‘ওপেন এয়ার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ অর্থাৎ খোলা আকাশের নিচে ছবি দেখানো।  টিকিট ছাড়াই। আপামর জনগণকে স্বাগত জানিয়ে সারাদিন ছবি দেখানো। এমন আশ্চর্য উদ্যোগই নিয়েছেন নাকতলার বাসিন্দা একদল তরুণ। গত ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি চলল তাঁদের উৎসব। অভিনব এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন ফিল্ম-স্কলার থেকে সাধারণ সকলেই।

কেন হঠাৎ অভিনব এই উদ্যোগ? ব্লু চক স্টুডিও-র তরফে রুডি জানালেন, “আমাদের ছেলেবেলায় তো ফিল্মক্লাবগুলি এমন অনেক উদ্যোগ নিত। পাড়ার লোকে এই ভাবে একসঙ্গে ছবি দেখার সুযোগও পেতেন। ক্রমশ সেই উদ্যোগ হারিয়ে গেল। মুছে গেল ফিল্মক্লাব। তার জায়গায় ঘরে ঘরে চলে এল ইন্টারনেট। মানুষ একা হতে থাকল। তার সাথে এলো নেটফ্লিক্স। মাল্টিপ্লেক্স। সেখানে সিনেমার আভিজাত্য কোথায়? বিনোদন ও একাকিত্ব ছাড়া তো কিছুই নেই সেখানে।” আর মানুষকে সেই একাকিত্ব থেকে যৌথতায় ফেরাতেই খোলা আকাশের নীচে স্ক্রিন খাটিয়েছেন তাঁরা। সান্ধ্য সিরিয়ালের উৎপীড়ন আর চটুল রাজনীতি পেরিয়ে এই সংস্কৃতি মানুষকে আবার কাছাকাছি আনবে বলেই বিশ্বাস তাঁদের।

গীতাঞ্জলি মেট্রো স্টেশনে নেমে দু’পা হাঁটলেই সেকেন্ড স্কিম গ্রাউন্ড। মধ্যবিত্ত পাড়ায় মাঝারি আকারের মাঠ। তার একদিকে সারি সারি চেয়ার পাতা। সামনে টাঙানো স্ক্রিন। দিনের বেলা সেখানে ছবি দেখা যাবে না। কারণ প্রোজেকশানের জন্য অন্ধকার দরকার। তাই দিনের বেলার জন্য মাঠের একদিকে খাটানো হয়েছে তাঁবু। সেখানে চলছে একের পর এক ছবি দেখানো। দিন ফুরোলে তবেই বাইরের স্ক্রিনে সিনেমার পালা। একের পর এক। মাথার উপর মশার ভোঁ-ভোঁ। তাতে কী! বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই দর্শকদের। ভ্রুক্ষেপও নেই। যথা সময়ে এসে হাজির হচ্ছেন পাড়ার সবাই। প্লাস্টিকের চেয়ারে জমিয়ে বসে ছবি দেখছেন।

মাঠটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন উদ্যোক্তারা। চারপাশে রঙিন কাগজ। ঝুলছে টুনি। তাঁবুর গায়ে গ্রাফিতি। লেখা ফেস্টিভ্যালের নাম। একপাশে পরপর লিটল ম্যাগাজিনের স্টল। সবমিলিয়ে জমজমাট ব্যপার।

চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, “আগে আইপিটিএ-ও এমন উদ্যোগ নিয়েছে বহুবার। পথে নেমেছেন শিল্পীরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। এই নাকতলাতেই সোভিয়েত দূতাবাসের প্রোজেক্টার দিয়ে এককালে সিনেমা দেখানো হত। তাতে সাধারণ হতদরিদ্র মানুষ এসেও ইউক্রেনের ছবি দেখতেন। আজও আবার সমাজের প্রয়োজনেই মানুষ এক হচ্ছেন। এ তো সাধুবাদ জানানোর মতোই ব্যপার।”

সম্প্রতি, বেহালা এলাকাতেও জনপরিসরে আয়োজিত হয়েছিল একটি ইন্সটলেশান অনুষ্ঠান। সনাতন দিন্দা, ভবতোষ সুতার প্রমুখ নামজাদা শিল্পীরা ছবিকে নিয়ে এসেছিলেন মানুষের মধ্যে। গ্যালারি থেকে বের করে ছবিকে রাস্তায় নামিয়ে আনার পিছনেও ছিল সময়ের দাবিই। শহরের নানা প্রান্তে একই উদ্দেশ্যে এমন আরও জটলার আয়োজন করছেন মানুষ।

Open air film festival 2020
নাকতলার কাছে এই মাঠেই দেখানো হল ছবি।

তবে অন্যান্য উদ্যোগের থেকে এই আয়োজন আলাদা কারণ এখানে কোনও হল বা ঘর নেই। আছে খোলা মাঠ। আর আছেন সাধারণ মানুষ। অবাণিজ্যিক এই উদ্যোগ তাই সত্যিই অভিনব। সঞ্জয়বাবু এ প্রসঙ্গে আরও জানালেন, কলকাতায় কোনও “জলসা” ছিল না দীর্ঘকাল। এমন উদ্যোগ আবার সেই সংস্কৃতিকেই ফিরিয়ে আনছে।

এই ফিল্মোৎসবে প্রায় ৩০টি নানা ভাষার ছবি দেখাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। আহ্বায়ক রুডি জানালেন, কর্নাটকে একটি কাফেতে গিয়েই এমন উদ্যোগের কথা মাথায় আসে। সেখানে কেবল আড্ডা মারছিলেন না লোকে। একটি ছবি দেখারও ব্যবস্থা ছিল। সেখান থেকেই তাঁর মনে হয় এমন কিছু যদি কলকাতাতেও করা যেত! ফিরে এসে এই উদ্যোগের কথা বন্ধুদের জানান। বন্ধুরা সকলেই ফিল্ম-বাফ। তাই বেশি দেরি হয়নি উদ্যোগের বাস্তবায়নে। বসন্তেই মানুষের জন্য খুলে গেল এই ওপেন এয়ার ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের দরজা।

কথা হচ্ছিল জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যর সঙ্গে। তাঁর ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ ছবিটি দেখানো হচ্ছে এখানে। জানালেন, “উদ্যোগ অবশ্যই ভালো। সারা বছর ধরে এটা করে যেতে পারলে আরও ভালো। আমি নিজেও নিজের ছবি গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখিয়েছি। অন্যের ছবিও দেখিয়েছি। তাই এমন উদ্যোগকে তো সাধুবাদ জানাবই আমি।” বারীন সাহা, নিমাই ঘোষের মতো পরিচালকরাও তাঁদের ছবি প্রোজেক্টার কাঁধে এ ভাবেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখাতেন। ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের সেই পরম্পরাই বয়ে নিয়ে যেতে চান উদ্যোক্তারা। কেন ছবির প্রদর্শনী আটকে থাকবে কিছু ডিস্ট্রিবিউটারদের হাতে? বাজার কেন নিয়ন্ত্রণ করবে ছবি দেখাকে? সাধারণ মানুষ কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না? এই চিন্তা থেকেই ক্রমশ এ ধরনের বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু করেছেন ছবিওয়ালারা। আর তারই আরেক ধাপ এমন উদ্যোগ।সারা বছরই এভাবে ছবি দেখিয়ে যেতে চান উদ্যোক্তারা। স্থান বদলে যেতে পারে। যে কোনও মাঠেই আয়োজিত হতে পারে এমন উৎসব।

বসন্ত প্রায় চলে এল। ক’দিন পরেই দোল। হাওয়া দিচ্ছে আস্তে। কিছুটা শীত মাখা হাওয়া। কর্ক উড়ে যাচ্ছে। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এরোপ্লেনও। পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে মেট্রো। গড়িয়ার খাল পেরিয়ে। সশব্দে। স্ক্রিনের পর্দা উড়ে যাচ্ছে সেই হাওয়ায়। শব্দ থমকে যাচ্ছে সেই শব্দে। তবু নাছোড় সিনেমাপ্রেমীরা। নাছোড় উদ্যোক্তারাও। চলছে সিনেমা। দিন থেকে রাত। রাত থেকে দিন। নাগাড়ে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কেউ গৃহবধূ তো কেউ অবসরপ্রাপ্ত। সকলের কাছেই এই উৎসব খুশির অপেরা। কারণ তাঁরা দেখতে চান ভালো ছবি। সুযোগ পান না। একসময় ফিল্মক্লাবগুলি এই ভূমিকাই নিত। কেমন যেন থমকে গেছিল মাঝপথে সবটা। আবার এই সূচনায় খুশি সকলে।

সিনেমা নিয়ে আরও পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের। জানালেন, এ পাড়াতেই এক কালে থাকতেন মৃণাল সেন। তাঁকে এবং রন ফ্রিকিকে স্মরণে রেখে আয়োজন করা হয়েছে এই ফেস্টিভ্যাল। দেখানো হচ্ছে ওহাইট বেলুন, অ্যাপোক্যালিপ্টো, রশোমন,  মডার্ন টাইমস, চালচিত্রের মত খ্যাতনামা ছবি। ভিড় করে দেখছেন জনতা। নিয়ম মেনেই সময় মতো হাজির হচ্ছেন তাঁরা। চলছে সিনেমা নিয়ে নানা গল্প আড্ডাও।

একটানা সিনেমা দেখে একটু ক্লান্ত লাগছিল। ফেরার পথে হাঁটছিলাম একা। সন্ধ্যা নামছে। ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে ল্যাম্পপোস্ট। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে ঘরে। পার্কে বসে যুগল। ফুলের দোকানে জল ছেটাচ্ছেন দোকানি। ভালোবাসার মরসুম এই ফেব্রুয়ারি। সবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে গেল। সামনে আবার বসন্ত উৎসব। মানুষের মন একে অন্যের সাথে মিলেমিশে যায় এ সময়। ঝকঝকে রোদে মানুষ হাত ধরে। বলে ফেলে মনে পুষে রাখা কথা। আর সিনেমা তো বরাবরই মানুষকে দিয়েছে বেঁধে রাখার মন্ত্র। একসঙ্গে দেখার ও সময় কাটানোর অবসর। খোলা মাঠে খোলা মনে যদি এ ভাবে মানুষ ছবি তা পান, তা হলে আর কী চাই এই অস্থির সময়ে!!

পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *