২০১২ সালে তাঁর কথা প্রথম জানতে পেরেছিলাম আমাদের বিভাগীয় অধ্যাপক প্রিয়ব্রত ঘোষাল মহাশয়ের কাছ থেকে। বেলুড় বিদ্যামন্দিরে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ক্লাস চলছে। সাম্মানিক বাংলা বিষয়ের পাঠ‍ক্রমের পঞ্চম পত্রে, ‘রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা ছোটগল্প’ বিভাগে ছিল বুদ্ধদেব বসু লিখিত সেই বিখ্যাত ছোটগল্প ‘একটি জীবন’। ১৯৮৭ সালে এই গল্প অবলম্বনে রাজা মিত্র সমনামেই একটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন। ক্লাসে এই তথ্য জানানোর পরে স্যার বললেন আমাদের, রাজা মিত্রের কাহিনির চিত্রনাট্য পাওয়া যায়। আগ্রহী আমি, কোথায় পাবো জানতে চাওয়ায় স্যার নাম নিলেন, সন্দীপ দত্ত মহাশয়ের। বললেন, কলেজ স্ট্রিটের সন্নিহিত টেমার লেনে তাঁর বাড়িতে নীচের একতলায় রয়েছে ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র’ (প্রতিষ্ঠা ১৯৭৮), সেখানেই চিত্রনাট্য পাওয়া যাবে। সেই আমার সেখানে যাওয়া শুরু।

Sandip Dutta

তারপরের এই দশ-এগারো বছরে যাতায়াত ক্রমশ বেড়েছে। সন্দীপদা’র শারীরিক অবস্থা কোনোদিনই খুব ভালো ছিল না। ছিল তাঁর অমেয় এক প্রাণশক্তি। তাকে সম্বল করেই তিনি লাইব্রেরি চালাতেন আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সভাসমিতিতে, যত্রতত্র ছুটে যেতেন। ফলত, অসুস্থও হয়েছেন বিস্তর। নিয়মিত ওষুধ ঠিকঠাক না খাওয়ার জন্যে অসুখ বেড়েছে। বিগত কয়েক বছরে, হাসপাতালে ভর্তি হলেও, প্রতিবারেই একটি সময়ের পরে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। আবার, নিয়ম করে লাইব্রেরি খুলেছেন। খালি এবারেই আর পারলেন না! 

এবারে, অসুস্থ হয়ে প্রথমে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির ঠিক আগের দিন, লাইব্রেরিতে গেছি কাজের প্রয়োজনে। সে কাজ তো খোঁজার, সেসব কোনোদিনই থামার নয়। যাই হোক, এবারে আর তাঁকে দেখে স্থির থাকতে পারিনি। চোখে জল আসছিল রীতিমতো। হাতে বই ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। এত কাঁপছে হাত, পড়ে গেল বই। সঙ্গে, দোসর হয়ে জুড়েছিল পায়ের ব্যামো। অতিরিক্ত মধুমেহ রোগের কারণে পা গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। ফলত, পা কেটে বাদ দিতে হয়। সেদিনই আশঙ্কা করেছিলাম, এবারে আর হয়তো তাঁকে ফেরত পাব না। খুব বাড়াবাড়ি হয়েছে এবার। মাঝে, কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা গেছে। সেই সময়েও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ফলে, প্রতিবারের মতো লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে তাঁর সরব উপস্থিতি এবারে পাওয়া যায়নি। 

আরও পড়ুন: বাংলালাইভ আড্ডাস্কোপ – লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি: আলাপচারিতায় সন্দীপ দত্ত ও শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

তিনি অবশ্য, একদিক থেকে আমাকে নিঃস্ব করে গেলেন। গবেষণার শেষ পর্যায় চলছে আমার। আগামী কয়েকমাসের ব্যবধানেই প্রথমে প্রি-সাবমিশন আর তার পরেই অন্তিম গবেষণাপত্র জমা দিয়ে নামের আগে একটা গালভরা উপাধি (ড.) লেখার ছাড়পত্র পাওয়া যাবে। এখনই, গবেষণার কাজের জন্যে দরকারি কিছু উপাদান দেবার কথা ছিল তাঁর। আশ্বস্ত করেছিলেন আমায়, ফিরে এলেই সেসব নিয়ে বসবেন। সংগ্রহ থেকে দরকারি বিষয় খুঁজে রাখবেন। সেসবের আর সু্যোগ আপনি দিলেন কই? 

Sandip Dutta on his library

অসুস্থতার সময়ে, নিয়মিত খোঁজ নিয়েছি তাঁর শারীরিক অবস্থার, মাননীয় প্রসূণ মজুমদার মহাশয়ের কাছে, কেমন থাকছেন তিনি। প্রসূনদা কাজের মানুষ। লাইব্রেরির অনেক কাজ তিনি সুন্দর পালন করতেন। সন্দীপদা’র সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়াও চমৎকার ছিল।

যে কথা বলছিলাম, ২০১২ সাল থেকে যাতায়াত শুরুর সময়ে ছিলাম বিদ্যামন্দিরের ছাত্র আমি। পরের বছরের আগস্ট মাসে, ২০১৩ সালে, স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করে বাংলায় স্নাতকোত্তর পড়তে এলাম প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজস্ট্রিট বইপাড়া হাতের মুঠোয় এলো। সন্দীপদা’র লাইব্রেরিতে যাতায়াত বাড়ল। এই সময়ে মূলত, বিদ্যায়তনিক পাঠক্রমের অনেক বিষয়ের জন্য উত্তর তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর লাইব্রেরির প্রয়োজন পড়ত। সেসবের পুরোটাই নিজের সাধ্যমতো করেছেন তিনি আমার জন্য। 

স্নাতকোত্তর শেষ হবার বছরেই, ২০১৫ সালে গবেষণার সুযোগ পাই আমি। বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে এম.ফিল. এর কাজ শুরু হয়। লোকনাথ ভট্টাচার্যের উপন্যাসে আখ্যানতত্ত্বের বিষয়টি কেমন প্রকাশ পেয়েছে, সেই কাজই করেছিলাম। এই পর্যায়ে তাঁর প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। বলাই বাহুল্য, এম.ফিল-এর কাজ সম্পূর্ণ করতে, তাঁর লাইব্রেরির গুরুত্ব অসীম ছিল। পরে, ২০১৮ সালে বিশ্বভারতীতেই আমার পিএইচ.ডি. র কাজ শুরু হলে, তাঁর লাইব্রেরির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হল। আমি লাইব্রেরির ‘আজীবন সদস্য’ হলাম। এর আগে পর্যন্ত, আমি বার্ষিক সদস্য ছিলাম। ২০১২ সাল থেকে শুরু করে  প্রতি বছরেই, মেয়াদ শেষ হলে সদস্যপদের পুনর্নবীকরণ করেছি। এম.ফিল. এর বিষয়টিকে কিঞ্চিৎ বাড়িয়েই এবারে বেছে নিলাম লোকনাথ ভট্টাচার্যের সামগ্রিক সাহিত্যকর্মকে। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন, এই লাইব্রেরির লোগো অঙ্কণ করেছিলেন। তো, এই শুভাপ্রসন্নের মাধ্যমেই লোকনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে একসময়ে সন্দীপদা-র আলাপ হয়, তাঁর সঙ্গে দিল্লিতে এক সফরে গিয়ে। সেসব গত শতকের সত্তর দশকের গোড়ায়। 

লোকনাথবাবু তখন দিল্লিতে বসবাস করছেন। অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ মহাশয়ের আমন্ত্রণে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে, স্নাতকোত্তর বাংলা বিষয়ের ক্লাসও তখন নিচ্ছেন। স্ত্রী ফ্রাসঁ ভট্টাচার্য দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনার কাজ করছেন। এমন সময়ে, লোকনাথবাবুর দিল্লির বাসভবনে সন্দীপদা গিয়েছিলেন শুভাপ্রসন্নের সঙ্গেই। শুভাপ্রসন্ন হলেন লোকনাথ বাবুর পারিবারিক আত্মীয়। এই পর্বে, লোকনাথবাবুর অমায়িক আতিথেয়তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। লোকনাথবাবুর সাহিত্যকর্ম নিয়ে গবেষণার কাজ করছি জেনে, এইসব অমলিন স্মৃতি আমার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন তিনি। 

Little magazine library

গবেষণার জন্যে তো বটেই, আমার লেখালেখি এবং সারস্বত চর্চার নেপথ্যেও এই মানুষটির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় (তখন, পত্রিকা-সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন প্রধানত, বিশিষ্ট কবি-অধ্যাপক অংশুমান কর) আমি শামসের আনোয়ারের কবিতা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। আমার সৌভাগ্য, প্রবন্ধটি শঙ্খবাবুর নজরে পড়েছিল। ২০১৯ সালের শুরুতে রোটারি সদনে আয়োজিত ‘প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা’ অনুষ্ঠানে মুখোমুখি সাক্ষাতের সময়, তিনি লেখাটির প্রতি তাঁর ভালোলাগার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। সে যাই হোক, শামসেরের কবিতা নিয়ে লেখার আগে, তাঁর কবিতা বিষয়ে চর্চার উপকরণ সব সন্দীপদা-ই খুঁজে দিয়েছিলেন আমায়। সম্প্রতি, এবারের বইমেলায়, শামসের আনোয়ারকে নিয়ে দশমিক পত্রিকা একটি সংখ্যা (সম্পাদক: পৃথ্বি বসু) প্রকাশ করেছে। অথচ, আমি যখন তাঁর কবিতা নিয়ে লিখেছি, তখন এই সংখ্যা বাজারে ছিল না। যা ছিল, তা তিনিই আমার জন্যে উজাড় করে দিয়েছিলেন। এরকম উদাহরণ আরও প্রচুর আছে আমার জীবনে। 

 

আপাতত, আরেকটি নিদর্শনের কথা বলি। এবারের বইমেলায় জিজ্ঞাসা পত্রিকা (সম্পাদক : সন্দীপ পাল) শতবর্ষে উপনীত সাহিত্যিক-সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ কে নিয়ে একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সংখ্যার জন্যে, ‘ব্রজ দা’ শিরোনামে লেখা, গৌরবাবুর গল্পগুলির ওপরে একটি প্রবন্ধ লিখেছি। এটি লেখার জন্যে, যাবতীয় পড়াশোনার কাজ তাঁর লাইব্রেরিতেই করেছি। তিনিই প্রথম জানিয়েছিলেন আমায়, গৌরকিশোরকে নিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের ভালো সংখ্যা এখনও হয়নি। তাও, যা চর্চা হয়েছে তাঁকে নিয়ে, সবটাই উজাড় করেছিলেন আমার জন্য। তিনি দুটি সংখ্যা দিয়েছিলেন আমায়। ১. দিনক্ষণ পত্রিকার ‘গৌরকিশোর’ নামক সংখ্যা (সম্পাদক: গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রকাশ. ১৪০১ বঙ্গাব্দ) এবং ২. রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকেষু পত্রিকার ‘রূপদর্শীর রঙ্গ ব্যঙ্গ’ সংখ্যা (সম্পাদক: পবিত্র অধিকারী, প্রকাশ. ১৪০৮ বঙ্গাব্দ)। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সংস্থা এবারে শঙ্খবাবুকে নিয়ে একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সংখ্যাটির জন্যে, তাঁর গ্রন্থপঞ্জি এবং তাঁকে নিয়ে চর্চাপঞ্জির সূচি তৈরি করেছিলেন তিনি। এই কাজের জন্য মাঝেমাঝেই খোঁজ নিতেন আমার কাছে, শঙ্খবাবুকে নিয়ে আমার কোনও লেখা আছে কিনা! তবে তিনি, ‘শঙ্খ ঘোষ চর্চাপঞ্জি’তে আমার লেখাটির উল্লেখ করবেন। 

