১৯১১ সাল। প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে খালি পায়ে খেলে ইংরেজদের হারিয়ে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জেতার বছর। সেই বছরই প্রয়াত হলেন এক বঙ্গসন্তান। নাম, হরিনাথ দে। মৃত্যুর সময় বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৪। তাঁকে সুস্থ করে তুলতে জান লড়িয়ে দিয়েছিলেন নীলরতন সরকার-সহ সেই সময়ের বাঘা বাঘা বাঙালি ডাক্তারেরা। খোঁজখবর নিতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ আরও অনেক দিকপাল। সাদা চামড়ার সাহেবদের অনেকেও ভেঙে পড়েছিলেন হরিনাথের মৃত্যুর খবর পেয়ে। স্বাভাবিক। প্রয়াত যুবক তো কোনও সাধারণ মানুষ নন। তিনি বাঙালীর গর্ব, বিস্ময়প্রতিভা! মাত্র ৩৪ বছরের জীবনেই রপ্ত করে নিয়েছেন ৩৪টি ভাষা! তাঁর ভাষাজ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছেন স্বয়ং পোপ। আশ্চর্য প্রতিভার খবর পেয়ে সম্মান জানাতে কসুর করেননি মহাপ্রতাপশালী লর্ড কার্জনও।

গত সোমবার ছিল হরিনাথের ১৪২ তম জন্মদিবস। কার্যত নিঃশব্দে কেটে গেল দিনটি। সংবাদমাধ্যম বা সোস্যাল মিডিয়া- কোথাও এক ছটাক জায়গাও পেলেন না তৎকালীন ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির (বর্তমানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি) প্রথম বাঙালি লাইব্রেরিয়ান হরিনাথ। বাঙালির বিস্মৃতি বড়ই সাবলীল, ইস্ত্রি করা জামার মতোই নিভাঁজ।

১৮৭৭ সালের ১২ অগস্ট আড়িয়াদহের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় হরিনাথের। বাবা ভোলানাথ ছিলেন তৎকালীন রায়পুর সেন্ট্রালের সরকারি আধিকারিক। ছোটবেলায় রায়পুরেই পড়াশোনা, তার পর সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল এবং কলেজ পেরিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৮৯৩ সালে সেখান থেকেই লাতিন এবং ইরেজিতে স্নাতক।

ভাষার প্রতি হরিনাথের আগ্রহ অবশ্য ছোট্টবেলা থেকেই। অক্ষরজ্ঞান হওয়ার সময় মা তরকারি কাটার ফাঁকে বাংলা অক্ষর লেখা শেখাচ্ছিলেন ছেলেকে। খানিকক্ষণ পর দেখেন একরত্তি হরিনাথ নিজেই ঘরময় লিখে রেখেছেন বাংলা বর্ণমালা। আরও কয়েক বছর পর ফের চমকে গেলেন পরিজন, পড়শিরা। বাড়ির কাছের একটি গির্জায় নিয়মিত যেতেন শিশু হরিনাথ। বাইবেল পাঠ শুনতেন নিয়ম করে। পাদ্রিসাহেব এক দিন আবিষ্কার করলেন, হিন্দিতে বাইবেল অনুবাদ করতে শুরু করেছেন ছোট্ট হরিনাথ।

বড় হওয়ার পর হরিনাথের প্রতিভায় চমকে গিয়েছিলেন স্বয়ং পোপ দশম পিউস। ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পোপের সঙ্গে নিখুঁত লাতিনে কথা বলতে শুরু করেন হরিনাথ। এক জন এশিয়াবাসীর মুখে শুদ্ধ লাতিন শুনে অবাক হয়ে যান পোপ। ঈষৎ পরিহাসের ছলে পরামর্শ দেন সময় পেলে ইতালিয়ান ভাষাটিও শিখে নিতে। মৃদু হেসে হরিনাথ তখনই পোপের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন বিশুব্ধ ইতালিয়ানে!

হরিনাথের ভাষাজ্ঞানের বহর দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং লর্ড কার্জনও। আরবি এবং পার্সি থেকে একাধিক বই ইংরেজিতে অনুবাদ করে কার্জনকে উপহার দেন হরিনাথ। অনুদিত বইয়ের প্রথম পাতায় লাতিনে কার্জনের উদ্দেশ্যে একটি উৎসর্গপত্র লিখেছিলেন তিনি। এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন বড়লাট যে, ঢাকায় গিয়ে নিজের দফতরে ডেকে নেন হরিনাথকে।

হরিনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি পড়িয়েছেন। কিন্তু সম্ভবত ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির (বর্তমানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি) প্রথম ভারতীয় লাইব্রেরিয়ান হিসাবে। হরিনাথের আগে বর্তমান ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান ছিলেন জন ম্যাকফারলেন। যিনি ভারতে আসার আগে সামলেছেন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সহ-লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব। ১৯০৭ সালে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন হরিনাথ। মাত্র ৩০ বছর বয়সে। আমৃত্যু সেই পদেই ছিলেন তিনি। বলে রাখা ভাল, ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস-এর প্রথম ভারতীয় আধিকারিকের নামও হরিনাথ দে।

হরিনাথকে বাঙালি মনে রাখেনি, কিন্তু তাঁর কাজগুলো রয়ে গিয়েছে। ইংরেজি-পার্শিয়ান অভিধান লিখেছিলেন তিনি, লিখেছিলেন তিব্বতী ভাষার অভিধান। ঋকবেদের একটি অংশ উপনিষদ, মূল শ্লোক ও টীকা-ভাষ্য-সহ অনুবাদ করেছিলেন একাধিক ভাষায়। এমন আরও অনেক কাজ। তাঁর বইয়ের সংগ্রহও ছিল চমকে দেওয়ার মতো। মৃত্যুর সময় হরিনাথের সংগ্রহে ছিল প্রায় হাজার সাতেক বই। তার মধ্যে ছিল কালীদাসের অভিজ্ঞানম শকুন্তলমের প্রাচীনতম পুঁথি, পার্সি ও তুর্কিতে লেখা বৈরাম খাঁর পান্ডুলিপি, ওয়ারেন হেস্টিংসের স্বহস্তে লেখা চিঠি, শাহজাদা দারাশিকো কর্তৃক বেদের অনুবাদের মতো অজস্র মণিমুক্তো।

হরিনাথকে আমরা মনে রাখিনি। তাঁর সংগ্রহশালাটিও যত্ন পায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *