প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] []

১২

– আচ্ছা মাম্মা! তুমি কি বিয়ে হয়ে এসে কখনও শুনেছ ছোটকুর কথা?
রোহিনী নোট নিতে নিতে হঠাৎ থেকে জিজ্ঞেস করে৷ 
‘ছোটকু!’ সীমন্তিনী বেকিং গ্লাভস্‌ পরে অ্যাপল পাই-টা কতটা হয়েছে পরখ করছিল৷ রোহিনীর প্রশ্নে একটু থমকেছে৷
– ছোটকু নামটা চেনা চেনা লাগছে না তো? কেন রে? কী হয়েছে? বাবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখ্‌? ওদের ফ্যামিলির সবাইকে তো আমি চিনিই না৷ বিয়ে হয়ে সোজা চলে এলাম এদেশে৷ এক্সটেনডেড ফ্যামিলিকে আর চেনার সুযোগ হল কই?
মাম্মার গলায় কি একটু আক্ষেপ মিশে আছে? রোহিনী ঠিক ধরতে পারে না।
– না, আর একটু হবে মনে হচ্ছে পাইটা৷ তুই ওয়াশিংটা এক লট একটু দিয়ে আসবি? আজ খুব ভাল রোদ ৷ বেডকভার-টভারগুলো একটু মেলে দিতে হবে৷

মাম্মার এই এক অবসেশন৷ খটখটে ড্রাই হয়ে গেলেও মনে হয় দেশের মতো খটখটে রোদে না শুকোলে যথেষ্ট জীবাণুমুক্ত হল না৷ প্রথম প্রথম রোহিনী তর্ক করত৷ এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে৷ রোহিনী খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেসমেন্টে গেল৷ বেসমেন্টে বিরাট বড় ওয়াশিং মেশিনটায় কাপড়চোপড় লোড করছে৷ দিন দিন পরিষ্কার পরিষ্কার বাতিকটা বাড়ছে মাম্মার৷ কোনও দরকার নেই, তাও মাঝে মাঝেই বেডকভার বেডশিট সব নামিয়ে দেবে কাচার জন্য৷ যেখানে যা আছে সব জড়ো করবে৷ সব নাকি নোংরা হয়ে গেছে৷ নিকি সপ্তাহে একদিন ওয়াশিং করে যায়৷ তাতে মাম্মার পোষায় না৷ দেশে থাকলে এটাকেই বলত শুচিবায়ু৷ এখানে এটার একটা গালভারি নাম আছে৷ ইন্টারনেটে দেখেছে রোহিনী৷ জার্মোফোবিয়া৷ রণোকে বলেওছিল৷ রণো ওর মাকে বেশি ঘাঁটায় না৷ কিছু বলতে গেলেই মাম্মা কেঁদেকেটে একশেষ করবে৷

রণো ওর মাম্মার এই অতিরিক্ত ইমোশনাল স্বভাবটা জানে৷ বিশেষ করে রণোর ব্যাপারে মাম্মা ভীষণ টাচি৷ একটু থেকে একটু হলেই মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়৷ একজন সন্তানের মা হলেই বোধহয় এরকম মারাত্মক রকমের পজেসিভ হয়? বাংলায় এক সন্তানের মা-দের কি যেন একটা জম্পেশ নাম আছে৷ বহু চেষ্টা করেও ঠিক মনে পড়ল না রোহিনীর৷ একটা ভালো বাংলা ডিকশনারি এখন ওর নিত্যসঙ্গী৷ রণোর দাদুর খাতাটা সাধুভাষায় লেখা বেশিরভাগটাই৷ রোহিনীর মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে বাংলার চর্চা রয়েছে৷ নিয়মিতভাবে ওর বাবা-মা ওকে আর ওর দাদাকে বাংলা পড়তে বাধ্য করেছেন৷ তার সুফল ও এখন বুঝতে পারছে৷ আইএসসি পাশ করার পরই আন্ডারগ্র্যাড পড়তে এদেশে চলে এসেছিল৷ পরে কখনও বাংলার দরকার হবে ভাবেওনি কোনওদিন৷ কিন্তু পরে যখন পার্টিশন নিয়ে কাজ করল, তখন বিস্তর বাংলা সোর্স পড়তে হয়েছিল ওকে৷ আর এখন তো জ্যোতির্ময় সেনের এই খাতাটা দৈবাৎ খুঁজে পেয়ে যেন জীবনটাই পাল্টে গেছে৷ খাতাটা নিয়ে এখন সত্যিই গভীর অবশেসন জন্মেছে ওর৷ রোহিনী অনলাইনে অর্ডার করে একটা ভালো ডিকশনারি আনিয়েছে৷ কোনও শব্দে হঠাৎ আটকে গেলে, বা খটোমটো লাগলে ও ডিকশনারির শরণাপন্ন হয়৷ 

ওয়াশিং চাপিয়ে ও উপরে উঠে দোতলায় নিজের ঘরে গেল৷ ওর মানে ওর আর রণোর ঘর৷ নামেই ওদের ঘর৷ রণো এখন বিশেষ আসার সময় পায় না৷ রোহিনী বরং ইদানিং বেশি আসার চেষ্টা করে৷ খাতাটা পড়তে পড়তে ওর মনে অনেক প্রশ্ন৷ তার উত্তরগুলো এবাড়ির কারোর জানা নেই৷ রণো আর বাবাই দুজনেই নিজের নিজের কাজের জগতে বুঁদ হয়ে থাকে৷ পিসিমণি নিজের মতো করে নিজের সমস্যাগুলোর সঙ্গে যোঝে৷ বেচারি পিসিমণি কী-ই বা করবে? জন্মেছে ইংল্যান্ডে৷ দু’বছর বয়স হতে হতেই আমেরিকায়৷ পিসিমণি চলনে বলনে কথাবার্তায় একদম অ্যামেরিকান– রোহিনী যতটুকু দেখেছে৷ ও এখন ডিভোর্সি, তার উপর ছেলের জন্য একটা অতিরিক্ত চাপ সব সময়ই রয়েছে যদিও বিয়াট্রিস রুণকে সবসময় আগলায়৷ রুণ কখনই আর পাঁচটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিক সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে না৷ সবসময় ওকে বাইরের লোকের কাছ থেকে সাহায্য নিতে হবে জীবনযাপনের জন্য৷ তাও এদেশে এধরনের স্পেশাল নিড ছেলেমেয়েদের জন্য অনেকরকম ব্যবস্থা৷ দেশে হলে কি করত পিসিমণি?

দাদুর খাতাটা নিয়ে বাবাই বা পিসিমণির উৎসাহ থাকার কথা নয়৷ ওরা তো বাংলা পড়া দূরস্থান, বাংলা বলতেও পারে না তেমন৷ বাবাই তাও একটু একটু বলে, কিন্তু ওদের মাতৃভাষা ইংরেজি৷ রণোরও যেমন৷ ডিকশনারিটা হাতে নিয়েই সাঁ করে শব্দটা মনে পড়ল রোহিনীর৷ যে নারীর একটিমাত্র সন্তান তাকে বলে কাকবন্ধ্যা৷ পুরনো দিনে ওনলি চাইল্ডের মাকেও প্রায় সন্তানহীনাই ভাবা হত৷ বন্ধ্যা নয়, সামান্য একটু কোয়ালিফায়ার৷ কাকবন্ধ্যা৷ আশা করা হত নারীদের বেশ কটি সন্তান থাকবে৷ সেই হিসেবে মাম্মা, পিসিমণি সবাই কাকবন্ধ্যা৷ রোহিনীর নিজের তিরিশ বছর বয়স হয়ে গেল৷ এখনও তারা সন্তানের কথা ভাবেনি৷ রণো চাকরি জীবনে উন্নতির বেশ উঁচু ধাপের সিঁড়িতে না উঠে বাচ্চা চায় না৷ রোহিনী নিজে কী চায়, তাও এখন ওর নিজের কাছে খুব স্পষ্ট নয়৷ যেন বিয়ের পর থেকে রণোর ইচ্ছেতেই ওর ইচ্ছে৷ অথচ ওদের দুটো স্বাধীন স্বতন্ত্র জীবন৷ কেউ কারোর ইচ্ছে অন্যের উপর চাপাবে না– এই অলিখিত পূর্বশর্ত থেকেই ওদের একত্র বাস৷ রোহিনীও কি তাহলে ভিতরে ভিতরে মেনে নিচ্ছে! রণোর ইচ্ছেতেই সম্মতি দিচ্ছে? সেরকম কি কথা ছিল? রোহিণীর নিজের উপর রাগ হতে থাকে কেন যেন৷ টেবিলে রাখা খাতাটার দিকে তাকায় ও৷ এই খাতাটা এখন ও যেখানে যায় সঙ্গে নিয়ে যায়৷ এটা যেন ওর নিজস্ব একটা সম্পদ৷ অথচ এ বাড়ির সবাই খাতাটা নিয়ে যাকে বলে লিস্ট বদারড৷ যে একমাত্র খাতাটা উৎসাহ নিয়ে পড়তে পারত, সেই মাম্মারও এ বিষয়ে কোনও উৎসাহ নেই৷ একবার-দুবার খুব আলগাভাবে বলেছে বটে,
– বাবা, এরকম যে একটা মেমোয়ার উনি লিখছিলেন, জানতামই না৷
কিন্তু তার বেশি কোনও উৎসাহ দেখায়নি৷ খাতাটা দেখতেও চায়নি নেড়েচেড়ে৷ 

Notebook
দাদুর খাতাটা নিয়ে বাবাই বা পিসিমণির উৎসাহ থাকার কথা নয়

আর দিদান? অরুণলেখার এখন একটু একটু করে স্মৃতিবিভ্রম বাড়ছে৷ ‘শি হ্যাজ হার গুড ডেজ অ্যান্ড ব্যাড ডেজ’৷ বাবাই সেদিন পিসিমণিকে স্কাইপ কলে বলছিল৷ ঠিকই কথাটা৷ দিদানের কোনও কোনও দিন পুরনো কথাগুলো খুব ভালো মনে পড়ে, কখনও কখনও স্মৃতির উপর সরের মতো আস্তরণ পড়ে৷ সেদিন একটু অসংলগ্ন কথা বলে৷ তবু, খেয়াল করেছে রোহিনী৷ নতুন স্মৃতিগুলো যত তাড়াতাড়ি ভুলে যায় দিদান, পুরোনগুলো ততটা নয়৷ ‘সিলেক্টিভ মেমারি ল্যাপ্স’ বাবাই বলেছিল৷ দিদানের একটা ভালো দিনে, যখন দিদানের চোখ মুখ দেখেই বোঝা যায় যে, পুরনো কথা নাড়াচাড়া করছে মাথার মধ্যে, তখন একদিন সুযোগ নিয়েছিল রোহিনী৷
– দিদান, দাদু একটা নোটবুকে নিজের জীবনের সব গল্প লিখে রেখেছেন৷ আমি খাতাটা খুঁজে পেয়েছি৷ তোমাকে আস্তে আস্তে পড়ে শোনাব? 
রোহিনী ঠিক বুঝতে পারছিল না অরুণলেখার প্রতিক্রিয়া কি হবে। নীল চামড়ার বাঁধানো খাতাটা অরুণলেখা শীর্ণ হাত দু’খানিতে তুলে দিয়েছিল রোহিনী৷ অরুণলেখা ফাউলার্স বেডে আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন৷ খাতাটা হাতে দিতে অনেকক্ষণ হাত বুলিয়েছিলেন খাতার উপরটায়৷ যেন অনেকদিন আগেকার একটা চেনা অভিজ্ঞানকে আলতোহাতে অনুভব করেছিলেন৷ কিন্তু খোলেননি খাতাটা৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অবশেষে খুব ক্লান্তভাবে বলেছিলেন,
– দিদিভাই! এইটা যখন উনি লিখতে শুরু করেন, গোড়া থেকেই আমার কৌতূহল ছিল খুব। কী লিখছেন জানার জন্য৷ একবার ঝুঁকে দেখেও ফেলেছিলাম, বাংলায় লিখছেন উনি৷ কিন্তু যতবারই জিজ্ঞেস করেছি, বলেছেন, জীবনের গল্পগুলো লিখছি৷ যখন জিজ্ঞেস করেছি, ‘আমাকে দেখাবে না?’ বলেছেন ‘যখন সময় হবে, তখন দেখাব৷’ সেই সময় আর আসেনি৷ তারপর তো স্ট্রোক হল৷ প্যারালাইজড্‌ হয়ে গেলেন৷ তখন ওঁকে নিয়েই চিন্তা ছিল৷ খাতার কথাটা মনেও ছিল না৷ তারপর যখন উনি চলে গেলেন, ওখানেই তো ছিলাম৷ একা থাকতাম৷ কিন্তু কখনও মনে হয়নি খাতাটা দেখি, কারণ ওটা তো উনি আমার জন্য লেখেননি, নিজের জন্যই লিখেছিলেন৷ হয়তো ইচ্ছে ছিল পরের জেনারেশনের কেউ পড়ুক৷ তুমি পড়ছ, দাদুকে তো দেখনি সেভাবে! এই খাতাটার মধ্যে দিয়ে উনি হয়তো তোমার মতো কারোর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন৷ সেটাই তো ভালো৷ 

অরুণলেখার এই কথার পর আর কখনও জোর করেনি রোহিনী৷ শুধু একবার অনুমতি নিয়েছে৷ হ্যাঁ, ওর কিছু করার দরকার হলে, বা কোনও অসম্পূর্ণ ন্যারেটিভকে সম্পূর্ণ করতে ও দরকার মতো অরুণলেখার কাছে আসবে৷ একটা অসম্পূর্ণ বয়ানকে সম্পূর্ণ গোল আকার দেবার জন্য ওর দিদানের কাছে অনেক কিছু জানা দরকার৷

– মাম্মা! ড্রায়ার থেকে কাপড়গুলো বের করেছিস?
সীমন্তিনী হেঁকে জিজ্ঞেস করছে৷
– ডোন্ট ওয়ারি মাম্মা৷ আই উইল ডু ইট ইন মাই ওন টাইম৷
রোহিনী শান্ত সমাহিত গলায় বলছে৷ 
– রোদ থাকতে থাকতে কাপড়গুলো একটু শুকিয়ে নে সোনা৷ আর তারপর যদি অ্যাপেল পাই টেস্ট করতে চাস, তাহলে আয়৷
সীমন্তিনীর গলায় সবসময় একটা ব্যস্ততা, যেন খুব তাড়াহুড়ো রয়েছে খুব৷ রোহিনী ঠিক করেছে মাম্মার কোনও কথায় তেমন পাত্তা দেবে না৷ মাম্মার মধ্যে একটা কন্ট্রোল ফ্রিক সত্তা আছে৷ সবসময় মাম্মা চেষ্টা করে সমস্ত কাজ নিখুঁতভাবে চলবে, ঘরবাড়ি একেবারে ধুলোহীন হয়ে সাজানো থাকবে৷ সবাই রোবটের মতো নিজের কাজগুলো করে ফেলবে৷ যদিও রোহিনী এতদিনকার অভ্যেসে দেখেছে এদেশে ঘরবাড়ি এমনিতেই পরিষ্কার থাকে৷ দেশের মতো রোজ রোজ ডাস্টিং করার দরকার হয় না৷ বিশেষ করে সীমন্তিনীদের বাড়ির মতো সব ঘরেই চমৎকার ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট থাকলে৷ মাম্মা ওসব শুনলে তো! নিকি এখন সপ্তাহে তিনদিন এসে সমস্ত ঘরের ডাস্টিং করে৷ ঘরে হুভার চালিয়ে, ওয়াশিং করে, ইন্ডোর প্লান্টগুলোর ব্যবস্থা করে, বাসন ধুয়ে সব কিছু ঝকঝক করে দেয়৷ ভালই ডলার খরচ হয় নিকির জন্য, তবে ও যে ওর কর্তব্যকর্মগুলো বেশ ভালোভাবেই করে এ বিষয়ে অন্ততঃ রোহিনীর কোনও সন্দেহ নেই৷ 

সীমন্তিনীও নিকির ওপর বিরূপ নয়, কিন্তু নিকি যখন থাকে না, সপ্তাহের সেই দিনগুলোও ও ধরে নেয় ওকে এই কাজগুলো করতেই হবে৷ ফলে সকাল থেকে টি-শার্ট আর প্যান্টের উপর একটা হাল্কা জোব্বার মতো অ্যাপ্রন পরে, কাঁধ অবধি চুল ঝুঁটি করে বেঁধে ও নেমে পড়ে অদৃশ্য ধূলিকণাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে৷ অরুণাভ ঠিক উল্টো, ব্যস্ত ডাক্তার৷ কিন্তু একই সঙ্গে বহুবিধ শখ ওর৷ সময় পেলেই সাঁতার কাটতে যায়, গল্ফ খেলে, সামারে কায়াকিং করতে চলে যায়৷ প্রথম প্রথম রোহিনীর দেখে খুব অবাক লাগত৷ বস্টনের যে সাবার্বে রণোদের বাড়ি, সেখানে থ্রি-কার গ্যারাজে একটা জায়গা নির্দিষ্ট, অরুণাভর কায়াক রাখার জন্য৷ সামারে অবধারিতভাবে বাবাই সপ্তাহান্তে কায়াক বড় গাড়ির সঙ্গে লাগিয়ে নিয়ে কায়াকিং করতে যেত৷ ইদানিং কয়েক বছর ধরে অরুণাভর ছটফটে স্বভাবটা একটু কমেছে৷ মাউন্টেনিয়ারিং বা ট্রেকিংয়ে ইদানিং প্রায় যায়ই না বাবাই, তবে যে কোনওরকম স্পোর্টস ওর এখনও প্রিয়৷ সন্ধ্যেবেলা সময় পেলেই বেসমেন্টের ঘরের আরামকেদারায় আধশোয়া হয়ে ফুটবল দেখতে ভালোবাসে৷ ফুটবল মানে অ্যামেরিকান ফুটবল৷ 

এইটা যখন উনি লিখতে শুরু করেন, গোড়া থেকেই আমার কৌতূহল ছিল খুব। কী লিখছেন জানার জন্য৷ একবার ঝুঁকে দেখেও ফেলেছিলাম, বাংলায় লিখছেন উনি৷ কিন্তু যতবারই জিজ্ঞেস করেছি, বলেছেন, জীবনের গল্পগুলো লিখছি৷ যখন জিজ্ঞেস করেছি, ‘আমাকে দেখাবে না?’ বলেছেন ‘যখন সময় হবে, তখন দেখাব৷’ সেই সময় আর আসেনি৷ তারপর তো স্ট্রোক হল৷ প্যারালাইজড্‌ হয়ে গেলেন৷ তখন ওঁকে নিয়েই চিন্তা ছিল৷ খাতার কথাটা মনেও ছিল না৷ 

বাড়ির কোনও ব্যাপারে কখনও সময় দেয় না বাবাই, নাকও গলায় না৷ বস্টন সাবার্বের এই জায়গাটা খুব শান্ত৷ অথচ শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়৷ রোহিনীর এখন এটা শ্বশুরবাড়ি৷ কে জানে যদি দিল্লিতেই থেকে যেত, তাহলে জীবনের গতিটা কীরকম হত? হয়তো সে দিল্লি ইউনিভার্সিটি কিংবা জেএনইউ-তে পড়ত, প্রচণ্ড ছাত্র-রাজনীতি করত, তারপর হয়তো জাঠ কি পাঞ্জাবি বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী কোনও ছেলেকে বিয়ে করে সে দিল্লিতেই থাকত, কোনও একটা ভালো কলেজে পড়াত, চাইলে তনিকা সরকারের কাছে গবেষণা করতে পারত৷ চিত্তরঞ্জন পার্কে এক প্রতিবেশীর আত্মীয় উনি৷ ওই বাড়িতেই তনিকা সরকারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল রোহিনীর৷ তনিকা সরকারের কাছে দাদুর এই খাতাটা দেখাতে খুব ইচ্ছে হল রোহিনীর৷ উনি দেখলে হয়তো অনেককিছু বলতে পারতেন খাতাটার বিষয়ে৷

সীমন্তিনী আবার ডাকল রোহিনীকে৷ নাঃ! মাম্মাকে বুঝতে হবে যে ওর পেট ভর্তি৷ খাওয়ার ব্যাপারে খুব সচেতন রোহিনী৷ সে ঠিক করেছে ভালো করে ব্রেকফাস্ট করলে সে লাঞ্চ খাবে না৷ আর যতই ইনসিস্ট করক মাম্মা, ওইসব অ্যাপল পাই-টাই ছুঁয়েও দেখবে না৷ রোহিনী একটা ফিটনেস রেজিম চালু করেছে নিজের জন্য৷ একটা নিজস্ব রুটিন থাকা দরকার ৷ একটা শৃঙ্খলায় বাঁধা দরকার জীবনকে৷ জ্যোতির্ময় সেনের জীবনকে ছুঁতে গেলে আরও গভীরে যেতে হবে৷ কী ভেবে একজন লোক প্রথমে ইংল্যান্ডে, তারপর আমেরিকায় এসে সেটল করল, ছেলেমেয়ের মধ্যে দিয়ে ঠিক কী স্বপ্ন সে দেখতে চেয়েছিল, কেমন ছিল তার জার্নিটা, সব কিছু জানা দরকার৷

১৩

দেশভাগ এবং স্বাধীনতা– দুটি শব্দ বহু বাঙালির জীবনে সমার্থক হইয়া গিয়াছে৷ যাঁহারা ভুক্তভোগী তাঁহারা বিলক্ষণ জানেন স্বাধীনতার অমৃতফলের সহিত একই সঙ্গে দেশভাগের বিষফলও আস্বাদন করিতে হইয়াছিল৷ আমাদের পরিবারের মতো কিছু কিছু হতভাগ্য প্রস্তুত হইবারও সময় পায় নাই৷ বস্তুতঃ খুলনায় ১৯৪৭ সনের ১৫ই আগস্ট ভারতের পতাকা উত্তোলিত হইয়াছিল৷ একদিনের ব্যবধানে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়া যায়৷ স্থির হয় মুর্শিদাবাদের পরিবর্তে খুলনা পাকিস্তানের  অন্তর্ভুক্ত হইবে৷ বাবা পূর্ব হইতেই মনস্থির করিয়া কলিকাতায় আসাই স্থির করেন এবং সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকরূপে যোগ দেন৷ সেই অনুযায়ী মা এবং আমরা তিনটি ভাই বোন (ছোটকু তখনও জন্মায় নাই) বাবার সঙ্গে কলিকাতায় আসিয়া উত্তরের শহরতলিতে বাসা লইলাম৷ কিন্তু জ্যাঠামশাইরা, যাঁহারা মোটামুটি নিঃসংশয় ছিলেন যে খুলনা সদর এবং নিকটস্থ সেনহাটি গ্রাম ইত্যাদি ইন্ডিয়াতেই রহিবে, স্বাধীনতার একদিন পরে সেই সিদ্ধান্ত বদল হওয়ায় তাঁহাদের মস্তকে বজ্রাঘাত হয়৷ অনতিবিলম্বেই তাঁহারা বুঝিতে পারেন, বিষয়-সম্পত্তি, ভদ্রাসনটুকু রক্ষা করা তো বটেই, পাকিস্তানি সরকারের জমানায় দৈনন্দিন জীবনাচরণই কঠিন হইয়া পড়িতেছে৷ বড় দুই জ্যাঠামশায় সেনহাটি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন৷ বড় জ্যাঠামশাই প্রধান শিক্ষক হিসাবে অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন৷ কিন্তু তিন-চার বৎসর পরেই দু’জনেই অনুভব করিতেছিলেন যে, তাঁহাদের প্রাপ্য সম্মান আর বজায় থাকিতেছে না৷ 

পারিবারিক দুর্গোৎসব বেশ কয়েক বৎসর বন্ধ হইয়া গিয়াছিল৷ পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত স্বপ্নবাসুদেবের মন্দিরের নিত্যপূজাও কোনওক্রমে নমো নমো করিয়া চলিতেছিল৷ কিন্তু যে বিদ্যালয় আমার ঠাকুর্দার প্রতিষ্ঠিত, সেখানে অন্তর্নিহিত রাজনীতি ও কোন্দল এত জটিল হইয়া উঠিল, যে ১৯৫২ সন নাগাদ জ্যাঠাদের পরিবার কলিকাতা আসিতে একপ্রকার বাধ্য হন৷ ইতিমধ্যে পাসপোর্ট চালু হয়৷ দুই দেশে যাতায়াত আর অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত রহিল না৷ যতদূর মনে আছে দুই জ্যাঠামশায় প্রায় সর্বস্বান্ত অবস্থায় কলকাতা পৌঁছান৷ স্কুল হইতে প্রাপ্য টাকা পয়সার খুব অল্প অংশই তাঁহারা পাইয়াছিলেন৷ বাকি পরে পাওয়া যাইবে বলিয়া আশ্বস্ত করা হইয়াছিল৷ সেই অর্থ আর কখনই পাওয়া যায় নাই৷ পৈত্রিক বাটিও ‘এনিমি প্রপারটি’ তকমা লইয়া বেদখল হইয়া যায়৷

Old Temple
পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত স্বপ্নবাসুদেবের মন্দিরের নিত্যপূজাও কোনওক্রমে নমো নমো করিয়া চলিতেছিল

জ্যাঠারা যখন কলিকাতায় আসেন, তখন বিজয়গড়, আজাদগড় ইত্যাদি এলাকাগুলির সমস্ত জমি রেফ্যুজিদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা হইয়া গিয়াছিল৷ বাস্তুহারা উন্নয়নের মধ্যেও বহু চোরাস্রোত ছিল৷ জ্যাঠারা মাঝে মধ্যে হা-হুতাশ করিতেন– যাদবপুর, বাঘাযতীন অঞ্চলের তথাকথিত ভালো এলাকাগুলি এর মধ্যে অন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হইয়া গিয়াছে বলিয়া৷ প্রায় নামমাত্র মূল্যে সেই জমিগুলি রেফ্যুজিরা পান৷ সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের গ্রামের কতিপয় মুরুব্বি ব্যক্তি মিলিয়া বেহালা অঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র কলোনী স্থাপন করিয়াছিলেন৷ জ্যাঠারাও ওই অঞ্চলে পাশাপাশি দুইটি জমি কিনিয়া বাড়ি করিতে সক্ষম হন৷ সেনহাটির লোকের সংখ্যাধিক্যের দরুণ ওই নতুন পাড়াটির পত্তন করিয়া নাম দেওয়া হয় সেনহাটি কলোনি৷ জ্যাঠাদের বাড়ি যখন হইতেছিল, তখন ওইসব অঞ্চল একেবারে নীচু এবং জলাজমি ছিল৷ রাতবিরেতে শিয়াল ডাকিত৷ আশ্চর্যের বিষয়, তাহার পনেরো-ষোলো বৎসর পরেই ওইসব স্থানের কেমন আমূল পরিবর্তন হইল৷ গা ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া কত বাড়ি মাথা তুলিল৷ বহু দোকানপাট-বাজার, রিক্সা, স্কুল, কলেজ সমস্ত মিলিয়া বেহালা অঞ্চল কলিকাতার দক্ষিণে একটি অত্যন্ত জনবসতিপূর্ণ এলাকা বলিয়া পরিগণিত হইল৷

দেশভাগ এবং শরণার্থী হইয়া চলিয়া আসা, এই বিরাট ঘটনার প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী হইয়াছিল এ বিষয়ে কোনও সংশয় নাই৷ রেফ্যুজি পরিবারগুলিকে বহু বিড়ম্বনার শিকার হইতে হইয়াছিল৷ ভাগ্যের বিড়ম্বনায় তাহাদের বহু পরীক্ষার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল৷ ছিন্নমূল মানুষের বেদনা এবং সংগ্রাম লইয়া সাহিত্য, বিশেষ করিয়া ফিল্ম কম হয় নাই৷ নূতন নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হওয়া একটি জটিল প্রক্রিয়ার অংশ৷ সেই প্রক্রিয়ার ঘূর্ণনে আবর্তিত হইতে হইতে পূর্ববঙ্গ হইতে আগত মানুষরা জীবনের সঙ্গে নতুনভাবে বোঝাপড়া করিতে সমর্থ হয়৷ তাহাদের মানসিকতায়ও কিছু পরিবর্তন হয়৷ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান– যেগুলি একসময় জলহাওয়ার মতোই স্বাভাবিক এবং সহজলভ্য বলিয়া মনে হইত, সেই বস্তুগুলি পঞ্চাশের দশকের রেফ্যুজিদের নিরন্তর সংগ্রামের বিষয় হইয়া দাঁড়ায়৷ পুরুষদের পাশাপাশি এই সংগ্রামে মেয়েরাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে৷ হয়তো স্বাধীনতার বিশ বৎসর পূর্বে নারী স্বাধীনতার ভূমিটি তৈরি হইয়াছিল৷ তবে ত্রিশ-চল্লিশের দশকে যে সব নারীরা লাইমলাইটে আসেন, তাঁহারা ব্যতিক্রমী৷ 

রোহিনী ঠিক করেছে মাম্মার কোনও কথায় তেমন পাত্তা দেবে না৷ মাম্মার মধ্যে একটা কন্ট্রোল ফ্রিক সত্তা আছে৷ সবসময় মাম্মা চেষ্টা করে সমস্ত কাজ নিখুঁতভাবে চলবে, ঘরবাড়ি একেবারে ধুলোহীন হয়ে সাজানো থাকবে৷ সবাই রোবটের মতো নিজের কাজগুলো করে ফেলবে৷ যদিও রোহিনী এতদিনকার অভ্যেসে দেখেছে এদেশে ঘরবাড়ি এমনিতেই পরিষ্কার থাকে৷ দেশের মতো রোজ রোজ ডাস্টিং করার দরকার হয় না৷ বিশেষ করে সীমন্তিনীদের বাড়ির মতো সব ঘরেই চমৎকার ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট থাকলে৷ 

স্বাধীনতা এবং দেশভাগের পরবর্তী বিশ বৎসর ধরিয়া নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রটি যে বাংলায় বহুলাংশে বিস্তৃত হইল, এ বিষয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নাই৷ আমার জেঠতুতো দিদিদের দেখিতাম, বৈদ্য পরিবারের এই মেয়েদের লড়াকু মানসিকতা আমাকে বিস্মিত করিত৷ খেঁদি, বুঁচি, আন্না, শেফালি– আমার দিদিরা প্রত্যেকে নিজ চেষ্টায় প্রাইভেটে বিএ বা এমএ পাশ করিয়াছিলেন৷ সেনহাটি কলোনিতে আমাদের পরিবারের লতায় পাতায় জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যেই তাঁহাদের বিবাহ হয়। কিন্তু প্রত্যেকটি মহিলা স্বাধীন উপার্জনক্ষম ছিলেন৷ ইঁহাদের কেহ বেহালায় স্কুলে পড়াইতেন, কেহ বা নার্সিং শিখিয়া হাসপাতালে নার্সের কাজ করিতেন৷ আবার জেঠিমারা সেলাই মেশিন কিনিয়া শেলাই শিখিয়া পাড়া-প্রতিবেশিনীর ব্লাউজ, পেটিকোট সেলাই করিয়া স্বামীদের সংসারের ব্যয় আংশিক নির্বাহ করিতেন৷ জ্যাঠারা চাকরিজীবনের উপান্তে ইন্ডিয়ায় আসেন৷ নতুন করিয়া আর চাকরি জোগাড় করা তাঁহাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না৷ কিন্তু বাড়িতে নিয়মিতভাবে তাঁহারা ছাত্র পড়াইতেন৷ বেশ কয়েক ব্যাচে ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁহাদের কাছে ইংরাজি, সংস্কৃত এবং অঙ্ক শিখিতে আসিত৷

আমাদের পরিবারটি জ্যাঠামহাশয়দের তুলনায় সচ্ছল ছিল৷ আমাদের নিজস্ব লড়াই ছিল, কিন্ত বোধকরি পার্টিশনের কিঞ্চিৎ পূর্বে স্থানান্তরিত হইবার দরুণ লড়াইয়ের প্রকৃতি কিছু ভিন্ন ছিল৷ বাবা কলকাতায় আসিয়াও সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করিতেন৷ স্বাধীন ভারতবর্ষে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্মরণে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজের নামকরণ করা হয় মৌলানা আজাদ কলেজ৷ এই কলেজটিতে আমিও আইএসসি পড়ি৷ সে ৫২-৫৩ সালের কথা৷ কলেজটিতে ঢুকিবার মুখে একটি মহুয়া গাছ ছিল৷ অর্বাচীন ছাত্ররা প্রায়ই গাছের তলায় পড়িয়া থাকা ফুলগুলি কুড়াইয়া মহুয়ার স্বাদ আস্বাদন করিত৷ যেমন ছাত্রদের ভিতর, তেমনি শিক্ষকদের ভিতর মিশ্র গোষ্ঠী ছিল৷ অধিকাংশই মুসলমান ছাত্র৷ কলেজে যেমন একদিকে বাংলা ও সংস্কৃত পঠন পাঠনের ব্যবস্থা ছিল, তেমনি আরবি, ফারসি, উর্দু ইত্যাদি ভাষাও অধ্যয়নের ব্যবস্থা ছিল৷ স্টাফরুমেও হিন্দু ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের একধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল৷ পার্টিশনের পরবর্তী বছরগুলিতেও এই সৌহার্দ্য কখনও ক্ষুণ্ণ হয় নাই৷

এইবার আমার ইমিডিয়েট ফ্যামিলির বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন৷ পূর্বেই বলিয়াছি আমার ভগিনীদ্বয় হাসি ও খুশি শান্তিনিকেতনে পড়িতে যায়৷ হাসি ও খুশির মধ্যে তফাৎ আড়াই বৎসরের৷ হাসি ও খুশি শৈশব হইতে কলাবিদ্যায় প্রভূত পারদর্শী ছিল৷ দু’জনেরই গানের গলা ছিল চমৎকার৷ সেজন্য প্রি-ইউনিভার্সিটির পর বাবা হাসিকে শান্তিনিকেতনে সঙ্গীতভবনে ভর্তি করাই সমুচিত বলিয়া বিবেচনা করেন৷ খুশি তাহার দুই বৎসর পরে কলাভবনে যোগ দেয়৷ উহারা শান্তিনিকেতনে আবাসিক ছাত্রী হিসাবে পড়িত৷ সেইখানে কোনও একবার ভগ্নীদের গ্রীষ্মের ছুটির গোড়ায় আনিতে গিয়া অরুণের সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়৷ আমার সহিত যে তখনই প্রথম দেখা, অরুণের স্মৃতিতে সেই ঘটনা ধরা নাই৷ প্রথম দর্শনেই সেই তরুণীকে দেখিয়া আমার মনে হইয়াছিল– বাঃ! বেশ মেয়েটি তো! ভিতরে ভিতরে একটু চিত্তচাঞ্চল্য টের পাইতেছিলাম৷ আমিও তখন পঁচিশ বৎসরের যুবকমাত্র৷ সেই পরিচয় গভীরতর হয় ১৯৬১-র বসন্তোৎসবে৷ সেই ঘটনায় হয়তো বা হাসিরও কিছু হাত ছিল৷ হাসি অরুণের ঘনিষ্ঠতম বান্ধবীও বটে৷ অরুণকে সে সর্বদা আমার সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করিত৷ 

Female Students, Santiniketan, 1929
হাসি ও খুশি শান্তিনিকেতনের যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অগ্রবর্তী ভূমিকায় থাকিত৷

হাসি ও খুশি দুইবোন শান্তিনিকেতনের যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অগ্রবর্তী ভূমিকায় থাকিত৷ খুশি অঙ্কনের পাশাপাশি নৃত্যশিল্পেও পারদর্শী ছিল৷ শান্তিদেব ঘোষের নাচের ট্রুপের সঙ্গে সে পরে জাভা, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি পরিদর্শন করিয়াছিল৷ সে রাত্রে বৈকালিকে ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ গানের মাদকতায় আমি তখনও আচ্ছন্ন ছিলাম৷ রাতে অরুণলেখাদের বাড়িতে ওর কয়েক বন্ধুর নিমন্ত্রণ ছিল৷ হাসির দাদা ও অভিভাবক হিসাবে সেই রাত্রে সেখানে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম৷ অরুণ এবং তাহার দাদা মোহন শান্তিনিকেতনের জল-বাতাসে মানুষ৷ তাহাদের ব্যবহারে কোনও জড়তা ছিল না৷ রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর অরুণদের সীমান্তপল্লির একতলার ছাদে গানের আসর বসিয়াছিল৷ হাসি ও অরুণ শুধু নয়, আরও অনেকে সে রাত্রে গান গাহিয়াছিল৷ খোলা আকাশের তলায় চাটাই বিছাইয়া একের পর এক গান৷ কখনও এসরাজ বাজাইয়া, কখনও খালি গলায়৷ একেবারে শেষ পর্যায়ে হাসি বলিয়াছিল
– অরুণ! তুই ওই জ্যোৎস্নারাতের গানটা গা৷
আর একবারও সাধিতে হয় নাই৷ এক ঢাল চুল খোলা, সামনে কোথাও একটা বকুল গাছ হইতে তীব্র মাদকতাময় গন্ধ আসিতেছিল৷ অরুণ গাহিতেছিল বসন্তের এই মাতাল সমীরণে৷ আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে৷

সেই গান যেন অন্য কোনও কল্পলোক হইতে ভাসিয়া আসিয়া সেদিনের ছাব্বিশ বছরের যুবক আমাকে আচ্ছন্ন করিয়া দিতেছিল৷ অরুণলেখার সঙ্গে জীবনের এই খেলাঘরে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি কাটাইলাম৷ মান অভিমান, ঝগড়াঝাঁটি সব দাম্পত্যের মতোই আমাদেরও দাম্পত্যের অংশ ছিল৷ মাঝে মাঝে মনে হইয়াছে, এই অরুণলেখাকে যেন চিনিতে পারি না৷ কী জানি অরুণেরও হয়তো আমাকে দেখিয়া মাঝে মাঝে এই একইরকম অচেনা ঠেকে৷ কিন্তু চক্ষু বুজিয়া মনের মধ্যে যদি সেদিনকার সেই বসন্তোৎসবের দৃশ্য মনে করি, তবে সব যেন একইরকম আছে মনে হয়৷ বাহান্ন বছর আগের সেই ছাদ, অরুণের একঢাল কালো চুল, জাদুকরী জ্যোৎস্না, দোলপূর্ণিমার সেই মায়াচাঁদ, সব কিছু অবিকল তেমনই আছে৷ মনে মনে সেই স্বপ্নজীবন তার তীব্র মাদকতাময় বকুলগন্ধ লইয়া ফিরিয়া আসিতে থাকে৷

১৪

সীমন্তিনীর আজকাল খুব ভালো লাগে৷ তাদের বাড়িটা আবার অনেককাল বাদে বেশ ভরে উঠেছে৷ অরুণলেখা আসার পর বাড়িটা বেশ ভরা ভরা লাগছিল প্রত্যেকবারের মতোই৷ সীমন্তিনী লক্ষ করেছে, ওর শাশুড়ির একটা শান্ত স্নিগ্ধ উপস্থিতি রয়েছে৷ একেবারেই উচ্চকিত নয়, কিন্তু একটা হালকা সুগন্ধের মতো বাড়িটাকে ঘিরে রাখে৷ হয়তো পুরোটাই ওর মন গড়া৷ কিন্তু বাড়িতে অরুণলেখা থাকলেই ওর মনে হয় মাথার উপরে একটা ছাতা খোলা রয়েছে৷ এক ধরনের প্রোটেকশন৷ রোহিণীর মা বাবা এসে কদিন খুব হৈ হৈ হল৷ সেই সময়েই জিনিয়ারও ইস্ট কোস্টে কাজ পড়ে যাওয়ায় বেশ একটা ফ্যামিলি রি-ইউনিয়ন মতো হয়ে গেল৷ পরের বছর কলকাতায় বেশ কিছুটা সময় নিয়ে যেতে হবে৷ রোহিণীর দাদার বিয়েতে রণো আর রোহিণী তো বটেই, সীমন্তিনী আর অরুণাভকেও যেতে হবে৷ ওরা অনেকবার করে বলেছে অরুণলেখাকেও নিয়ে যাবার জন্য৷ কিন্তু মামণির শরীর কি অতদূরে যাবার ধকল সইতে পারবে?

পূর্বেই বলিয়াছি আমার ভগিনীদ্বয় হাসি ও খুশি শান্তিনিকেতনে পড়িতে যায়৷ হাসি ও খুশির মধ্যে তফাৎ আড়াই বৎসরের৷ হাসি ও খুশি শৈশব হইতে কলাবিদ্যায় প্রভূত পারদর্শী ছিল৷ দু’জনেরই গানের গলা ছিল চমৎকার৷ সেজন্য প্রি-ইউনিভার্সিটির পর বাবা হাসিকে শান্তিনিকেতনে সঙ্গীতভবনে ভর্তি করাই সমুচিত বলিয়া বিবেচনা করেন৷ খুশি তাহার দুই বৎসর পরে কলাভবনে যোগ দেয়৷ উহারা শান্তিনিকেতনে আবাসিক ছাত্রী হিসাবে পড়িত৷ সেইখানে কোনও একবার ভগ্নীদের গ্রীষ্মের ছুটির গোড়ায় আনিতে গিয়া অরুণের সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়৷ 

ভাবতে ভাবতে ঝম ঝম করে বৃষ্টি এল৷ কাচের বড় বড় জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে খুব ভাল লাগে সীমন্তিনীর৷ ওর ছোটবেলায় কলকাতায় বৃষ্টি এলে ঠাকুমার ঘরে গিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ত।
–  ঠাম্মা, একটা গল্প বলো৷
ঠাম্মা গল্পের ঝুলি খুলে বসতেন৷ ঠাম্মার কাছে শুনেছিল ওর দাদু নাকি ভাগ্যান্বেষণে বর্মায় গিয়ে ছিলেন কিছুদিন৷
– আমার তখন পাঁচ মাস চলছে৷ তোমার পিসি ছোট, আর তোমার বাবা আমার পেটে, তখন তোমার দাদু পাড়ি দিলেন বার্মা৷
– তুমি কোথায় ছিলে?
– কেন, এই বাড়িতেই৷ তখন আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদরা, চাকরবাকর– বাড়ি একেবারে গমগম করত৷ 
– বাবা যখন জন্মাল,তখন? 
– তখন তো লোকে কথায় কথায় অত হাসপাতালে ছুটত না৷ মেডিকেল কলেজ ছিল৷ কিন্তু খোকা হয়েছিল বাড়িতে৷

ভবানীপুরের বাড়ির ভিতরদিকের একটা ঘর ছিল আঁতুড়ঘর৷ সীমন্তিনীর বাবা অম্বিকাচরণের জন্ম সেখানে৷ বিয়ের পর রোহিণীকে নিয়ে যখন কলকাতায় এসেছিল সীমন্তিনী, তখন আঁতুড়ঘরটা দেখে খুব অবাক হয়েছিল রণো আর রোহিণী৷ রণো বেশ কয়েকবার গেছে কলকাতায়,কিন্তু সীমন্তিনীর বাবার জন্ম যে বাড়িরই একটা ঘরে, সেটা ওকে বলা হয়নি কখনও৷ ওই বাড়িতেই অম্বিকার জন্ম৷ মৃত্যুও৷ অম্বিকা খুব বেশিদিন বাঁচেননি৷ বাবা আর একটু বেশিদিন থাকলে সীমন্তিনী ওর ঘরসংসার দেখাতে পারত বাবাকে৷ সীমন্তিনীর হঠাৎ মনে হল, বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে অরুণাভ ছুটে গেছিল চটজলদি টিকিট কেটে৷ কিন্তু কী পরিস্থিতিতে বাবা ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চলে গেলেন, গিয়ে অরুণাভ কী দেখেছিল এসব আর কখনও জানা হয়নি অরুণাভর কাছ থেকে৷ তখন সীমন্তিনী হেভিলি প্রেগন্যান্ট৷ ওকে যতটা সম্ভব ঢেকে, প্রোটেক্ট করে চলতেন শুধু অরুণাভ নয়, অরুণলেখা আর জ্যোতির্ময়ও৷ ওই সময়ে শ্বশুর শাশুড়ির সাহচর্য আর উপস্থিতি ওর কাছে ছিল আর্শীবাদের মতো৷ মা-বাবা যেভাবে সন্তানকে রক্ষা করে, ওঁরা ঠিক সেভাবেই সব ঝড় ঝাপটা থেকে চিরকাল ঢেকে এসেছেন সীমন্তিনীকে৷ অম্বিকার আকস্মিক মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পরে অরুণাভকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে সীমন্তিনী,
– তুমি গিয়ে কী দেখেছিলে? 
অরুণাভ বার বার এড়িয়ে গেছে৷
– কী হবে সীমন ওসব মনে করে? যিনি গেছেন, তিনি তো আর ফিরবেন না৷ তার চেয়ে শেষ যেমন দেখেছ, সেই হাসিখুশি জীবন্ত মানুষটাকেই মনে রেখে দাও৷
অরুণাভ খুব আস্তে আস্তে সীমন্তিনীর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল৷

‘কিছু কিছু গল্প অজানাই থেকে যায়৷ অজানাই থাক না…’ যেমন বলেছিলেন বিক্রম৷ ওঁর প্রথম উপন্যাস তখন সদ্য বেরিয়েছে৷ বিশালকায় উপন্যাস রুদ্ধশ্বাসে কয়েকদিনের মধ্যে পড়ে ফেলেছিল সীমন্তিনী৷ তার দু-একমাসের মধ্যে বস্টনের বার্নস অ্যান্ড নোবলের দোকানে বুক ট্যুরের অংশ হিসেবে একটা আলোচনাসভায় এসেছিলেন উনি৷ তখন যুবক৷ অরুণাভরই আশপাশে বয়স৷ রোগা পাতলা চেহারা৷ মাথার সামনের দিকটা আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে আসছে৷ ওঁকে দেখার জন্য দোকানে প্রায় দেড়শো লোকের আসন সব কানায় কানায় ভরা৷ উজ্জ্বল কিন্তু নরম আলোর বৃত্তে বসে লেখক খুব মৃদস্বরে পাঠ করলেন উপন্যাসের স্বনির্বাচিত কয়েকটি অংশ৷ তারপর প্রশ্নোত্তরের পালা৷ উৎসাহী পাঠকরা একের পর এক প্রশ্নের ডালি সাজিয়ে জবাব জানতে চাইছিলেন লেখকের কাছে৷ উনি একটুও ব্যস্ত বা বিব্রত হচ্ছিলেন না৷ যেন প্রতিটি প্রশ্নই অনুমান করেছিলেন– এরকমভাবে হেসে থেমে থেমে জবাব দিচ্ছিলেন৷ সেই সময়ই সীমন্তিনীর মনেও বইটা পড়ার সময়ই যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটাই একটু অন্য ভাষায় করেছিলেন এক পাঠক৷ গল্পের নায়িকার তার প্রেমিকের সঙ্গে কেন বিয়ে না হয়ে অন্য একজনের সঙ্গে কেন বিয়ে হল? তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ে হলে কি হত? লেখক একটু বিষণ্ণ হাসি হেসেছিলেন৷ পাতলা হয়ে আসা চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলেছিলেন,
– ওর সঙ্গে বিয়ে হলে কী হত, আমি জানি না৷ কারণ বিয়েটা হয়নি৷
আবার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে উনি বলেছিলেন,
– আসলে জান তো, কিছু কিছু গল্প অজানাই থেকে যায়৷ অজানাই থাক না!

সীমন্তিনীর হঠাৎ মনে পড়ে গেল কথাটা৷ সব গল্প নিটোলভাবে শেষ হয় না৷ আবার কিছু কিছু গল্প এক একজনের জীবন পরিধির মধ্যে ঘটে শেষ হয়ে যায়৷ কত গল্প আছে, যেগুলো সময় থাকতে কখনও ঠিকমতো শোনা হয় না৷ রোহিণী এইজন্যই পুরনো গল্পগুলোকে ধরে রাখতে চায়৷ জ্যোতির্ময়ের ডায়েরির মধ্যে যে পুরনো সময় উঁকি মারে, চেনা মানুষদের ঘরোয়া কথায় যে হারিয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর ছবি ভেসে ওঠে, ও সেগুলোকে খুঁজে বেড়ায় পুরনো সময়টাকে বুঝতে৷

অরুণলেখা এখনও জীবনের যে ঘটনাগুলো মনে করতে পারেন, তার অনেকগুলো হয়তো সীমন্তিনীর জানা৷ কিন্তু অরুণলেখার জীবনের অনেক খুঁটিনাটিই তো ও জানে না৷ উনি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সেসব গল্পও হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো৷ এসব ভাবতে ভাবতে সীমন্তিনীর একটু অস্থির লাগল৷ কী ভেবে ও তাড়াতাড়ি বাড়ির চটিটা গলিয়ে অরুণলেখার ঘরে এল৷ দুপুর থেকেই রীতিমতো ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে৷ অরুণলেখা জানলার পাশে রাখা বেতের গোল চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছেন৷ ঘরের মিউজিক সিস্টেমে বর্ষার গান বাজছে৷ ‘যায় দিন শ্রাবণ দিন যায়’ সংকলনটার নাম৷ রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান ও কবিতার সুগ্রন্থিত একটি সংকলন৷ অরুণলেখা এখন নিজে গান চালাতে পারেন না৷ উনি ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে পুরনো দিনের টার্ন টেবল রেকর্ড প্লেয়ার আর পরের দিকে ক্যাসেট প্লেয়ারে অভ্যস্ত ছিলেন৷ রোহিণী নিশ্চয়ই চালিয়ে দিয়ে গেছে৷ এরকম ছোট ছোট জিনিসগুলো রোহিণী সবসময় খেয়াল রাখে বাড়িতে থাকলেই৷ সীমন্তিনী মনে মনে তারিফ না করে পারে না৷ সীমন্তিনীরই তো খেয়াল করা উচিত ছিল৷ ও এলো চুলগুলো একটা আলগা হাত খোঁপা করতে করতে অরুণলেখার কাছে এসে বলল,
– ঠিক দেশের মতো বৃষ্টি পড়ছে আজ, তাই না মামণি?
অরুণলেখা হাসলেন। বললেন,
– এদেশে বৃষ্টি হলে মাটির সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায় না৷ আমাদের ওখানে বৃষ্টি হলেই ওই যে সুঘ্রাণটা উঠত, ওটা এদেশে আসার পর খুব মিস করতাম৷ তারপর আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে গেল৷
– দেশে যেতে ইচ্ছে করে মামণি?
সীমন্তিনী আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল৷ 
– নাঃ, এখন আর করে না৷ দেশে আর কতবছর ছিলাম বল! জীবনের বেশিটাই তো এখানেই কাটল, ইংল্যান্ডে চার বছর বাদ দিলে৷  
– এখন এটাই তোমার দেশ, কী বল দিদান?
রোহিণী সুড়ুৎ করে কখন ঘরে ঢুকে এসেছে খেয়ালই করেনি সীমন্তিনী৷ ও হাসিমুখে বলল,
– আরে, তুই কখন চলে এলি? 
– হাঁউ মাঁউ খাঁউ, গল্পের গন্ধ পাঁউ…
রোহিণী মজা করে বলছে৷ 
– যেই দেখেছে আমার ঘরে তুমি আসছ, অমনি ও এসেছে৷ পুরনো গল্প পেলে আর কিছু চায়না মেয়েটা৷ 
– একেবারে ঠিক কথা৷ দিল্লিতে এরকম বৃষ্টি হলে আমার মা মাসিরা গোল হয়ে বসে গল্প করার জন্য, কিন্তু উইথ চা অ্যান্ড পাঁপড়ভাজা৷ এনিবডি ফর চা অ্যান্ড পাঁপড়? হাত তোল৷ 
– গুর্মুখের দেওয়া আগের পাঁপড়গুলোও ফুরোয়নি এখনও৷ চা কি চাইনিজ টি টা করবি? তাহলে দ্যাখ প্যানট্রিতে সেকেন্ড তাকে আছে৷
সীমন্তিনী বলছে৷ 
– নো ওয়ে৷ পিওর লপচু চা ইন দিস্‌ ওয়েদার৷ আমি জানি কোথায় আছে৷
বলে রোহিণী হুড়মুড় করে চলে গেল চা আর পাঁপড়ের জোগাড় করতে৷ অরুণলেখা সীমন্তিনীকে বললেন,
– মেয়েটা সত্যিই খুব আন্তরিক৷ আমাদের বাড়ির উপযুক্ত। 
সীমন্তিনীও সায় দিল।
– ওর বাড়িতেও খুব ঘরোয়া পরিবেশে বড় হয়েছে তো! সেটা বোঝা যায়৷ শিপ্রাদিরা সকলেই এত চমৎকার৷ আমাদের সঙ্গে ওয়েভলেংথে খুব মেলে৷

MAC
স্বাধীন ভারতবর্ষে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্মরণে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজের নামকরণ করা হয় মৌলানা আজাদ কলেজ৷

সীমন্তিনীদের শোবার ঘরগুলো সব উপরতলায়৷ ঘরের লাগোয়া একটা ছোট প্যানট্রি আছে চটজলদি চা জলখাবার করার জন্য৷ সকালের বেড টি আর বিকেলের চা স্ন্যাক্‌স সব এখান থেকেই হয়৷ অরুণলেখার স্যুপ অবধি৷ সন্ধ্যেয় বেশিরভাগ দিনই অরুণলেখা স্যুপ আর এক পিস টোস্ট খান৷ বাইরের লোক বা গেস্ট না থাকলে ছোটখাট খাবারের জন্য নীচের বড় কিচেনে যাবার দরকারই পরে না৷ রোহিণী বেশ চট করে চা আর পাঁপড় সেঁকে এনেছে৷ 
– হ্যাভ আই মিস্‌ড্‌ এনিথিং? 
– নো, উই আর ওয়েটিং ফর ইওর গ্রেসাস কম্পানি৷
সীমন্তিনী বলল৷ অরুণলেখা পাঁপড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– আমাদের দমদমের বাড়ির ওখানে খুব বড় রথের মেলা বসত৷ পাঁপড়ভাজা ছিল মাস্ট৷ 
– বাড়িতে ভাজতে, না মেলায় কিনতে?
রোহিণী জিজ্ঞেস করল৷ 
– মেলায় তো বটেই৷ আমরা দফায় দফায় মেলায় গিয়ে ঘুরে আসতাম৷ 
– কার সঙ্গে যেতে?
এবার সীমন্তিনী৷ 
– যখন যার সঙ্গে হয়৷ শাশুড়ির সঙ্গে যেতাম৷ শাশুড়ির খুব গাছের শখ ছিল৷ বেছেবুছে চারা কিনে নিয়ে আসতেন দমদমের বাড়ির সামনে জমিতে লাগানোর জন্য৷ ওই করে লেবু লঙ্কা, ধনেপাতা, কত কী হয়েছিল৷ এমনকি ছোট ছোট টমেটো অবধি৷ দুটো আমগাছও লাগিয়েছিলেন৷ তবে সেই আম আর আমাদের খাওয়া হয়নি৷
– কেন?  
– তার আগেই চলে গেলাম তো ইংল্যান্ডে৷ ফের গেলাম শ্বশুরমশাই যখন মারা গেলেন৷ সে তো আর আমের সিজন না৷ ভালো হিসমাগর হত, খুশি বলেছিল৷ 
– তোমরা আমের সিজনে একবারও যাওনি?
রোহিণী প্রায় বিশ্বাসই করতে পারছে না৷ 
– নাঃ, অরুণলেখা জবাব দিচ্ছেন।
– পরে মে মাসে একবার-দুবার উনি দেশে গেছেন কাজ নিয়ে৷ দিল্লিতে হাসির বাড়িতে মায়ের সঙ্গে দেখাও করে এসেছেন, কিন্তু তখন আর আমগাছ কোথায়? বাড়িই তো বিক্রি হয়ে গেল৷ হাতবদল হয়ে যারা কিনেছিল, তারা খেত হয়তো।
অরুণলেখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ 
– রথের মেলার কথা বলছিলে দিদান৷
রোহিণী মনে করায়৷ 
– হ্যাঁ রথের মেলা বসত নাগেরবাজার থেকে সাতগাছি অবধি পুরো যশোর রোড জুড়ে৷ এদিকে দমদম রোডের দিক থেকে শুরু হয়ে যেত৷ 
– কী বিক্রি হত ওখানে?
– ওরে বাবা! কী বিক্রি হত না? মাটির পুতুল, মাটি দিয়ে তৈরি ফল, শসা, কলা, পেয়ারা, আম, ঠিক সত্যিকারের মতো দেখতে৷ সেই দেখে বাবাইয়ের কী আনন্দ!
অরুণলেখা যেন দেখতে পাচ্ছেন ছোট্ট বাবাইয়ের হাসি৷ 
– বাবাইও যেত রথের মেলায়!
রোহিণী বলে৷ 
– ও বাবা! ও তো আগে পা বাড়িয়ে তৈরি৷ কাকা পিসিদের কোলে চড়ে মেলায় যাবার জন্য পা বাড়িয়ে থাকত৷ একরকম ছোট্ট ছোট্ট চিনে লন্ঠনও বিক্রি হত৷ 
রোহিণী লক্ষ করে অরুণলেখা যত না জিনিসের নাম করছেন, তার চেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন ‘কত কী বিক্রি হত’ শব্দগুলোর উপর৷

অরুণলেখা এখনও জীবনের যে ঘটনাগুলো মনে করতে পারেন, তার অনেকগুলো হয়তো সীমন্তিনীর জানা৷ কিন্তু অরুণলেখার জীবনের অনেক খুঁটিনাটিই তো ও জানে না৷ উনি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সেসব গল্পও হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো৷ এসব ভাবতে ভাবতে সীমন্তিনীর একটু অস্থির লাগল৷ কী ভেবে ও তাড়াতাড়ি বাড়ির চটিটা গলিয়ে অরুণলেখার ঘরে এল৷ দুপুর থেকেই রীতিমতো ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে৷ অরুণলেখা জানলার পাশে রাখা বেতের গোল চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছেন৷ 

সীমন্তিনী কী যেন ভাবছিল দমদমের বাড়ির কথা হওয়ার পর থেকে৷ হঠাৎ ও বলে
– আচ্ছা দমদমের বাড়িটা কারা কিনেছিল? 
– বিষ্টুবাবু বলে এক ভদ্রলোক৷ উল্টোদিকের পাড়া দেবীনিবাসে থাকতেন৷ ওঁর একটা দেশলাইয়ের কারখানা ছিল৷ আর হোসিয়ারি বিজনেস না কী সব ছিল৷ 
– দেশলাই কারখানায় কি তৈরি হত? দেশলাই কাঠি?
প্রশ্নটা করেই রোহিণী বুঝতে পারে প্রশ্নটা খুব বোকা বোকা হয়ে গেল৷ দেশলাই ছাড়া আর কীই বা তৈরি হতে পারে দেশলাই কারখানায়? অরুণলেখা হেসে ফেললেন।
– দেশলাইয়ের কাঠি, বাক্স৷ কাঠিগুলো বাক্সে ভরা হতে হবে তো! একবার খুশি লিখেছিল দেশলাই কারখানায় দাউ দাউ করে আগুন লেগে অনেক টাকার মাল নষ্ট হয়েছে৷ 
– ভদ্রলোক বাড়ি প্রোমোট করতে দিলেন কেন?
সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল৷ 
– প্রোমোটিং হয়েছিল নাকি?
অরুণলেখা এবার আর ঠিক মনে করতে পারছেন না।
– হয়তো অর্থকষ্টে পড়েছিলেন৷ ওই সময় কারখানাগুলো তো লাটে উঠে গেছিল৷ ট্রেড ইউনিয়ন, অমুক তমুক৷ ভদ্রলোকের এক ছেলে দুর্গাপুরে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছিল ওর পরে পরেই৷ ভদ্রলোক নাকি ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলেন এই বাড়ি অভিশপ্ত৷ যে থাকবে, তারই পুত্রশোক হবে৷ আমার দেওরকেও তো ওর কয়েকবছর আগে পুলিশ গুলি করে মেরেছিল রাতের অন্ধকারে৷

Arunlekha
দিদান কি ঘুমিয়ে পড়ল হঠাৎ?

অরুণলেখা একটানা কথা বলে হাঁফাচ্ছেন একটু৷ 
– একটু জল খাবে দিদান? 
– নাঃ, থাক৷ বাড়ি প্রোমোটিং হয়েছে জানলে কী করে মামণি?
প্রশ্নটা সীমন্তিনীর প্রতি৷ 
– বাঃ, আমরা গেছিলাম না? অরুণাভ যেবার কলকাতায় গেল৷ আমার সঙ্গে আলাপের পর আমরা তো একদিন দেখতে গিয়েছিলাম তোমাদের পুরনো জায়গা৷ তখনই দেখেছিলাম বোর্ড লাগানো আছে ওখানে৷ বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠবে৷ তোমার ছেলে ফিরে এসে বলেওছিল তোমাকে৷ ছবি তুলেছিল তোমাদের দেখাবার জন্য৷ তোমার মনে নেই? 
অরুণলেখা একটু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
– বলেছিল বাবাই? কি জানি, আজকাল আর কিছু মনে পড়ে না৷ শুধু আগের বাড়ি, সেই রাস্তাগুলো, সেই মানুষগুলোই চোখের সামনে ভাসে৷ 
– মাম্মা, তুমিও গেছ ওই বাড়িতে?
রোহিণীর বিস্ময় আর ধরছে না৷
– না রে, ওটাকে বাড়িতে যাওয়া বলে না৷ আমি তো বাইরে থেকে দেখেছি বন্ধ বাড়ি৷ ঠিক যেন অপেক্ষা করছে লোকেরা এসে ভেঙে ফেলবে সেই জন্য৷
সীমন্তিনী বলে। তারপর হঠাৎ আরও একটা তথ্য মনে পড়ে ওর৷ 
– ওহোঃ! আর একটা কথা মনে পড়ল মামণি৷ এটা কি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি কখনও? আচ্ছা, ওখানে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল৷ আমাদের ওঁর বাড়িতে ডেকে খুব আদর যত্ন করেছিলেন৷ বলেছিলেন, তোমরা দিদি বলতে ওঁকে৷ কী যেন নামটা! দাঁড়াও, এতদিন পরে মনেও করতে পারছি না৷
সীমন্তিনী ভাবতে চেষ্টা করে৷ 
– অপাদি, না না পপাদি মনে হয়!
একটু অনিশ্চিতভাবে বলে সীমন্তিনী৷ অরুণলেখার মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷
– কে! পপাদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোমাদের বলনি তো?
একটু মৃদু বকুনি দেন অরুণলেখা৷ ত্রিশ বছর আগের একটা এনকাউন্টার এতদিন বাদে বলার সময় পেল মাম্মা! আর দিদানও এমন করে বলছে যেন পরশুই কারও সঙ্গে দেখা হওয়ার বিষয় বলতে ভুলে গেছে মাম্মা৷ গোটা জিনিসটাই সাররিয়াল৷ কান খাড়া করে শুনতে শুনতে এসব চিন্তাতরঙ্গ খেলা করে যায় রোহিণীর মাথায়৷ অরুণলেখা বলছেন,
– পপাদিকে চিনব না? বিয়ে হয়ে আসার পর ওর ছিল আমার সত্যিকারের বড় ননদের মতো৷ হাসি আর খুশি তো তার আগের থেকেই বন্ধু৷ পপাদি আমাকে নতুন বউ বলে অদ্ভুত একটা স্নেহের চোখে দেখত৷ 
– উনি তো বিয়ে করেননি, না? ভাইদের সংসারে থাকেন বলেছিলেন৷ 
– না না, বিয়ে হয়েছিল পপাদির৷ সে এক দুঃখের কাহিনি৷ অনেক দিনক্ষণ ঠিকুজি-কুষ্টি মিলিয়ে নাকি বারেন্দ্র পাল্টি ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন ওর বাবা৷ স্বামীর ঘরে গিয়ে দেখে লোকটির বহু বছর ধরে একজন অন্য মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে৷ একবস্ত্রে সেই যে ঘর ছেড়ে চলে এল আর ফিরে যায়নি৷ এসব আমি আমার শাশুড়ির কাছ থেকে শুনেছিলাম৷ মা বলতেন, ‘পপাটা বড় দুঃখী৷’ আমি বিয়ের পর থেকেই দেখেছি ও বাবা ভাইদের সংসারে রয়েছে৷ দাসীর মতো খাটত৷ কিন্তু ওর প্রাপ্য সম্মানটা পায়নি কোনওদিন৷ আমাকে একবার বলেছিল পপাদি দুঃখ করে… ‘বাবা মা উঠতে বসতে বলত– চলে এলি কেন জেদ করে? মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে পারতিস্‌৷ স্বামীর ঘরে লাথিঝাঁটা খাওয়াও অনেক বেশি সম্মানের৷ মেয়েদের এত জেদ ভালো নয়৷ একটু মানিয়ে নিতে হয়৷ তুই বল্‌ দেখি যেখানে দেখি ঘরটাই গোড়া থেকে ভাঙা, সেখানে মাটি কামড়ে থাকব কোন্‌ ভরসায়?’

রোহিণীর মনে হল প্রায় ষাট বছর আগের একটি মেয়েকে বর্ণনা করছেন অরুণলেখা৷ অথচ মনে হচ্ছে দিদান সদ্য ওই মহিলার সঙ্গে কথা বলেছে৷ ওই মহিলা দাদাইয়ের চেয়ে বড়৷ এখন তার মানে প্রায় নব্বই বছর বয়স হবে ওঁর৷ মাম্মার সঙ্গেও তো দেখা হয়েছে ত্রিশ বছর আগে৷ এখন কি বেঁচে আছেন উনি? এবার কলকাতায় গেলে একবার মহিলার খোঁজ করে দেখবে বলে ঠিক করল রোহিণী৷ বৃষ্টির তোড় একটু কমেছে৷ আবার সেকেন্ড দফায় চা খেতে ইচ্ছে করছে সীমন্তিনীর৷ এবার সীমন্তিনী উঠল চা করতে৷ রোহিণী পা দোলাতে দোলাতে গম্ভীরভাবে বলল,
– আমার জন্য একটু এনো তো মাম্মা৷ আর হ্যাঁ, তোমার স্টোরে কি কেক ফেক আছে বের কর৷
সীমন্তিনী ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে চা করতে গেল৷ ফিরেছে শুধু কেক নয়, আরও বেশ কয়েক রকম স্ন্যাক্স সাজিয়ে৷ কেউ খেতে চাইলে খুব আনন্দ হয় সীমন্তিনীর৷ এখন বাড়িতে সবার মাপা খাবার৷ অরুণলেখার তো বটেই৷ অরুণাভ চিরকালই স্বাস্থ্য সচেতন৷ রণো আর রোহিণী কবজি ডুবিয়ে ভাত মাছ মাংস খাওয়ায় বিশ্বাসী নয়৷ রণো মাঝে সম্পূর্ণ ভিগান ডায়েট ফলো করছিল৷ এখন সেই ফেজ়টা ওভার হয়েছে বলে সীমন্তিনী মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত৷ রোহিণীও পারলে নিরামিষ খেতেই প্রেফার করে৷ ওদের প্রজন্মকে খাইয়ে সুখ নেই– সীমন্তিনী তা বুঝে গেছে৷ 

চা আর স্ন্যাক্স সাজিয়ে সীমন্তিনী ঘরে এসে দেখল অরুণলেখা আর রোহিণীর গল্প হিমালয় ভ্রমণের দিকে ঘুরে গেছে৷ রোহিণী চোখ বড় বড় করে শুনছে৷ অরুণলেখা বলছেন।
– তারপর সুন্দরানন্দজি এক এক করে ওঁর সব সংগ্রহ আমাদের দেখালেন৷ বাবাইয়ের তখন ছ’বছর বয়েস৷ আমরা ইংল্যান্ডে যাবার আগে একবার টুক করে বেরিয়ে পড়েছিলাম৷

kedarnath
টুক করে তোমরা কেদার বদ্রি চলে গেলে!

– টুক করে তোমরা কেদার বদ্রি গঙ্গোত্রী এসব চলে গেলে! যেন শপিং করতে মলে যাচ্ছ!
হাসি আর থামতে চাইছে না রোহিণীর৷ সীমন্তিনী ধমক দিচ্ছে…
– অত হাসির কী আছে? তখন ওরকম যেত৷ লোকের তখন স্ট্যামিনাও অনেক বেশি ছিল৷ আমার ঠাকুর্দা বার্মা থেকে অন্য অনেকের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে কলকাতা ফিরেছিলেন৷ সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময়৷ জাপানিরা যখন বার্মা দখল করে নিল তারপর৷ 
অরুণলেখাও সায় দিলেন।
– এটা একদম ঠিক বলেছ মামণি৷ তখন লোকেরা অনেক কষ্ট করতে পারত৷ সেই আগের যুগে জলধর সেন কি দেবেন ঠাকুর ছেড়ে দাও, ওঁরা তো বিখ্যাত পরিব্রাজক। কিন্তু আমাদের বাঙালি ঘরের কত মহিলারাও মাইলের পর মাইল হাঁটতে কসুর করতেন না৷ তীর্থযাত্রা আর হিমালয়ের সৌন্দর্য দেখা– এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যেত৷
– ঢিলটা হল হাঁটা?
রোহিণী ফোড়ন কাটে৷ 
– হ্যাঁ? কী বলছ দিদিভাই?
অরুণলেখা একটু থতমত খান৷  রোহিণী গল্পের দিকে ফেরে আবার৷ 
– না, কিছু না৷
– সবটাতে ফিচলেমি
সীমন্তিনী ঝঙ্কার দেয়৷
– আচ্ছা মামণি, তুমি ওই যে তোমার চেনা মহিলার কথা বলতে যিনি হিমালয়ে ঘুরতেন, আর বই লিখতেন সেসব নিয়ে?
– কে, রানিদি?
অরুণলেখা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন
– রানিদির মতো মানুষ দেখা যায় না চট করে৷ ওঁদের একটা দল ছিল৷ ভাসুর, জা, সবাইকার সঙ্গে একসঙ্গে মিলে ঘুরতেন৷ হিমালয়ে, এদিকে কুম্ভে, কত কত যে হাঁটতেন৷ প্রতিদিন উনিশ কুড়ি মাইল করে হেঁটে রাতে চটিতে বসে ডায়েরিতে লিখে ফেলতেন সেদিনের ভ্রমণবৃত্তান্ত৷ এনার্জি পেতেন কোথায় তাই ভাবি৷ পূর্ণকুম্ভ, হিমাদ্রি, ওসব বিখ্যাত বই ওই ডায়েরির মেটিরিয়াল থেকেই লেখা৷ 
– চটি কী?  
– চটি হচ্ছে পান্থশালা৷ ইন্‌ বলতে পার৷ ভ্রমণে ক্লান্ত মানুষেরা রাতে ওই চটিতে যাহোক একটু খেয়ে মাথা গুঁজত৷ রাতটুকু কাটানো, তারপর আবার হাঁটা৷ 
– এখনও চটি আছে হিমালয়ে!
রোহিণীর জিজ্ঞাসার শেষ নেই৷ 
– এখন আছে কিনা বলতে পারব না৷ রানিদিরা যখন গেছেন পঞ্চাশের দশকে তখন হাঁটতেও হত বেশি৷ দুর্গম পাহাড়ি জায়গায় বাসের রাস্তা তৈরি হয়নি৷ থাকার জায়গাও ছিল না ওই চটিগুলো ছাড়া৷ 
– তোমরাও ওই চটিতে ছিলে?
– আমরা যখন গেছি তখন বিড়লাদের গেস্টহাউস তৈরি হয়ে গেছে৷ খুব একটা আরামদায়ক কিছু না, তবু চটির চেয়ে বেটার৷ পরিচ্ছন্ন মধ্যবিত্তের বেসিক থাকার জায়গা৷ 
– সেইবারই কি তোমার সঙ্গে তোমার দাদার দেখা হল?
সীমন্তিনীর মুখ ফসকে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেছে৷ রোহিণী সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিয়েছে৷ 
– দাদা মানে? সুমিত্র, যার নাম রবীন্দ্রনাথের দেওয়া? 
অরুণলেখা একটু চুপ করে থাকলেন৷ তারপর বললেন,
– হ্যাঁ, সেই দাদাই বটে৷ যার কথা তোমাকে ইন্টারভিউতে বলেছিলাম৷ 
তারপর সীমন্তিনীকে বললেন,
– নাঃ, দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আরও পরে৷ সে গল্প অন্য কোনওদিন বলব৷ বিলেত আসার আগে যেবার হিমালয়ে বেড়াতে গেলাম, তখন অবধি তো সব ঠিকই ছিল৷ বাবা মাও রয়েছেন তখন৷ পুরো ঘটনাটাই তো ঘটল অনেক পরে৷

কোন ঘটনার কথা বলছে দিদান! দাদার সঙ্গে দেখা হওয়ার ব্যাপারটাই বা কী? দিদানের দাদা কি তাহলে শান্তিনিকেতনে ছিলেন না? রোহিণীর মনে হঠাৎ অনেক প্রশ্ন গজগজ করছে৷ কে এই গল্পটা ঠিক বলতে পারবে? মাম্মাই বা কতটা জানে? দাদুর খাতাটায় কি দিদানের বাবা, মা, দাদার বিষয়ে কিছু লেখা আছে? আর একবার খুঁজে দেখা দরকার৷ আজ যেন হঠাৎ সুর কেটে গেছে৷ অরুণলেখা চোখ বুজে ফেলেছেন৷ দিদান কি ঘুমিয়ে পড়ল হঠাৎ? রোহিণী কী একটা বলতে গিয়েও কথা গিলে নিল৷ সীমন্তিনী ইশারায় ওকে বারণ করছে কথা বলতে৷ সত্যি আজকে অনেক কথা বলেছে দিদান৷ বাকি গল্পটা পরের জন্য থাক৷

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৭ সেপটেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Shiksha, Worthpoint
Aparajita Dasgupta

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

5 Responses

  1. বুধবারের প্রতীক্ষায় থাকি বাকি কদিন।এবারের ঘটনাগুলোর আংশিক যেন স্থান,কাল ভেদে অন্য ফ্রেমে আরো চেনা আমার কাছে তাই আরো বেশি ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *