উনিশ শতকের গোড়া থেকেই আমেরিকার মাটিতে জনপ্রিয় হতে শুরু করে দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলন। নিউ রিপাবলিকান নেতা আব্রাহাম লিংকনের উত্থান সেই আন্দোলনকে আরও জোরালো করে তোলে। কিন্তু দাসেদের উপর অত্যাচার, নিপীড়নের দুশো বছরের ইতিহাস একদিনে মুছে ফেলা সম্ভব ছিল না। একদিকে কালো চামড়ার নিগ্রোদের মুক্তির দাবি, আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রয়োজনে দাস-ব্যবহার— এই দুরকম দাবিকে কেন্দ্র করে স্পষ্ট বিভাজনরেখা ফুটে ওঠে উত্তর আর দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে।
আরও পড়ুন: বাঙালি হয়েও আন্তর্জাতিক : শিল্পসাধক অতুল বসু
ইতিহাস বলছে, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথা চালু হয়। ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। আমেরিকার মতো বিশাল দুটি মহাদেশের লক্ষ লক্ষ একর অনাবাদী জমি চাষ করার মতো জনবল সেখানকার সামন্ত প্রভুদের ছিল না। ফলে আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ কালো মানুষ ধরে আনা হল সেইসব অনাবাদী কৃষিজমিতে শ্রম দানের জন্য। শুরু হল ‘ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড’। মূলত সেখানকার দাস-ব্যবসার কেন্দ্রভূমি ছিল পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল, যার বিস্তার সেনেগাল থেকে এঙ্গোলা পর্যন্ত।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাসদের প্রকাশ্য হাটে গরু-ছাগলের মতো কেনাবেচা করা হত। তুলা, তামাক, আখ ও অন্যান্য ফসলের জমিতে তাদের উদয়াস্ত অমানুষিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হত। কথায় কথায় চলত অত্যাচার। পাছে কেউ পালিয়ে যায় তার জন্য গলায় আর পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা হত দাসের। ঘর গেরস্থালির যাবতীয় কাজকর্ম করানো হত ক্রীতদাসীদের দিয়ে, সঙ্গে চলত যৌন নির্যাতন। জাহাজে চালান করার সময় বহু দাসের মৃত্যু ঘটত। অনাহারে অর্ধাহারে অসুখে অত্যাচারেও মারা যেত বহু ক্রীতদাস। পলাতক দাসদের অনুসন্ধানের জন্য শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা শিকারি কুকুর নিয়োগ করত। উত্তর আমেরিকার চাইতে দক্ষিণ আমেরিকাতেই ভয়াবহ চেহারা নেয় এই দাসপ্রথা।

১৮৬১-১৮৬৫, টানা পাঁচ বছর এই ক্রীতদাসপ্রথাকে কেন্দ্র করে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে মেতে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ, যার পোশাকী নাম ‘ওয়ার বিটুইন দ্য স্টেটস’। ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত পটভূমিতেই লেখা হয় এক যুগান্তকারী উপন্যাস, ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের লেলিহান আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল এই বইটি। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে লেখা এই বই আমূল বদলে দিয়েছিল আমেরিকার ইতিহাস। গৃহযুদ্ধ আরম্ভের পর আব্রাহাম লিংকন একবার দেখা করেন বইটির লেখিকার সঙ্গে। সেদিন প্রথম সাক্ষাতে সবিস্ময়ে তিনি বলেছিলেন : ‘So this is the little lady who started this great war.’ ইতিহাসের পালাবদলের সাক্ষী সেই বইটির লেখিকা, বছর আটত্রিশের মার্কিন তরুণী হ্যারিয়েট বিচার স্টো (Harriet Beecher Stowe).
হ্যারিয়েট এলিজাবেথ বিচার স্টো-র (১৮১১-১৮৯৬) জন্ম কানেটিকাটের লিচফিল্ডে। তাঁর বাবা লাইম্যান বিচার ছিলেন একজন ক্যালভানিস্ট ধর্মযাজক। তিনিও ছিলেন দাসপ্রথা বিলোপের পক্ষে একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা। মা রোক্সানা বিচার ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এক নারী। বহু ভাইবোনের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা হ্যারিয়েট শৈশব থেকেই দাসপ্রথার বর্বরতার সাক্ষী। বাবা মায়ের আদর্শ অনুসরণ করে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে ছোট থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করে তুলেছিলেন তিনি। স্বামী রেভারেন্ড কেলভিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু দাসকে মুক্ত করে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয়ও দিয়েছিলেন।

পৃথিবীর মানবিকতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দলিল ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’। এই বইটি লিখে এককথায় অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন হ্যারিয়েট, কলম যে তরবারির চাইতেও শক্তিশালী সেকথা আরও একবার প্রমাণিত হয়েছিল আবহমানকালের সাহিত্যের ইতিহাসে। প্রথম বছর বইটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই তিন লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। গ্রেট ব্রিটেনে বিক্রি হয়েছিল এক মিলিয়ন কপি। প্রায় চল্লিশের কোঠায় লেখা এই বইটি প্রথমে ‘ন্যাশনাল এরা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তারপর ১৮৫২ সালের ২০ মার্চ এটি বই হিসেবে প্রকাশ পায়। এর প্রায় দেড় দশক পরে আব্রাহাম লিংকন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন করে দাসপ্রথার অবসান ঘটান। উইলিয়াম বুথ নামের এক ঘাতক যখন লিংকনকে হত্যা করে, তখন তিনি একটি থিয়েটার হলে ছিলেন। মৃত্যুর সময়ও তাঁর সঙ্গে ছিল একটি উপন্যাস: ‘আঙ্কেল টম’স কেবিন’।
পৃথিবীর মানবিকতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দলিল ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’। এই বইটি লিখে এককথায় অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন হ্যারিয়েট, কলম যে তরবারির চাইতেও শক্তিশালী সেকথা আরও একবার প্রমাণিত হয়েছিল আবহমানকালের সাহিত্যের ইতিহাসে।
এই উপন্যাসের ক্রীতদাস টম স্বপ্ন দেখেছিল এক শোষণমুক্ত সমাজের। যেখানে সবাই সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। যেখানে দাসপ্রথা থাকবে না। যেখানে মানুষ অর্থ ও ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে নিজেকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের চেয়ে বড় বলে মনে করবে না। একদা নাস্তিক কবি শেলিও এই স্বপ্ন দেখেছিলেন।
এই উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শিশুকন্যা ইভা। সে-ই প্রথম টমকে জানায় তার স্বপ্নের কথা। যে স্বপ্ন এক অত্যাচার-মুক্ত সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন। ইভার স্বপ্ন আসলে হ্যারিয়েট বিচার স্টোর আদর্শগত স্বপ্ন। আঙ্কল টম’স কেবিন সেই স্বপ্ন-সম্ভাবনার উপন্যাস— যার অন্য নাম ‘Life Among The Lowly’.

১৮৪৯ সালে প্রকাশিত একজন ক্রীতদাসের (Josiah Henson এর লেখা The Life of Josiah Henson) আত্মজীবনীমূলক বই পড়েই হ্যারিয়েট এরকম একটি বই লেখার অনুপ্রেরণা পান ব’লে নিজেই জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি বহু নিগ্রো ক্রীতদাসের সঙ্গে কথা বলে নিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর উপন্যাসের টমকাকা কোনও ব্যক্তিচরিত্র নয়। সে একটি নিপীড়িত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, এক অন্ধকার সময়ের প্রতীক।
টম প্রথমে ছিল কেন্টাকির এক ফার্ম-মালিক আর্থার শেলবির ক্রীতদাস। একদিন অর্থের অভাবে শেলবি ও তার স্ত্রী এমিলি ঠিক করে টমকে বিক্রি করে দেবে। সঙ্গে ক্রীতদাসী এলিজার ছেলে হ্যারিকেও। শেলবির ছেলে জর্জ টমকে ভীষণ ভালোবাসত। সে চায়নি টমকে বিক্রি করা হোক। এলিজা ও হ্যারি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। টম তাদের পালাতে সাহায্য করে।
এরপর টমকে দাস-ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মিসিসিপির স্রোতে ভেসে সে চলে যায় বহু দূরে। এবার তার মালিক হয় ক্লেয়ার নামে এক ব্যক্তি। তার ছোট্ট মেয়ে ইভা। টমের সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অসুস্থ ইভা মৃত্যুর আগে আঙ্কেল টমকে জানায় তার স্বপ্নের কথা : সে স্বপ্ন দেখেছে এমন এক আশ্চর্য পৃথিবীর, যেখানে মানুষে মানুষে কোনও ভেদাভেদ নেই, যেখানে সকলেই সমান, যেখানে শোষণ ও অত্যাচার বলে কিছু নেই। (এই নিষ্পাপ বালিকার স্বপ্নই যেন হ্যারিয়েটকে এই বই লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। ইভা যেন হ্যারিয়েটেরই অল্টার ইগো)।

ক্লেয়ারের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী টমকে বিক্রি করে দেয় সাইমন লেগ্রি নামে এক নিষ্ঠুর ব্যক্তির কাছে। সাইমন তাকে লুসিয়ানায় নিয়ে যায়। সেখানে আরও অনেক ক্রীতদাসের সঙ্গে দেখা হয় টমের। সাইমন চাইত, টম তার হয়ে অন্য দাসদের উপরে অত্যাচার করুক। কিন্তু সেই প্রস্তাবে রাজি হয় না সে। ফলে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সাইমন। টমের ঈশ্বরবিশ্বাসকেও পছন্দ করত না সাইমন। স্বাভাবিকভাবেই অমানুষিক নিপীড়ন চলত তার উপরে। সহ-ক্রীতদাসদের বাঁচাতে বাইবেল পড়া বন্ধ করে দেয় সে। এবং গোপনে ক্যাসি ও ইমেলিন নামে দুজন ক্রীতদাসকে পালাতে সাহায্য করে। এই অভিযোগে সাইমন টমের উপরে ভয়ংকর নির্যাতন শুরু করে এবং তাকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়।
ক্লেয়ারের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী টমকে বিক্রি করে দেয় সাইমন লেগ্রি নামে এক নিষ্ঠুর ব্যক্তির কাছে। সাইমন তাকে লুসিয়ানায় নিয়ে যায়। সেখানে আরও অনেক ক্রীতদাসের সঙ্গে দেখা হয় টমের। সাইমন চাইত, টম তার হয়ে অন্য দাসদের উপরে অত্যাচার করুক। কিন্তু সেই প্রস্তাবে রাজি হয় না সে।
মৃত্যুর আগে সাইমন জানতে চায়, টম তাকে প্রভু বলে স্বীকার করে কীনা। কিন্তু মার খেতে খেতে মরে যাওয়ার আগেও টম জানায়, প্রভু একজনই, তিনি ঈশ্বর, সাইমন মালিক মাত্র, আর কিছু নয়। অনমনীয় জেদ ও গভীর ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে মারা যায় টম। প্রথম মালিক শেলবির ছেলে জর্জ তাকে মুক্ত করার জন্য যখন সেখানে আসে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার প্রিয় আঙ্কেল টম আর ইহজগতে নেই। মর্মাহত জর্জ ফিরে গিয়ে বাড়ির সমস্ত ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দেয়।
দক্ষিণ আমেরিকায় নিষিদ্ধ হয়েছিল এই বই। কিন্তু আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতকে কে কবে বন্দী করে রাখতে পেরেছে। একশ সত্তর বছর পরেও ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ আজও সমান প্রাসঙ্গিক। আজও এই বই আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। আজও হ্যারিয়েট বিচার স্টো মানবিক-বিশ্বের মানুষের কাছে সমান প্রণম্য।
একের দশকের বাংলা কবিতার পরিচিত নাম। পেশায় সাংবাদিক। পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্মাননা সহ একাধিক পুরস্কার। আগ্রহ আছে থিয়েটার ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে।
সংশোধন প্রয়োজন। আমেরিকা নয়, হবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। সেই ভুলের জন্য –”…উত্তর আমেরিকার চাইতে দক্ষিণ আমেরিকাতেই ভয়াবহ চেহারা নেয় এই দাসপ্রথা।…” গোলমাল বাধিয়ে ফেলেছে। দক্ষিণ আমেরিকা ভিন্ন মহাদেশ। লেখা উচিত ছিল– ‘আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর অংশের তুলনায় দক্ষিণাঞ্চলে’।