ঝাড়খণ্ডের পানি-ভাত, আসামের পইতা-ভাত, ওড়িশার পাখালা-ভাত… ইত্যাদি ইত্যাদি… অতি সাধারণ নিম্নবিত্ত খাবারদাবার। কিন্তু এবার বিশ্বের দরবারে স্থান পেল এদের স্বজাতি, বাংলার “পান্তা ভাত”! অস্ট্রেলিয়ার মাস্টারশেফ সিজ়ন ১৩-র ফিনালেতে কিশওয়ার চৌধুরী বাংলার পান্তাভাতকে সাজিয়ে গুছিয়ে এনে হাজির করলেন বিশ্বের দরবারে। আর প্রথম চোটেই কেল্লাফতে! মুঠোয় মাস্টারশেফের খেতাব!

মাস্টারশেফ-এর খাবার মানেই অচেনা, অজানা, দারুণ সাজানো খাবার, যার অর্ধেক উপকরণই আমরা জীবনে খুঁজে পাব না, আর যার নামও খুব কম শোনা, এইসব চিরকেলে ধারণা ভেঙে চুরমার করে ফেলতে পারল বাঙালির সাহস! মানে, পান্তা ভাত! ভাবা যায়! যেটা খাওয়াতে ছোটবেলায় কত কসরত করতেন মা ঠাকুমা দিদিমারা, কখনও বড়ি ভেজে, কখনও নানানভাবে আলুসেদ্ধ মাখা দিয়ে, কখনও বা কাঁচা পোস্ত দিয়ে, আচার দিয়ে, সর্ষের তেল কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা আর কী কী না দিয়ে!

Paan Flavoured Icecream
কিশওয়ারের বানানো পান ফ্লেবারের আইসক্রিম

আর এখন যেটা খাবার জন্যে গরম পড়লেই মন ব্যাকুল হয়ে যায়! এক থালা পান্তা ভাত, আলুসেদ্ধ মাখা, আর খুব ভাগ্য ভাল হলে ইলিশ ভাজা… খাবার তো নয়! প্রাণের আরাম আর মনের আনন্দ! পুরনো অ্যালবামের পাতা ওল্টানোর মতো… ভাতের সঙ্গে স্মৃতি রোমন্থন।

খাবারের সঙ্গে যে গল্প ইতিহাস আর ভালবাসা জড়িয়ে, সেইটেই সবার সামনে তুলে ধরলেন কিশওয়ার চৌধুরী। কে তিনি? আদতে মেলবোর্নের বাসিন্দা অভিবাসী ভারতীয়। বয়স মোটে ৩৮। ছাপাখানার ব্যবসা ওঁর।  দুই সন্তানের মা। অবসরে কবিতা লিখতে ভালবাসেন। কর্মসূত্রে বছর ছয়েক তাঁকে থাকতে হয়েছিল বাংলাদেশে। বাঙালি রান্নার প্রেমে পড়া তখন থেকেই। নিজের বাংলাদেশী শেকড়কে অস্বীকার করা তো দূরের কথা, বরাবরই তাঁকে খুব বেশি আপন মনে করেন কিশওয়ার। তাই মাস্টারশেফের মঞ্চে প্রথম থেকেই তাঁর সঙ্গী ছিল বাঙালি রান্না। চোখে ছিল বিশ্বের দরবারে নিজের খাবার তুলে ধরার স্বপ্ন!

Kolkata Croissant
কলকাতার ক্রঁসা – কিশওয়ারের হাতে তৈরি

ফিনালের অনেক আগে থেকেই মন কাড়েন কিশওয়ার। দুর্দান্ত প্রেজেন্টেশনে মাছের ঝোল, ফুচকা, খিচুড়ি, বেগুন ভর্তা, হরিয়ালি চিকেন, কোরমা, পোলাও, রেজালা, পরোটা বা কলকাতা ক্রসাঁ… এক এক পর্বে এক এক রান্নায় মাতিয়ে দিয়েছেন বিচারকদের। সবেতেই কিছু না কিছু বাংলার ছোঁয়া, দেশজ স্পর্শ… কিশওয়ারের আইস্ক্রিম পান ছিল, বিচারকদের কথায়, “A love letter to Bangladesh!” কিম্বা খাসির রেজালাতে, “what’s in this bowl is magic!” তবু সবার ওপরে উঠে গেল গ্র্যান্ড ফিনালের ডিশ কিশওয়ারের দেওয়া নাম “স্মোকড রাইস” বা বাঙালির পান্তাভাত!

Rezala and Paratha
কিশওয়ারের বানানো রেজালা আর পরোটা

জাজ মেলিসা লিয়ং তো সেই খাবারের থালা হাতে গুণগান করেই চললেন, সেই শক্তিপ্রদ খাবার, তার ইতিহাস, তার ফ্লেভার, স্বাদ আর রঙের কনট্রাস্ট-এর কথা বলে। এরপর শুনলাম তাঁর গলায়, “to have the heart and soul of the dish be all about something…” মনে হল মা-ঠাকুমাদের আজীবনের হেঁশেল ঠেলা আর অক্লান্ত পরিশ্রম আজ সার্থক হল! সারাদিন পরিশ্রমের পর বেঁচে যাওয়া ভাতে জল ঢেলে যে মন প্রাণ জুড়ানো রূপ দিয়েছিল এরকমই কোনও বাঙালি খাদ্যরসিক সত্তা, তাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরলেন কিশওয়ার! পান্তাভাত মোমেন্ট! আমাদের মতো বহু দক্ষিণ এশিয়াবাসীই সেদিন নিশ্চই খুশিতে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন। 

আসলে বহু বছর ধরে খাবারের সাম্রাজ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অর্থনীতিতে চাঙ্গা শক্তিশালী দেশের খাবারদাবার! বিশ্বের রেস্তোরাঁয় ফরাসি, ইটালিয়ান, জাপানি খাবারের যা চাহিদা মেক্সিকান, থাই বা ভারতীয় খাবারের তার চেয়ে কিছু কমই। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এক বাঙালি মহিলা বিশ্বের কাছে বাঙালি খাবার কে তুলে আনলেন নতুন রূপে রঙে।

Smoked Rice and Sardin Fry
কিশওয়ারের ফিনালের মেনু – স্মোকড রাইস বা পান্তাভাত, সার্ডিন মাছ ভাজা আর আলুভাতে মাখা

এবার দেখে নেওয়া যাক ফিনালে তে কিশওয়ার এর মেনু:

পান্তা ভাত
সার্ডিন মাছ, সয় সসের কোটিং দিয়ে মুচমুচে ভাজা
বিচারকদের ভাষায় আলু সেদ্ধর বালিশ (আলু ভর্তা)
আর লেবু ধনেপাতা দিয়ে মাখা পেঁয়াজের সালসা
একটা ছোট্ট বাটিতে পান্তার জল!

তিন প্রতিযোগী পিট ক্যাম্পবেল, জাস্টিন নারায়ণ আর কিশওয়ার চৌধুরীর মধ্যে হৃদয় চাইছিল কিশওয়ার কেই! তবু, তৃতীয় হয়েও বাঙালির মনে সেরার শিরোপা পেলেন কিশওয়ার! শাবাশ বাঙালির সাহস আর বুকের পাটা! বাঙালি খাবার নিয়ে, ঐতিহ্য নিয়ে, আর সবার ভালবাসা নিয়ে আরও অনেক পথ এগিয়ে যাবার অফুরন্ত শুভেচ্ছা রইল কিশওয়ারের জন্য!
“Thank you for letting all of us witness your Everest!”

 

*সব ছবি সৌজন্য: Internet

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *