বাড়ি থেকে বেরোবার সময় দুটো শাড়ি অতিরিক্ত নিয়ে বেরত সাবিত্রী। প্রতিদিনের একই নিয়ম, এছাড়া নিজের পরিধানের শাড়িটি তো আছেই।
বাড়ি ফিরে তিনটি শাড়িই রোজ কেচে শুকোতে দেয় সে। কী না লেগেছে… কাদা, গোবর, আরও কত আবর্জনা। কিছুই ছুড়তে বাকি থাকে না লোকজনের। বাড়ি থেকে বেরনো মাত্রই শুরু হয়ে যায়। মাথাটাও কাপড় দিয়েই ঢাকতে হয়। মুখ হাত-পা না হয় ইস্কুলে গিয়ে ধুয়ে ফেলে সাবিত্রী। কিন্তু ওই নোংরা শাড়ি পরে বাচ্চা মেয়েগুলোর সামনে যাওয়া যায় না। এমনিতেই কত বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হয় মেয়েগুলোকে, সে উঁচুজাতেরই হোক বা মাহার বা মাঙ জাতের। মাহার, মাঙ ছেলেদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে সাবিত্রীর স্বামী জ্যোতিবা। ছেলেদেরই ইস্কুলে পাঠাতে চায় না কেউ, মেয়েদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। জাতপাতের বিচারে, জ্যোতিবা বা সাবিত্রীদের ফুলে জাতের থেকেও তলায় মাহার আর মাঙরা। তাদের পড়াচ্ছে বলে জ্যোতিবা, সাবিত্রী দু’জনকেই ছাড়তে হয়েছে শ্বশুরের ভিটে।
সেও অনেককাল হল। প্রায় দশ-পনেরো বছর। এখন একটার জায়গায় তিনটে স্কুল চালায় স্বামী-স্ত্রী মিলে। মেয়েদের স্কুল দুটোর দায়িত্ব সাবিত্রীর, ছেলেদের স্কুল জ্যোতিবার। তা ছাড়া ইংরেজ শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে, মিশনারিদের সঙ্গে দেখা করে স্কুলগুলোর জন্য টাকাপয়সা যোগাড় করা – সবই করে জ্যোতিবা।
জ্যোতিবা ফুলে, ইতিহাস যাকে প্রথম কাস্ট রিফর্মার বা জাতিগত ভেদাভেদের বিরুদ্ধে কথা বলা দলিত মানুষ হিসেবে চেনে। ‘দলিত’ শব্দটাও ঘটনাচক্রে তাঁরই চয়ন, “গুলামগিরি’(১৮৭৩) বইতে।

সাবিত্রীবাঈ ফুলে, জ্যোতিবার স্ত্রী, সহধর্মিণী। বিয়ে যখন হয়, সাবিত্রীর বয়স তখন দশ, জ্যোতিবার তেরো। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর কাছে পড়াশুনো শুরু সাবিত্রীর। স্বামী জ্যোতিবা ফুলে হলে কী হবে, পড়াশুনো করেছিল ওই তেরো বছর বয়স পর্যন্তই– অন্যান্য ফুলে কিশোরদের কাছে অভাবনীয় ব্যাপার। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাথমিক হিসেবপত্তর শিখেছিল, তারপরেও খোদ স্কটিশ মিশনারি স্কুলে গিয়েছিল। মিশনারি স্কুলে না গিয়েও তো উপায় নেই। ‘ফুলে’ জাতের ছেলেকে তো সংস্কৃত পড়তে দেবে না কেউ, উঁচু জাতের ছেলেদের সঙ্গে বসতেও দেবে না। তেরো বছর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে জ্যোতিবা। আরও পড়ত হয়তো, জ্যোতিবার বাবা গোবিন্দরাও ফুলে ছাড়িয়ে দিলেন – তারপর বিয়েও দিয়ে দিলেন। তাই বিয়ের পর থেকেই সাবিত্রীকেই পড়াতে শুরু করেন জ্যোতিবা।
খুব দ্রুত শিখে নিতে থাকেন সাবিত্রী। এভাবে প্রায় সাত বছর অতিক্রান্ত হল। এল ১৮৪৭ সাল। এই বছরটি জ্যোতিবার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরপর থেকে আর শুধুমাত্র বাবাকে লুকিয়ে পড়াশোনা করা, স্ত্রীকে পড়াশোনা শেখানো পর্যন্ত আবদ্ধ থাকল না জ্যোতিবার কর্মকাণ্ড। আরও বৃহত্তর কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ল জ্যোতিবা। একসময় শুধু এই কর্মকাণ্ডের জন্যই ইতিহাস চিনে নিল তাঁকে। এই বিষয়ে লেখা জ্যোতিবার বই পথিকৃৎ। তার আগে সেই গুরুত্বপূর্ণ বছরের ঘটনাটি বলে নেওয়া যাক।
বছরটা ১৮৪৭। তখন জ্যোতিবা কুড়ি, সাবিত্রী সতেরো। জ্যোতিবার কাছে বেশ কিছুটা পড়াশুনো শিখে ফেলেছে সাবিত্রী। এমন সময় জ্যোতিবার এক প্রিয় বন্ধুর বিয়ের দিন এল। খুব সেজেগুজে বিয়েবাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে জ্যোতিবা। ফুলে বাড়ির ছেলে হলে কী হবে, তারা বেশ সম্পন্ন পরিবার। ফুলেরা পেশায় ফুল সরবরাহকারী বা মালি। জ্যোতিবার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে ফুলের ব্যবসায়। খোদ পেশোয়াদের ফুল সরবরাহ করে তারা। গ্রামে ভালই খাতির তাদের। তার উপর জ্যোতিবার মতো পড়াশোনাই বা ক’জনের আছে। যে বন্ধুর বিয়ে, সেও তো জ্যোতিবার মিশনারি স্কুলেরই বন্ধু।
ঠিক বিয়েবাড়ির শুরুতেই ঘটল সেই ঘটনা, যা জ্যোতিবাকে বাধ্য করল নতুনভাবে ভাবতে। বরযাত্রীর শোভাযাত্রার সঙ্গে যাবে বলে সবে পা বাড়িয়েছে জ্যোতিবা, এমন সময় বন্ধুর বাবা এগিয়ে এসে বাধা দিলেন। শোভাযাত্রা বা বিয়েবাড়ির কোথাও যেতে পারবে না জ্যোতিবা – সে ফুলে, নিচুজাতের, আর তার বন্ধু উঁচু জাতের। তাই কোনওভাবেই বিয়েবাড়িতে যেতে পারবে না সে। একরাশ অপমান ও দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরল জ্যোতিবা। পরে নিজেই অন্য বন্ধুকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন সেই কথা, এবং বহু পরে, ১৯৯১ সালে, মহারাষ্ট্র সরকার সেই চিঠি প্রকাশ করে ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস অফ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে (দ্বিতীয় খণ্ড)’ গ্রন্থে।
নিজের চারপাশ ও সমাজকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করে জ্যোতিবা। তারই ফল মাহার আর মাঙ জাতের ছেলেদের জড়ো করে বাড়িতে স্কুল শুরু করা। সাবিত্রীর উৎসাহও কম নয়, যদিও ছেলেদের স্কুল, তাই সাবিত্রী সামনে গিয়ে পড়ায় না– অন্য সবরকমভাবে সাহায্য করে স্বামীকে।

মাহার আর মাঙ জাতের ছেলেরা বাড়িতে আসছে? জ্যোতিবা তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করছে? পড়াচ্ছে? মাহার আর মাঙরা যে একেবারে অস্পৃশ্য, ফুলেদের থেকেও অনেক নিচুতে তাদের অবস্থান! গোবিন্দরাও জ্যোতিবাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে অনড়। এভাবে চললে যে জ্যোতিবার পুরো পরিবারকে পতিত হতে হবে! তাই জ্যোতিবা আর সাবিত্রীকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় তাদের পরিবার। সাবিত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যান খান্দোজি নেভেশে পাতিল, সাবিত্রীর বাবা। বাড়ির বয়স্কদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার নেই, তবু প্রতিবাদের চেষ্টা করেছিল সাবিত্রী। কয়েকমাস বাদে সে ফিরেও আসে। জ্যোতিবা তখন এক বন্ধুর আশ্রয়ে। সেই বন্ধুর নামও ইতিহাসে স্থান পেয়েছে – ওসমান শেখ। সেখানে জ্যোতিবা ও সাবিত্রীর সঙ্গে দেখা হয় ওসমান শেখের বোন ফতিমা শেখের। এখানেও ইতিহাস সঞ্চিত রাখে কিছু বাঁক– ফতিমা শেখ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ফিরে আসেন সাবিত্রীর জীবনে, অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন।
যদিও ফাতিমা শেখের ভূমিকা আরও পরেকার কথা। এই মুহূর্তে, অর্থাৎ ১৮৪৮ সালে সাবিত্রী, জ্যোতিবা দু’জনেই ব্যস্ত মাহার আর মাঙদের স্কুল নিয়ে। ওসমান শেখের বাড়িতেই চলে সেই স্কুল। মাহার, মাঙ মেয়েদের পড়াশোনা শেখাবার ইচ্ছে সাবিত্রীর, কিন্তু সে আর হচ্ছে কই?
ইতিমধ্যে জ্যোতিবা উঠে পড়ে লেগেছেন সাবিত্রীর উচ্চশিক্ষার জন্য। তিনি নিজে যতদূর পড়েছিলেন তা তো শেখানো হয়ে গেছে সাবিত্রীকে। এরপর জ্যোতিবার বন্ধু সখারাম যশবন্ত পারাঞ্জপে ও কেশব শিবরাম ওভালকার পড়া দেখিয়ে দিতেন, কিন্তু তা আর যথেষ্ট নয়। আরও অনেক পড়তে হবে সাবিত্রীকে, অনেকদূর যেতে হবে।
ওভালকরই সুপরামর্শ দিলেন। আহমেদনগরে মিস ফেরার-এর টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট আর মিস মিচেলের নর্মাল স্কুল– এই দু’টি স্কুলে যদি পড়াশোনা করতে পারে সাবিত্রী, তাহলে প্রথাগত ইংরেজি শিক্ষা আর আদবকায়দা দুটোতেই দুরন্ত হয়ে উঠতে পারবে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। জ্যোতিবার উৎসাহে ১৮৪৯ সালে সাবিত্রী রওনা দিলেন আহমেদনগর। ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার, আনন্দীবাঈ যোশির জন্মগ্রহণ করতে তখনও বাকি ১৬ বছর, এবং প্রথম প্র্যাকটিসিং ডাক্তার কাদম্বিনীর জন্ম হতে বাকি এক যুগ। চন্দ্রমুখী বসুর ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক হয়ে ওঠার তখনও বাকি ৩০ বছর।
জ্যোতিবা ফুলে তখন ওসমান শেখের বাড়িতে মাহার আর মাঙদের জন্য স্কুল চালাচ্ছেন, আপ্রাণ চেষ্টা করছেন স্কুলের জন্য দান বা অনুদান পাওয়ার। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য শিক্ষা কতটা প্রয়োজন, বোঝাতে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন।
আর সাবিত্রীবাঈ? আহমেদনগরে, জ্যোতিবার থেকে দূরে, প্রস্তুত হচ্ছেন স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার জন্য। সেই যুদ্ধ– যার জন্য অপমান গঞ্জনা, কটূক্তি এবং আবর্জনায় লিপ্ত হতে হয়েছে তাঁকে।
সেটা ১৮৫১ সালের কথা। এখনও দু’বছর বাকি।
তথ্যসূত্র:
‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬
‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজি: মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২
‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯
‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্ অফ্ মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১
*ছবি সৌজন্য: লেখক
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।
The article on Savitribai Phule is well written. I am eager to read the book. Congratulations.