লেখক-গবেষক-চিন্তক-অধ্যাপক শ্রী সুধীর চক্রবর্তী আজীবন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা ছিলেন। নিজের বাড়ির চেয়েও বেশি আপন ছিল তাঁর এই শহর। তার প্রতিটি কোণা হাতের তালুর মতো চিনতেন সুধীরবাবু। তাঁর কলেজজীবনে গ্রন্থাগার কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সে কথাই লিখে গিয়েছেন এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে। ওঁর ‘মেঘে মেঘে তারায় তারায়’ বইটিতে গ্রন্থিত হয়েছে এ লেখাটি। সুধীরবাবুর সহধর্মিণী শ্রীমতী নিবেদিতা চক্রবর্তীর প্রশ্রয়ে এবং ওঁর পুত্রতুল্য স্নেহধন্য কবি শ্রী অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের পরিশ্রমে, বানান অপরিবর্তিত রেখে, লেখাটি বাংলালাইভে পুনঃপ্রকাশিত হল। ওঁদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।  

১৯৫৩-৫৪ সালে যখন কৃষ্ণনগরে থাকি এবং কলেজে পড়ি স্নাতকস্তরে, তখন খুব কবিতা পড়ার নেশা হয়েছিল। কবিতা মানে পাঠ্যপুস্তকের সুবোধ্য ছন্দোময় ব্যাপার নয়। তখন পাবলিক যে ধরনের কবিতাকে দুর্বোধ্য মনে করত এবং ব্যঙ্গ করে বলত আধুনিক কবিতা, আমার ঝোঁক ছিল সেইদিকে। কলেজ লাইব্রেরিতে ইংরাজি আধুনিক কবিতার বেশ কতক নামী কবির বই পেতাম— যেমন এলিয়ট, স্পেন্ডার, অডেন, হপকিনস্ আর সেসিল ডে লুইস। অবশ্য সমকালীন বাংলা আধুনিক কবি আর তাঁদের কাব্য সম্পর্কে দিশা পাওয়া যেত বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায়। বেরত তিনমাস অন্তর। সযত্নে সংকলিত বহু ধরনের চমৎকার কবিতা মুদ্রিত হত অ্যান্টিক কাগজে— একটাও ছাপার ভুল থাকত না। কবিতা’-র পৃষ্ঠায় সমালোচনা বা বিজ্ঞাপন পড়ে কোন্ কোন্ কবির কী কী কাব্য সংগ্রহ করবার দরকার, তার লিসটি করে, দু’মাস অন্তর, কিছু টাকা জমিয়ে, যেতাম কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায়। এখন ভাবতে অবাক লাগবে কিন্তু তখন সেই পঞ্চাশের দশকে এক একটা কবিতার বই কিনতে পাওয়া যেত মাত্র দু’টাকা বা তিনটাকায়।

শেয়ালদা স্টেশনে নেমে সামান্য একটু হাঁটলেই বইপাড়া। পঁচিশ-তিরিশ টাকা খরচ করে এক সাইডব্যাগ ভর্তি করে হাওয়ায় উড়তে উড়তে সন্ধেবেলায় ফেরার ট্রেন ধরতাম। সে কী উত্তেজনা! ব্যাগে রয়েছে জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘সমর সেনের কবিতা’, অমিয় চক্রবর্তীর ‘পারাপার’, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-র ‘সংবর্ত’, নরেশ গুহ-র ‘দুরন্ত দুপুর’, অরুণকুমার সরকারের ‘দূরের আকাশ’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’, বুদ্ধদেব বসুর ‘শীতের প্রার্থনা’ বসন্তের উত্তর— ভাবা যায়? ভাবতে এখনও অবশ্য অলৌকিক বলে মনে হবে। তবে সত্যি যে, তিরিশ টাকার কাব্য কেনার পরে শতকরা কুড়ি ভাগ কমিশন লাভের বিশেষ দাক্ষিণ্যে জুটে যেত আরও দুটি বই। এবারে ফেরবার পথে, আড়াই ঘণ্টার ট্রেন ভ্রমণে সব ক’টি নতুন বই নাড়াচাড়া, গন্ধশোঁকা, কবিতা পাঠের মগ্নতায় হঠাৎ খেয়াল হত, আরে! কৃষ্ণনগর সিটি স্টেশনে ট্রেন ঢুকে গেছে! মনে পড়ত, যে সব বই কিনেছি সেগুলি সম্পর্কে চমৎকার বিশ্লেষণবহুল আলোচনা আছে বুদ্ধদেবের (ততদিনে জেনে গেছি, তাঁর সাঁটের নাম, বু.ব) ‘কবিতা’পত্রিকার পাতায়। 

Buddhadev Basu
বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকা তখন শুধু লাইব্রেরিতেই মিলত

সারা শহরের মধ্যে সেই পত্রিকার একটি মাত্র গ্রাহক কপি আসত দেশবন্ধু লাইব্রেরিতে। সেই গ্রন্থাগারের অবস্থান শহর থেকে মাইল দেড়েক হাঁটাপথের দূরত্বে উত্তর দিকে, ঘূর্ণিতে। ঘূর্ণি তো তখনই ভুবনবিখ্যাত মাটির পুতুলের জন্যে। দেশবন্ধু লাইব্রেরির একটু আগে কুমোরদের পট্টি। দেখা যেত এক এক বারান্দায় বসে একমনে কারিগররা গড়ে চলেছেন রিয়ালিস্টিক শৈলীর আশ্চর্য পুতুল। সেই এলাকা পার হয়ে যাচ্ছি হেঁটে, শান্ত স্তব্ধ শরতের শেষ দুপুরে, একা একা। মনের মধ্যে ছটফটানি। কখন রিডিং রুমে বসে খুলব ‘কবিতা’ পত্রিকার পাতাগ্রন্থাগারের সদস্য তো নই। ভরসা হলেন সেই ঘরোয়া নির্জন পাঠাগারের সদাহাস্য গ্রন্থাগারিক জেহাদন নবী মোল্লা। পঞ্চাশ পেরনো মানুষটির চোখে চশমা পরনে ধুতি আর গেঞ্জি, পায়ে চটি। বলবেন, ‘এসো ভায়া। কবিতাপাগল’ তখন তো আমি নিতান্ত এক কলেজপড়ুয়া ছোকরা। তবে জেহাদনদা (সবাই তাঁকে ওই নামে ডাকত) বুঝেছিলেন এই ছেলেটা বিকেলে খেলার মাঠে না গিয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না মেরে, পায়ে হেঁটে, শহর থেকে বেশ দূরে আধা গ্রাম্য এই ঘূর্ণি লাইব্রেরিতে প্রায়ই আসে কেন? না, ‘কবিতা’ পত্রিকা পড়তে! কী আশ্চর্য, ‘কবিতা’ যে কেউই পড়ে না। একদিন কাছে এসে নিবিষ্ট পাঠরত আমাকে বললেন, 

‘বুদ্ধদেব বসুকে বুঝি খুব পছন্দ? জানো এখানে তাঁর লেখা দুটো বই আছে। ‘বন্দীর বন্দনা’ আর ‘কঙ্কাবতী’তুমি অবশ্য আমাদের মেম্বার নও। তাতে কী? আমার নামে ইস্যু করে দেব। নিয়ে গিয়ে বাড়িতে ধীরে সুস্থে পড়োপড়া হলে ফেরত দিয়ে দেবে। দাদা বলে ডাকো— মন ভরে যায়। লেখাপড়া করে একদিন দেখো তুমিও লেখক হবে। জেহাদন নবী লেখক আর পাঠক চেনে। কতবছর ধরে বই ঘাঁটছি।’

ক্রমে ক্রমে বুঝলাম বইপত্তরই জেহাদনদার প্রাণ। বিয়ে-থা করেননি। লাইব্রেরির সামনেই বাড়ি। একাই থাকেন। সারাদিন যদিও বইয়ের ঝাড়ামোছা সাজানো গোছানোতেই কেটে যায়। না, তখনও দেশে লাইব্রেরি সায়েন্সের কিতাবি পঠনপাঠন চালু হয়নি। তিনি পাশ করা ডিগ্রি বা ডিপ্লোমাধারীও ছিলেন না। তবে ছবির মতো জানতেন কোন্ আলমারিতে কোন্ বই আছে। তাঁর দায়িত্ব ছিল অবৈতনিক। বইপাগল মানুষ। ভোগবিলাস নেই, নেশা নেই, সারাবছর দেখতাম ওই ধুতি আর গেঞ্জি, পায়ে চটি। মুখে হাসি। 

‘এসো ভায়া। তোমার ‘কবিতা’-র নতুন সংখ্যা এসেছে। বোসো, বসে পড়োআর একটা কথা শুনবে এই মুখ্যু দাদার? শুধু পড়লে হবে না, লিখতে হবে। একদিন দেখা যাবে দেশবন্ধু লাইব্রেরির আলমারি আর ক্যাটালগে তোমার বই থাকবে। বলা রইল, পরে মিলিয়ে নিও।’

এরপরে আমার জীবন আর দেশবন্ধু লাইব্রেরি যেন আমূল বদলে গেল। বিএ পাশ করে আমি গেলাম কলকাতা, এমএ পড়তে। পাশ করে কলকাতারই এক কলেজে হলাম অধ্যাপক। ‘কবিতা’ পত্রিকা তখন নিজেই কিনি। ইত্যবসরে প্রাইভেট সেই আঞ্চলিক গ্রন্থাগার সরকারি বদান্যতায় হয়ে গেল জেলা গ্রন্থাগার। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার টাকায় নতুন ক’টা বিল্ডিং হল। পাশ করা লাইব্রেরিয়ান এলেন আইন মেনে। সরকারি নিয়োগ এসে গেলেন বেতনভুক সহকারীরা। আড়ে দিঘে গ্রন্থাগার প্রসারতা পেল। কমিটি হল। স্বাভাবিক যে, এই নয়া ব্যবস্থায় আর প্রশাসনে জেহাদন নবী মোল্লা হয়ে গেলেন উদ্বৃত্ত ও অপ্রয়োজনীয়। বেশ ক’বছর পরে, খবর পেলাম কে বা কারা জেহাদনদাকে মার্ডার করে গেছে। একা সেই ঘরে পাওয়া গেল তাঁর লাশ। শরিকি বিবাদ সম্ভবত। গ্রামের দিকে তাঁর নামে কিছু জমিজমা ছিল। সেটাই কাল হল। তবে জেহাদনদার ভবিষ্যৎবাণী ব্যর্থ হয়নি। সেই গ্রন্থাগারে আমার লেখা বই সাজানো রয়েছে। রয়ে গেছে অনুজের প্রতি অগ্রজের অটল বিশ্বাসের অভিজ্ঞান।

 

*ছবি সৌজন্য: Facebook, Indiaart

banglalive logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *