আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬]

বহতা নদীর মতো তিরতিরিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের কথন। নদী থেকে যেমন শাখা নদী, আমাদের এই ঐতিহাসিক সাক্ষ্যও আঁকড়ে ধরেছে অনেক শাখা গল্পকে। শাখা নদী আবার তার প্রশাখা বিস্তার করেছে, আমরা পেয়েছি ছত্রপতি সাহুকে, বাবাসাহেব আম্বেদকরকে। 

ছত্রপতি সাহু এখন মৃত। এক শাখানদীর বুকে পলি। আমরা এখন মূল নদীতে ফিরলাম। জ্যোতিবা সাবিত্রীর কাহিনির সেই মূলস্রোতে আমরা যখন শেষ নৌকা বেয়েছি, তখন জ্যোতিবা প্রকাশ করেছেন তাঁর সেই বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুলামগিরি’, যেখানে প্রথম ‘দলিত’ শব্দটি আত্মপ্রকাশ করবে। শুধু বই প্রকাশ করেই থেমে থাকেন না জ্যোতিবা, তারপর সেই বইয়ের উপর ভিত্তি করে পথনাটিকা বা ‘তামাশা’ তৈরি করে গ্রামে গ্রামে যান তিনি। জ্যোতিবার মৃত্যুর পর এই শক্তিশালী গণমাধ্যম নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। তারপর প্রাণ ফিরে পায় আবার ছত্রপতির হাত ধরে। আর সেই সূত্রেই আমরাও খুঁজে পাই ছত্রপতিকে।

ছত্রপতিকে মনে আছে আমাদের। আমরা দেখেছি, ছত্রপতি দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর তৈরি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধের ঠিক উপরে। কখনও দেবদাসীদের রক্ষা করতে হাতে তুলে নিচ্ছেন অস্ত্র, কখনও বিধবাবিবাহের সমর্থনে শুধু আইন প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, আয়োজন করছেন অসবর্ণ গণবিবাহ, বিধবাবিবাহের। জ্যোতিবা সাবিত্রীর নির্দিষ্ট উত্তরসূরি না হয়েও, বহতা রেখেছেন সেই অসামান্য ধারাকে। 

আর এই পথিকৃতেরা? তাঁদের আমরা যখন প্রথম দেখেছি, তখন তাঁদের বয়স যথাক্রমে তেরো ও এগারো। ফুলে পরিবারের বউ হয়ে আসা সাবিত্রীকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়াশোনা শেখাচ্ছেন জ্যোতিবা। মাহার ও মাংদের পড়ানোর ব্যবস্থা করছেন উনিশ বছরের জ্যোতিবা, সাবিত্রীও পাশে আছেন। পরিবারের লোক জানতে পারায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে জ্যোতিবাদের। এরপর তাঁদের জীবনে আসবেন ওসমান শেখ, তাঁর বোন ফতিমা শেখ এবং জ্যোতিবা-সাবিত্রীর সময় বদলে দেওয়া সংগ্রামের বিশ্বস্ত সাথী হয়ে দাঁড়াবেন। দলিত মেয়েদের পড়াবেন সাবিত্রী, সংখ্যালঘু মেয়েদের ফতিমা শেখ। 

Fatima and Savitri
সাবিত্রীর মতো তাঁর বান্ধবী ফতিমাও প্রশিক্ষণ নিলেন শিক্ষিকা হবার

আমরা দূর থেকে দেখেছি সাবিত্রী বাঈ, ফতিমা শেখ দু’জনেই কত অনায়াসে অতিরিক্ত পোশাক, শাড়ি নিয়ে বের হচ্ছেন বাড়ি থেকে, সমাজের ছুঁড়ে দেওয়া কালি আবর্জনায় নষ্ট হচ্ছে তাদের পরিধান, আবার নতুন করে প্রস্তুত হয়ে নিরন্তর করে চলেছেন তাদের কাজ। নদীর এরকম এক বাঁকেই আমরা ছেড়ে এসেছিলাম জ্যোতিবা, সাবিত্রীকে। জ্যোতিবা তখন গুলামগিরির প্রচার করছিলেন, সাবিত্রীও সঙ্গে ছিলেন গ্রামে গ্রামে তামাশা অভিনয়ে। এই সময় নাগাদই সাবিত্রী প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম মহিলা সমিতি। দুঃখের বিষয়, সাবিত্রীবাঈ ফুলের দ্বারা প্রথম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়, এই তথ্য ছাড়া আর কোনও কিছুই জানা যায় না। হয়ত এই শাখানদীর উপরে জমা পলি, সরাবার চেষ্টা করবে করবে কেউ, যেমন করেছেন সাংবাদিক গবেষক তেজস্‌ হারাদ। 

জ্যোতিবা-সাবিত্রীর জীবন বিষয়ে গবেষনা করছিলেন তেজস্‌, রয়টার্সের ফেলো হয়ে। হঠাৎই লক্ষ্য করেন, নদীরা বাঁক নিতে নিতে অদৃশ্য হয়ে গেছে এক অববাহিকায়। সেই অববাহিকার নাম যশবন্তরাও। সাবিত্রী-জ্যোতিবার দত্তকপুত্র। ঠিক যে সময়, নদীর যে বাঁকে আমরা ছেড়ে এসেছিলাম জ্যোতিবা-সাবিত্রীকে, তার কিছুদিন পরেই তাঁদের জীবনে আসেন লক্ষ্মীবাঈ, আর তারপরে যশবন্তরাও। যে বিধবা আশ্রম, আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন জ্যোতিবারা, সেখানেই আশ্রয় নিতে আসেন লক্ষ্মীবাঈ, আরও অনেক কুলীন বিধবার মতোই। আরও অনেকের মতোই অন্তঃসত্ত্বা ও অসুস্থ অবস্থায়।

সেখানেই একসময় মারা যান লক্ষ্মীবাঈ আর সংলগ্ন অনাথ আশ্রমে বড় হতে থাকে যশবন্ত। আর কীভাবে যেন জড়িয়ে পড়তে থাকে জ্যোতিবা সাবিত্রীর জীবনে। গ্রামে গ্রামে তামাশা অভিনয় করতে যান জ্যোতিবা-সাবিত্রী, যঙ্গে যান যশবন্ত। অনাথ আশ্রম, বিধবা আশ্রমের সব কাজ সেরে বাড়ি ফেরেন সাবিত্রী, যশবন্ত সঙ্গ ছাড়তে চায় না। জ্যোতিবার বয়স তখন তিরিশ, সাবিত্রীর আঠাশ। তাঁদের জীবনে এলেন যশবন্ত। দত্তক নিলেন তাঁরা।  ফুলে দম্পতির দত্তকপুত্র হলেন জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ যশবন্তরাও। 

আর এক সম্ভাব্য ইতিহাস। আরও এক শাখানদীর জন্ম। আবারও এক সমাজের নোংরা পলি ঠেলে উজান বওয়ার চেষ্টা। যশবন্ত বড় হবেন। মারা যাবেন জ্যোতিবা। সাবিত্রীর সন্তানের ধর্ম পালন করে শেষ পর্যন্ত লড়াই করবেন যশবন্তরাও। তারপর মারা যাবেন তিনিও। 

তারপর? এই তারপর নিয়ে বহুদিন বাদে খোঁজ করতে আসবেন এক বিলেতফেরত সাংবাদিক। খনন হবে ইতিহাসের অববাহিকা। আবারও সেই খননকার্যের সাক্ষী থাকব আমরা।

*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, theprint, Facebook
* তথ্যঋণ: 
১. ‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্‌ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬
২. ‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২
৩. ‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্‌’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯
৪. ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্‌ অফ্‌ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১

Isha Dasgupta Author

ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *