অমুকবাবু ডুব মেরেছেন বলে তাঁর বস তমুকবাবুর সকাল থেকেই মাথা গরম। এগারোটা নাগাদ আর থাকতে না পেরে তমুকবাবু, অমুকবাবুকে ফোন করলেন। লাউডস্পিকারে। দু’জনের কথোপকথন অনেকটা এ রকম —
–অমুকবাবু, প্রতি দশ দিনে আপনার একবার করে জ্বর আসছে। সে আপনার ছুটি আপনি নেবেন। কিন্তু ফাঁকিবাজির তো একটা লিমিট থাকে।
–বস্। মিথ্যে বলিনি বস্। একশো দুই টেম্পারেচার। কপাল পুড়ে যাচ্ছে।
–আপনাকে এই টিমে নিয়ে আমারও তো কপাল পুড়ছে অমুকবাবু। পই পই করে বলেছিলাম কাল ফাইলটা পাঠিয়ে বাড়ি যাবেন। পাঠাননি। এ বারে কী করব আমি?
–সরি বস্। এক্কেবারে রেডি ছিল। পাঠাতে ভুলে গিয়েছি। ডেস্কটপে সেভ করে এসেছি।
–তাই? আমার এক্ষুণি চাই ফাইলটা। এই যে আপনার কম্পিউটার অন করলাম। পাসওয়ার্ডটা বলুন।
(এটা সিনেমা হলে, সাবটাইটেলে লেখা হত— দীর্ঘশ্বাস)
–কী হল, চুপ করে আছেন কেন? বলুন।
–বস্। কাল সকালে এসেই দিয়ে দেব, সবার আগে। ফাইল রেডি আছে।
–বললাম তো, আমার এক্ষুণি চাই। ইউ আর ক্রসিং ইওর লিমিট। বলুন। কুইক।
–তমুকবাবু স্যার, প্লিজ স্যার।
–আমি ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেব। বলুন। ইয়ার্কি মারছেন আমার সঙ্গে সকালবেলায়?
–মুখে বলতে পারব না স্যার। আমি আপনাকে এসএমএস করে দিচ্ছি।
–ঠিক আছে। ডিজগাস্টিং।
এর পরে ঠকাস করে ফোন রেখে দেওয়ার শব্দ এবং তমুকবাবুর মোবাইলে পাখির শিসের আওয়াজ। তমুকবাবু ঘামতে শুরু করেছিলেন হঠাৎ। অমুকবাবুর থেকে তমুকবাবুর কাছে এসএমএস-এ যা লেখা এসেছিল তা হল bosskepetai7। মানে “বসকে পেটাই ৭।” পরের দিন অমুকবাবুর ডিপার্টমেন্ট বদল হয়েছিল। অমুকবাবুকে পরে চায়ের আড্ডায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, “গুরুদেব, বসকে পেটাই তো বুঝলাম। কিন্তু এর পরে আবার সাত কেন?” অমুকবাবু বলেছিলেন, “তিন মাস পর পর পাসওয়ার্ড বদলাই তো। সিকিওরিটি বলে কথা। বসকে পেটাই ১ দিয়ে শুরু হয়েছিল।”
অমুকবাবুকে পরে চায়ের আড্ডায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, “গুরুদেব, বসকে পেটাই তো বুঝলাম। কিন্তু এর পরে আবার সাত কেন?” অমুকবাবু বলেছিলেন, “তিন মাস পর পর পাসওয়ার্ড বদলাই তো। সিকিওরিটি বলে কথা। বসকে পেটাই ১ দিয়ে শুরু হয়েছিল।”
আমার এক বান্ধবী, সুকৃতি, সম্প্রতি মধ্যরাতে ফোন করে জানিয়েছিল যে সিদ্ধার্থর সঙ্গে ও আর একদিনও একসাথে থাকতে পারবে না। কারণ সিদ্ধার্থর জিমেল-এর পাসওয়ার্ড ছিল লাভইউনিশা। সুকৃতি বলছিল, “আজ আড়চোখে
না দেখলে জানতেই পারতাম না কোনওদিন। একটা দুশ্চরিত্র, লম্পট। আমার সঙ্গে ঘর করবে আর নিশার সঙ্গে প্রেম।” সিদ্ধার্থ পরে বলেছিল, ওর জীবনে নিশা নামে কারও অস্তিত্ব নেই। কোনও দিনও ছিল না। ‘একটা সামান্য পাসওয়ার্ড দিয়ে আমায় বিচার করল সুকৃতি?’
তিন চার দিন আগে একটা দিন চলে গেল চুপচাপ। ওয়ার্ল্ড পাসওয়ার্ড ডে। ৭ মে।
কেউ জানলই না। অথচ পাসওয়ার্ড নামক কয়েকটা মাত্র গুপ্ত অক্ষরে বাঁধা পড়ে আছি আমরা সবাই। সারা জীবন ধরে জমানো আর্থিক সঞ্চয় যেমন আটকানো থাকে মাত্র চারটে সংখ্যায়, ঠিক তেমনই প্রতিটা জীবনকাব্য যে অদৃশ্য ফিতে দিয়ে ঘিরে রাখি আমরা, তা হল পাসওয়ার্ড। এটিএম-এর পিন নম্বরের মধ্যে কোনও রোম্যান্টিকতা নেই, সৃজনশীলতাও নেই। ম্যাড়ম্যাড়ে চারটে সংখ্যা। এ ছাড়া অন্য সব পাসওয়ার্ড অক্ষর আর সংখ্যার যুগলবন্দি। আট থেকে ষোলো ডিজিট দিয়ে তৈরি নিজের গুপ্তকথা। আজকের এই অ্যানড্রয়েড বেঁচে থাকায়, এই ক’টা ডিজিটের বিশ্বাসে নিজেদের সর্বস্ব সঁপে দিই আমরা। আমার না বলা বাণী। অমুকবাবুর মতো স্ক্রিনে স্টার হয়ে ঝরে পড়া আমার ইচ্ছে-কথা।
গুগল পাসওয়ার্ডটা কেউ যদি জেনে যায় কী কী হতে পারে দেখি! ফোনের কন্ট্যাক্ট ডিটেলস গেল, ছবি যা তুলেছিলেন (ব্যক্তিগত-সহ) গুগল ফোটোজ় মারফৎ তাও গেল বেহাত হয়ে। বলে রাখা ভাল, শুধু এই ফোনে তোলা ছবি নয়, যাবতীয় ছবি যা এত দিন ধরে তুলেছিলেন এবং সিঙ্ক করেছিলেন গুগল ফোটোজ়-এ, ফুটে গেল সবই। সাধের ইমেলটাও গেল। পনেরো বছর আগে কাউকে যদি প্রেমপত্র লিখে থাকেন, প্রিয় অভিনেত্রীর একটা দুষ্টু ছবি যদি সেভ করে থাকেন ড্রাফট-এ, পরে দেখবেন বলে, খুল্লমখুল্লা হয়ে গেল তাও। গুগল ড্রাইভে যত্ন করে রাখা গোপনীয় নথিগুলোও আর ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’-র মতো হয়ে গেল। স্ক্রিনটা আড়াল করে ইউটিউবে কী কী দেখেছেন সেটাও বেরিয়ে এল খোলা চিঠির মতো। সোজা কথায় বলতে গেলে, মাত্র কয়েকটা গুপ্ত ডিজিট আমার ভিতরের আমিকে, আসল আমিকে নগ্ন করে দিতে পারে প্রকাশ্যে। গুগল অ্যাকাউন্ট একটা উদাহরণ মাত্র। আরও বহু ওয়েবসাইট, সার্চ ইঞ্জিনেও এই একই রকমের সুবিধা মেলে। এবং আশঙ্কাও।
পাসওয়ার্ডের জন্য বছরে একটা বিশেষ দিন পালন করার কথা যাঁর মাথা থেকে প্রথম বেরিয়েছিল তাঁর নাম মার্ক বার্নেট। পেশায় ডিজিটাল সিকিওরিটি গবেষক। ইনটেল সিকিওরিটি-র বড় পছন্দ হয়ে যায় মার্কের এই আইডিয়া। ঠিক হয়, প্রতি বছর মে মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার বিশ্ব পাসওয়ার্ড দিবস হিসেবে মেনে চলা হবে। ২০১৩ সাল থেকে শুরু। তার মানে এ বছরে অষ্টম বারের জন্য এই পাসওয়ার্ড দিবস পালন করা হল। প্রতি বছর যা হয়, এ বছরও তাই হল এই দিনে। সাইবার গবেষকরা একই রেকর্ড বাজালেন— পাসওয়ার্ড মজবুত করুন। পাল্টান নিয়মিত।

বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, মানুষের মন প্যাঁচালো হলেও পাসওয়ার্ড দেওয়ার বেলায় যাবতীয় প্যাঁচ খুলে যায়। সংসারের যাত্রামঞ্চে কোনখানে ঠিক কোন কাঠিটা নাড়লে আমার অপ্রিয় মানুষটাকে ভাল টাইট দেওয়া যাবে, ‘কেমন দিলাম, কেমন দিলাম’ গাইতে গাইতে চুলে বিলি কেটে দেবে বিকেলের হাওয়া— এমন ভাবতে আর আঁক কষতে আমাদের বড় আনন্দ হয়। সমস্ত ভাবনা হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করে পাসওয়ার্ড দেওয়ার বেলায়। তাই তো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা রেখেও কেউ নেট ব্যাঙ্কিং-এর পাসওয়ার্ড দেন নিজের জন্মতারিখ। ইমেলের পাসওয়ার্ড হিসেবে অবলীলায় লিখে রাখেন বৌয়ের নাম। দুনিয়াজোড়া হ্যাকাররা এমন মধুর জন্যই তো ওঁৎ পেতে বসে থাকেন। সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে পরামর্শ দেন যাঁরা, তাঁরা বলেন পাসওয়ার্ড হওয়া উচিত কঠিন, আন্দাজ করা শক্ত, এমন কিছু সংখ্যা ও অক্ষরের সমষ্টি। বিভিন্ন ইমেল অ্যাকাউন্ট থাকলে, প্রতিটার জন্য আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ডের বন্দোবস্ত করতে হবে। যেন একটি খোওয়া গেলেই সবক’টা এর শিকার না হয়। কিন্তু কে কার কথা শোনে! একটা সমীক্ষা বলছে, বিশ্বের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ সাকুল্যে একটি পাসওয়ার্ড দিয়েই একাধিক অ্যাকাউন্ট চালান।
বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, মানুষের মন প্যাঁচালো হলেও পাসওয়ার্ড দেওয়ার বেলায় যাবতীয় প্যাঁচ খুলে যায়। সংসারের যাত্রামঞ্চে কোনখানে ঠিক কোন কাঠিটা নাড়লে আমার অপ্রিয় মানুষটাকে ভাল টাইট দেওয়া যাবে, ‘কেমন দিলাম, কেমন দিলাম’ গাইতে গাইতে চুলে বিলি কেটে দেবে বিকেলের হাওয়া— এমন ভাবতে আর আঁক কষতে আমাদের বড় আনন্দ হয়। সমস্ত ভাবনা হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করে পাসওয়ার্ড দেওয়ার বেলায়।
তবে উল্টোটাও দেখেছি। এক অতি সচেতন মানুষের কথা জানি। পৃথিবীর যে কোনও জায়গা থেকেই সাইবার ক্রাইমের খবর কানে এলে তাঁর রাতে ঘুম হত না। কাজে মন বসাতে পারতেন না। ঠিক করেছিলেন, হ্যাকারদের জব্দ করবেন। ভদ্রলোকের পাঁচটা ইমেল অ্যাকাউন্ট ছিল। সাধারণত এমন পাসওয়ার্ড দিতেন— h9$g@k9, vO_$w6#F, xC8m!5!dP ইত্যাদি। পাঁচটা ইমেলের এমন ভয়ানক পাঁচটা পাসওয়ার্ড ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাসওয়ার্ড মনে রাখতে হবে, কোথাও লিখে রাখা চলবে না। ওই উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে, পাসওয়ার্ড মনে রাখতে গিয়ে প্রলাপ বকা শুরু করলেন যখন, ঠিক করলেন এগুলো লিখে রাখতেই হবে কোথাও। একটি এক্সেল ফাইল খুলে লিখে রাখলেন সব। এবারে ওই এক্সেল ফাইলটি খোলার জন্যও এমন ভয়ানক একটি পাসওয়ার্ড রাখলেন। ‘মস্ত বড় এক কাজ’ হওয়াতে খুশিতে ঢকঢক করে কোল্ড ড্রিঙ্ক খেলেন। এবং, বোতলটা দোকানের পাশে ক্রেটে নামিয়ে রাখার সময়ই উপলব্ধি করলেন, এক্সেল ফাইল খোলার পাসওয়ার্ডটা ভুলে গিয়েছেন। ভদ্রলোককে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, “আপনি চাইলে আমার কোনও নিউরোসার্জন বন্ধুকে বলে নতুন পাসওয়ার্ডটা আপনার খুলিতে ট্যাটু করে লেখানোর ব্যবস্থা করতে পারি।”
তবে কেউ জানবেও না আর মনে রাখারও ঝামেলা নেই— এমন পাসওয়ার্ড কী দেওয়া যেতে পারে? স্কুলজীবনে এক বন্ধুর কাছ থেকে এর এক আশ্চর্য সমাধান শুনেছিলাম। তখন পাসওয়ার্ডে এত ছোট হাতের, বড় হাতের অক্ষর আর সংখ্যা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। বন্ধুটা বলেছিল, আমি আমার পাসওয়ার্ড রেখেছি ‘ইনকারেক্ট’। ভুল কিছু টাইপ করলেই কম্পিউটার বলে দেয়, ‘ইওর পাসওয়ার্ড ইজ ইনকারেক্ট!’
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
দূর্দান্ত। এই নিয়ে আমিও একটা লিখেছিলাম, ছেলেরা পাসওয়ার্ড এ লিখে রাখে পুরনো প্রেমিকার নাম।
Daroon.