সন্দীপ দত্তের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের দুটি দিক আছে বলেই মনে করি। ১. লিটল ম্যাগাজিনের সর্বক্ষণের কর্মী এবং বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে এই বাংলার প্রায় সব প্রান্তে এবং অনেক সময়ে বহির্বঙ্গে এবং বাংলাদেশেও, প্রকাশিত যাবতীয় লিটল ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে, এই সব পত্রিকার সম্পাদকদের পাশে সবসময় থেকেছেন। তাঁর প্রয়াণে এমন সম্পাদকেরা কার্যত অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন। ২. এই কারণটি প্রত্যক্ষত বিদ্যায়তনিক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত বিভিন্ন গবেষকদের এম.ফিল., পিএইচ.ডি. ইত্যাদি গবেষণাকর্মের যোগ্য সহায়ক হয়ে উঠেছিলেন। আমি নিজে দেখেছি লাইব্রেরিতে, তিনি গবেষকদের প্রবণতা অনুযায়ী তাঁদের গবেষণার বিষয় নির্বাচনে সহায়তা করছেন। গবেষকদের যোগ্য সঙ্গত করছেন। তাঁরাও গবেষণার বিষয়ে সন্দীপদার পরামর্শ নিতে ছুটে আসতেন লাইব্রেরিতে। অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন তাঁরাও। এই তালিকায় পড়ি আমিও। নিজের চেষ্টায় যে জায়গায় তিনি লাইব্রেরিকে নিয়ে গেছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ এবং শিক্ষণীয়। লাইব্রেরিতে কাজ করা গবেষকদের সম্মাননা দেওয়া এবং পাশাপাশি গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সারস্বত চর্চার জন্যে সম্মাননা-জ্ঞাপন, তাঁর কর্মকৃতির অনন্য নজির। 

এতকিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে গিয়ে প্রভূত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি। এমন প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করাতে গেলে, সে তো করতেই হয়। প্রথমত, তাঁর ব‍্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে যতটা সময় দেওয়া প্রত‍্যাশিত ছিল, তা তিনি হয়তো দিতে পারেননি। নিজের সাধনায় ডুবে থেকে নির্দ্বিধায় সে ত‍্যাগে তিনি ব্রতী হয়েছেন। দ্বিতীয়ত,  নিজেকে বিদ্যালয় শিক্ষকতার মধ্যেই আটকে রেখেছেন। যেরকম তাঁর পড়াশোনা, স্মৃতি এবং মেধা, অনায়াসেই তিনি প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক হতে পারতেন। এমনকি, তিনি পিএইচ.ডি.-ও করেননি নিজের পছন্দমতো বিষয়ে গবেষণার সুযোগ না পাওয়ায়। সেই সময়েই, এই ১৯৮২-৮৩ নাগাদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর বাংলা বিভাগে লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনী করেছিলেন। অথচ, এই লিটল ম্যাগাজিন নিয়েই গবেষণার সুযোগ তিনি পাননি। সত্যি, তাঁর দুর্ভাগ্য! লাইব্রেরিকে অবশ্য তিনি দারুণ সাজিয়েছেন। লাইব্রেরিতে এখন গেলে দেখা যাবে, বিষয় অনুযায়ী, তাকে তাকে সব উপাদান রক্ষিত আছে। মোট ৮৫ টি বিষয়নির্ভর উপাদান এখন গ্রন্থাগারে রয়েছে। আশি হাজার থেকে এক লাখ মতো এমন পত্রিকা লাইব্রেরির সংগ্রহে রয়েছে। সত্যি, এক ঈর্ষণীয় সংগ্রহ!

