কলেজপাড়া বললেই তো বোঝায় কফি হাউজ। কফি হাউজের হাজারো আকর্ষণের মধ্যে যেটি প্রধান, অমোঘ এবং প্রায় অলক্ষ্য বা ব্যাপ্ত, বিস্তৃত এবং কখনও কখনও কর্ণভেদী আওয়াজের মধ্যেও এর নির্জনতা, যার স্পর্শ, আমোদ ও প্রশ্রয় পেতে হলে প্রেমিক, প্রেমিকা বা কবি হতে হবে। বিপ্লবের দিনগুলোয় কী বিপুল তর্ক, ঝগড়া, হুঙ্কার টেবিলে-টেবিলে, কিন্তু সমুদ্রের পাড়ে নির্জন সৈকত রচনা করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমিক-প্রেমিকারা ভাব বিনিময় করেই চলেছে। বান্ধবী বলত,
– আমার ভিড় ভাল লাগে।
– কেন?
জিজ্ঞেস করাতে একবার উত্তর দিয়েছিল,
– তাতে বেশ একলা হওয়া যায়।
আর একটা ব্যাপারও ছিল। কফি হাউজের গমগমে সাউন্ড ট্র্যাকের ব্যাকগ্রাউন্ডে মনের অনেক নিবিড় কথা গলা না নামিয়েই বলা যেত। ফলে হলজোড়া আওয়াজও বইছে আর তার মধ্যেই প্রেমিক-প্রেমিকার কথাও ভাসছে। এই শব্দতরঙ্গের মধ্যে জন ডান-এর অমর পঙক্তিটা কবিতা হিসেবে আওড়াতে পারলে তা প্রেম নিবেদনই হয়ে পড়ত :
For God’s sake hold your tongue, and
Let me love,
কিংবা
But we will have a way more liberal,
Than changing hearts, to join them; so we
Shall
Be one, and one another’s all.
তবে সে-সময় কফি হাউজের অপূর্ব কিছু উপগ্রহও ছিল, যেখানে ঈষৎ পেকে ওঠা জুটিদের ভর করতে হত। যেমন কলেজ স্ট্রিট আর হ্যারিসন রোডের জংশনে দোতলার ওপর জ্ঞানবাবুর রেস্টরেন্ট। আহা, বড় ভালো চা আর টোস্ট বানাত! জানলার বাইরে তাকিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে নিজেদের আলাপ চালানো যেত। পেটে খিদে থাকলে বসা যেত জমাটি মিষ্টির আখড়া ‘রাজ’-এ। আর সত্যিকারের প্রাপ্তবয়স্ক সময় কাটানোর জন্য ছিল বসন্ত কেবিনের এক একটা কেবিন। দু’কাপ চা আর চারটে ভেজিটেবল চপের মূল্যে স্বর্গ!

কেন জানি না আমাদের কলেজকালকে ক্রমান্বয়ে রোমাঞ্চকর করে তুলেছে বামপন্থী বিপ্লব আর হলিউডের সিনেমা। আমাদের কলকাতায় সত্যজিৎ রায় তৈরি করছেন তরুণ লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ আর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। যুবসমাজেরই জীবনছবি। আর বলিউডে মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি বানাচ্ছেন তরুণ তরুণীদের প্রেমপিপাসা, রাগ-অভিমান, রাজনীতি আর গান নিয়ে অপরূপ চলচ্চিত্র ‘জাবরিস্কি পয়েন্ট’। ক্লাস করে দল বেঁধে আমরা দেখতে গেলাম আর হাঁ হয়ে বেরোলাম— আরে, এই সব ছেলেমেয়ে তো আমরা!
কফি হাউজ থেকেই একদিন বান্ধবীকে নিয়ে মেট্রোতে দেখতে গেলাম সিডনি পোয়াতিয়ের স্নিগ্ধ, রোম্যান্টিক ছবি ‘টু স্যর উইথ লভ’। পরদিন ক্লাসে এইসান গপ্পো জুড়লাম ফিল্মটার যে বাকিরা দল বেঁধে ছুটল মেট্রো। এর ক’দিন বাদে শহরে আরেক ভূমিকম্প— আন্তোনিওনির ১৯৬৬ সালের অবিস্মরণীয় কীর্তি ‘ব্লো আপ’! এখনও মনে পড়ে ছবি দেখে বেরিয়ে রেস্তোরাঁয় বসে ছ’জন আমরা নিশ্চুপ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। চা-কফির অর্ডার দিতেও ভুলে গেছি।

এখন ভাবলে বেশ আনন্দই হয় যে আমরা যখন এমএ ইংলিশ কোর্সে প্রেসিডেন্সি আর ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি আর প্রেসিডেন্সি করছি, তারকবাবু, জ্যোতিবাবুর (ভট্টাচার্য) ‘কিং লিয়র’ পড়ানো শুনছি, ডঃ অমলেন্দু বসুর ‘ডক্টর ফস্টাস’ নিয়ে লেকচার অ্যাটেন্ড করছি, তখন শহরে একে একে এসে পড়ছে গ্রিগোরি কোজিন্তসেভের পরমাশ্চর্য ‘কিং লিয়র’ আর রিচার্ড বার্টন আর এলিজাবেথ টেলর অভিনীত ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটক অবলম্বনে অপরূপ স্পেকট্যাকুলার ফিল্ম ‘ডক্টর ফস্টাস’। দুই শ্রেষ্ঠ এলিজবেথান নাট্যকারের কী অলৌকিক পুনরাবির্ভাব কলকাতার সিনেমা হলে! কপাল সত্যি আমাদের!
হলিউডের সেরা জুটি বলে সাঙ্ঘাতিক একটা রব তো ছিলই লিজ়, বার্টনের ‘ডক্টর ফস্টাস’-এ ফস্টাস ও হেলেন অফ ট্রয় হয়ে নামা। আমাদের ভীষণ কৌতূহল ডাকসাইটে শেক্সপিয়ারিয়ান অভিনেতা রিচার্ড বার্টন কেমন উচ্চারণ করেন ওই নাটকে মার্লোর ছড়িয়ে রাখা অপূর্ব সব রুপোলি সংলাপ। আর এও লেখালেখি হচ্ছে কাগজপত্রে তখন, যে বিজ্ঞানী ফস্টাস জাদুবলে যখন নামিয়ে এনেছেন নিজের গবেষণাগারে তখন হেলেনরূপী এলিজাবেথ টেলর সম্পূর্ণ নগ্নিকা! যারা জন্মেও মার্লো বা তাঁর নাটকের নাম শোনেনি সেই সব পাবলিকও লাইন দিয়ে টিকিট বাগাচ্ছে।

সিনেমা দেখতে বসে তারা মনে হয় ঘুমিয়েই পড়েছিল কারণ দু-চারটে হাই তোলা ছাড়া বড় একটা আওয়াজ কিছু করেনি। তাতে বার্টনের ঠোঁটে মার্লোর অপরূপ সব সংলাপ শোনায় কোনও সমস্যা হয়নি। আর সেই আশ্চর্য মুহূর্তে হেলেন অফ ট্রয় লিজ টেলার তাঁর অনুপম দেহবল্লরি থেকে বস্ত্রবর্জন করে যখন সম্পূর্ণ নগ্না, সেই মুহূর্তে মিনার্ভা সিনেমা হলের তাবৎ দর্শক বিলকুল স্তব্ধ। কারও মুখে সামান্যতম ধ্বনি সরছে না, শুধু সেই নগ্ন লিজ/হেলেনের দিকে বিস্মিত চাহনিতে চেয়ে বার্টন/ফস্টাস বলে যাচ্ছেন…
Was this the face that launch’d a thousand ships,
And burnt the topless towers of Ilium?
Sweet Helen, make me immortal with a kiss!
লিজ-বার্টন জুড়ির ‘ডক্টর ফস্টাস’-এ বার্টনের সংলাপ উচ্চারণ, নিজের রূপমাধুর্য ও প্রযোজনার জাঁকজমকের তুলনা ছিল না, তবে সিনেমা হিসেবে খুব স্মরণীয় কাজ, কিন্তু তা হয়নি। নাটককে সিনেমায় আনার ঐন্দ্রজালিক কৌশলতার এক সেরা নমুনা অচিরে শহরে এল। রুশ চলচ্চিত্রকার গ্রেগোরি কোজিন্তসেভের ‘কিং লিয়র’। আমরা সব বন্ধুবান্ধবীরা দল বেঁধে ওরিয়েন্ট সিনেমায় ছবিটা দেখে মাথা কুটতে লাগলাম, ‘হায় রে, আমাদের পরীক্ষার আগে যদি ছবিটা দেখে ফেলা যেত!’ কোজিন্তসেভের অপর কীর্তি ‘হ্যামলেট’ অবশ্য আমরা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম আগেই। অপার মুগ্ধ হয়েছিলাম হ্যামলেট চরিত্রে ইনোকেন্তি স্মোকতুনভস্কির অভিনয়ে। সত্যজিৎ রায় যে-ছবি দেখে নায়ককে বর্ণনা করেছিলেন পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে। আমরা তো রুশ ভাষার ছবি দেখছি ইংরেজি সাবটাইটেলে এবং বেশ আমোদিতও হচ্ছি, কারণ সেগুলো তো শেক্সপিয়ার থেকেই নেওয়া! অর্থাৎ শেক্সপিয়ারের ভাষা ধরে ধরে তাঁর রুশ অনুবাদ দেখছি রুপোলি পর্দায়। যে অনুবাদটি করেছেন আবার এক অমর রুশ কবি বরিস পাস্তেরনাক!
‘হ্যামলেট’ আমাদের কোর্সে ছিল না, তবে আমাদের দলে কেউ ছিল না যে ‘হ্যামলেট’ পড়েনি। এবং সবাই তাজ্জব হয়েছিলাম নাটকটাকে এভাবে সিনেমা করার কল্পনা ও প্রয়োগশক্তিতে। ভাবা যায়, হ্যামলেটের তুলনাহীন স্বগতোক্তি ‘To be or not to be : that is the question’ নায়ক মনে মনে বলতে বলতে যাচ্ছে বাজারের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে! বিপুল ভিড়ের মধ্যে বিক্ষুব্ধ, প্রশ্নদীর্ণ নায়ক চরম একা! আহা, আর কী সুন্দর স্মোকতুনভস্কি হারিয়ে যাচ্ছেন নিজের মধ্যে! এর বহুদিন পর টরোন্টো শহরে মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে কিছুদিন থাকার সময় টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে কোজিন্তসেভের ‘হ্যামলেট’ চিত্রনাট্য আনিয়ে পড়েছিলাম। আর অমনি মনের চোখের সামনে ভাসতে থাকল কোনও দিনও ভুলতে না পারা সাদা-কালো ছবিটার মনের রঙে রাঙিয়ে ওঠা সব দৃশ্য! নতুন করে প্রেমে পড়লাম ‘হ্যামলেট’-এর।

কলেজকালে কফি হাউজ, মেট্রো-লাইটহাউজ, মিনার্ভা ছাড়া আর একটা আড্ডাস্থল হয়েছিল আমার কনভেন্ট রোডের গায়ে ৬ নং ক্যানাল স্ট্রিটে সেতারি বন্ধু বাবলুদার বাড়ি। যে বাবলুদাকে সবাই চেনে সেতারি সুব্রত রায়চৌধুরী হিসেবে। আমাদের ক্রিক রো পাড়ারই ছেলে ছিল এককালে, পরে বাড়ি কিনে খুব কাছের ওই রাস্তাটায় উঠে যায়। পাড়ায় থাকতে গুলি খেলা হত, আর পড়াশুনোর গল্প। বাবলুদা খুব ছোকরা বয়েসেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে কমার্স বিভাগে প্রফেসর হয়ে গিয়েছিল।
বাবলুদা ক্যানাল স্ট্রিটে থাকার পর আমাদের আড্ডাটা হয়ে পড়েছিল গানবাজনা নিয়ে। বড়ে গুলাম আলি খাঁ, আমির খাঁ, ভীমসেন যোশী; নয়তো রবিশঙ্কর, আলি আকবর, বিলায়েত খাঁ। বাবলুদা এসবের মধ্যেই একসময় জার্মান সরকারের বৃত্তিতে জার্মানি ঘুরে আসে। ওর সকাল-সন্ধে রেওয়াজের ফাঁকে এই সব গানবাজনার আড্ডা চলত। ভৈরবীর একটা অঙ্গ বাজাচ্ছে হয়তো, তারই প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
– কলামন্দিরে আলি আকবরের প্রোগ্রামে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে গেছিলে?
– হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?
বাবলুদা হাসলেন।
– বাহ্ রে, তুমি আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে আলি আকবর শুনবে আর ভাবছ আমি টেরটি পাব না?
– আপনি গেছিলেন?
– না, শহরে ছিলাম না। এসে শুনলাম শ্রী আর ভৈরবী বাজিয়েছিলেন।
আমি বললাম,
– এরকম ভৈরবী জীবনে বেশি শুনিনি। কী আসরে, কী রেকর্ড-রেডিওতে।
বাবলুদা বলল,
– আমার খবর তাই।
বললাম,
– সাধে খাঁ সাহেবকে ভৈরবীসিদ্ধ বলে!
বাবলুদা ওর কোল থেকে সেতারটা নামিয়ে রেখে বলল,
– তোমাকে একটা লাইভ কনসার্টের টেপ শোনাব। খাম্বাজ, ভৈরবী সব পাবে। তারপর শুনব তোমার রিয়্যাকশন।
জিজ্ঞেস করলাম,
– কার বাজনা?
—বিসমিল্লা খাঁ আর বিলায়েত খাঁর ডুয়েট।
বলা বাহুল্য, সন্ধেবেলা ফের পৌঁছে গেলাম। সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনে বাজানো কনসার্টের দু’ঘণ্টার টেপটা পর পর দু’বার শুনে প্রায় পাগল হয়ে দু’জনে রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম। ‘দারুণ’, ‘দুর্ধর্ষ’, ‘অপূর্ব’, ‘অসাধারণ’ বলে বলে কথা ফুরিয়ে গেছিল দু’জনের। একসময় ‘গারা’ রাগটার সুরেও আসা হল। সে-সুরটা ‘মুঘলে আজম’ ছবির ‘মোহে পনঘট পে নন্দলালা ছেড় গেয়ো রে’ গানে লাগিয়েছিলেন সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদ। বিসমিল্লা, বিলায়েতের সানাই, সেতারে ওই গারার ট্রিটমেন্ট নিয়ে দু’জনই হঠাৎ একসময় বলে বসলাম একটাই কথা ‘বীভৎস সুন্দর!’ সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা বোঝাতে কেনই জানি না দু’জনের ঠোঁটে বীভৎস শব্দটা এসে গেল। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Imdb, Notre Cinema, oscars.org, Youtube
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।
অনেক কিছু জানতে পারলাম, স্যার। ধন্যবাদ। আমরা এই ফেলে আসা দিনের কথা গুলো হয়তো জানতেই পারতাম না, যদি না আপনি এ ব্যাপারে সচেষ্ট হতেন। এগুলো তো আমাদের স্বর্ন ময় দিনের ঘটনা।