে? আগে হপ্তায় তরুকে ওরা আশীর্বাদ করতে আসছে। তুই জানিস এসব?- হিমচোখে বিশুর দিকে তাকাল পাঁচকড়ি। গলার আওয়াজ বরফের মত ঠাণ্ডা

মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে পাঁচকড়ির প্রশ্নটাকে উড়িয়ে দিল বিশু। “জানি তোগতকাল বিকেলেই তরু বলেছে আমাকে। ও সম্বন্ধ তুমি ভেঙ্গে দাও। আমার সঙ্গেই তরুর বিয়ে হবে

“তরু বলেছে তোকে! তার মানে…।” বিস্ময়ে কথা আটকে যাচ্ছিল পাঁচকড়ির।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ। তরুর সঙ্গে অনেকদিন ধরেই সম্পক্কো চলছে আমার।  অনেকদিন ধরে তোমাকে বলব বলব করেও বলা হয়নি কথাটা।” 

“অন্য জায়গায় তরুর সম্বন্ধ ঠিক হয়ে আছে, আমি নিজে মুখে তাদের কথা দিয়েছি, এসব জানার পরও তুই আমার কাছে কথা পাড়তে এসেছিস! তোর ভাগ্য ভালো বিশে, আমার দাওয়ায় দাঁড়িয়ে এই কথা বলছিস। ঘরে ঢুকে পড়া রাস্তার কুকুর বেড়ালকেও কেউ মারেনা, নইলে এখানেই তোকে কেটে চারটুকরো করে ফেলতাম আমি।”

রোঁয়া ফোলানো বাঘের মত ফুঁসছিল পাঁচকড়ি। অবাক চোখে সর্দারের দিকে তাকিয়ে ছিল বিশু। তরু আর ও, দুজনে দুজনকে ভালোবাসে। ওদের বিয়ে হবে। এই সহজ সোজাসাপটা কথাটা সর্দার বুঝতে পারছেনা! মুখের হাসি দেখতে দেখতে পাল্টে গেছে রাগে।

“তাহলে তুমিও একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো সর্দার। তরু একমাত্র আমার। তুমি নিজে হাতে তুলে দিতে চাইলে ভালো নইলে লাঠির দাপে ওকে তুলে নিয়ে যাবো আমি, মনে রেখো কথাটা।” ঠাণ্ডা গলায় কথাগুলো বলে পাঁচকড়ির দাওয়া থেকে বেরিয়ে গেছিল বিশু।

পাড়াপড়শিরা বলে এরপর থেকে তিনদিন তরুকে চোরকুঠুরির ঘরে আটকে রেখেছিল পাঁচকড়ি সর্দার। বেধড়ক পিটুনি আর একই সঙ্গে পাখিপড়া করে বোঝানো, দুটোই চলেছিল প্রহরে প্রহরে। কিন্তু নাছোড় গোঁ ধরে বসেছিল তরুবালা। মরে গেলেও বিশু ছাড়া আর কারও সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। চারদিনের মাথায় বিদ্যুতের মত খবরটা ছড়িয়ে গেছিল গোটা গাঁয়ে। সর্পাঘাতে মৃত্যু হয়েছে তরুবালার। খবরটা পাওয়ার পর উন্মাদের মত হয়ে গিয়েছিল বিশু। নাওয়াখাওয়া নেই। শূন্য দুচোখের দৃষ্টি। দিনরাত ঠায় বসে থাকত গাছের তলায়। দিনদুয়েক বাদে খবরটা এনেছিল মেঘা। ঘটনার রাতে বেদেপাড়ার লখাই সাপুড়েকে নাকি ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে পাঁচু সর্দারের বাড়ির আশেপাশে। শোনামাত্র লাফ দিয়ে মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল বিশু। গুলবাঘের মত জ্বলন্ত দুটো চোখ। “চল” হুমকে উঠেছিল বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে।

আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৮)

পরের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ১০)

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

One Response

  1. বাংলায় দলিত সাহিত্য কি তুমি লিখেই ছাড়বে ? দলিত মানেই যে বাংলা, বাংলার রূহ যে দলিত মানুষ গুলো তাদের প্রতিস্পর্ধা , তাদের কমিটমেন্ট , তাদের নিজেদের নিয়ম সমস্ত পিতৃতন্ত্র কে ভেঙে যে এক অনন্য বোধে তৈরী হয়ে আছে সেটা সাবর্ণ দের লেখায উঠে এলো কি? তুমি করে দেখালে , মনে পড়ে সেই বৃদ্ধ জীর্ণ আগুনের ঋষি কে যাঁর মন্ত্রে তোমার লেখা , আজ তোমার মাধ্যমে তাঁকে সালাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *