গাঁয়ের আলপথ ধরে এগিয়ে চলছিল জনাবিশেকের দলটা। মাঝখানে পালকি।
পালকির পাশে পাশে হাঁটছে বিশ্বনাথ। পথের ধারে একটা বিশাল দিঘি। চারপাশ গাছগাছালিতে ঘেরা।
— থাম সবাই। হাঁক পাড়ল বিশ্বনাথ।
— অনেকক্ষণ হাঁটা হয়েছে। মথুরাপুর এখনও আধক্রোশটাক দূর। একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক।
হুকুম পাওয়া মাত্র দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। দিঘির জলে স্নান করতে গেল কেউ কেউ। আসার সময় থলে ভরে চিঁড়ে মুড়ি গুড় বেঁধে দেওয়া হয়েছে অর্জুন সিংহের বাড়ি থেকে। নিজের হাতে সব গুছিয়ে দিয়েছে বীণা। তাই দিয়ে ফলার করতে বসে গেল সবাই। ঘোমটার আড়াল থেকে উদাস চোখে বাইরে তাকিয়েছিল বিজয়া। ধীরপায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল বিশ্বনাথ।
— কিছু যদি মনে না করেন তাহলে একটা প্রস্তাব ছিল মা ঠাকরুণ। ঠাকুরসাহেবের কাছে যা শুনেছি, তাতে আপনার কর্তার চালচলন তেমন একটা সুবিধের ঠেকছে না আমার। তাই আমি বলি কি, আপনি পালকি নিয়ে একটু আগেভাগেই পৌঁছন ওখানে। আমি আমার লোকদের নিয়ে খানিক দেরিতে যাচ্ছি। ততক্ষণ আপনার সম্পত্তি আমার কাছে গচ্ছিত থাকবে। রাজি থাকলে জানান। আপনার মালপত্র কেউ ছুঁয়েও দেখবে না। বিশ্বাস রাখতে পারেন আমার ওপর।
জবাবে ঘোমটার আড়ালে বিষণ্ণ হাসল বিজয়া।
— দ্যাখো বাবা, তুমি কে তার পরিচয় পেয়ে গেছি আমি। এখন তুমি যদি আমার সবকিছু কেড়েকুড়েও নাও, তাহলেও আমার মতো অসহায় মহিলা কী-ই বা করতে পারে। রাখলে তুমি-ই রাখবে আর মারলেও তুমি।তবে কাল রাত থেকে তোমাকে যেটুকু দেখেছি তাতে মনে হয় লোকে তোমার সম্পর্কে যা বলে সেটাই ঠিক। ভয়ঙ্কর হলেও অধার্মিক মোটেও নও তুমি। তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি।
— কৃতার্থ হলাম মা ঠাকরুণ। আপনারা তাহলে তাড়াতাড়ি একটু ফলার সেরে নিন। তারপরেই আপনাদের ডুলি রওয়ানা দেবে।
কথা শেষ করেই পালকির সামনে থেকে সরে এল বিশ্বনাথ।
***
দাওয়ায় বসে ভুড়ুক ভুড়ুক থোলো হুঁকোয় টান দিচ্ছিলেন বিনোদবিহারী মুখুজ্জে।
অসহায় বিরক্তি আর রাগে কুঁচকে রয়েছে ভুরুজোড়া।
বিরক্তির কারণ দুই স্ত্রী — লক্ষ্মীদাসি আর গৌরবালা। অসম্ভব কলহপ্রিয়া দুই নারী।
এই মুহূর্তে একজন ইঁদারার পাড়ে, অপরজন রান্নাঘরে। সেখান থেকেই চোখা চোখা বাক্যবাণ ছুড়ে দিচ্ছেন একে অপরের উদ্দেশে।
বিনোদ জানেন এই কলহ থামানোর চেষ্টা করাটা বৃথা, একইসঙ্গে বেশ খানিকটা ভয়েরও। মাঝখানে পড়ে কিছু বলতে গেলেই যৌথভাবে তীরটা ঘুরে যাবে তার দিকে। বহুদিনের অভিজ্ঞতা থেকে ব্যাপারটা শিখেছেন তিনি।
দাওয়ায় বসে বসে তাই নিজের ভাগ্যকেই অভিসম্পাত দিচ্ছিলেন বিনোদ।
কুলীন বামুনের ছেলে। সাতপুরুষে বিবাহ ছাড়া আর কোনও বৃত্তিই জানা নেই। পরিবারের এই রীতি মেনেই মাত্র বারো বছর বয়সে ছেলেকে বিবাহ নামক পেশায় জুতে দিয়েছিলেন স্বর্গত পিতৃদেব জলদবিহারী মুখুজ্জে। এখনও অবধি সাঁইত্রিশবার বিবাহ করেছেন বিনোদ।
তবে ছেলেকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন জলদবিহারী। উনসত্তর বছর বয়সে গঙ্গাযাত্রার আগে পর্যন্ত দার-পরিগ্রহ করেছিলেন সর্বমোট চুয়াল্লিশটি। আরও কয়েকবছর ধরাধামে টিঁকে থাকতে পারলে সংখ্যাটা যে অর্ধশতকে গিয়ে পৌঁছত, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ ছিল না পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন কারও মনেই। রকমসকম দেখে গাঁয়ের এক গণ্যমান্য ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন জলদকে,
— মুখুজ্জে মশাই, এতগুলি কন্যার পাণিগ্রহণ করলেন। সবাইকে দর্শন দেবার সময় পান কখন?
— আজ্ঞে যখন যেখানে ভিজিট পাই সেখানেই দর্শন দিই। কে অগ্রাধিকার পাবে, তা নির্ভর করে ভিজিটের পরিমাণের ওপর।
বিগলিত হেসে জবাব দিয়েছিলেন জলদবিহারী।
পরিবারের এই রীতি বিনোদও মেনে চলেছেন অক্ষরে অক্ষরে। শ্বশুরালয় থেকে আমন্ত্রণ এলে কথাবার্তা বলে দক্ষিণার ব্যাপারটা পাকা করে নেন আগেভাগেই। কিন্তু সেক্ষেত্রেও একটি গুরুতর সমস্যা রয়েছে। পিতৃদেব জলদবিহারী ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। অর্জিত ধনসম্পত্তি সমস্তটাই আয়ব্যয় করতেন নিজের হাতে। বজ্রকঠিন শাসনে সংসার চালাতেন। বিনোদের মাতা ঠাকরুণ সমেত আরও দুই বিমাতার ট্যাঁফোঁ করার উপায় ছিল না।
তবে ছেলেকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন জলদবিহারী। উনসত্তর বছর বয়সে গঙ্গাযাত্রার আগে পর্যন্ত দার-পরিগ্রহ করেছিলেন সর্বমোট চুয়াল্লিশটি। আরও কয়েকবছর ধরাধামে টিঁকে থাকতে পারলে সংখ্যাটা যে অর্ধশতকে গিয়ে পৌঁছত, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ ছিল না পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন কারও মনেই।
পিতৃদেবের পদাঙ্ক অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে চললেও তাঁর একটি চরিত্রগুণ পাননি বিনোদবিহারী। সেটি হল ব্যক্তিত্ব। দুই গৃহিণীর দাপটে সর্বদা তটস্থ বিনোদ। একেবারে বেশ কয়েকটি শ্বশুরালয় দর্শন সেরে ফেরামাত্র ছাঁদার মালপত্র, দক্ষিণার নগদ অর্থ…সবকিছু কেড়েকুড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন দুই গৃহিণী। তারপরও অবশ্য ভাগবাঁটোয়ারার বখরা নিয়ে কাকচিল তাড়ানো ঝগড়া চলে কমপক্ষে দু’তিনদিন। মাঝখান থেকে নিঃস্ব হয়ে যান বিনোদ। একতিল আফিম, একটিপ নস্যি বাঁ একছিলিম তামাকের জন্য ভিখিরির মত হাত পাততে হয় স্ত্রীদের কাছে। অসহ্য গঞ্জনার পর তা কোনওসময় জোটে, আবার জোটেও না।
প্রথম প্রথম দক্ষিণার অর্থ থেকে নিজের হাতখরচের জন্য আগেভাগেই সামান্য কিছু সরিয়ে রাখতেন বিনোদ। কিন্তু স্ত্রীরাও পাকা খেলোয়াড়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। কোন বাড়ি থেকে কতটা কী আসতে পারে, সেটা নখদর্পণে। নাপতেনি পাঠিয়ে খোঁজ নিতেন আড়েঠারে। ধরা পড়ার পর বিনোদের দুর্দশা বেড়েছিল বৈ কমেনি। অতঃপর সে চেষ্টায় ক্ষ্যান্ত দিয়েছেন তিনি। এখন হাত পেতে ভিক্ষাবৃত্তিই ভরসা।
হুঁকোয় টান দিতে দিতে আড়চোখে একবার রান্নাঘরের দিকে তাকালেন বিনোদবিহারী। হেঁসেল থেকে ভেসে আসছে বড়গিন্নির চিলচিৎকার।
— ওরে ভাতারখাকি, শতেকখোয়ারি। রাতে সোয়ামির পাশে শুয়ে গতর ঢলিয়ে ঢলিয়ে কত কিছু যে খসিয়ে নিলি। ভেবেছিস কিছু বুঝি না আমি? ঝাঁটা মারি ও রকম ভাতারঢলানো পয়সায়।
ইঁদারার পাড়ে ছোটগিন্নি গৌরবালা। সামনে পাঁজা করা বাসনপত্রের ডাঁই। জবাব দিল মিটিয়ে মিটিয়ে
— তা গতর থাকতে ওরকম তুমিও তো কম খসাওনি দিদি। কথায় বলে ‘সেই তো মল খসালি, তবে কেন লোক হাসালি’ শুনে মরে যাই মরে যাই।
— কী বললি ঢেমনি মাগি! আমি গতরঢলানি? হেঁসেল থেকে খনখনে গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন লক্ষ্মীদাসি। “ছোটলোক বারোভাতারি কোথাকার…”
— কী হচ্ছেটা কি? দাওয়া থেকে চিৎকার করলেন বিনোদ।
— তোমাদের জ্বালায় কি পাড়ায় লোক টিঁকতে পারবে না? কখন থেকে একটু আগুন চাইছি, কানেই যাচ্ছে না কারও।
কিছুক্ষণ বাদে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন লক্ষ্মী দাসি। হাতের চিমটেয় ধরা জ্বলন্ত আগুনের টিকে। তারচেয়েও জ্বলন্ত একজোড়া চোখ। — নাও। বসে বসে সাতগুষ্টির মুখে নুড়ো জ্বালো।
বলে কলকেয় টিকেটা গুঁজে দিয়ে যেমন এসেছিলেন তেমনই দুমদুমিয়ে ফিরে গেলেন রান্নাঘরে। কল্কে থেকে ছিটকে পড়ল আগুনের কুচি। ধুতি ঝাড়তে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন বিনোদ।
সব মিলিয়ে মথুরাপুরের মুখুজ্জে বাড়ির অন্দরমহল যখন বেজায় সরগরম, ঠিক সেইসময় সদর দরজায় ঠুকঠুক কড়া নাড়ার শব্দ।
— কে?
হুঁকোহাতে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন বিনোদ। দরজার সামনে একগলা ঘোমটা মাথায় দাঁড়ানো একজন স্ত্রীলোক। পিছনে মাটিতে নামিয়ে রাখা দুই বেহারার একটা ছোট পালকি। পাশে দাঁড়ানো বেহারা দুটো কাঁধের গামছা দিয়ে ঘাড় মুছছে।
— কে তুমি? সামান্য বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করলেন বিনোদ মুখুজ্জে।
— আমি বিজয়া। মৃদু গলায় উত্তর এল ঘোমটার নিচ থেকে।
— কোন বিজয়া? বিরক্তিমাখা স্বরে ফের প্রশ্ন করলেন বিনোদ।
— দেবীপুরের রাখোহরি গাঙ্গুলির মেয়ে। আজ থেকে বারো বছর আগে ১৪ই আষাঢ় আপনার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল আমার।
অবগুণ্ঠনের আড়ালে কণ্ঠস্বর আরও স্পষ্ট এবার।
— বিবাহ হয়েছিল তাতে কী? খেঁকিয়ে উঠলেন বিনোদ। “এখেনে কি মনে করে?”
ঘোমটা সামান্য তুলে এবার সরাসরি বিনোদের দিকে তাকাল বিজয়া।
— ছ’মাস আগে আমার মা গত হয়েছেন। সংসারে তিনকুলে আর কেউ নেই আমার। বাধ্য হয়েই আপনার হতে হল আমাকে।
— মানে?! বোমার মত ফেটে পড়লেন বিনোদবিহারী।
— একটা নয়, দু’টো নয়, সাঁইত্রিশবার বিবাহ করেছি আমি। তাদের যতজনের বাপ মা মরবে, সবাইকে কুলোডালায় বরণ করে ঘরে তুলতে হবে নাকি? মামদোবাজি পেয়েচ! ভালো চাও তো মানে মানে এখনি দূর হও এখান থেকে। নয়তো অনর্থ ঘটে যাবে যাবে বলে দিলাম।
চ্যাঁচামেচি শুনে ততক্ষণে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্মীদাসী আর গৌরবালা। এমনিতে ঘোরশত্রু কিন্তু সব শোনামাত্র দরজার বাইরে দাঁড়ানো অনাহুত সতীনকে আক্রমণ করলেন একযোগে। কাংস্যবিনন্দিত কণ্ঠে প্রথমেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন লক্ষ্মীদাসী
— ইঃ! কে এলেন রে আমার পিরিতের মুড়িবোঁদে। মা মোলো আর তেনার সোয়ামি সোহাগ উথলে উঠল একেবারে। এখনই বিদেয় হও মানে মানে। নইলে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব এই বলে দিলুম।
প্রথম প্রথম দক্ষিণার অর্থ থেকে নিজের হাতখরচের জন্য আগেভাগেই সামান্য কিছু সরিয়ে রাখতেন বিনোদ। কিন্তু স্ত্রীরাও পাকা খেলোয়াড়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। কোন বাড়ি থেকে কতটা কী আসতে পারে, সেটা নখদর্পণে। নাপতেনি পাঠিয়ে খোঁজ নিতেন আড়েঠারে। ধরা পড়ার পর বিনোদের দুর্দশা বেড়েছিল বৈ কমেনি। অতঃপর সে চেষ্টায় ক্ষ্যান্ত দিয়েছেন তিনি। এখন হাত পেতে ভিক্ষাবৃত্তিই ভরসা।
তারস্বরে বড় সতিনের সঙ্গে গলা মেলালেন গৌরবালা।
— একদম হককথা বলেছ দিদি। একে তো আমাদের সেই কি বলে ‘আজ আধপেটা তো কাল হরিমটর’ অবস্থা। তার মধ্যে ইনি এসে ঘাড়ে চাপবেন। আহ্লাদ দেখে মরে যাই একেবারে। তাও যদি সঙ্গে কিছু নিয়ে থুয়ে আসত। এতো দেখছি খালি পালকিতে একবস্ত্রে এসছে। আমি নিজ্যস বলছি ছ’মাস হল মা মরেছে। বাড়িতে একা ছিল এতদিন। এ মেয়ে নিঘঘাত কুলটা হয়েছে। নইলে বলা নেই কওয়া নেই এমন হুট করে চলে আসে!
ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা গম্ভীর গলার আওয়াজ…
— ভদ্দরঘরের মেয়েকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে এভাবে অপমান করছেন? কাজটা কি ঠিক হচ্ছে মা জননী?
গলার আওয়াজে সামনে তাকালেন বিনোদ আর তাঁর দুই পরিবার। নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে একজন। নাতিদীর্ঘ টানটান চেহারা। ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাভরণ। পরনে মালসাট মেরে পড়া ধুতি। মুখে ভারী বিনয়ী একটা হাসির আড়ালে খাপখোলা ছুরির মত ঝকঝক করছে বড় বড় চোখজোড়া।
— তুমি কে হে বাড়ি বয়ে মাতব্বরি করতে এয়েচ? নাম কি তোমার? নিবাসই বাঁ কোথায়? এ গাঁয়ে আগে দেখিনি বলেই তো মনে হচ্ছে।
তীব্র বিরক্তিমাখা গলায় বললেন বিনোদবিহারী। জবাবে সামান্য হাসল লোকটা।
— এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে করে ফেললেন ঠাকুরমশাই? তাহলে প্রথম প্রশ্নের জবাবটাই দিই আগে। অধমের নাম বিশ্বনাথ বাগদি। গরীবগুরবো মানুষরা যাকে বাবু বিশ্বনাথ আর আপনাদের মত ভদ্রলোকেরা বিশে বাগদি, বিশে ডাকাত নামে ডাকে। আর যদি নিবাস জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলব সারা বাংলা।
শোনামাত্র গুমগুম করে পায়ের তলায় মাটি কেঁপে উঠল বিনোদবিহারীর। কোনওমতে টাল সামলালেন দরজা ধরে। পরমুহূর্তেই হাঁউমাউ করে উঠলেন আর্তস্বরে
— আমি তোমাকে চিনতে পারিনি বাবা। মাপ করে দাও এবারটির মতো। এরকম ভুল আর হবে না জীবনে…।
বিনোদবিহারীর থেকে চোখ সরিয়ে গৌরবালার দিকে তাকাল বিশ্বনাথ।
— মা আমার একেবারে খালি হাতে আসেননি মা জননী।
বলেই হাঁক পাড়ল ঘাড় ঘুরিয়ে।
— এই এদিকে আয় তোরা!
আড়াল থেকে এগিয়ে এল তিনজন মোটবাহক। মাথায় ভারী ভারী বাক্সপ্যাঁটরা। সবাই মিলে ধরাধরি করে নামিয়ে রাখল ঘরের সামনে। হিমচোখে বিনোদবিহারীর দিকে তাকাল বিশ্বনাথ।
— এতে যা আছে তাতে সারাজীবন চলে যাবে মা ঠাকরুণের। আপনাদের মত মান্যিগণ্যি মহাজনদের ছিটেফোঁটা ভাগ দিয়েও। তবে কিভাবে কোথায় কতটা খরচ খরচা করবেন সেটা ঠিক করবেন মা ঠাকরুণই। ওঁর ওপর কোনও জোরজুলুম হচ্ছে কিনা প্রতিমাসে সেটা খতিয়ে দেখতে একবার করে এখানে আসবেন আমার বন্ধু অর্জুন সিংহ। আপনার পাশের গাঁয়েই বাড়ি। নামটা শোনা আছে আশা করি।
শোনামাত্র ফের একবার আঁতকে উঠলেন বিনোদবিহারী।
— বিলক্ষণ বিলক্ষণ! ওঁর নাম শোনেনি আশপাশে দশবিশটা গাঁয়ে আছে নাকি কেউ? কারও আসার দরকার নেই। ও টাকা ভুল করেও ছোঁব না আমরা কেউ। আর তোমার মা ঠাকরুণ রানির হালেই থাকবে এ বাড়িতে। এই পৈতে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি আমি।
হাসির আড়ালে ধারাল চোখজোড়া এতক্ষণে একটু নরম হল। বিনোদবিহারীর সামনে এগিয়ে এল বিশ্বনাথ।
এতে যা আছে তাতে সারাজীবন চলে যাবে মা ঠাকরুণের। আপনাদের মত মান্যিগণ্যি মহাজনদের ছিটেফোঁটা ভাগ দিয়েও। তবে কিভাবে কোথায় কতটা খরচ খরচা করবেন সেটা ঠিক করবেন মা ঠাকরুণই। ওঁর ওপর কোনও জোরজুলুম হচ্ছে কিনা প্রতিমাসে সেটা খতিয়ে দেখতে একবার করে এখানে আসবেন আমার বন্ধু অর্জুন সিংহ। আপনার পাশের গাঁয়েই বাড়ি। নামটা শোনা আছে আশা করি।
— দায়ে পড়ে আপনার মত মানী মানুষকে কয়েকখানা ব্যাঁকাত্যাড়া কথা বলে ফেলেছি। মাপ চাইছি তার জন্য। এবার তাহলে আসতে আজ্ঞা দিন।
ভয়ঙ্কর ত্রাসে তখনও থরথর করে কাঁপছিলেন বিনোদবিহারী।
— ন-না না বাবা সে কী কথা! ক-কিছুটি মনে করিনি আমি।
তুতলে জবাব দিলেন কোনমতে।
— যাক নিশ্চিন্ত হলাম। বলে বিজয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল বিশ্বনাথ।
— তাহলে আমি আসি মা ঠাকরুণ। কোনও ভয় নেই। আপদবিপদ হলে ঠাকুরসাহেবকে একটিবার জানাবেন। ছেলে খবর পেয়ে যাবে।
অবগুণ্ঠনের আড়ালে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিল বিজয়া। ফুঁপিয়ে উঠল এবার।
— এ জন্মে তো কিছু পেলাম না। পরের জন্মে রাজপুত্তুর হয়ে আমার কোলে এস বাবা। ঠাকুরের কাছে এই প্রার্থনা রইল।
নিচু হয়ে বিজয়াকে প্রণাম করল বিশ্বনাথ। তারপর মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল আর একবারও পিছনে না তাকিয়ে।
আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র ১৬
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
এবারের টার কোনো তুলনা হবে না , বেমিসাল ! শ্রেণী গুলোর বিভাজন , তাদের পেশা , তাদের বোধ, তাদের তাহজীব , এগুলো রেজিস্টার্ড হয়ে রইলো বাংলা সাহিত্যে। একেই বলে শ্রেণী-সচেতন সাহিত্য। কুর্নিশের কোনো শেষ হবে না। এই বাংলা সাহিত্যে আপনার পদার্পন আর আপনার যাপন ক্রিয়ার মেলবন্ধন নিজেই একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।