বঙ্কিমের সম্পাদনায় প্রকাশিত বঙ্গদর্শন পত্রিকার প্রথম সংখ্যা (১৮৭২), প্রমথ চৌধুরির সম্পাদনায় প্রকাশিত সবুজ পত্র পত্রিকার প্রথম সংখ্যা (১৯১৪) সংগ্রহে আছে। এই তালিকাই প্রমাণ করে, কত দুষ্প্রাপ্য পত্রিকার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে সন্দীপদা’র এই লাইব্রেরি। এতসব ত্যাগ স্বীকারের পাশাপাশি, তাঁর লেখকসত্তাও ব্যাহত হয়েছে। এসবের মধ্যেও অবশ্য কবিতা লিখেছেন, প্রবন্ধের বই উপহার দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য সম্পাদনা কর্মের সঙ্গেও যুক্ত থেকেছেন। লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ক তাঁর বইগুলি ছাড়া এই ধরনের পত্রিকার ইতিবৃত্ত নির্মাণ অসম্ভব হবে – প্রসঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন (১৯৮৭), লিটল ম্যাগাজিন ভাবনায় (২০০৯), বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিবৃত্ত (প্রথম খণ্ড, ২০১২, দ্বিতীয় খণ্ড, ২০১৬ এবং তৃতীয় খণ্ড-যন্ত্রস্থ), লিটল ম্যাগাজিন স্বতন্ত্র অভিযান (২০১৯)। পাশাপাশি, বিভূতিভূষণ, তারাশংকর প্রমুখ লেখকের কালপঞ্জি নির্মাণ করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়: জীবন ও সাহিত্য নামক সাহিত্যিক সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ তাঁর সম্পাদনা শৈলির এক অনন্য নজির। ‘নষ্ট লজিক’ নামক অসাধারণ এক স্মৃতিকথা লিখেছেন।

এমন অনবদ্য মানুষটি কার্যত প্রচারবিমুখ ছিলেন। কোনও সংস্থা ব্যক্তিগত স্তরে সংবর্ধনা দিতে এলে, লাইব্রেরির পক্ষ থেকে তিনি এই সম্মান গ্রহণ করেছেন। ‘অথ পথ’ পত্রিকার (সম্পাদক: হরিসাধন চন্দ্র) সাম্প্রতিক সংখ্যাটি তাঁর এবং লাইব্রেরির কর্মকাণ্ড নিয়েই। এমন কৃতবিদ্য মানুষের সঙ্গে অনুষ্টুপ পত্রিকার যোগ অনস্বীকার্য। সামান্য যে-কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের প্রতিটি সংখ্যা লাইব্রেরির গবেষকদের কাজের জন্য বিনামূল্যে তিনি পেতেন, ‘অনুষ্টুপ’ তাদের মধ্যে অন্যতম। এই পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে তিনি লিখেওছেন। পরে, সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। সেরকম একটি লেখার কথা হোক এবার, ‘রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপনের রবীন্দ্রনাথ’ (প্রথমে, পত্রিকার ৪৪/৪ সংখ্যায় প্রকাশিত। পরে, সমীর সেনগুপ্ত এবং অনিল আচার্যের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত অনুষ্টুপের রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জালিক মাধ্যম ‘বাংলালাইভ’ সংস্থার সঙ্গে সন্দীপদা এবং তাঁর লাইব্রেরির যোগাযোগ অনস্বীকার্য। লাইব্রেরির প্রতিটি অনুষ্ঠানের আন্তর্জালিক সম্প্রচারের দায়িত্ব ছিল এই সংস্থার। সংস্থার ফেসবুক পেজে এবং ইউটিউব চ্যানেলে সব সম্প্রচারিত হয়েছে। সংস্থার তরফে দুটি পর্বে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিশিষ্ট গল্পকার শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য। বাংলালাইভের ইউটিউব চ্যানেলে খুঁজলেই পাওয়া যাবে। এই আলাপনে লাইব্রেরি এবং সন্দীপদার মহান কর্মযজ্ঞের সম্পর্কে অনুধ্যানী পাঠক অনেকটাই অবহিত হতে পারবেন। 

তিনি যে আর আমাদের মধ্যে নেই, ভাবতেই চাইছে না মন। যাই হোক, তিনি আমাদের জন্য, সারস্বত চর্চার জন্যে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে যেভাবে সংস্কৃতির সেবা করলেন, তাঁর শুভানুধ্যায়ী হিসেবে কিছু করার দায় আমাদের ওপরেও বর্তায়, তবেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সম্পূর্ণ হবে। ১. টেমার লেনে তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তাটির নাম পালটে এবার হোক, ‘সন্দীপ দত্ত সরণি’। ২. তাঁর সাধের তিলোত্তমায় এই গ্রন্থাগার যেমন সুষ্ঠভাবে তাঁর পরিচালনায় চলেছে, তেমনিই চলুক। কখনই যেন বন্ধ হয়ে না যায়। এমন দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ যাতে বেহাত না হয়ে যায়, তাও সন্দীপদা’র পরিবার সংশ্লিষ্ট সকলের এবং গ্রন্থাগারের সকল শুভানুধ্যায়ীদের দেখা উচিত। 

 

 

 

ছবি সৌজন্য: লেখক, সন্দীপ দত্তের Facebook প্রোফাইল

Bodhisattva Bhattacharyya

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য লেখক, গবেষক, অনুবাদক। পারিবারিক সূত্রে উনিশ শতকের প্রাতঃস্মরণীয় এক মনীষা প্রথিতযশা দার্শনিক অধ্যাপক ড. কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের প্রপৌত্র। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির, বেলুড় মঠ এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যথাক্রমে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে ২০১৭ সালে লোকনাথ ভট্টাচার্যের উপন্যাসে আখ্যানতত্ত্বের প্রয়োগ বিষয়ে গবেষণা করে এম.ফিল. ডিগ্রি পেয়েছেন। অধুনা সেখানেই তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম বিষয়ে পিএইচ.ডি. গবেষণারত। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয়, নরেন্দ্রপুর-এর বাংলা বিভাগের সাম্মানিক অতিথি অধ্যাপক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্র-পত্রিকায় এবং দৈনিক সংবাদপত্রে তাঁর বিদ্যায়তনিক প্রবন্ধ এবং ফিচার প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি। ‘অনুষ্টুপ’, ‘আরেক রকম’, ‘উদ্বোধন’, ‘এবং মুশায়েরা’, ‘আজকের গাঙচিল’, ‘কলেজ স্ট্রীট’, ‘কবিতীর্থ’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘পরম্পরা’, ‘তবু একলব্য’, ‘বহুরূপী’, ‘সন্ধান’, ‘সৃষ্টির একুশ শতক’ প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ সমালোচনায় তিনি নিযুক্ত। ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার গ্রীষ্ম, ২০১৯ (৫৩/৩) সংখ্যায় বিশ্রুত দার্শনিক ড. কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পর্কে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে। Correction of error as a logical process শীর্ষক কৃষ্ণচন্দ্রের একটি ইংরেজি প্রবন্ধের অনুবাদ এবং তাঁর চিন্তায় হিন্দুত্বের পরিগ্রহণ বিষয়ক একটি বাংলা প্রবন্ধ, ক্রোড়পত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সংবাদ প্রতিদিন নামক দৈনিক সংবাদপত্রের রোববার বিভাগে বিলীয়মান স্মার্ত মুহূর্তরা শীর্ষক একটি ফিচার প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা পরিষৎ সংস্থা (International Society of Bengal Studies, ISBS) কর্তৃক সম্প্রতি সম্মানিত হয়েছেন ‘বঙ্গবিদ্যা তরুণ গবেষক ২০২১’ সম্মানে। এযাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ চারটি, ১. ‘দিলীপকুমার রায় সমীপে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ (দূরদর্শনে আয়োজিত সাক্ষাৎকারের অনুলিখন)’, ২. ‘গুরু-স্বামী ব্রহ্মানন্দ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ রচিত ইংরেজি প্রবন্ধ ‘Guru’ এর অনুবাদ)’, ৩. ‘শ্রীরামকৃষ্ণানুভব-স্বামী গম্ভীরানন্দ (ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে প্রদত্ত স্বামী গম্ভীরানন্দজীর বক্তৃতার অনুলিখন)’ এবং ৪. ‘ভ্রম-সংশোধন: একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়া-কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য (দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য রচিত ‘Correction of an error as a logical process’ নামক ইংরেজি প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ এবং অনুলিখন)’। আগ্রহের বিষয়, নাটক-থিয়েটার, উনিশ শতক এবং লোকসাহিত্য। অনুবাদ চর্চায় পারঙ্গম। নেশা, পুরনো-নতুন যাবতীয় গ্রন্থ সংগ্রহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *