সম্প্রতি, একটি কবিতা সংকলন হাতে এসেছে যার পৃষ্ঠাসংখ্যা মাত্র ৯৬ অথচ অনেক ভারী ভারী খণ্ড খণ্ড কবিতাসংগ্রহ এই ক্ষীণকায় বইটিকে অতিক্রম করতে পারে না। আমার নিজের কথাই বলছি। আমার তো ৬ খণ্ড কবিতাসংগ্রহ আছে কিন্তু এই বিশ্বাস আমার মধ্যে দৃঢ়বদ্ধ হল এই কৃশ গ্রন্থ, আমার স্তূপাকার কবিতা সংগ্রহসমূহকে অনায়াসেই তুচ্ছ করতে পারে। বইটির নাম ‘নির্বাচিত কবিতা : সুমন গুণ’। ১৯৯০ সাল থেকে সুমন গুণের কবিতাগ্রন্থ প্রকাশ পেয়ে চলেছে। তাঁর এই অবিরল ধারায় লেখা কবিতার মধ্য থেকে মাত্র ৯৬ পৃষ্ঠার একটি সংকলন তৈরি করা খুবই কঠিন কাজ ছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু শীর্ণ এই সংগ্রহ তার ললাটে জয়টিকা ধারণ করতে পেরেছে এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
সুমন গুণের কবিতা প্রধানত ২টি ধারায় প্রবাহিত। তার মধ্যে একটি ধারার প্রতি তাঁর পক্ষপাত অধিক। সেই ধারাটি হল সংহত, সংক্ষিপ্ত ও ঘনত্বময় কবিতারচনার ধারা। এই গোত্রের কাব্যরচনায় তিনি চূড়ান্ত সার্থকতা অর্জন করেছেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। এখন বলি তাঁর দ্বিতীয় ধারাটির কথা। এই দ্বিতীয় ধারায় প্রকাশিত হয়েছে আমাদের বাংলার সাধারণ, নিম্নবিত্ত, জৌলুসহীন, পরিশ্রমী অথচ মমত্বময় এবং চিরস্নেহাশ্রিত জীবন প্রবাহ। এই দ্বিতীয় ধারাটির দৃষ্টান্ত আগে রাখতে চাইছি, পরপর ৩টি কবিতা পাঠকের সামনে রেখে।

অন্ধকার
পাঁচটায় ঘুম ভাঙে, প্রতিদিন, ছটার আগেই
গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট পড়ে অটো নিয়ে কেষ্টপুর মোড়ে
চলে আসে সাধন বিশ্বাস।
সাধনের বাবা নেই, বাড়িতে ক্ষয়াটে মা, রোগা বোন, এইট-পাশ ভাই
যাবার আগে বাবা একটা অন্ধকার টালির গুমটি করে গেছে
খালের বাঁদিকে।
ডান বা বাঁদিক নিয়ে সাধনের মাথাব্যথা নেই, সে শুধু সকাল থেকে রোজ
অটোয় সংসার তোলে, পয়সা গোনে, খুচরো নিয়ে ঝগড়া করে, দুপুরে একবার
বাড়ি এসে আলু সেদ্ধ, কলাইয়ের ডাল খেয়ে যায়।
ক্রমশ বিকেল এসে সাধনের নির্বিকার অটোর কিনারে
ছায়া ফেলে, সিটে এক পা তুলে সাধন চেয়ে থাকে
একটু দূরের ভাঙা, একতলা বাড়ির উঠোনে
করবী গাছের দিকে, একা
সান্ধ্য
তেলেভাজা বিক্রি করে সুবলের মা, সন্ধের আগেই
সুবলকে সঙ্গে নিয়ে স্টেশনের উলটোদিকে এসে
জোগাড়যন্ত্র শুরু করে দেয়।
একটি কড়াই, কিছু বাটি, থালা, চামড়ের ব্যাগ
কেরোসিন স্টোভ, আলু, আনাজ, তেলের শিশি, লঙ্কা, পেঁয়াজ
সাজায়, দেশলাই জ্বালে, আস্তে আস্তে একজন-দুজন
ক্রমশ সামনে বেশ খদ্দেরের ভিড় জমে যায়
সুবল, বয়স ষোলো-সতেরো, পেটানো, কালো, দীঘল শরীর
মা’র সঙ্গে প্রতিদিন সন্ধে থেকে রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত
তেলেভাজা বিক্রি করে, বাটি ধোয়, পেঁয়াজ কুচিয়ে রাখে,
রোজ
বন্ধুরা সাইকেল নিয়ে দূরের ব্রিজের দিকে উড়ে যায়, বিকেলের মেঘ
ঝুঁকে আসে সুবলের অসম্পূর্ণ ছাউনির সামান্য দক্ষিণে
সংগ্রহ
প্রতিদিন ভোরে, সাড়ে চারটেরও আগে, দুটি রোগা কালো মেয়ে
বিটি রোড পার হয়ে আসে।
পিঠে বড়ো প্লাস্টিকের ব্যাগ, তাতে কুড়িয়ে কুড়িয়ে
ভরে নেয় কাগজ, বোতল, চটি আর কত কি। সারাক্ষণ
উবু হয়ে খুঁজে যায় বর্জ্যের তৈজস।
ছটার আগেই তারা চলে যায়, ঘুম ভেঙে উঠে
মানুষ আবার উঁচু ব্যালকনি থেকে, ছাদ থেকে, জানলা দিয়ে ছুড়ে
শহরে ছড়িয়ে দেয় সভ্যতার প্রকাশ্য ময়লা
মাঠে জলে চওড়া রাস্তায়
আবার পরের দিন ভোরে দুটি রোগা কালো মেয়ে
বিটি রোড পারে হয়ে এসে
এইসব নোংরা থেকে খুঁটে নেয় অবশিষ্ট, গোপন রসদ

প্রথম দুটি কবিতায় যে বাংলাকে দেখতে পেলাম আমরা তা আমাদের সকলেরই পরিচিত। কিন্তু এই সাধন বিশ্বাস, এই অটোচালক, তাকে আমি, ১৩ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখে চললেও, কখনও ঠিক এইভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি কি? না, করিনি। কবিতার শেষ অংশে শ্রমক্লান্ত, সারাদিনের যাত্রীবহনের ক্লান্তি নিয়ে চালকের ওই ‘একটু দূরের ভাঙা, একতলা বাড়ির উঠোনে করবী গাছের দিকে, একা’ তাকিয়ে থাকাটির মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হল বিশ্বসংসারের মধ্যে যে-কবি অবস্থান করছেন তিনি ওই সাধন বিশ্বাস ও করবী গাছের পারস্পরিক সম্পর্কে দেখা দিয়ে গেলেন।
‘সান্ধ্য’ কবিতায় আমরা দেখতে পাই রাস্তার ধারে তেলেভাজা বিক্রি করা সুবল নামক ১৬/১৭ বছরের কিশোরের মাকে। সুবলকেও দেখতে পাই। দেখতে পাই এমনকী বন্দী সুবলের বন্ধুদের স্বাধীন সাইকেল নিয়ে উড়ে যাওয়া। কবিতার শেষে আমরা বুঝি সুবল ও তার মা বাস করে রাস্তার ধারের এক ছাউনিতেই—যেখানে বিকেলের মেঘ ঝুঁকে আসে। কবিতার এই অংশে, পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন ‘বিকেলের মেঘ’ শব্দটির বিপরীতে কীভাবে ধাক্কা দিচ্ছে ‘অসম্পূর্ণ’ কথাটির প্রয়োগ! এবং ‘দক্ষিণে’-র ঠিক আগে ‘সামান্য’ কথাটিকেও বসানো হয়েছে সুবলের ফুটে ওঠা কৈশোরকে অসমাপ্ত রাখার ভবিতব্যকে স্পষ্ট করার জন্য।
তবে ‘অন্ধকার’ কবিতায় ‘করবীগাছ’ এবং ‘সান্ধ্য’ কবিতায় ‘বিকেলের মেঘ’ ও ‘দক্ষিণে’ কথা দুটি আমাদের কাছে যেটুকু সান্ত্বনাচিহ্ন আনে—‘সংগ্রহ’ কবিতাটি থেকে সেই সান্ত্বনাবিন্দু পুরোপুরি হরণ করে নিয়েছে রচনা প্রক্রিয়াটি। যে দুটি রোগা কালো মেয়ে বি. টি. রোড পার হয়ে জঙ্গল থেকে খুঁজে যায় ‘বর্জ্যের তৈজস’—তারা এ সমাজে সামান্য মায়াশ্রিত মেঘচ্ছায়া পায় না। কিন্তু কবিতাটি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার দ্বারা তীক্ষ্ম ছুরির মতো পাঠকের বোধে ও মমত্বে গেঁথে গিয়ে রক্তক্ষয় ঘটাতে থাকে। এই কবিতাকে বলা যায় প্রকৃত অর্থে ‘ডিস্টার্বিং’। যেহেতু বাসে বা ট্যাক্সিতে যেতে যেতে এমন দুটি মেয়েকে আমরা প্রত্যেকেই দেখেছি তাই আমাদের মনে পড়ে যায় প্রয়াত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বাক্য যা তিনি মুখে বলেছিলেন লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীকে। কী বলেছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস? বলেছিলেন, ‘…আপনি ওদের নিয়ে লিখে, আপনি ওদের আমাদের সঙ্গে যেভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন… তার ফলে আমাদের মনে অপরাধবোধের সৃষ্টি করেছেন; আমাদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করেছেন আমাদের মনে কাঁটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন… আপনার সবচেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্ট আপনার উপন্যাসে আপনি আমাদের তৃপ্তি না দিয়ে… অপরাধ দিয়েছেন, খোঁচা দিয়েছেন আমাদের নিরাপদ অস্তিত্বকে’। এই সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হয় ১৭ ডিসেম্বর ১৯৯৬ যখন মহাশ্বেতা দেবী বাংলাদেশে ইলিয়াসের আতিথ্য গ্রহণ করেন। ৯৬-এর ডিসেম্বরে এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের পর ৯৭-এর জানুয়ারিতে ইলিয়াস মারা যান। এই সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছিলেন তসলিমা আখতার। মহাশ্বেতা ও ইলিয়াসের এই সাক্ষাৎকারটি পাঠক পেতে পারেন অর্ক দেব সম্পাদিত ‘কথাবার্তা’ নামক এক অসামান্য সাক্ষাৎকার সংগ্রহে। মহাশ্বেতা দেবী যে শবর, সাঁওতাল, ভীল এই ধরনের আদিবাসীদের সঙ্গে থেকেছেন দীর্ঘদিন এবং লিখেছেন তাদের ওপর অত্যাচারের বিবরণ সেকথা আমরা সবাই জানি।

কবি সুমন গুণ তাঁর ‘সংগ্রহ’ কবিতায় এইভাবে আমাদের মনে ভাঙা কাচের টুকরো ঢুকিয়ে দিয়েছেন যা আমি পাঠক হিসেবে উপড়ে ফেলতে পারছি না। এই কবিতায় ‘বর্জ্যের তৈজস’ শব্দটি যেমন মারাত্মকভাবে নেমে এসেছে, তার তুলনায় সভ্যতার প্রকাশ্য ময়লা এবং মেয়ে দুটি যে ‘নোংরা থেকে খুঁটে নেয় অবশিষ্ট গোপন রসদ’ এই দুটি প্রয়োগও আমাকে ঘুমছুট করে দেয়। কেননা ওই রোগা কালো মেয়ে দুটি যে ময়লা কুড়োতে বাধ্য হচ্ছে তার পিছনে যে সমাজের হাত আছে সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত একজন ব্যক্তি আমিও কি নই? তবে ভুলে গেলে চলবে না কবি সুমন গুণ এ-কবিতায় একাধিকবার আমাদের জানিয়েছেন এই রোগা কালো দুটি মেয়ে কখন আসে। তারা আসে সাড়ে চারটেরও আগে, ভোরে। অর্থাৎ ব্রাহ্ম মুহূর্তে। আমরা মনে না করে পারি না যে রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন ব্রাহ্ম মুহূর্তে উঠে আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকতেন সূর্যদেবকে উদিত হতে দেখবেন বলে। আর ‘সংগ্রহ’ কবিতার কবি, সুমন গুণ, সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে আমাদের দেখিয়ে দিলেন সভ্যতার ভুক্তাবশিষ্ট দুটি রোগা কালো মেয়েকে যারা ডাস্টবিন থেকে নোংরা কুড়োতে আসে। দুই যুগের দুই কবি দৃষ্টির এক মহাসংঘাত রচিত হল যেন!
এরপর আমরা অন্য একটি কবিতা দেখে নিই —
হিংস্র
তুমি কি ইস্কুলে যাও? এই ছেলেটির
দিকে চেয়ে মনে মনে আমি
বলি, এখন তো বারোটা, তুমি
এভাবে খালি গা, হাফপ্যান্ট পরে দুপুরের রোদে
রাস্তায় ছুটছ কেন? বাড়িতে কি কেউ
নেই, মা, রাগী দিদি, চৌকিতে বিরক্ত বাবা?
এই
কোনওদিকে না-তাকানো হিংস্র অবেলায়
ছেলেটি, সর্বাঙ্গে গতি, কেন স্কুলে যেতে পারল না?

এই কবিতার লক্ষ্য একটি খালি গা হাফপ্যান্ট পরা বালক যে রাস্তায় দৌড়চ্ছে দুপুরের রোদে। শুধু এইটুকু দৃশ্যকে ভেদ করেই সুমন গুণের কবিত্বের চোখ দেখতে পেয়ে গেল একটি অভাবী সংসারকে—যে সংসারের জন্ম হয়েছে বলে এই বালকটি স্কুলে যেতে পারল না! কবিতার নাম ‘হিংস্র’। কেন এই নামকরণ? প্রথমত বালকটির দৌড়নোর মধ্যে এক ক্রোধের ভঙ্গি পর্যবেক্ষণে এল কবির—দ্বিতীয়ত এই যে সব বালকরা স্কুলে যাওয়ার সংগতি ও অধিকার পেল না তাদের মধ্য থেকেই তো ভবিষ্যতের সমাজবিরোধী ওয়াগন ব্রেকাররা তৈরি হয়ে ওঠে! এদিকেও ইঙ্গিত পাঠায় ‘হিংস্র’ এই নামকরণটি।
কোনও পাঠক প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই নামকরণটিকে লক্ষ্য করে আমি বড় বেশি অনুমানের আশ্রয় নিচ্ছি অথবা অনুমানের আশ্রয় নিয়েছেন কবি স্বয়ং। এর উত্তরে শুধু একটাই কথা বলব: কবি ও বিজ্ঞানীর দৃষ্টি কোথাও কোথাও এক। বিজ্ঞানী প্রথমে যা অনুমান করেন পরবর্তী সময়ে সে কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয় মহাজগতে। আইনস্টাইনের মহাকর্ষ সূত্র অব্যর্থভাবে প্রমাণিত হল মাত্রই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে—যখন মহাকাশে অবস্থিত স্পেস স্টেশনে রাখা গ্রাহক যন্ত্রে ধরা পড়ল ১৫০ লক্ষ বছর আগে দুটি ব্ল্যাকহোলের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে, একটি অপরটির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়—এবং সেই সংঘাত থেকে উৎপন্ন তড়িৎ-চৌম্বকীয় ঢেউ এত বছর ধরে মহাশূন্যে দৌড়তে দৌড়তে এসে আজ এই ২০১৮-তে ধরা দিল মানুষের স্থাপিত গ্রাহকযন্ত্রে। সেই সঙ্গেই প্রমাণিত হল আইনস্টাইন যা একসময় বলেছিলেন সূত্রাকারে তা সে-মুহূর্তে অনুমান বলে মনে হলেও আজ তা সত্য হিসেবে নিজের প্রমাণ দিল। এই ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তর থেকে তো একবিন্দু আলোও নির্গত হয় না—তবে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব প্রথম কীভাবে জানতে পেরেছিল বিজ্ঞানীরা? তার জন্য কি অনুমানের প্রয়োজন হয়নি? বিজ্ঞানে যা একসময় অনুমান, পরে তা-ই প্রমাণ।
আরও পড়ুন: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা: ‘অবচেতনের উদ্ধার’
যদি গণিতের দিক দিয়ে ভাবি তা হলে শূন্যের আবিষ্কার কি আসলে একরকম অনুমানই নয়? ৯টি দেশলাই কাঠি অথবা ৯টি কলম পাশাপাশি রাখলাম। পরের দেশলাই কাঠি অথবা কলমটি রেখে বললাম : এই হল ১০ নম্বর! এই শূন্যটা এল কোথা থেকে? এ তো অনুমান! অথচ এই শূন্যের আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই গণিতে ও মানবসভ্যতার বিরাট অগ্রগতি ঘটে। আমাদের এই কবিও তাই দুপুর ১২টার রৌদ্রে খালি গা হাফপ্যান্ট পরা একটি বালকের দৌড়নো দেখেই সে-বালকের দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবার দেখতে পেয়েছেন— কবিতার নামকরণ করেছেন ‘হিংস্র’ শব্দটি দিয়ে, কেননা এইরকম বালকরাই একদিন বড় হতে হতে অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনে হাতে অস্ত্র তুলে নেয় সমাজবিরোধীরূপে, বিপক্ষ দলের অথবা পুলিশের গুলি খেয়ে নিহত হয়। ছোট্ট এই কবিতাটি আমাদের এই সমাজকে এইভাবে পরিস্ফুট করে তুলল। কবির অনুমান-দৃষ্টির কথা বলছিলাম এতক্ষণ। এবার আরও একরকম অনুমানের দিকে যাই, সুমন গুণ লিখিত আরও একটি কবিতা পাঠকের সামনে আনি তবে:
মেঘলা
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে অনুরাধা নামের মেয়েটি
কী করে জানলাম ওর নাম? নীল-পাড় শাড়ি
বাঁ হাতে একটু তুলে, পা টিপে টিপে, ডানহাতে
সাইডব্যাগ সামলে একা যেভাবে সে হেঁটে যাচ্ছে পিছল রাস্তায়—
এই বিকেলে, এই মেঘলা, ভিজে আর দূরের বিকেলে
আমার যে কেন দেখে মনে হল স্কুলে ওকে শান্তা দিদিমণি
রোল কলে এভাবে ডাকেন : ১২, অনুরাধা, কাল আসোনি কেন?…

আগের কবিতাটিতে ছিল স্কুলে যাওয়ার সুযোগ না-পাওয়া একটি বালকের রাস্তায়-রাস্তায় দৌড়নো। আর এ-কবিতায় রয়েছে স্কুল থেকে ফিরে আসা, সাইডব্যাগ সামলানো, বৃষ্টি থেমে যাওয়া পিছল রাস্তায় নীলশাড়ি পরা একটি কিশোরীর সাবধানে হেঁটে যাওয়া। ‘বৃষ্টি’ কথাটি পুরো কবিতায় কোথাও নেই। তবে আমি ‘বৃষ্টি থেমে যাওয়া’ বললাম কেন? কারণ, ‘ভিজে’ কথাটি আছে কবিতায়, রাস্তা যে ‘পিছল’ সে-কথাও জানাতে ভোলেনি কবিতা। সর্বোপরি এ-কবিতার শিরোনাম ‘মেঘলা’। এ-কবিতায় কথক নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছেন মেয়েটির নাম তিনি কী করে জানলেন? সে-প্রশ্নের উত্তর অবশ্য কবিতায় নেই। না থাকার-ই কথা। তবে কবিতার প্রথম লাইনেই আছে ওই কিশোরীর নাম ‘অনুরাধা’। যেহেতু কবিকথক কোনও উত্তর দেননি, মেয়েটির নাম তিনি কী করে জানলেন? তাই একে আমরা এক জাগ্রত স্বপ্নধারণা বলতে পারি। দেখামাত্র এক অপরিচিতাকে আমরা কি মনে-মনে কোনও নাম দিয়ে দিই না? কবিতা লিখতে বসে মনে-মনে তাকে সেই নাম ধরে ডাকি নাকি? এও তেমনই এক ডাক! কিন্তু সেই ডাক কীভাবে আচমকা বাঁক নিয়ে কবিতাটিকে এক মায়া পৃথিবীতে উড়িয়ে নিল!
‘আমার যে কেন দেখে মনে হল স্কুলে ওকে শান্তা দিদিমণি রোল-কলে এভাবে ডাকেন: ১২, অনুরাধা, কাল আসোনি কেন?…’
কোনও অপার্থিব স্বর্গের উর্বশী নয়, এই স্কুলের কিশোরী—তবুও সে এক অপূর্ব মাধুর্যে যেন মিশে গেল শান্তা দিদিমণির ওই রোলকলে। বাঙালি জীবনের মাধুর্য! এখানে ছন্দ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি কথা বলে রাখি, অবশ্য কবিতায় যাঁরা ছন্দ স্বীকার করেন না তাঁরা এই সূক্ষ্ম কারুকাজটি নজর করবেন না নিশ্চয়ই। এবং আমি এ-কথাও মনে করি না যে কবিতায় ছন্দ স্বীকার করা আবশ্যিক কোনও কর্তব্য। তবে ছন্দ না জানলে, ছন্দের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য-উদ্ভাস ছন্দ না-জানা কবিতা লেখককে আনন্দ দিতে পারবে না ঠিকই। কিন্তু কোনও কবিতায় ছন্দ যখন আছে, তখন যদি তার কোনও আশ্চর্য শ্রুতিধর্ম ধরা পড়ে, তবে পাঠক হিসেবে আমার তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। সেই ঔচিত্যবোধের বশবর্তী হয়েই আমি ‘মেঘলা’ কবিতার শেষ লাইনটি আরেকবার পাঠককে পড়ে শোনাই: ‘রোল-কলে এভাবে ডাকেন: ১২, অনুরাধা, কাল আসোনি কেন?…’ ২২ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে প্রস্তুত এই লাইনটির শেষ তিনটি শব্দ হল ‘কাল আসোনি কেন?…’। এখানে উচ্চারণটি কীভাবে আসছে? ‘কালা সোনি কেন…’। অর্থাৎ ‘কাল’ শব্দটির শেষ অক্ষর ‘ল’-এর ভেতর প্রবিষ্ট হচ্ছে ‘আ’ অক্ষরটি। তাই মাত্রাসাম্য বজায় তো থাকছেই সেই সঙ্গে সংলাপের অনায়াস স্বাভাবিকতা ক্লাসরুমের ভিতরকার পরিবেশ অবিকল তুলে আনছে। আরও লক্ষ্যণীয় ১২ সংখ্যাটি অক্ষর ব্যবহার না লিখে সংখ্যাকে সরাসরি ব্যবহার করায় কবিতাটিতে এক নতুনত্ব এল।
এই ডাক থেকেই আমরা পৌঁছে যাব ‘ডাক’ নামক অপর একটি কবিতায়। এ-লেখায়, সুমন গুণের সংহত, সংক্ষিপ্ত ও ঘনত্বময় কাব্যপথ দেখা দেবে।
ডাক
দূরের বাড়ির ছাদে বসে আছে যে-মেয়েটি, তার
ডাক নাম কেয়া, তাকে
ছোটমা ঝিনুক বলে ডাকে

একটি কবিতা যে কতদূর উচ্চাশাবিহীনভাবে লেখা যায়, একজন পাঠক পাওয়ারও প্রত্যাশা না রেখে এই কবিতাটি তার একটি নির্লোভ প্রমাণ। অথচ এত সামান্য শব্দেই মনে এক অকূল মাধুর্য জেগে ওঠে কেয়া বা ঝিনুক নামে ওই না-দেখা মেয়ের জন্য। এর পরে আমরা আরেকটি ছোট্ট কবিতায় যাব :
পাকা দেখা
যাত্রা হবে, সিঁদুর নিও না মুছে, আটটা থেকেই
মাইক বাজছে, মাঠে লোক, বেলুন ফুলিয়ে
দৌড়চ্ছে হাফপ্যান্ট, তার দিদি
রাস্তা থেকে প্যান্ডেল দেখছে, জানে সামনের পৌষেই
বান্ধবনগর ছেড়ে চলে যাবে, পাকা-কথা কাল
এ-কবিতাও মাত্র ৫ লাইনেই সম্পূর্ণ হয়েছে। অথচ এই কবিতার ভেতর মুখ লুকিয়ে বসে আছে একটি অসামান্য ছোটগল্প। এত অল্প কথায় এতটা বলে উঠতে পারা মোটেই সহজ কাজ নয়। নিজে কিছু কিছু লেখার চেষ্টা করি তাই জানি কবিতাটির শুরুতে আমরা দেখি ‘যাত্রা হবে’ কথাটি। একটি কমা ব্যবহারের পরেই আসছে এমন একটি ৮ মাত্রার বাক্যবন্ধ যা আজকের দিনের তরুণ-তরুণীদের কাছে খুব অচেনা ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তাই একটু খুলে বলি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামেগঞ্জে একসময় একটি যাত্রাপালা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। রথযাত্রার দিন, প্রত্যেকটি বাংলা দৈনিকে সেই যাত্রাপালার একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নামগুলিও থাকত সেখানে। সেই যাত্রাপালাটি হল : ‘সিঁদুর নিও না মুছে’। কবি সুমন গুণ কোনও উদ্ধৃতচিহ্ন ছাড়াই সরাসরি সিঁদুর নিও না মুছে যাত্রাপালা নামটি ব্যবহার করেছেন। কেন এমন করলেন তিনি? সে-বিষয়ে আমার ধারণা কী তা পরে বলছি। আগে বলি এই ৫ লাইনের কবিতাটির মধ্যে গ্রামে যাত্রাপালা হওয়ার আগে থেকে কী ধরনের আয়োজন ও সমারোহ ঘটে তার অত্যন্ত নিপুণ বিবরণ ফুটিয়ে তুলেছে এই কবিতা স্কেচের মতো অত্যল্প আঁচড়ে। সেখানেও একটি বালককে দেখা যাচ্ছে। সেও দৌড়চ্ছে। তবে ক্রোধে নয়, আনন্দে। কেননা তার দিদির বিয়ে ‘সামনের পৌষেই’. এবং তার দিদি ‘বান্ধবনগর’ ছেড়ে চলে যাবে—এইবার আসছে কবিতার নামকরণের সঙ্গে সংযুক্ত মূল প্রসঙ্গটি—‘পাকা-কথা কাল’। এবার যদি আমরা কবিতার নামকরণের দিকে ফিরে যাই কী দেখব? দেখব কবিতার নামকরণ ‘পাকা দেখা’। এ কবিতার মধ্যেও একটি তরুণী উপস্থিত। শহরের মেয়ে নয়—গাঁয়ের মেয়ে। যাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে যাত্রাপালা ইত্যাদি দেখা বারণ হয়ে যায়। তাই, সে-তরুণী রাস্তা থেকে প্যান্ডেল দেখছে। আর এখানেই একটি গভীর দুঃখবোধও খুব গোপনে বুনে দিয়েছেন এই কবিতার লেখক ওই তরুণীর মনে। কারণ, সে জানে তার বিয়ে হয়ে যাবে, জানে বাল্যকাল থেকে বেড়ে ওঠা এই গ্রাম ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে পরের ঘরে, কোনও অচেনা সংসারে—যে সংসারকে আজীবন তাকে বলতে হবে তার নিজের সংসার। কোনও মেয়ের যখন বিয়ে স্থির হয়ে যায়—বাবা-মার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে—তখন একদিকে তার মনে একরকম সুখবোধ কাজ করে নিশ্চয়ই কিন্তু সেই সঙ্গে অজানা ভয়ও কাজ করে। এ বিয়ে টিঁকবে তো? স্বামী ফেরত দিয়ে যাবে না তো বাপের বাড়িতে? অথবা ভাগ্য বৈগুণ্যে স্বামীহারা হবে না তো সে কোনওদিন? কারণ, স্বামীকে পাওয়া মানেই তো স্বামীকে হারানোর ভয়! সেই কারণেই, আমার ধারণা, ‘সিঁদুর নিও না মুছে’ নামক যাত্রাপালার নাম ব্যবহারের সময় এই কবিতায় উদ্ধৃতিচিহ্নটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন কবি কারণ, কথাটি হয়ে গেছে মেয়েটিরই গোপন আশঙ্কার কথা। এইখানেই কবির নিপুণতার পরিচয়। এ-কবিতায় ‘বান্ধবনগর’ বলে একটি শব্দ আছে। মেয়েটি তার নিজের গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে স্বামীর ঘরে। মেয়েটির গ্রাম তার কাছে কী? তার বান্ধবনগর। কত সই-সখী-সহেলী তার এই গ্রামে। কত মাঠ-পুকুর-গাছপালা, কুকুর-বেড়াল তার এই গ্রামে, সবই তার চেনা। সবাই তার বন্ধু। এখানে বলে রাখা দরকার যে ‘বান্ধবনগর’ শব্দটি কবি সুমন গুণ নিজের কবিতায় একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নামই ‘বান্ধবনগরে বাড়ি’। অর্থাৎ এই কবি মনে করেন যা আমরা সবাই এক বান্ধবনগরে বসবাস করি। সবাই সবার বান্ধব। সেই গুরুত্বপূর্ণ স্বর তাঁর কাছে বান্ধবনগর। থাকুক না এদেশে-ওদেশে, এ জেলায়-ও জেলায় বহুবিধ রাজনৈতিক দল। ঘটুক না হানাহানি। পারমানবিক যুদ্ধের ভয় ঝুলে থাক না আমাদের মাথার ওপর। তবু এই কবির কাছে আমাদের বসতি, আমাদের পল্লী, আমাদের পাড়া—আমাদের সমগ্র পৃথিবী এক বান্ধবনগর ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই ভাবনার মধ্যেই আছে এক মহত্ব। কোনও মানুষই চিরদিন বেঁচে থাকে না। বেঁচে থাকে তার চিন্তার মহত্ব।

পাকা দেখা মানে তো বিবাহ? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু সে-বিবাহ এখন সম্পন্ন হয়নি। সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনাকেই নিশ্চিত করছে মাত্র। তাহলে বিবাহ প্রসঙ্গে আমরা আরেকটি কবিতায় যাই? কবিতাটি এইরকম:
রূপকথা
বিয়ে আসছে, তাই দৌড়ে দোকান থেকে
বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল, টেবিলে
চলকে গেল খদ্দেরের চা।
তোর বাবার বিয়ে নাকি রে : হাঁটু মুড়ে
ক্যাশবাক্স সামনে নিয়ে মালিক চেঁচাল।
বাজনা বাজছে, ভিড়, অনেকগুলো গাড়ি, ঘাড় গুঁজে
ছেলেটা খুঁজছে :
লাল শাড়ি, সারা-গা-গয়না
নতুন বউয়ের ফরসা মুখ
এ কবিতায় দেখা যায় চায়ের দোকানে কাজ করা একটি ছেলেকে। এই ছেলেটিও দৌড়চ্ছে। তার মালিকের ধমক উপেক্ষা করে দৌড়চ্ছে। আমরা, সুমন গুণের কবিতায়, ৩টি ছেলেকে ৩ বার দৌড়তে দেখলাম। ৩টি দৌড় তিনরকম কেননা দৌড়ের কারণগুলি ভিন্ন।
এই কবিতায় ক্যাশবাক্স নিয়ে বসা যে মালিক তাকে আমরা সকলেই চিনি। কখনও না কখনও দেখেছি, দেখেছি সেই নিষ্ঠুর মালিককে। চায়ের দোকানে কাজ করা ছেলেটিকে আমরা সকলেই দেখেছি। তার অভাব ও হতদরিদ্র অবস্থা দেখেছি। কিন্তু কেউ তার মনের রূপকথাটি দেখিনি। অন্তত আমি তো দেখিইনি। সমস্ত শাসন অগ্রাহ্য করে যে রূপকথা খুঁজতে চায় : ‘লাল শাড়ি, সারা-গা-গয়না/নতুন বউয়ের ফরসা মুখ’। ওই চা দোকানের শ্রমিক ছেলেটি মধ্যেও যে এমনই একটি রূপকথার আশা জেগে আছে তা আমি কি কখনও কোনও কবিতায় পড়েছি? মনে পড়ছে না। বরং মনে পড়ছে : ‘ঘরেতে এলো না সে তো মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া/পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর’! মহাকবির লেখা এ-কবিতাকে যদি আমরা চিরদিনের কবিতা বলে স্বীকার করে নিই, তাহলে আজকের শ্রমিক যুবকের মনে চাপা পড়া রূপকথাকে যে কবিতা প্রকাশ করে সেও তো চিরস্থায়ী কবিতা-ই। আর কারোর কাছে না হোক, আমার কাছে তো বটেই। কারণ, বাজনা বাজছে, অনেকগুলো গাড়ি, ভিড়—এই সবকিছুর মধ্যে মালিকের আদেশ অমান্য করে দৌড়ে আসা শ্রমিক ছেলেটি খুঁজছে তার রূপকথা। এ-কবিতায় আমার কাছে কাব্যশক্তির সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত বলে মনে হয়েছে কবিতার শিরোনামটিকে। এমন রূপকথা আমাদের সবার মধ্যে আছে, থাকে, মরে যায়, আবার বেঁচে ওঠে। কারণ, রূপকথার মৃত্যু নেই।

এইমাত্র রূপকথা সম্পর্কে এতসব বললাম তো! রূপকথা তো চিরদিনের, সে কথাও বললাম। এবার যে কবিতাটি পাঠকদের পড়তে দেব তার নাম ‘তাৎক্ষণিক’। কবিতাটি দেখি :
তাৎক্ষণিক
ছড়ানো মাঠের একটা পথ দিয়ে চলে যাচ্ছে দূরে
নিমতিতা গ্রামের মেয়েটি।
গঞ্জের দোকান থেকে ফিরে এল, সারাদিন বাধ্যতামূলক
সেলাইয়ের পরে হাতে সমাজসম্মত রোজগার।
বাড়িতে শুকনো মা, ক্ষতবিক্ষত বাবা, আর রোগা ভাই।
ফিরে গিয়ে, অর্জিত আনাজ, মশলা, ভাতের সংসার
সামলে, ভাইয়ের পড়া দেখিয়ে ঘুমোতে যাবে নির্ধারিত মেঝেতে, চাদরে
এই কবিতায় আবার আমরা কবির এক দৈবদৃষ্টি অনুভব করি। প্রথম দুটি লাইনে শুধু এইটুকু বলা আছে যে ছড়ানো মাঠের মাঝখানে একটা সরু পায়ে-চলা পথ দিয়ে দূরে চলে যাচ্ছে একটি মেয়ে। স্পষ্ট বোঝা যায় দূরপাল্লার বাস বা ট্রেনের জানলা থেকে একপলক দেখা গেছে সেই মেয়েটিকে। বাকি কবিতার মধ্যে যে ভারতবর্ষের জননীআত্মা স্থাপিত তার উদ্বোধন ঘটিয়েছেন এই কবিতালেখক সম্পূর্ণ নিজের সামর্থ্যে! একে যদি আমরা কবি কল্পনা বলে তুচ্ছ করি তাহলে আমরা নিজেদেরই প্রবঞ্চনা করব। এই মেয়েটিও একজন শ্রমিক। যে গঞ্জের দোকানে সারাদিন বাধ্যতামূলক সেলাইয়ের কাজ করার পর সামান্য উপার্জন হাতে বাড়ি ফিরবে। বাড়ির পথে যাওয়ার সময় বাজার ঘুরে কিনে নিয়ে যাবে আনাজ, চাল-ডাল। রান্না করবে বাড়ি গিয়ে। তার বাড়িতে শুকনো মা। মায়ের আগে ‘শুকনো’ কথাটি বসিয়ে কেবল দারিদ্র্য আর দুঃশ্চিন্তাপীড়িত মাতৃরূপ উন্মোচন করা হল না, উন্মোচিত হলেন এই দেশমাতৃকাও যার মাটি খরায় শুষ্ক। ক্ষতবিক্ষত বাবা, রোগা ভাই। ক্ষতবিক্ষত কেন? হয়তো কারখানায় লকআউট। রোগা ভাই, তবু সে-ই একমাত্র আশা। তাই শেষ লাইনে আমরা প্রথম শব্দ হিসেবে পাই ‘সামলে’—‘সামলে’র আগের লাইনে শেষ শব্দ দুটি কী? ‘ভাতের সংসার’। সেই ভাত কে রান্না করে? ওই মেয়েটি-ই কি? ওই নিমতিতা গাঁয়ের মেয়েটি? এই ‘নিমতিতা’ নামক গ্রাম নিশ্চয়ই অনুমান নয়। আমি বাসরাস্তার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম একটু আগে। হাইওয়ে ধরে যে বাসরাস্তা গেছে সেই রাস্তা নিমতিতা গাঁয়ের পাশ দিয়েই তো গেছে! নিমতিতা পার হয়েই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে মেয়েটিকে একা হাঁটতে দেখা গেল। অথবা নিমতিতা নামক ছোট্ট স্টেশনও থাকতে পারে। সেই স্টেশন ছাড়ালেই ওরকমই বিরাট তেপান্তর। মাঝখান দিয়ে চলেছে একটি মেয়ে।
একজন কবি, একজন অভিনেতা, একজন কথাসাহিত্যিক তাঁর সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যান নিজের পর্যবেক্ষণ শক্তিকে প্রয়োগ করেই। আমাদের এই ‘তাৎক্ষণিক’ নামক কবিতার লেখক ও প্রান্তরের মেয়েটিকে একঝলক দেখেই তুলে এনেছেন তার দরিদ্র সংসারের খুঁটিনাটি। তুলে এনেছেন তার আশা-আকাঙ্ক্ষাও। কী সেই মেয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা? ভাইকে বড় করা। ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তোলা। তাই শেষ লাইনে আমরা পাই ‘ভাইয়ের পড়া দেখিয়ে ঘুমোতে যাবে নির্ধারিত মেঝেতে, চাদরে।’ অর্থাৎ তাদের শোওয়ার জন্য একটা খাটও নেই বাড়িতে! তাই মেঝেতেই ঘুমোতে হয় সেই মেয়েকে। ‘কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে/সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে/বলিল : তোমারে চাই: দুইখানা হাত তার হিম/ চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম/ চিতা জ্বলে…’ জীবনানন্দের সেই প্রান্তরের নারীও এক সন্ধ্যায় হেঁটে চলেছিল। এই নিমতিতা গ্রামের মেয়েটিও হাঁটছে, দিনান্ত বেলায়। কিন্তু এই দুই নারীর সংঘর্ষে জেগে উঠল আজকের যুগ, এখনকার ভারতবর্ষ। এই মেয়েটির আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বললাম—তার ভাইকে ঘিরে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা। সংসারে সুদিন আসবে এইটুকু মাত্রই চাওয়া তার। কিন্তু ‘রূপকথা’ কবিতার চা দোকানের ওই শ্রমিক ছেলেটির সঙ্গে আমরা কি ‘সারাদিন বাধ্যতামূলক সেলাইয়ের’ কাজে নিয়োজিতা এই মেয়েটির দেখা করিয়ে দিতে পারি?
দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে ২৬ এপ্রিল
* অলঙ্করণ: চিরঞ্জিৎ সামন্ত
*ছবি সৌজন্য: Rawpixel, Artmajeur,
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।
অসাধারণ অন্তর্লীন বিশ্লেষণ।দু’জোড়া চোখের নিরীক্ষণ কখন একে অপরকে ছুঁয়ে পেরিয়ে যায় কবিতার অবাক প্রান্তর । শ্রদ্ধেয় কবিদ্বয় জয় গোস্বামী ও নির্মলেন্দু গুণ দু’জনকেই জানাই হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য এমন যুগলবন্দী উপহার দেওয়ার জন্য।
কবির আলোচনা আর এক কবির কবিতা মন ছুঁয়ে গেছে পরতে পরতে ।দুই কবির জন্য রইলো এক রাশ শ্রদ্ধা।