পড়ুন: কবিতার সঙ্গে বসবাস- নির্বাচিত কবিতা : সুমন গুণ- পর্ব ১
সুমন গুণের কবিতার পর কবিতায় প্রেম তার পদচিহ্ন রেখে গেছে। কিন্তু সে-প্রেম বেশিরভাগ সময় খুব নিরুচ্চার, সংগোপন এক মৃদু প্রদীপালোকের মতো জ্বলে। সে-প্রেমে বিষাদ আছে, কিন্তু কোনও জ্বালাপোড়া, তীব্র অধিকারবোধ ও তা আয়ত্ব না-করতে পারার আক্রোশ-সঞ্জাত কোনও ক্রোধী হাহাকার নেই। সে-প্রেম যেন দূরের বাড়ির কোনও আধোচেনা ঘর থেকে বাইরের রাস্তায় এসে পড়া জানালার আলো। এর বেশি চাপ তাঁর প্রেমের কবিতা বহন করে না। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায় সে-মনের ভেতর কীভাবে কোনও প্রেমার্তিকে, এমনকী শরীরের আর্তিকেও— কবিতার মধ্যে কত নম্র ও প্রশমিত স্বরে ঢেলে দেওয়া যায়। যেন নদীতে নদীর জলই অঞ্জলি দিলাম। তিনটি কবিতা পরপর পড়ে নেব আমরা।
জনান্তিকে
নিছক কমনরুমে, মাঝে মাঝে, ক্লাস শেষ হলে
বিপাশা রক্ষিত
দূরের চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার বাঁদিকে
ঝুঁকে, ডান হাত
চেয়ারের নিরাসক্ত হাতলে গচ্ছিত রেখে, নিচু
হয়ে, প্রায় মুগ্ধ জনান্তিকে
বলে, শোন, জরুরি দু’কথা আছে, অশোকদা কোথায়?
আমি, পথভ্রষ্ট, খুব মনোযোগ দিয়ে চারপাশ
দেখে, বলি : এইমাত্র এখানেই তো…
ততক্ষণে, ফিরে দেখি, ধৃতিকান্ত কিংবা ত্রিবেদীকে
ধরে, চোখ কুঁচকে, বিপাশা
গুরুতর কিছু শোনাচ্ছেন।
এভাবেই, মাঝে মাঝে, আমাকে অকূলে রেখে দিয়ে
বিপাশা সুদূরে চলে যায়
দুরূহ
সেদিন, পরীক্ষা ছিল, একটু পরে ঢুকল বিপাশা,
দু’কানে চঞ্চল দুল, আর
উস্কানিমূলক টিপ কপালে।
আমায়
দেখেও না দেখে
ব্যাগটা রাখল, সরে গেল অন্যদিকে।
বিপাশার গ্রীবার উড়াল
দূর থেকে দেখলাম, বারবার ফাল্গুনের হাওয়া
চূর্ণ চূর্ণ রোমাঞ্চের ঘোর
নিয়ে, যেন, চারপাশে ছড়িয়ে রইল।
গোপনে
বিপাশাকে, আমি খুব ভরসা করি না।
ওকে নিয়ে আমি শুধু মনে মনে ঘুরতে বেরোই,
নন্দনে বা কোনও
রাতের পার্টিতে
ইচ্ছে আছে ওকে নিয়ে সহাস্য ঢুকব,
চেনাশোনা যাঁরা থাকবে পরিচয় করাব সহজে,
ফেরার সময় ওকে গাড়িতে নিপুণ তুলে দেব।
বিপাশা কি টের পায়
এত ঘনযাপনের ছক
আমার শিরায় কাজ করে?

কবি সুমন গুণ পেশায় অধ্যাপক। সেই অধ্যাপনা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত কোনও বিশেষ না-বলা প্রণয়সঞ্চার এই সব কবিতায় প্রস্ফুটিত হতে দেখি।
‘জনান্তিকে’ কবিতায় প্রথমেই আমরা ‘কমনরুম’ কথাটি পেয়ে যাচ্ছি— কিন্তু তার আগে বসানো রয়েছে ‘নিছক’ শব্দটি। মনে রাখতে হবে কবিতাটা প্রথম শব্দও ‘নিছক’। এইভাবে ‘বিপাশা রক্ষিত’ নামক অধ্যাপিকার সঙ্গে একঘরে বসলেও সেই নারী সম্পর্কে এই প্রণয়-অনুভূতি যে কোনওদিন বলা হবে না— অপূর্ব সঙ্কেত প্রয়োগের দক্ষতায় মাত্র প্রথম দুটি লাইনেই সে-দিকে আলো পাঠিয়ে রাখলেন এই কবি। কবিতাটির মাঝখানে আমরা কমনরুমে, অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের ক্যাজুয়াল চলা-ফেরা, গল্প-গাছা দেখতে থাকি— সেখানে এই ‘বিপাশা রক্ষিত’ কবির চোখে প্রধান উজ্জ্বলতা হয়ে অবস্থান করেন—ঠিকই—কিন্তু তা কখনও কবির আচরণে প্রকাশ পায় না। এই নিরুচ্চার প্রেমের কবিতার যুগ বহুদিন হল প্রায় অবলুপ্ত। কিন্তু আমাদের বাঙালি জীবনে তার অস্তিত্ব আজও আছে। সে-কথাই প্রমাণ করে সুমন গুণের এই তিনটি কবিতা। ‘গোপনে’ কবিতাটির মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি লাইন আছে:
“ওকে নিয়ে আমি শুধু মনে মনে ঘুরতে বেরোই”,—কবিতাটির পুরো প্রথম স্তবক জুড়েই এই ‘মনে মনে’ নানা কাজ, বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয়, রাতের পার্টিতে যাওয়া—সকলই সম্ভব হয়ে ওঠে। তারপরে একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় স্পেস আসে। স্পেসের পরে ছোট ৩টি লাইন বুঝিয়ে দেয় কবির কোনওদিন না-বলতে পারা প্রণয়ের প্রাপ্তি ও শূন্যতা। ‘দুরূহ’ নামক কবিতায় শুধু আছে বিপাশার চঞ্চলতা। কেননা কবিতা প্রথমেই জানিয়ে দিচ্ছে: “সেদিন পরীক্ষা ছিল”—তারপরেই আমরা পাচ্ছি “একটু পরে ঢুকল বিপাশা”—কোথায় ঢুকল? নিশ্চয়ই সেই কমনরুমে। এবং কবিতার শেষ ৩টি লাইনে বিপাশার চারিদিক ঘিরে যে ফাল্গুনের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে তা শুধু ধরা পড়ল কবির চোখেই। কিন্তু এরপর আমরা যে কবিতাটি দেখব সেখানে প্রমাণ হবে এই অধ্যাপকের একটি দৃষ্টি শিক্ষকের অন্য দৃষ্টি কবিত্বের। আমরা ‘সান্নিধ্য’ নামক একটি কবিতা তুলে দিচ্ছি পাঠকদের জন্য:
সান্নিধ্য
সামনের বেঞ্চে একেবারে বাঁদিকে বসত মেয়েটি। অনুচ্চারিত চুড়িদার, একটি
নিঃশব্দ বিনুনি আর সামান্য পাউডারে যে কী গনগনে দেখাত ওকে।
তবে ওর স্বরে কোনও সম্ভাবনা ছিল না। খসখসে আর নিরুত্তাপ শোনাত ওর
গলা, যখন কথা বলত।
এই মেয়েটিকেই নবীনবরণের দিন করিডোরে দেখে থেমে গিয়েছিলাম।
হলুদ-সবুজে হিংস্র একটি শাড়ি পরেছে, ছাড়া চুল হিলহিল করে ঢেউ তুলছে
সারা শরীরে, চোখে-ঠোঁটে সহাস্য প্রসাধন।
বন্ধুদের সঙ্গে উচ্ছ্বাসের মধ্যে আমাকে দেখে তাকাল, অনুতাপহীন ওর হাসির
ছোবল নিয়ে, আমি, নিরপরাধ স্টাফরুমের দিকে হেঁটে গেলাম।

এই কবিতায় এসে পড়ছে এক ছাত্রী। এই ছাত্রী সামনের বেঞ্চে বাঁদিকে বসত। অর্থাৎ বাঁদিকে বসাটুকু, ক্লাস নিতে এসে প্রত্যেকদিনই চোখে পড়ত সেই অধ্যাপকের। কেননা মেয়েটি তাঁর কাছে একটি বিশেষ নারী। শিক্ষাদান তাঁর ব্রত— তবু সৌন্দর্য দেখার চোখ তো কখনও পরিত্যাগ করে না কবিকে। তাই এই মেয়েটিকে বড় মনে আছে তাঁর।
সেই মেয়েটিকেই দেখা গেল নবীনবরণের দিন। সেদিন সে একেবারে অন্যরূপা। অন্য সাজ তার। অন্য আবেদন। কবিদৃষ্টি তাও কি দেখল না? দেখার পর কী হল? কবিতার শেষ দুটি লাইনের দিকে আমরা লক্ষ্য করব এবার। লক্ষ্য করব বন্ধুদের উচ্ছ্বাসের মধ্যে সেই তরুণীর উপস্থিতি—লক্ষ্য করব:
“…অনুতাপহীন ওর হাসির ছোবল নিয়ে, আমি, নিরপরাধ স্টাফরুমের দিকে হেঁটে গেলাম।” এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ‘আমি’ কথাটিকে কীভাবে থমকে দেওয়া হল আগে ও পরে একটি করে কমা রেখে! কেননা অধ্যাপক তো তাকে এইভাবে পূর্বে দেখেননি কখনও। অথচ মেয়েটিকে তিনি গোপনে দেখতেন। আজ তার এই হাস্যময়ী নিষ্পাপ কিন্তু তীব্রতাময় উচ্ছ্বাস চোখে পড়ায় তাঁর মন থমকে গেল। তিনি আবার নতুন করে বুঝলেন: এই ছাত্রী তাঁর কেউ নয়, তাঁর প্রণয়িনী হবে না কখনও, এবং এই প্রণয়চিন্তা কি একরকম অপরাধ? কিন্তু তাঁর মনোভাব তো কখনও তিনি প্রকাশ করেননি! তাই ‘নিরপরাধ’ তিনি হেঁটে গেলেন স্টাফরুমের দিকে। একজন মানুষ চলতে চলতে হঠাৎ একটি মেয়েকে দেখে মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল— তারপর আবার চলতে শুরু করল তার গন্তব্যের দিকে। এই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়াটিকেই, ‘আমি’ শব্দটির সামনে ও পিছনে একটি করে কমা বসিয়ে দিয়ে জীবন্ত করা হল। এ-ই হচ্ছে যতিচিহ্নকেও কীভাবে শব্দ ব্যবহারের বিকল্প হিসেবে প্রয়োগ করা যায় তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্তের একটি। এই নিরপরাধ শব্দটি মূলত একটি আত্মশ্লেষ। আর এই স্টাফরুম কী? এ হল সেই ‘নিছক কমনরুম’! যেখানে বিপাশা রক্ষিতের উপস্থিতি জ্বলমান হয়ে থাকে। একজন পুরুষ, বা একজন কবি, অন্যপক্ষে একজন নারী যে একজন কবি— তারা সারা জীবন ধরে যে কেবল একজন পুরুষকে নিয়েই কবিতা লিখবেন বা একজন নারীকে নিয়েই—তা তো নয়। মুগ্ধতা বারবার আসে। সে-জন্যই কবিতা লেখা হয়। তবে এই ‘সান্নিধ্য’ কবিতার শেষে একদিকে ‘অনুতাপহীন’—অন্যদিকে ‘নিরপরাধ’—শব্দ দুটি ‘আমি’ কথাটির দুদিকে বসানো কমা প্রয়োগের থমকে যাওয়াকে কীভাবে সঙ্কেতায়িত করে তুলল কবিতায় তা আমাদের অভিভূত করে।
এরপর আরও একটি নিরুচ্চার প্রেমের কবিতা পড়তে দেব পাঠককে যা সুমন গুণের কবিতার প্রধান চরিত্রধর্ম সংহত ঘনতায় নিবদ্ধ।
পরাস্ত
একটি নিশ্চিত খাম পড়ে আছে সামান্য টেবিলে।
কিনারে সোহাগচিহ্ন, অপরাধ দ্বিধায় মুদ্রিত।
নিছক টেবিলে, শান্ত, পড়ে আছে প্রতিরোধহীন
একটি নিপুণ, লাল খাম

এই কবিতাও তাঁর সর্বোচ্চ কবিত্ব চিহ্ন রেখেছে নিজের নামকরণটির মধ্যে। সাড়ে ৪ লাইনের কবিতা। বিষয় বলতে, টেবিলে একটি খামের পড়ে থাকা। এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় লাইনটি : ‘কিনারে সোহাগচিহ্ন, অপরাধ দ্বিধায় মুদ্রিত’। সাধারণত বিবাহের আমন্ত্রণপত্রে এককোণে একটু হলুদ রঙ ছুঁইয়ে দেওয়া হয় এখানে তাকেই বলা হচ্ছে ‘সোহাগচিহ্ন’। কার সোহাগ? যে স্বামী জীবনে আসতে চলেছে তার সোহাগ। আর লাইনটির দ্বিতীয়ার্ধ ‘অপরাধ দ্বিধায় মুদ্রিত।’ একথা বোঝায় যে একদিন কোনও সম্পর্ক ছিল হয়তো বা কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল—যুক্তজীবনের প্রতিশ্রুতি—এই খামের প্রাপককে। সেই প্রাপক আজ কী দেখছে? শুধু খামটিকে নয়, খামের কিনারে দেওয়া ‘গাত্রহরিদ্রা’র ইঙ্গিতটুকুও নয়—দেখছে সেই সম্পর্কটিকে যেখানে সে প্রাপক পরাস্ত হয়েছে। এত সামান্য আয়োজনে এমন একটি বেদনা কত নির্বিকারভাবে ফুটে উঠল কবিতাটিতে। আমার অতিরিক্ত সংযোজন হল এই কবিতার নাম ‘পরাস্ত’ হলেও—খামের প্রাপক তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেকে পরাস্তজ্ঞান করলেও—কবিতাটি কিন্তু জয়ী হয়েছে। এইরকম সংহতি ও ঘনতাময় আরও একটি সংক্ষিপ্ত কবিতা তুলে দিই যে কবিতার মধ্যে কিন্তু প্রবল শারীরিকতা আছে। অথচ তার প্রকাশধরণ এত সংযত ও সংক্ষিপ্ত যা আমাদের বিমূঢ় করে দেয়।
পিকনিক
দূরের বাড়িতে আলো, বাইরের গাছ ও দেয়াল
বারোটা কুড়ির রাতে সজাগ,
হয়তো
দ্রুতশ্বাস বিছানার পর
বাথরুমে এসেছে ঘরনি
এ কবিতায় একই পাড়ার দূরবর্তী কোনও বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে মধ্যরাত পার হয়ে জেগে থাকা এক কবির চোখ। অন্য কোনও বাড়ির উল্লেখ না থাকলেও বোঝা যায় মাত্র একটি বাড়িতেই আলো হঠাৎ জ্বলল। কেন? তার কারণ শেষ দু-লাইন বলে দেয়। ‘দ্রুতশ্বাস বিছানার পর’ লাইনটি পাঠকমনে ঝড় তুলে দেয়। তারপরের লাইনটি বলে অভ্যস্ত দাম্পত্যকথা।
এই দাম্পত্য এবং বাড়ির বিষয় হিসেবে এসেছে এমন একটি কবিতা এবার দেখা যাক:
অবেলা
তোমাদের বাড়িটা কেমন না, কোনও হাসি নেই।
কথাটা বলে লিপি জানলা দিয়ে বাইরে
তাকাল। নতুন বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে এসে
তার সবসময় বান্ধবনগরে নিজের বাড়ির কথা
মনে পড়ে। সেখানে সারাদিন
কথা, চেঁচামেচি, সামনে মাঠ, পাশের বাড়ির
ন’কাকা, রুমা, ঝিমলি
এখানে সারাদিন শাড়ি, শাশুড়ি, বিছানা গোছানো
আর দেখে দেখে রান্না শেখা, টিভি
থাবা-বাড়ানো বরের দিকে তাকিয়ে, মনে মনেই
বলল লিপি :
তোমাদের বাড়িটা কেমন, না। কোনও হাসি নেই।

এই কবিতার মধ্যে আমরা দেখতে পাই নতুন বিয়ে হয়ে আসা এক তরুণীর দাম্পত্যহতাশা। এ কবিতার মধ্যে ‘বান্ধবনগর’ শব্দটির ব্যবহার আছে। এই কবি, সুমন গুণের ক্ষেত্রে, ‘বান্ধবনগর’ এমন একটি শব্দ যা পাঠকের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। একেকটি রাগে বিশেষ কয়েকটি স্বরের একটি ‘ফ্রেজ’ বারবার ব্যবহৃত হয়ে রাগের রূপটিকে প্রতিষ্ঠা দেয়। সুমন গুণের কবিত্বের মূল চরিত্র জানতে ‘বান্ধবনগর’ শব্দটির সঙ্কেত পাঠকের পক্ষে বোঝা আবশ্যিক। এ কবিতা বিষয়ে বিস্তারিত বলছি না—শুধু এইটুকু বলছি এতদিন লিখছেন এই কবি, কিন্তু বাংলার সাধারণ জীবনকে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত, সহায়সম্বলহারা ও সব থেকেও কিছু না-পাওয়া জীবনগুলিকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই কবি তাঁর রচনায়—সে কথা এই ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইটি পড়তে গিয়েই অনুভব করলাম। নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মাল—এত দেরি করলাম কেন জানতে? ‘অবেলা’ কবিতাটির মধ্যে বাঙালি মেয়েদের জীবন, বাড়ির মতে, অচেনা পাত্রকে বিবাহ করে কেমন দমবন্ধ, হাঁফিয়ে ওঠা বন্দিদশা প্রাপ্ত হয় তার প্রমাণ আছে। ‘থাবা বাড়ানো বর’ এই কবিতায় সমগ্র পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য-প্রতীক হয়ে ওঠে।
অসুখী দাম্পত্যের কথা যেমন তুলে ধরেছে এই ‘অবেলা’ কবিতাটি, তেমনই, স্বামীর গভীর টান, স্ত্রীর প্রতি নির্ভরতা, জীবনসঙ্গিনীর থেকে দূরে থাকা—এক পুরুষকে কীভাবে একাকীত্বের মধ্যে টেনে রাখে—তারও পরিচয় সুমন গুণের কবিতায় পাওয়া যায় একাধিক পথে। একটি দৃষ্টান্ত মাত্র তুলে ধরি:
বিচ্ছিন্ন
একা হয়ে বুঝতে পারছি তুমি কত পরিচর্যাময়
হাতে ধরে রেখেছিলে আমার সমস্ত চাওয়া, বাইরে বেরুনো, রাত করে
বাড়ি ফেরা, ধোয়া জামা, নতুন রুমাল।
টেবিলে শুকনো রুটি, খোলা বিস্কুটের কৌটো, সারারাত
এভাবেই পড়েছিল, দড়ি থেকে ভেজা
পাজামা ঝুলছে, লাল চাদরটা যে কোথায় ফেললাম—
রাত বেড়ে যায়, তুমি বাড়িতে কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
বেশ কয়েক বছর ধরেই আমি জানি সুমন গুণ আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, বাংলা বিভাগে। তাঁর পরিবারের বসবাস কলকাতায়, মাঝে মাঝেই তাই যাওয়া-আসা করতে হয় তাঁকে। পরিবার ছেড়ে দূরে থাকতে হয় চাকরির কারণে। এই ‘বিচ্ছিন্ন’ নামক কবিতাটিতেও সুমন গুণ আরেকবার প্রমাণ করলেন, কবিতার নামকরণ কবির কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ সেকথা তিনি জানেন এবং তার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্তগুলি বারবার স্থাপন করেন নিজের কবিতায়। এই কবিতায় স্ত্রীর কাছে না-থাকা, সেই অভাববোধ, কত শান্ত বিষাদের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
‘বিচ্ছিন্ন’ নামকরণটি ‘বিবাহ বিচ্ছিন্ন’ শব্দটির সংকেত আনছে—যদিও এই দম্পতি মোটেই ডিভোর্সি নয়। তবু, সাময়িকভাবে তো তারা আলাদা থাকতে বাধ্য হচ্ছে— সেই শূন্যতা স্পষ্ট করতে গিয়ে কবিতাটি ‘বিবাহ বিচ্ছিন্ন’ শব্দের আদি অর্থটিকেও, যেন খেলাচ্ছলে ব্যবহারে নিয়ে এল। এই হল সূক্ষ্ম কাব্যের কারুকাজ! সমস্ত দিনের কাজকর্মের শেষে, একা বসে, স্বামী ভাবছে, নিজের অগোছালো স্বভাবটিকে কীভাবে কোনওদিন অনুভব করতে দেয়নি তার স্ত্রী। ছোট্ট ছোট্ট ডিটেইল, চিত্রকরের ব্রাশের সামান্য কিন্তু অত্যন্ত জরুরি টান দেওয়ার মতো ফুটে উঠেছে সংক্ষিপ্ত কবিতাটির ভিতর। ৮ লাইনের কবিতা, দুটি স্তবকে ভেঙেছে। প্রথম স্তবকে জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে অতিবাহিত করা দিনরাত্রিগুলির স্বল্প চিত্র— সে সব কাজ যে জীবনে কত গুরুত্বময় ছিল, স্বামী বোঝেনি তখন, স্ত্রীর পরিচর্যা তাকে বুঝতে দেয়নি। হ্যাঁ, পরিচর্যা শব্দটি ইচ্ছে করেই রাখা হল প্রথম লাইনের শেষ শব্দ হিসেবে— কারণ এই পরিচর্যারই অভাব ফুটে উঠেছে দ্বিতীয় স্তবকে। এই দ্বিতীয় স্তবকে স্বামী একা, কর্মস্থলে। সেই স্তবক দেখাচ্ছে স্বামী নিজের দেখাশোনা নিজে করে উঠতে পারে না। সেই ডিটেইল-ও ফুটে উঠেছে চিত্রকরের নিপুণ ব্রাশের স্পর্শে। তবে অতুলনীয় এই কবিতার শেষ লাইন। এত ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে জীবনসঙ্গিনীর প্রতি স্নেহকাতরতা জাগানো হয় এখানে যা ভেতরকার চাপা কষ্টকে জ্যোস্নার মতো রাত্রির একাকী আশ্রয় করে তোলে।
সুমন গুণের কবিতার মধ্যে পিতৃস্নেহ কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার দুটি উদাহরণ পাঠককে জানাব এবার:
অসমবয়সি
খেলা ও আহ্লাদ নিয়ে সারাদিন আনন্দে রয়েছ।
আমরা বিষয়ে থাকি, বাড়ি ফিরি পরের দিনের
কাজ টুকে, রোজ
মন ভার হয়ে থাকে কাগজে বন্ধুর নাম দেখে।
তোমরা সামান্য বাঁশি, কাগজের টুকরো কিংবা রং
নিয়ে খেলছ, গল্প শুনে মনে রেখে শোনাচ্ছ, নতুন
গল্পের বায়না ধরছ, না হলে কান্নায়
ভেঙে গিয়ে আবার একটু পরে মজা পেয়ে হেসে উঠছ খুব
তোমাদের থেকে আমি শিখে নিতে চাই মুহূর্তের
সঞ্চয় কীভাবে সেই মুহূর্তেই ঢেলে ফেলা যায়।
দূরের মঞ্চের দিকে ঝোঁক নেই, তোমরাই পুরো
বেঁচে আছ, জোর করে কাজের ঘর থেকে
টেনে এনে বলছ : ‘তোমার কোনও কাজ নেই, আমাদের
সঙ্গে শুধু খেলো, শুধু খেলতেই থাকো’…
পরম্পরা
ছোট থেকে শিখে নিচ্ছ যাদু ও আহ্লাদ, সারাদিন
মজে আছ মুগ্ধ খেলনায়, মাঝে মাঝে
প্রচণ্ড ইচ্ছেয় শুধু ভেঙে ফেল তুচ্ছ ফুলদানি
তোমাদের থেকে আমি শিখে নেব শৈশবের সব
আলপনা, প্রথম বিস্ময়, প্রশ্ন, মর্জি ও উল্লাস।
পাখির সঞ্চার দেখে তাকিয়ে থাকব, পুকুরের
জল দেখে ঝুঁকে পড়ব, হাত দিয়ে
ছুঁতে চাইব রঙিন আগুন।
এখন যতটা স্বচ্ছ, জানি তার সবটা থাকবে না।
বড় হতে হতে তোমরা ভেঙে পড়বে, পৃথিবীর সব
নোংরা শুষে কালো হবে, পরাজিত হবে।
এভাবে চেঁচিয়ে আর ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারবে না।

প্রথম কবিতাটিতে আমরা লক্ষ্য করি পিতা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতার কষ্ট নিয়ে যখন ঝুঁকে পড়ছেন একা একা—মানসিকভাবে ঝুঁকে পড়ছেন কিন্তু বলছেন না কাউকেই সেই ব্যর্থতাগ্লানি—সেই সময় কীভাবে সন্তানরা তার পিতাকে টেনে নিয়ে নিজেদের সঙ্গে খেলতে বাধ্য করছে। কীভাবে তাঁকে তাঁর কাজের টেবিলে মুখ গুঁজে বসে থাকা থেকে মুক্তি দিচ্ছে সন্তানদের আবোলতাবোল খেলাধুলো! যে-সন্তানদের রোজই কোনও না কোন গল্প শোনান পিতা সেই সন্তানরাই পিতার বলা গল্প তাঁকে ঘুরিয়ে শোনাচ্ছে—নতুন গল্প শোনানোর আবদার জানাচ্ছে। —আর পিতা তাঁর মঞ্চ আরোহণপ্রিয় সঙ্গীদের কথা ভুলে এক সরল আনন্দে ডুবে যাচ্ছে সন্তানদের সঙ্গে।
এ-কবিতায় উল্লেখ করা হয়নি, তবু আমাদের বুঝতে বাধা হয় না যে এই গম্ভীর পিতা যেন সন্তানদের সূত্রেই আবারও ফিরে পাচ্ছেন তার হারিয়ে যাওয়া বাল্যকালকে।
তবে দ্বিতীয় কবিতাটির লক্ষ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিজ সন্তান বিষয়ে এমন কোনও কবিতা পূর্বে বাংলার কবিতার ইতিহাসে লেখা হয়েছে কি না জানি না। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘ছেলে গেছে বনে’। কিন্তু সে-লেখা কিন্তু সে-লেখা ছুটে গিয়েছিল তৎকালীন নকশালপন্থী যুবকদের প্রতি স্নেহার্দ্র দুশ্চিন্তা সম্বল করে। কিন্তু এই ‘পরম্পরা’ কবিতায়, সুমন গুণ প্রত্যক্ষভাবে নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই এক নির্মোহ কাঠিন্যে ভর করে লিখেছেন এই ১২টি লাইন। কোনও নিষ্ঠুরতা থেকে নয়, কিন্তু সত্য যে নিষ্ঠুর এবং সমাজ যে নিষ্ঠুর সত্যকে গ্রহণ করতেই বাধ্য করে প্রত্যেক বড়ো হয়ে উঠতে থাকা বালক বা কিশোরকে—সেই আশঙ্কার দিক থেকে নিজের চোখ ফিরিয়ে রাখেননি এই কবিতার রচনাকার পিতা। সেই জন্যই কবিতাটিকে আপাত দৃষ্টিতে নিষ্ঠুর মনে হলেও আবারও বাংলার তথা ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থার গতিপ্রকৃতিকে চিহ্নিত করেছে এ-কবিতা নিজ সন্তানদের ভবিষ্যৎকে কবিতার বিষয় হিসেবে ব্যবহার করে। অতুলনীয় লেখা!
মারিও পুজোর একটি উপন্যাস আছে যার নাম ‘ফ্যামিলি’। নিশ্চয়ই সকলেই পড়েছেন সে-উপন্যাস, চতুর্দশ শতাব্দীর পোপ আলেকজান্ডারকে ঘিরে এই উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত। মারিও পুজো তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে বলতে চেয়েছেন ‘ফ্যামিলি’ বা পরিবারের গুরুত্বের কথা। মানব জীবনে তার পরিবার এক অপরিহার্য আশ্রয়। আর আমাদের এই কবি সুমন গুণ তাঁর পরিবারকে কী চোখে দেখেছেন সে কথা বলবে পরের ছোট্ট কবিতাটি :
ঐশ্বর্য
বাড়িতে ফেরার পথে দেখি
দোতলা সংসার যেন নিরুদ্বেগ অপেক্ষায় আছে
বাড়ির সামনে দুটি অনিবার্য ল্যাম্পপোস্ট, আমি
দূর থেকে টের পাই সামনের রাস্তা ও দেয়াল
নিশ্চিত আলোয় যেন ধুয়ে যাচ্ছে, কারও সাধ্য নেই
সামান্য আঁচড় কাটে আমাদের সহাস্য দরজায়

পরিবারের পুরুষটি সারাদিন পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরছেন। একটু দূর থেকে দেখতে পাচ্ছেন বাড়ির সামনের দুটি ল্যাম্পপোস্ট—তারা ‘অনিবার্য’, কেন? কারণ দুদিকে দুটি ল্যাম্পপোস্টই যেন দাররক্ষীর ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে! পথবাতির আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে সামনের রাস্তা ও দেওয়াল—কোন দেওয়াল? যে পুরুষটি বাড়ি ফিরছেন, তার বাড়ির দেওয়াল। এবং আলোটি কেমন? আলোটি ‘নিশ্চিন্ত’! হ্যাঁ, তারপরই এসে পড়ছে কবিতার শেষবাক্য: ‘কারো সাধ্য নেই/ সামান্য আঁচড় কাটে আমাদের সহাস্য দরজায়’। এই সেই পরিবার যাকে দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছেন পিতা ও মাতা। যে পরিসরে সন্তানরা গল্প শোনার জন্য আর নিজেদের সঙ্গে খেলার করার জন্য কাজের ঘর থেকে ডেকে নেয় তাদের কর্মব্যস্ত পিতাকে। এবং এই কবিতার নামকরণ আবারও সুমন গুণের কবিত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন হয়ে জ্বলজ্বল করে—কারণ, কবিতাটির নাম ‘ঐশ্বর্য’! নিজের পরিবারকে নিজের ঐশ্বর্য হিসেবে বিশ্বাস করে সে কথা কবিতায় বলবার উদাহরণ কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
‘গার্হস্থ্য’র কথা বললাম আমরা, বললাম পরিবারের কথা, যে পরিবার, এই কবি সুমন গুণের কাছে, এক ‘ঐশ্বর্য’! কিন্তু সেই ‘ঐশ্বর্য’ স্থাপিত হয় কোথায়? কোথায় সেই পরিবার অবস্থান করে? নিশ্চয়ই কোনও গৃহে। অর্থাৎ কোনও বাড়িতেই একটি পরিবার স্থাপিত হতে পারে। এইবার আমরা দেখব, আমাদের এই কবি, সুমন গুণ ‘গৃহ’ বা ‘বাড়ি’কে কী দৃষ্টিতে দেখেছেন। একটি কবিতা তুলে দিই:
হাতবদল
বাড়ির নিজস্ব কিছু ভাষা আছে, স্তব্ধ ও নীরব
সেইসব কথা রোজ মিশে থাকে জীবনযাপনে
চাপা, অন্তর্হিত
বাড়িটির কথা খুব মনে পড়ে, এত বছরের
আর্তি ও আহ্লাদে গড়া, সামনের জানলায়
কাচ একটু ভাঙা, রং চটে গেছে গ্রিলে, এবছর
কাজ করানোর কথা ছিল, পাশের বাড়ির
নারকেলগাছের ডাল ছাদে নেমে এসেছে, নীচের
ঘরে কি এখনও সেই দোলনাটা আছে?
একদিন ঘুরে আসব পুরনো পাড়ায়, একটু থেকে
ছুঁয়ে দেখব হাতবদল হয়ে যাওয়া ইটপাথরের
মর্মে কোনও মন আছে কিনা

এই কবিতা শুরু হচ্ছে এমন একটি কথা দিয়ে যা আমরা প্রায় কেউই ভাবি না। কবিতার প্রথম লাইন বলছে: ‘বাড়ির নিজস্ব কিছু ভাষা আছে, স্তব্ধ ও নীরব।’ বাড়িতে আমরা বাস করি। আমাদের প্রত্যেকেরই ভাষা-কথা আমরা ব্যবহার করে চলি অবিরত বাড়ির ভিতর অবস্থান করার সময়ে। বছরের পর বছর কেটে যায়—’বাড়ির নিজস্ব কোনো কথা ছিল কিনা’— এ কথা কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সুমন গুণের এই কবিতাটির নাম ‘হাতবদল’। কবিতাটি পড়লেই আমরা বুঝতে পারি একসময় একটি বাড়িতে দীর্ঘকাল বাস করেছেন একজন মানুষ তাঁর পরিবার নিয়ে। তারপর বাড়ির ‘হাতবদল’ হয়েছে অর্থাৎ বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন তাঁর মনে পড়ছে যে ‘ সামনের জানলার কাচ একটু ভাঙা, রং চটে গেছে গ্রিলে, এবছর কাজ করানোর কথা ছিল…’। অর্থাৎ বাড়িটি নতুন করে রেনোভেট করার কথা ভাবছিলেন এ বাড়ির বাসিন্দা। কিন্তু বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছে অন্যের হাতে। এখানেই আসছে ‘হাতবদল’ নামকরণটির অমোঘতা। বাড়িরও কি তাহলে মন আছে? সেই কথাই বলছে কবিতার শেষ অংশ: “একদিন ঘুরে আসব পুরনো পাড়ায়, একটু থেকে/ ছুঁয়ে দেখব হাতবদল হয়ে যাওয়া ইটপাথরের/ মর্মে কোনও মন আছে কিনা…”
আমরা জানি বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে প্রাক্তন পুরুষটি নতুন নারীর সঙ্গে বসবাস করার সময়েও ফেলে আসা নারীটির কথা মন থেকে পুরোপুরি উপড়ে ফেলতে পারেন না। আবার বিবাহবিচ্ছিন্না কোনও রমণী তার পূর্বতন স্বামীর কথা মাঝে-মাঝেই মনে করতে বাধ্য হয়। জীবন শ্লেটের মতো নয়। অভিজ্ঞতাগুলি খড়ির দাগের মতো ডাস্টার দিয়ে ঘসলেই মুছে ফেলা যায় না। বাড়ি জড় বস্তু। জড় বস্তুর মন থাকে না। এক্ষেত্রে কবির নিজের মনই ইটপাথরের মর্মে প্রবিষ্ট হয়ে অপূর্ব কবিত্বের উদ্ভাস ঘটালো ‘হাতবদল’ কবিতাটির মধ্য দিয়ে। বাড়িটির হাতবদল হয়েছে, কিন্তু সেই বাড়ির যে প্রাক্তন বাসিন্দা, তিনি এখনও সেই বাড়ির স্তব্ধ ও নীরব ভাষা-কথা যেন নিজের জীবনে শুনতে পান। “তাদের মতন ভাষা কথা কে বলিতে পারে আর?” —লিখেছিলেন জীবনানন্দ তাঁর ‘বোধ’ কবিতায়। একজন কবির ভাষাকথা অন্য জন বলতে পারেন না। তাই তিনি অন্য এক কবি হয়ে ওঠেন। তেমনই এক ‘অন্য কবি’ রূপে বাংলা কবিতায় এসেছেন সুমন গুণ। তাঁর এই ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইটি এর প্রমাণ।

পরিবারের কথা বলছিলাম তো এক্ষুনি! পরিবারের মূল কেন্দ্র হলেন মা। এবার আমরা একটি অন্যরকম কবিতার দিকে যাব:
স্তব
বিকেলের আলো এই ক্যাম্পাসের পাহাড়ি সন্ধ্যায়
অন্ধকার হয়ে মিশে যায়
শেষ মুহূর্তের রং উঁচু ডালে, বাংলা বিভাগের ছাদে, টিলার ওপরে
আলোচনাহীন ঝরে পড়ে
মাসকমের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে খোলা ও উজ্জ্বল
অর্থপূর্ণ মেয়েদের দল
দুর্বোধ্য ধুলো উড়িয়ে অন্যমনস্ক কিছু গাড়ি
ইতস্তত ফিরে যাচ্ছে বাড়ি
কয়েকটি নির্জন ফুল নিঃশব্দ আগুন হয়ে জ্বলে
চড়াইয়ের পাশের জঙ্গলে
আপৎকালীন ডানা মেলে রেখে নারকেলগাছে
দুটি সাদা পায়রা বসে আছে
আমার মা এরকমই শান্ত আর সামান্য সন্ধ্যায়
তিনদিন আগে মারা যায়
এই কবিতার নাম ‘স্তব’। কিন্তু কেন এই নামকরণ সেকথা কবিতাটি শেষ ২ লাইনের আগে পর্যন্ত গোপনই রেখে চলে। ‘ক্যাম্পাস’ শব্দটি আছে তার মানে নিশ্চয়ই কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া আছে চারপাশে। ‘পাহাড়ি সন্ধ্যায়’ তার মানে পাহাড়ও রয়েছে কাছাকাছি। ‘বাংলা বিভাগের ছাদ’ কথাটিও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। ২য় স্তবকে আমরা পাব ‘মাসকমের’ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে ‘খোলা ও উজ্জ্বল’ মেয়েরা। ‘মাসকম’ কথাটির অর্থ বোঝাই যায়, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে য্রে মাসকমিউনিকেশন শিক্ষা দেওয়ার বিভাগটি আছে—তাঁকে ছোট করে ‘মাসকম’ বলা হচ্ছে এখানে। এরপরই ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর বিলীন হয়ে আসছে কয়েকটি গাড়ি ফিরে যাওয়ার ধুলো ওড়ার সঙ্গে-সঙ্গে। জেগে উঠছে স্বয়ং প্রকৃতি। যে প্রকৃতির মধ্যে নির্জন ফুল নিঃশব্দ আগুন হয়ে জ্বলে। যেখানে নারকোল গাছে দুটি পায়রা বসে আছে। এরপরে এসে পড়ছে শেষ স্তবক, যা নির্বিকারভাবে উচ্চারণ করছে: ‘আমরা মা এরকমই শান্ত আর সামান্য সন্ধ্যায়/তিনদিন আগে মারা যায়।’ শেষ লাইনের পরে কোনও যতিচিহ্ন ব্যবহার করা হয়নি। এ কবিতায় ৬টি স্তবক আছে। প্রথম স্তবকটি ৪ লাইনের, তারপরের স্তবকগুলি ২ লাইনের। কোনও স্তবকের শেষ শব্দের পরেই কোনও যতিচিহ্ন নেই। এইভাবে কোলাহলময় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের জনবহুলতা থেকে ফুল, নারকোল গাছ, সাদা ডানার পায়রায় চলে আসে এ-কবিতা কেবল স্তবক শেষে একটি করে যতিচিহ্নহারা শূন্যতা রাখতে-রাখতে। স্তবকগুলির মধ্যে-মধ্যে কিন্তু যতিচিহ্নের ব্যবহার আছে এবং তাও আছে কেবল প্রথম স্তবকে যখন ‘ক্যাম্পাস’ কোলাহলপূর্ণ—তখনই। কেননা যতিচিহ্নও, আমাদের এই কবিতার কাছে এক কোলাহল-ই। আর স্তবকশেষের যতিচিহ্নহীনতা এক শূন্যতার-ই দ্যোতক। যে-শূন্যতাকে আমরা আবিষ্কার করব কবিতার শেষ দুটি লাইনে পৌঁছে। কারণ কোনও মানুষ যখন মাকে হারায় তখন তার চেয়ে বড়ো শূন্যতা আর কী আছে সেই মানুষের জীবনে! অথচ সেই শূন্যতাকে বলা হল নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক এক কবিতাস্বরকে ব্যবহার করে। কবিতাটি শেষ করার পরে আমরা বুঝি কেন এই কবিতার নাম ‘স্তব’! বুঝি সাদা পায়রা দুটির ডানামেলা কেন ‘আপৎকালীন’ বিশেষণে চিহ্নিত! কবিতা পড়ার পর আমাদের মন ভার হয়ে থাকে। শোক, কত সংহতভাবে নিজেকে প্রকাশ করল এই কবিতায়।

পুনশ্চ : সুমন গুণের ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চেষ্টা করলাম। না-বলা রয়ে গেল আরও অনেক কবিতার সৌন্দর্য। তবে এই ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইয়ের মধ্যে গৃহীত হয়নি এমন একটি কবিতা তুলে দিয়ে আমি আমার আজকের কথা বলা থেকে বিরতি নেব। কবিতাটি এইরকম:
আসক্তি
তোমাকে দূরের জলে দেখি মাঝে মাঝে,
দেখি এক শান্ত, স্থির, অনুরক্ত নৌকোর মত
স্রোতের সামান্য স্পর্শ লক্ষ্য করে অপস্রিয়মাণ।
পাশের সড়কে আমি, গন্তব্যপ্রবণ
বন্ধু ও দঙ্গল নিয়ে ছুটে যেতে যেতে টের পাই,
এই দৃশ্যে আমি এক অবলুপ্ত প্রার্থনাসঙ্গীত।
এই কবিতাটি আমার চোখে পড়ে ২০২২ সালের ‘এখন শান্তিনিকেতন’ নামক পত্রিকার শারদসংখ্যায়। কবিতাটি পড়ে আমার মন এক মুগ্ধস্রোতে ভেসে চলে। এমন এক নির্জন উদ্ভাস, শ্লোকের মতো এমনই গভীরতাময় এক স্বরধারা বয়ে এল তিন লাইনের দুটি স্তবকে ভাগ করা এই ক্ষুদ্র কবিতার মধ্য দিয়ে—যে আমি সম্পূর্ণ সমর্পণ করলাম নিজেকে এই কবিতাটির কাছে। বাক্যহারা সেই সমর্পণ। আলোক সরকার, ষাটের দশকে লেখা এক কবিতায় বলেছিলেন : ‘উচ্চারণসাধ্য নয় সব কিছু’—আমিও বুঝতে পারছি এই কবিতা বিষয়ে কিছু উচ্চারণ করা আমার সাধ্যের অতীত! কেননা এই কবিতা জানিয়ে দিচ্ছে আমরা, যারা কখনও-না-কখনও কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি—আমরা সকলেই আসলে এক ‘অবলুপ্ত প্রার্থনাসংগীত’ ছাড়া কিছু নই!
*অলঙ্করণ: চিরঞ্জিৎ সামন্ত
*ছবি সৌজন্য: Flickr, Etsy.com, Adobe stock, Wikimedia Commons, Pixels,
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।
বইটি পাঠের পরে কবির এত নিবিড় পর্যবেক্ষণ আমাদের অবাক করে । আমার উপলব্ধিতে মনে হচ্ছে যেন এই মাত্রা পড়ে উঠলাম আপনার কাব্য সমগ্ৰ টি । আলোচক কবি জয় গোস্বামীকে প্রণাম সামগ্ৰিক ভাবে তার এই কাব্যালোচনায় আমরা সমৃদ্ধ হয়েছিলো । ব ইটি সংগ্ৰহের আশায় থাকলাম ।
অভিনন্দন
তাপস সরখেল
কাশিমবাজার বহরমপুর ২
মুর্শিদাবাদ ৭৪২১০২ মো: ৯৪৭৬৪০৯৮১৩