সময়টা এই বছরের এপ্রিল-মে মাস । ফোনে আমার মা বলল,

— “জানিস আজকাল বারান্দায় দাঁড়ালে খুব অদ্ভুত লাগে।”

মায়ের বয়স হচ্ছে, সব কথার প্রাসঙ্গিকতা সবসময় ঠাহর করে উঠতে পারি না…আর এই এই অনিশ্চিত, পাল্টাতে থাকা বছরে  তো আরও  না।

— “কেন মা?” জিজ্ঞাসা করলাম।
— “হঠাৎ খেয়াল করলাম, একটাও প্লেন যায়না আকাশ দিয়ে।”

কলকাতায় আমার বাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে খুব দূরে নয়, তাই আকাশ দিয়ে যাতায়াত করার সময় আকার আর শব্দে বেশ জানান দিয়ে যায় এরোপ্লেন, এখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে বেশ লাগে। গত চব্বিশ বছর ধরে মায়ের সঙ্গে আমার একটা ছেলেমানুষি মজা আছে। মা বলে ওই প্লেনের আওয়াজ শুনলেই আমার কথা মনে পড়ে। তাই সেদিন মায়ের ওই অতি সাধারণ কথাটাতে এই বয়সেও, ভেতরে ভীষণ ভাবে কী যেন মুচড়ে উঠল। এত বছরের প্রবাসী, এত হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব পেরিয়ে কতবার ফিরে গেছি। হ্যাঁ, টিকিটের দাম, যাবার দিনক্ষণ, স্কুল, অফিসের ছুটি এসব নিয়ে বিলক্ষণ মাথা ঘামিয়েছি। গেছি, ফিরে এসেছি। কানেক্টিং ফ্লাইট পাওয়া, মালপত্র ঠিকভাবে পৌঁছনো এগুলো নিয়ে চিন্তা, পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস আর ফেরার সময় আশঙ্কায়, কষ্টে গলা বন্ধ হয়ে, আসা– যেমন দেখে যাচ্ছি, তেমন ভাবে ফেরত পাব তো? কিন্তু একটা জিনিস দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি, চাইলে ফিরতে পারা  যাবে না…প্রত্যেক বছর যাতায়াতটা একটা অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল। সেটা প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে, হাজার হাজার মাইল দূরত্বটা এই প্রথমবার একটা বিরাট ভার হয়ে চেপে বসবে, ভাবিনি।

ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি…

কারওরই না।

প্রত্যেক বছর সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসের একটা সপ্তাহান্তে কাছাকাছি কোনও টাউনের স্কুলে দুর্গাপুজো হবে, আমরা নতুন শাড়ি,পাজামা পাঞ্জাবিতে সেজে গুজে হাঁপাতে হাঁপাতে মা দূর্গার আলোভরা চিরচেনা হাসিমুখের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে নিশ্বাস ফেলব, সেই একই  হাসির  ছটায় ঝলমল করবে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের, পরিচিতদের মুখ…খাওয়া আড্ডা, অনুষ্ঠান এই সবে কেটে যাবে দুটো দিন…আর প্রত্যেক বছর বরণের সময় ছোট মেয়ের মতো মাকে বলব  ‘সবকিছু ঠিক রেখ মা, আসছে বছর  ফিরে এস –এই ভাবে’-সেটাও প্রায় একটা অভ্যেস হয়ে গেছিল। ভাবিইনি কখনও অন্যরকম কিছু হতে পারে। এবছর অন্যরকম, মা আসবেন কিন্তু আমরা একসঙ্গে আর যেতে পারব না উৎসবে…সেটা সত্যিই দুঃখের।

কিন্তু তার থেকে অনেক অনেক বেশি বিষাদের রঙ নিয়ে এসেছে এবারের শরৎ। এবার, যে দুর্ভাবনায় কাঁটা হয়ে দিন কাটছিল আমাদের অতিমারী শুরু হবার পর থেকেই, সেই দুর্বহ আশঙ্কা সত্যিতে পরিণত হয়েছে– হারাচ্ছি গুরুজনদের। একের পর এক দুঃসংবাদ। কাছে, দূরে, পরিবারে, বন্ধুদের পরিচিতদের…সেই খারাপ খবরের মিছিলের যেন শেষ নেই। হ্যাঁ যাতায়াতের রাস্তা বেশির ভাগ সময় বন্ধ ছিল, তাই আশঙ্কাজনক অবস্থা শুনে, শেষ খবর শুনে যেতে পারেনি এখানকার মানুষগুলো। অসহায় ভাবে ভিডিওফোনে দেখেছে প্রিয়জনের শেষকৃত্য, একা পরিবার নিঃসঙ্গ ভাবে করেছে শেষ কাজ, পুজো, আচারনে। আর শেষের দুই এক মাসে খুব কম কিছু মানুষ আছে যারা খবর পেয়ে  কোনওভাবে পৌঁছেছে দেশে – কীভাবে, কতটা ঝুঁকি নিয়ে, সেটা বলতে গেলে আর একটা গল্প হয়ে যাবে। চোখের সামনে দেখেছি,শুনেছি এই কাছের মানুষগুলোকে। ঠিকভাবে শোক করতে না পারা, এই অবস্থায় দেশে নিজের পরিবারের কাছে ফিরতে না পারা, এক একটা যন্ত্র মানুষ করে দিয়েছে এদের। শুধু দিন কাটাচ্ছে। হাত পা নাড়াচ্ছে, কথা বলছে, কাজ করছে। কোনওমতে নিজেদেরকে ঠেলে ধাক্কিয়ে খাড়া হয়ে আছে, কিন্তু প্রাণ নেই….

এই সময়ে  আমরা যে যেখানে থাকি, আশঙ্কিত থাকি তো দূরে থাকা আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে। এই বছরের প্রথম ভাগে কোভিড যখন মৃত্যু তান্ডব চালিয়েছিল উত্তর আমেরিকায়, এমন কোনওদিন যায়নি যেদিন যোগাযোগে থাকা বা একদম না থাকা আত্মীয়, বন্ধুদের মেসেজ আসেনি দেশ থেকে.…’সাবধানে থেক সাবধানে থেক আর কোথাও বেরিও  না।“

প্রত্যেকদিন ।

আসন্ন দূর্গাপুজোয় বড় আশঙ্কার সময় আসছে সামনে। হাজার হাজার মানুষ এক জায়গায় আসার আর তারপর রোগটা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার সংকট।

এই পুজোতে তাই একটাই প্রার্থনা–

এই দুঃসংবাদের  মিছিল শেষ হোক। আর কোনও আত্মীয়, গুরুজন, বন্ধুদের হারাতে চাই না….কিছুতেই না। সবাই যেন আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের সুস্থ রাখি আর অন্যদের বাঁচিয়ে রাখি। ঘরে থাকি। পুজো ফিরে আসবে স্বমহিমায়, আরও ঔজ্জ্বল্যে, আগামী বছর।

জন্ম, বড় হয়ে ওঠা কলকাতায়। গত একুশ বছর ম্যাসাচুসেটস,আমেরিকা প্রবাসী। বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। এখন পর্যন্ত লেখা বেরিয়েছে ওয়েব ম্যাগাজিন পরবাসে এবং আনন্দবাজারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *