আবাল্য সুহৃদ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন: ‘ …গোলাভরা ধানের মতোই তার ছিল গলা-ভরা গান।’

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়( ১৬.০৬.১৯২০ – ২৬.০৯.১৯৮৯) সংস্কৃতির এক চির-উজ্জ্বল নক্ষত্র। লাবণ্যময় কণ্ঠে আর মাধুর্যময় সুরে তিনি শ্রোতাদের মোহিত করেছেন এক দীর্ঘ সময় ধরে। মৃত্যুর তিন দশক বাদেও তিনি সমান আদরণীয়।

ছোটবেলা থেকেই গান-বাজনার ভক্ত হেমন্ত ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময় একান্ত বন্ধু হিসেবে পেলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও রমাকৃষ্ণ মৈত্রকে। সুভাষই তাঁকে নিয়ে যান বেতারে, বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানিতে। অডিশন দিয়ে প্রথম বেতার-অনুষ্ঠানে হেমন্ত গাইলেন সুভাষেরই লেখা আমার গানেতে এলে চিরন্তনী’, নিজে সুর দিয়ে। কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানির শৈলেশ দত্তগুপ্তের খুব পছন্দ হল হেমন্তর গলা। ১৯৩৮-এর মে মাসে নরেশ্বর ভট্টাচার্যের কথায়, শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে হেমন্তের প্রথম রেকর্ড: জানিতে যদি গো তুমি’ এবং বল গো বল মোরে’ ( GE 2464)

hemanta mukhopadhyay indiatimes
লাবণ্যময় কণ্ঠ আর মাধুর্যময় সুর ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ঐশ্বর্য

সেসময় সাহিত্যচর্চাও করেছেন হেমন্ত। লিখেছেন গল্প। দেশ’ পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছিল। তবে প্রথম রেকর্ডেই তুমুল সমাদর পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সঙ্গীতেই সমর্পিত হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। চলচ্চিত্রে প্রথম নেপথ্যে গাইলেন শচীনদেব বর্মনের সুরে রাজকুমারের নির্বাসন’ (১৯৪০) ছবিতে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম বেসিক রেকর্ড ১৯৪৪-এ, অনাদিকুমার দস্তিদারের পরিচালনায় আমার আর হবে না দেরি’ এবং কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’। এইভাবে বেসিক, আধুনিক, ছায়াছবির গান ও রবীন্দ্রসঙ্গীত কণ্ঠে নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চললেন হেমন্ত। 




শিল্পী হেমন্তর প্রধান সম্পদ, তাঁর মধুমাখা কণ্ঠ
, স্পষ্ট উচ্চারণ, স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গি। দেবতারা গান গাইলে এমন কণ্ঠে গাইতেন, বলতেন সলিল চৌধুরী। হেমন্তের গলার ভক্ত নামী-অনামী থেকে সাধারণ আবালবৃদ্ধবনিতা, সকলেই। শচীনদেব বর্মন, পঙ্কজকুমার মল্লিকের গুণমুগ্ধ হেমন্তের প্রথম দিককার কথা কোয়ো নাকো’, ‘সেদিন নিশীথে বরিষণশেষে’ বা রজনীগন্ধা ঘুমাও’ গানে উক্ত পূর্বসূরীদের প্রভাব বোঝা যায়। তাঁর গায়নে অনেকটা স্বকীয়তা এল চারের দশকের শেষার্ধে, যখন রেকর্ডে গাইলেন নবীন সলিল চৌধুরীর কথায়-সুরে কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা।’ অভিনব কাহিনি-গান, কী বিষয়ে কী সুরের আঙ্গিকে। চিরাচরিত প্রেম নয়, এক প্রান্তিক গাঁয়ের বধূর আশা ও আশাভঙ্গের কথা এখানে, সুর ও ছন্দবিন্যাসও স্বতন্ত্র। তালফেরতা আসে গানের কথা অনুযায়ী। হেমন্তই নির্বাচন করেছিলেন এই গান, তাই সলিল সঠিকভাবেই মনে করেছিলেন হেমন্তদা না থাকলে তিনি সলিল চৌধুরী হতে পারতেন না।

সার্থক জুটি সলিল-হেমন্তর সার্থক সৃষ্টি কত না গান: পথ হারাব বলেই এবার’, ‘আমি ঝড়ের কছে রেখে গেলাম’, ‘পথে এবার নামো সাথী’, ‘মনের জানালা ধরে’,শোনও কোনও একদিন’ ইত্যাদি। সলিল সুরারোপিত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’ বা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পালকি চলে’ হেমন্তের কণ্ঠে প্রাণ পায়। সুরের চকিত ওঠানামা, ছন্দবিন্যাস– সব দিকেই সলিলের সুর একেবারেই সহজ পথে হাঁটে নাআর হেমন্ত তাঁর গানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার। অথচ হেমন্তের ক্ষেত্রে একটা কথা খুবই চালু যে, হেমন্ত নাকি সহজ সুরের গানেই সার্থক। আসলে, রাগাশ্রিত হলে বা কিছু অলংকরণ যুক্ত করলেই গান কঠিন হয় না। অপ্রত্যাশিত স্বর-ছন্দবিন্যাসেও গান জটিল হতে পারে। এমন উদাহরণ অজস্র রয়েছে সলিল চৌধুরীর ক্ষেত্রে। তা ছাড়া অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষের গানেও। 




সুরের চলন সহজ নয়
, এমন অনেক গানেরই সফল রূপদাতা হেমন্ত। সূক্ষ্ম অলংকরণ সমৃদ্ধ পাঞ্জাবি হির’ বাংলা গানে প্রথম প্রয়োগ করলেন অনুপম ঘটক শুকনো শাখার পাতা’-তে (কথা: হীরেন বসু)। এই কঠিন গানকে অবলীলায় কণ্ঠে ধরলেন হেমন্ত। আবার অনুপমের সুরে শ্রী তুলসীদাস’ (১৯৫০) ছবিতে কীর্তন-প্রাণিত গানেও (লিখিনু যে লিপিখানি) নিজেকে উজাড় করে দিতে পারলেন হেমন্ত। অকাল-প্রয়াত অনুপম ঘটকের সার্থক উত্তরসূরী নচিকেতা ঘোষ। তাঁর সুরে আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’-তে (কথা: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) স্বরগ্রাম-বিস্তৃতি মন্দ্রসপ্তকের পঞ্চম থেকে তারসপ্তকের পঞ্চম পর্যন্ততা ছাড়া স্বরের ক্রোমাটিক ব্যবহার তো আছেই। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত এই গানটি হেমন্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান।

নিজের কণ্ঠসামর্থ্যের কথা ভেবে হেমন্ত আপত্তি জানালেও তাঁকে দিয়েই নচিকেতা গাইয়েছিলেন বন্ধু’ ছবির (১৯৫৮) জটিল চলনের গান মালতি ভ্রমরে করে কানাকানি’ বা মউ বনে আজ।’ দুটি গানই সুরূপায়িত। ধন্যি মেয়ে’ ছবির (১৯৭১) রাধে মনটা রেখে এলি বল কোন মথুরায়’তে নচিকেতার অদ্ভুত স্বরবিন্যাস, তার পাশেই বেসিক যদি জানতে চাও তুমি’ গানে ভরপুর মেলোডি– সবেতেই সফল রূপকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। 

Hemanta Nachiketa Pair
অভিন্ন-হৃদয় হেমন্ত-নচিকেতা ছিলেন সঙ্গীতেও অপ্রতিরোধ্য জুটি

শিল্পীর কণ্ঠকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানেন প্রতিভাবান সুরকাররাই। সন্ন্যাসী রাজা’ (১৯৭৫) ছবিতে রাগ-নির্ভর বা নাটকীয় গানগুলি মান্না দে-র গলায় রাখলেও একটি স্তোত্র হেমন্তকে দিয়েই গাওয়ান নচিকেতা। এখানে স্বরের গভীরতা, লাবণ্য আর উচ্চারণের স্পষ্টতাই দরকার ছিল, যাতে একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হতে পারে। সহজ গানেই হেমন্ত সফল, এই যুক্তির বিপ্রতীপে আরও বহু গানের কথা মনে পড়ে। যেমন, ‘মায়ামৃগ’ (১৯৬০) ছবিতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুরে ওরে শোন শোন গেরোবাজ’ গানে ছন্দের বদল, লয়ের পরিবর্তন, সুরের বৈচিত্র্য– সব কিছুতেই দারুণ স্বতঃস্ফূর্ত হেমন্ত।

নামী সুরকার সুধীন দাশগুপ্তের সুরে হেমন্তের গান কম। একটিই বেসিকপ্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা অবলম্বনে সাগর থেকে ফেরা।’ তা ছাড়া সুশান্তসা’ (১৯৬৬), ‘সজারুর কাঁটা’ (১৯৭৪) প্রভৃতি তিন-চারটি ছবিতে সুধীনের সুরে গেয়েছেন হেমন্ত। নিপুণ সুরকার রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে সাত নম্বর বাড়ি’-তে (১৯৪৬) ফেলে আসা দিনগুলি মোর’, ‘জলজঙ্গল’ ছবিতে (১৯৫৯) এত ফুল ফুটেছে’, ‘মায়ার সংসার’-এ (১৯৬২) ঘুম যায় ওই চাঁদ’ ইত্যাদি গান হেমন্তের কণ্ঠেই প্রাণ পায়। 

 

ক্ল্যারিওনেট-শিল্পী রাজেন সরকারও ছিলেন সে যুগের একজন দক্ষ সুরকার। আমাদের নিশ্চয় মনে পড়বে রাজেন সরকারের সুরে হেমন্তের ঢুলি’ (১৯৫৪) ছবির জীবন যে রে স্বপ্ন মায়া’, ‘অশান্ত ঘূর্ণি’ ছবিতে (১৯৬৪)আমার নতুন গানের জন্মতিথি এল’, ‘নতুন জীবন’ ছবিতে (১৯৬৬) লাজবতী নূপুরের রিনিঝিনি।’ পবিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুরে উল্লেখযোগ্য পিতা পুত্র’ ছবিতে (১৯৬৯) ভোরের আলোয় পড়ল তোমায় মনে’, গোপেন মল্লিকের সুরে বিষকন্যা’ ছবিতে (১৯৬১)-তে মেঘের স্বপন দেখি’ গানগুলিও উল্লেখযোগ্য। 




লব্ধপ্রতিষ্ঠ সুরকারদের পাশাপাশি নবীন প্রতিশ্রুতিবান সুরকারদের সুরেও বহু গান গেয়েছেন হেমন্ত। গত শতকের পাঁচের দশকে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও শ্যামল মিত্র যখন আস্তে আস্তে পরিচিত হচ্ছেন শিল্পী-সুরকার হিসেবে
, তখন সতীনাথের সুরে গাইলেন প্রেমের এক অসামান্য গান– তোমার আমার কারও মুখে কথা নেই।’ আর শ্যামলের সুরে পথে যেতে যেতে।’ শ্যামলের সুরে ছবিতেও গেয়েছেন এই খেয়া বাইব কত আর’ (খেয়া, ১৯৬৭)। রতু মুখোপাধ্যায় সে সময় সঙ্গীতজগতে নবাগত, তাঁর সুরে শোনালেন দুটি চমৎকার গান, কী দেখি পাই না ভেবে গো’ এবং ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা।’

সলিল-শিষ্য অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে তিনটি আলাদা মেজাজের গান সবাই চলে গেছে’, ‘এমন একটা ঝড় উঠুক’, এবং ‘অনেক অরণ্য পার হয়ে’তিনটিকেই আলাদা আলাদা আঙ্গিকে রূপায়িত করেন হেমন্ত। গণনাট্য সঙ্ঘের পরেশ ধরের সুরে একটিই রেকর্ড। একটিতেই বাজিমাত– শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি’ আমরা চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করি হেমন্তের অনুভবী গায়নে। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেও গেয়েছেন গান, শ্রোতারা অবাক। প্রতিমা কিন্তু তারপরে আর সুর করেননি। প্রবীর মজুমদারের সুরে উল্লেখযোগ্য গান তুমি এখন অনেক দূরে’, ‘গভীর রাতে হঠাৎ জেগে।’

এ পর্বে আমরা আলোচনায় রাখলাম বিভিন্ন সুরকারের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বেসিক ও ছায়াছবির গানের কথা। পরবর্তী পর্বে আসবে রবীন্দ্রসংগীতে হেমন্তের কথা আর সুরকার হেমন্তের প্রসঙ্গ।

Swapan Shome

স্বপন সোম এ কালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত গবেষক। গান শিখেছেন মোহন সোম, মায়া সেন ও সুভাষ চৌধুরীর মতো কিংবদন্তীদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে 'দেশ' পত্রিকায় সংগীত সমালোচনা করেছেনl গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক', 'সানন্দা', 'আজকাল', 'এই সময়', 'প্রতিদিন' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়l

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *