সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা নানা বর্ণের বিচ্ছুরণে ঐশ্বর্যবান হয়ে উঠেছে। কারণ এখন প্রবীণ এবং নবীন কবিরা বহু বৈচিত্রের সমাহারে সমৃদ্ধ করে তুলছেন বাংলা কবিতাকে। কবিতার এই সমৃদ্ধির এক প্রধান কারণ কবি সুবোধ সরকারের কবিতা। সুবোধ সরকার বাংলা কবিতায় এক নতুন কথন রীতির আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। আধুনিক কবিতার বিরুদ্ধে যে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বছরের পর বছর ধরে ক্রিয়াশীল, সুবোধ সরকারের কবিতা সেই অভিযোগের এক মূর্তিমান প্রতিবাদ। সুবোধ সরকার তাঁর কবিতায় কথা বলেন স্পষ্ট ভাষায়, সোজাসুজি। সুবোধ সরকারের কবিতা সরাসরি পাঠকের মর্মে এসে বিদ্ধ হয়। কোনও অস্পষ্টতা, কোনও ধোঁয়াশাকে প্রশ্রয় দেয় না সুবোধ সরকারের কবিতা। সমাজের চারিদিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় তাঁর কবিদৃষ্টি। যাবতীয় অনাচার, ভ্রষ্টতা, অসাম্য এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সে-কবিতা সোজা আঘাত করে। সমাজের কেন্দ্রস্থলে যে-বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, লোভ, কপটতা এবং হিংসা সবসময় ঘূর্ণিত হয়ে চলেছে, সুবোধ সরকারের কবিতা তাকে এড়িয়ে চলে না। প্রত্যাঘাত হানে। সুবোধ সরকারের কবিতার ভাষা কোনও ছদ্ম আবরণ ব্যবহার করে না। তাই সে-কবিতা যে-পাঠকই পড়ুন, তিনি নিজের পরিপার্শ্বকে নির্ভুলভাবে তৎক্ষণাৎ চিনতে পেরে যান। এমনকি নিজের ব্যক্তিগত সামাজিক অবস্থানটি কোথায় তাও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন সুবোধ সরকারের কবিতার পাঠক।
সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার প্রধান এই কারিগরের লেখা কবিতাজগতকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। সুবোধ সরকারের কবিতায় ক্লেশ, তীব্র ব্যঙ্গ এবং সদর্থক ক্রোধ সেসব লেখাকে নতুনভাবে স্মরণীয় করে তুলেছে। বিষ্ণু দে-র একটি কবিতার বইয়ের নাম ছিল ‘সংবাদ মূলত কাব্য’। বিষ্ণু দে-র কবিতার রচনারীতির সঙ্গে সুবোধ সরকারের কবিতার গঠনের কণামাত্র সাদৃশ্য নেই। কিন্তু সূবোধ সরকার এতই শক্তিশালী কবি যে, সুবোধ নিজের কবিতায় বিষ্ণু দে-র এই ‘সংবাদ মূলত কাব্য’-তে বাক্যবন্ধটির এক নবজন্ম দিয়েছেন। সুবোধ সরকারের কবিতার পাঠক সে-কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ভেতর সে-লেখার সংযোগ খুঁজে পান। তাকে কোনও দ্বিধা বা সংশয় আচ্ছন্ন করে না, কারণ সুবোধ সরকার যখন কবিতায় কথা বলেন তখন সমস্ত দ্বিধা ও সংশয়কে সরিয়ে রেখে সরাসরি মনের কথা বলেন। ফলে তা পাঠকেরও মনের কথা হয়ে উঠতে কোথাও বাধা পায় না।

আটের দশকে সুবোধ সরকারের একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল, যার নাম হল ‘একা নরকগামী’। সে-কাব্যগ্রন্থ আজকের তরুণ-তরুণীরা হাতে পেয়েছেন কিনা জানি না। সে-বই পড়লে বোঝা যায়, সুবোধ সরকার প্রথাসিদ্ধ ছন্দমিল সমন্বিত কবিতা রচনায় কতখানি দক্ষতা অর্জন করেছেন। ঈর্ষনীয় সে-দক্ষতা।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সুবোধ সরকার প্রধানত ছন্দোমুক্ত কবিতা রচনা করেন। যদিও ছন্দ-মিলযুক্ত কবিতাও যে তিনি এখন রচনা করছেন না তা নয়, তবু তাঁর এখনকার কবিতার প্রধান বাহন একটি ছন্দোমুক্ত নতুন কথনরীতি।
সুবোধ সরকারের কবিতার পাঠক অতি দ্রুত সে-লেখার সঙ্গে নিজের সংযোগ আবিষ্কার করে, তার মূল কারণ সে-পাঠক যে-সামাজিক পরিবেশে জীবন যাপন করছে তার অসঙ্গতি ও অসাম্য সুবোধ সরকারের কবিতা স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়। সুবোধ সরকারের কবিতা কখনও ভান করে না। কারণ সে-কবিতা আকাশবাতাসের মতই খোলা।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এবং কবিতা বিষয়ক গদ্য লেখায় সুবোধ সরকার একাধিক বার বলেছেন যে, কবিতা থেকে তিনি সব গয়না খুলে ফেলতে চান। সে-কাজ তিনি সার্থকভাবেই করে চলেছেন। কোনও আভরণ ছাড়াই সুবোধ সরকারের কবিতা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যায়।
মানুষ। এই শব্দটি সুবোধ সরকারের কবিতার বীজমন্ত্র। তাঁর কবিতায় মানুষ বারবার বহু রূপে উপস্থিত হয়। কখনও সে অসহায়, নির্যাতিত মানুষ, কখনও সে নির্যাতনকারী মানুষ। ‘মানুষ’ এই বিষয়টিকে কখনই সুবোধ সরকারের কবিতা ছেড়ে যায় না। ‘মানুষ’ সুবোধ সরকারের কবিতার আত্মা বলা যায়।

তবে কি সুবোধ সরকারের কবিতা কেবলই বিভিন্ন প্রকার অন্যায় ও অত্যাচারের কথাই শুধু বলে? না, তা কখনই নয়। আনন্দ উদযাপনকারী কবিতাও সুবোধ সরকারের হাতে আমরা পেয়েছি। সেখানে হৃদয় উদ্দীপিত হয়ে উঠছে। ‘বেহালার সেই ছেলেটা’ নামে সুবোধ সরকারের একটি কবিতা আছে, যে-কবিতার বিষয়বস্তু হলেন ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাণবন্ত আবৃত্তি সে-কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছে সহস্র শ্রোতার মনে। তরুণী ক্রীড়াবিদ হিমা দাস-কে নিয়ে একটি স্মরণীয় কবিতা লিখেছেন সুবোধ সরকার। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে উঠে দাঁড়ানো খেলোয়াড় হিমা দাস স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন। সুবোধ সরকারের এই কবিতা কোনও পত্রিকায় ছাপা হওয়ার আগেই ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। সকলের হাতের ফোনে ফোনে ঘুরতে থাকে হিমা দাসকে নিয়ে লেখা সুবোধ সরকারের এই কবিতা। আমার ফেসবুক নেই ফোনে। আমার ফোন পুরনো আমলের। কিন্তু আমার স্ত্রী কাবেরীর ফোনে কাবেরীর এক বান্ধবী এই কবিতা পাঠিয়ে দেন। কাবেরী আমাকে পড়ে শোনায় এবং আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। একেই বলে সত্যিকারের মানুষের কবি। সুবোধ সরকার ‘মানুষের কবি’ এই অভিধার এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

অসামান্য প্রেমের কবিতাও এসেছে সুবোধ সরকারের হাতে। কোনও রকম আড়ষ্টতা দ্বিধা–সঙ্কোচ নেই সেখানে। স্পষ্ট প্রেমের আভরণহীন একান্ত নিবিড় সম্ভাষণ আছে। প্রেমের কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও সুবোধ সরকার নতুন কথনরীতি উদ্ভাবন করে নিয়েছেন তাঁর কবিতায়।
আমি সুবোধ সরকারের কবিতার বইগুলি উল্টে-পাল্টে পড়ি আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবি, এ ভাবেও কবিতা লেখা সম্ভব?
আজ সুবোধ সরকার কোনও মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়লে মঞ্চের সামনে ভিড় করে এগিয়ে আসেন তরুণীরা। তাঁরা মোবাইল ফোন তুলে কবিকে লক্ষ করেন। তাঁদের ফোনে ধরে রাখতে চান কবিতা পাঠরত সুবোধ সরকারের ছবি। এ তো আমার স্বচক্ষে দেখা দৃশ্য। এবং এ ঘটনাও বাংলা কবিতার পক্ষে গৌরব করার মত জিনিস। সুবোধ সরকারের একের পর এক কবিতাকে বাচিক শিল্পীরা কণ্ঠে তুলে নেন। কারণ সেই সব শিল্পীরা জানেন, স্রোতার হৃদয়ে স্থান লাভ করার জন্যে সুবোধ সরকারের কবিতা এক অনন্য উপাদান।
সুবোধ সরকার সদ্য ষাট বৎসর বয়স পার হয়েছেন। কিন্তু তাঁর কবিতায় চিরযৌবনের চমৎকারিত্ব। প্রতিবাদে, প্রেমে, আসক্তিতে, উদ্দীপনায় সে-লেখা সমুজ্জ্বল। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে সুবোধ সরকার এক সার্থকভাবে উড্ডীন জয়পতাকা।
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।