ঠক করে চায়ের কাপটা দাদার সামনে নামিয়ে চলে গেল বউদি। প্রমাদ গুণল সুজয়।   

এখনই গৃহযুদ্ধ শুরু হল বলে। দাদা বিজয় কম কথার মানুষ। কিন্তু রেগে গেলে মুখ তুবড়ি। সমস্যা মা’কে নিয়ে। বাবা গত হয়েছেন প্রায় বছর ঘুরতে চলল। সামনেই বাৎসরিক। মা এখনও রান্নাঘরের চাবি বউদির হাতে তুলে দিতে পারল না। কেন যে মেয়েরা এমন করে! 

মাকে অনেক বুঝিয়েছে সুজয়। আলাদা টিভি, গুচ্ছ গুচ্ছ গল্পের বই কিনেছে মায়ের জন্য।  সিরিয়াল দেখার জন্য উৎসাহ দিয়েছে। বাইকে বসিয়ে বেড়াতে নিয়ে গেছে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। কিন্তু মায়ের মন দু’দণ্ডের বেশি টেঁকেনি কোথাও। ঘুরে ফিরে সেই রান্নাঘর। সকালের জলখাবার থেকে রাতের মেনু- সব নিয়ে মায়ের মাথাব্যথা। বউদির  একফোঁটা স্বাধীনতা নেই।      

অথচ বউদি নতুন নয়। তিন্নির বয়সই তো সাত পেরিয়ে আট বছর হল। মায়ের এবার বোঝা উচিত। ‘বাণপ্রস্থ’ শব্দটার মাহাত্ম্য এখন  উপলব্ধি করে সুজয়।

মাকে কীভাবে আগলাবে! দাদা বউদির ঝগড়ার মূল কারণ মা। সে চলে গেলে আরও  তিরিক্ষি হবে মা। অথচ সামনের মাসেই পৌঁছতে হবে দুবাই। আই টি সেক্টরের চাকরি।  যেখানে  পাঠাবে, বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দৌড়াও। ওদিকে শ্রেয়াও গাল ফুলিয়ে বসে আছে – কেন সুজয় সাত তাড়াতাড়ি সাগরপাড়ে যাচ্ছে তাকে ছেড়ে। আরে চাকরগিরির কি সুসময় দুঃসময় হয়?   

হোয়াটস অ্যাপে শ্রেয়াকে মেসেজ করল সুজয়।   

“আমি চলে গেলে মা’কে দেখো কিন্তু”   

টকাটক দুটো নীল টিক পড়ল।  

তার মানে শ্রেয়া অনলাইন। রিং করল সুজয়।    

“কী ব্যাপার আজ ক্লাস নেই? ভরদুপুরে অনলাইন?”   

“ইউনিভার্সিটিতে ব্যাপক গোলমাল । সামনে ইলেকশন। বাইরের  ছেলেপুলে ঢুকে গুণ্ডামি  করছে।” 

“তুমি ঠিক আছ তো?”  সুজয়ের গলায় উদ্বেগ। 

“উহ, কত দরদ!”  

“তুমি কোথায়?” ঝাঁঝিয়ে উঠল সুজয়।  

“চেঁচিও না। সামনের মাসে তুমি তো পগারপার। ঝামেলা হলে আসতে পারবে?”  

সুজয়  নিশ্চুপ।  

ডাইনিং হল থেকে বউদির গলা ভেসে এল, “হয় উনি থাকুন নয় আমি। আর সহ্য হয়না। মেন্টাল টর্চার”   

“চুপ কেন?” শ্রেয়ার ঈষৎ খসখসে কণ্ঠস্বর।   

বন্ধুরা বলে হাস্কি ভয়েস। এই গলার জন্যই দু’বছরের  জুনিয়র মেয়েটার প্রেমে পড়েছিল সুজয়। চমৎকার আবৃত্তি করে।  

“কী চাও বলতো শ্রেয়া ? চাকরিটা ছেড়ে দিই?”   

কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।   

“আজ বাইরেটা দেখেছ সুজয়?”      

জানলায় আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া। কাছেই কোথাও কোকিল ডাকছে।  হলুদ ঝরাপাতা আর লাল শিমূলে ঢাকা সাদার্ন এভিনিউ। সুজয় দেখল একজোড়া দোয়েল।     

“বসন্তদিন হারিয়ে গেলে আর ফেরত পাওয়া যায়না, সুজয়।” শ্রেয়ার গলায় বিষণ্ণতা।   

লাইন কেটে দিল নাকি নেটওয়ার্কের গণ্ডগোল?  সুজয় মোবাইল ছুঁড়ল বিছানায়। একটা সিগারেট খুব দরকার। মাথা টিপটিপ করছে।      

এখনই বিয়ের প্রশ্ন ওঠে না। পায়ের তলার মাটি কাঁচা। চাকরির এক বছরও হয়নি। শ্রেয়ার বাড়িতে মেনে নেবে না। প্রচুর পয়সাওয়ালা। বাবা হাইকোর্টের জাজ, মা সরকারি আমলা। একটা ন্যূনতম ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স লাগবে। একটা নতুন ফ্ল্যাট। ফার্নিশড। শ্রেয়া বেশ ক’বার এসেছে  এবাড়িতে। মায়ের সঙ্গে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করে গেছে। বুদ্ধিমতী মেয়ে। বিয়ের পর মাকে পাকাপাকি নিয়ে যাবে সুজয়। শ্রেয়া  ঠিক ট্যাকল করে রাখতে পারবে। জিনস আর ক্রপটপ পরেও যেভাবে মা’কে গলিয়ে ফেলল, আশ্চর্য হয়ে গেছে সুজয়।

দুবাই থেকে দুব্রোভনিক শহরে যেতে হল সুজয়কে। জায়গাটা পূর্ব ইয়োরোপ। ক্রোয়েশিয়া। দুবাইয়ের থেকে ঢের সুন্দর। বছর দেড়েক আগে কলকাতায় রাত জেগে টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার সময় ক্রোয়েশিয়ার প্রেমে পড়েছিল সুজয়। ফুটবলার মদ্রিচ, ‍রাকিটিচ, পেরিসিচ।  বিশ্বমানের খেলোয়াড় সব। উফ, পায়ের কী টাচ! তেমন সুন্দরী দেশের প্রধানমন্ত্রী। গ্যালারিতে  বসে ফুটবলারদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন।  সুপ্ত আশার বীজ পুঁতেছিল সুজয়। কোনোদিন সম্ভব হলে ক্রোয়েশিয়া ঘুরতে যাবে। তা বলে মধ্যবিত্ত বাঙালি ছেলের ভাগ্যে এত তাড়াতাড়ি শিকে ছিঁড়বে- স্বপ্নের অতীত!  

দুব্রোভনিক নগর অ্যাড্রিয়াটিক সাগরতীরে। সারাদিন কাজের চাপ। এমনকি সন্ধেবেলাও। বহুজাতিক কোম্পানি চুষে নিংড়ে কাজ আদায় করে। রাত দশটায় কাজ শেষ হল। ক্লান্ত শরীর  নিয়েই সমুদ্রের ধারে গেল সুজয়। রোজ সকাল থেকে এই চাপ আর সহ্য হচ্ছে না। ওদিকে  কলকাতার বাড়িতেও হুলুস্থুল। মা গতকাল একটা হোমে চলে গেছে রাগ করে। নাহ, দাদা এখনও এতটা পাষাণ হয়নি যে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। মায়ের নিজের কীর্তি। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে নিয়ে কবে যে চুপিচুপি একটা ওল্ড এজ হোমে নিজের ব্যবস্থা করেছে, কাউকে জানায়নি। আটমাস হল সুজয় বাড়িছাড়া। এর মধ্যেই এত কাণ্ড হবে ভাবতে পারেনি। মা প্রচণ্ড জেদি আর তেমন অভিমানী। দাদা বউদিকে দুষে লাভ নেই।  

রাত সাড়ে দশটাতেও দুব্রোভনিক আলো ঝলমলে। ট্যুরিস্টে থিকথিক করছে। যেন কলকাতার এসপ্ল্যানেড কিংবা গড়িয়াহাট। স্ত্রাদুন নামে একটা হেরিটেজ রাস্তার দুধারে অসংখ্য সুবেশা নরনারী নৈশভোজে বসে। বেহালায় ছড় তুলছে কেউ কেউ। সমুদ্রের পাড়ে এসে দাঁড়াল সুজয়। মৃদু হাওয়া দিচ্ছে। স্নিগ্ধ। সারাদিনের ধকল কেটে যাচ্ছে। সামনেই একজোড়া যুবকযুবতী আলিঙ্গনাবদ্ধ। সুজয় চোখ সরিয়ে নিল। মাকে একটা ফোন করবে বলে  মোবাইল বার করতেই চোখে পড়ল অদূরে একটা বাড়ি। অন্ধকার। নির্জন। এই আলোর মালা, জনস্রোতের মধ্যে কেমন বেখাপ্পা। 

একজন বৃদ্ধ তার দিকে তাকিয়ে। চোখাচোখি হতে হাসল সুজয়।  

“হোয়াটস দ্যাট?”  

ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন বৃদ্ধ, “কোয়ারেন্টাইন সেন্টার।”  

পাঁচশো বছর আগে যখন বেনের দল জাহাজে করে উপকূলে ভিড়ত, সংক্রামক প্লেগের ভয়ে এখানে আটকে রাখা হত চল্লিশ দিন। বলা হত কোয়ারেন্টাইন। রক্ষীরা পাহারা দিত যাতে কেউ চল্লিশদিন অতিক্রম করার আগে বেরিয়ে না পড়ে। তাহলেই তো ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়বে দুব্রোভনিকে। মহামারীতে ছেয়ে যাবে দেশ।   

কিন্তু মানুষ কীভাবে এমন আলাদা হয়ে একা একা বাঁচতে পারে? একটা দুটো নয়, চল্লিশ দিন!  পরিবার পরিজন ছেড়ে খুপরির  চার দেওয়ালের মধ্যে !   

দাদা বিজয়ের কাছ থেকে আগেই ফোন নম্বরটা নিয়ে রেখেছিল। দ্রুত ডায়াল করল সুজয়। 

তিন চারবার রিং হওয়ার পর উল্টোদিক থেকে সাড়া এল। 

“হ্যালো, কে?”  

“আমি সুজয়, শিবানী দত্তর ছেলে। একটু দেওয়া যাবে লাইনটা?”   

“এত রাতে?”  

সুজয় জিভ কাটল। তাড়াহুড়োয় খেয়াল নেই, কলকাতায় এখন রাত তিনটে। 

“সরি, লং ডিস্টান্স কল। ইন্টারকম আছে?”     

কিছুক্ষণ বাদে মায়ের গলা পেল সুজয়। এই দশটা মিনিট  যেন দশ বছর।       

“এটা কী করলে মা?”   

“ ওহ, তুই খবর পেয়ে গেছিস? বোঝো!”  

“মানে?”  

“ভাবলাম জানাব না। কেমন আছিস?”  

সুজয় কথা বাড়াতে পারছে না। চোখে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের বাষ্প। 

“জানিস ছোটু, এই প্রথম তোদের সবাইকে ছেড়ে …” 

“কিন্তু কেন? আমরা কি মরে গেছি ?”   

ওদিক থেকে সাড়া নেই। সুজয় অনুভব করল মায়ের ঘরটা এখন দুব্রোভনিক সমুদ্রসৈকতের অন্ধকার বাড়িটার মতো।

পাক্বা দু’মিনিট কথা বলতে পারল না মা ছেলে দুজনেই।   

“শোনো মা, ছুটি জমাচ্ছি।তাড়াতাড়ি ফিরব। কিন্তু একটা শর্তে।”   

“বাড়ি ফিরতে বলিসনা ছোটু।”  

“দাদা ফোন করেছিল। ভয়ানক মন খারাপ। ডিপ্রেশনে চলে যাবে।”      

“ওটা তো বউয়ের গোলাম। ছাড়।”      

“একা দাদাই চেঁচায় না মা। তুমিও তো একটু শান্তভাবে রিঅ্যাক্ট করতে পার।” 

“তুই বুঝি এইজন্য ফোন করলি?”   

“আচ্ছা, তুমি ঘুমাও এখন। ওষুধগুলো মনে করে খেও। কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিও।”     

শ্রেয়াকে এখনও  মায়ের খবরটা দেওয়া হয়নি। এতো রাতে নিশ্চয়ই অফলাইন! মোবাইলে চোখ রাখল সুজয়।   

সারি সারি মুখের পাশে সবুজ আলো জ্বলছে। মানুষগুলো চ্যাটবক্সে। সবাই যেন  এক একটা অদৃশ্য  কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে। চারদিকে অগম্য দেওয়াল। বাস্তবে ছোঁয়া যায়না।

ফ্ল্যাটে ফিরে স্নান করল সুজয়।  আজ একটা ভাল ঘুম দরকার। মায়ের জন্য মন ভারি। ঘুমের ওষুধ না খেলে চলবে না। 

দেখতে দেখতে হুড়মুড়িয়ে চলে গেল সময়। কলকাতায় দুর্গাপুজো এল। গেলও।  ফেরা  হল না সুজয়ের।  এমনকি ক্রিসমাসেও ছুটি মিলল না। কোম্পানি জানিয়েছে এক বছর না হলে ছুটিছাটা কিচ্ছু মিলবে না। ছুটির দিনে দুব্রোভনিকের জনবহুল রাস্তা স্ত্রাদুনে চলে যায় সুজয়। একটা বিয়ার নিয়ে বসে থাকে সৈকতে। দু’ চারটে চেনা মুখ হাসে। সামান্য গল্পস্বল্প হয়।         

মা এখনও হোমে। দু’একদিন বাদে বাদে কথা হয়। বউদি দাদা দুজনেই জোর করে নিয়ে  এসেছিল পুজোর সময়। ফের হোমে  চলে গিয়েছে মা।   

বউদি ফোন করে কান্নাকাটি করে। সুজয় বোঝে, দাদার সঙ্গে বউদির তিক্ততা বেড়েছে। কিন্তু বউদিরও তো নিজস্ব জীবন আছে। শখ আছে। তেত্রিশ বছরের রুচিশীলা মহিলা, ঘর সাজাতে ভালবাসে। আট বছরের মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে এও তো তার বসন্তদিন!

সুজয় এখন নিজে নিজে রান্না করতে শিখে গিয়েছে। শ্রেয়ার সঙ্গে দিনে দু’ তিনবার চ্যাট হয়। দুর্গাপুজোয় বন্ধুরা ধুনুচি নাচের ছবি পোস্ট করেছিল ফেসবুকে। সুজয় কমেন্টে লিখল, মার্চে আসবে। দোলের সময়। যা যা খামতি হয়েছে রঙ খেলে,  হুল্লোড় করে পুষিয়ে নেবে।   

শনি রবি অফিস যাচ্ছে সুজয়। নিয়মিত। ছুটি জমানো দরকার। একটা ফ্ল্যাট বুক করবে কলকাতার আশেপাশে?  দক্ষিণখোলা থ্রি বেড রুম। মায়ের ঘরে একটা বারান্দাও লাগবে। খাস  কলকাতায় সাধ্যাতীত।  ফ্ল্যাটের দাম আকাশছোঁয়া। প্রচুর কামাতে হবে। আপনমনে বলল সুজয়।

দিনামো জ্যাগ্রেব ক্লাবে মদ্রিচ খেলত। টুক করে একবার ঘুরে আসতে হবে জ্যাগ্রেব। দুব্রোভনিক থেকে ছ’ ঘণ্টার ড্রাইভ। কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা থাকলে সে মিস করত না।ফুটবল কোন বাঙালি না ভালবাসে?     

মুশকিল হল, কাল থেকে  শুধু খারাপ খবর আসছে। এখানে একটা ঘুসঘুসে জ্বর হচ্ছে। ছোঁয়াচে। সুজয়ের বস বললেন, “দুশ্চিন্তা কোরও না। ইয়োরোপে শীতকালে ফ্লু – নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তোমাদের দেশে হয় না?”  

সুজয় ঢোঁক গিলল। ওরে বাবা, ভারতীয়দের কি রোগের শেষ আছে? গরীবগুর্বো মানুষ সব। রোগের এক একটা ডিপো। যক্ষ্মা , কুষ্ঠ। কী নেই!  তারপর আছে বাঙালির আমাশা আর কোষ্ঠকাঠিন্য। কোনটা বেশি?  ভাবল সুজয় । হেসে ফেলল জোরে । 

কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের ওপারেই ইতালি। সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে ইতালিতে প্রচুর লোক এই রোগে মারা যাচ্ছে। তাদের অফিসেও কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার মাখা। সহকর্মীরা বিভ্রান্ত। কিছুটা আতঙ্কিত।    

সকাল হতে না হতেই মাকে ফোন করল সুজয়।  

“তুমি ঠিক আছ ? এখনই বাড়ি ফেরো।”     

“প্যানিক করছিস কেন ছোটু ?”  

“মা, ইয়ার্কি নয়। মহামারী লেগেছে। ফোরকাস্ট আছে দেশেও হবে।”    

“জ্ঞানের কথা রাখ। তোদের বাবার বসন্ত হল,  বিজয়ের হাম , সব কাটিয়ে দিলাম একার ঘাড়ে।    এখন বুড়ো বয়সে আতঙ্ক?”    

“এ সেই বসন্ত নয় মা। ভয়ংকর!”  

“গুটি বসন্ত আমার বাবাকে খেয়েছিল।  মাকেও। তুই কাকে ভয় দেখাচ্ছিস ছোটু?”   

“ভ্যাকসিনে সেই গুটি বসন্ত পৃথিবী থেকে পাকাপাকি  উধাও। এই জ্বরটার কিন্তু  কোনও ওষুধ  নেই মা।”      

“মৃত্যুভয়ের  টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি ছোটু।”   

সুজয় থমকে গেল।  

“তুমি তাহলে বাড়ি ফিরবে না?”  

“তুই আয়। তারপর।”  মায়ের নির্লিপ্ত স্বর।  

ফোন রেখে মেলবাক্স চেক করল সুজয়। বসের আর্জেন্ট নোটিশ । ওয়ার্ক ফ্রম হোম। 

শুধু তাইই নয়, আরও একটা খবরে পিলে চমকে গেল সুজয়ের।  আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। সমস্ত বিমানের টিকিট ক্যানসেল। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল সুজয়।   

মানে? ঘরে ফেরা হবে না? পরিযায়ী পাখির মতো আটকা পড়ে থাকতে হবে এখানে! হে ঈশ্বর!   

ক’টা দিন ঘোরের মধ্যে কাটল সুজয়ের। রোগটা হু হু করে ছড়াচ্ছে। শহরের মধ্যে ঘোরাফেরা নিষেধ। ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের মধ্যে পাগল পাগল লাগছে। সুপারমার্কেট থেকে খাবার দাবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু মুখোমুখি কথা বলার একটা লোক নেই। ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে  জনপ্লাবিত যে স্ত্রাদুনকে রোজ দেখা যায়, আজ শুনশান। প্রেতপুরী।   

শ্রেয়ার সঙ্গে স্কাইপে রোজ  কথা হয় সুজয়ের। কলকাতার অবস্থাও ভাল না। অতিমারি  ঠেকাতে  লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। যে যার ঘরে বন্দী।  

শ্রেয়ার ছলছলে চোখে একটাই জিজ্ঞাসা।  

“আমাদের আবার দেখা হবে তো?”  

সুজয় জানে না কী উত্তর দেবে। এ মহামারীর শেষ কোথায় , কবে কে জানে! 

শেষরাতে ঘুম ভাঙল ফোনের আওয়াজে। 

“ঘুমাচ্ছিলি ছোটু?”  

“কী হয়েছে মা?”  সুজয়ের বুক ছ্যাঁত করে উঠল।  

“বউমার ঘুষঘুষে কাশি। পাঁচদিন ধরে জ্বর।”  

“আর তুমি?”   

“আরে, আমি ঠিক আছি ।  বাড়িতে। ভাগ্যিস একটা ট্যাক্সি  নিয়ে চলে এলাম।  পরদিনই লকডাউন করেছে।”  

“দাদা?”   

“বলদটা কিচ্ছু জানায়নি আমাকে। ভাগ্যিস তিন্নি ফোন করল।” 

“বউদির কী হয়েছে? ডাক্তার দেখিয়েছ?”  

“দোতলায় আলাদা ঘরে রেখেছি। ডাক্তার বলল দু’হপ্তা ছোঁয়া যাবেনা।”

“তোমরা?”    

“বড়খোকা আর তিন্নি একতলায়। আমিই বউমাকে দেখব। ভাবিস না। বউমা আগে সুস্থ হোক।”

সুজয়ের বুক ধুকপুক। মহামারী কী তাদের ঘরেও ঢুকল?    

“তোর কাঁচাঘুম ভাঙ্গালাম। এখানে  সকাল আটটা” ।  

“কী হবে মা?” সুজয় ডুকরে কেঁদে উঠল।   

ফোনের ওপার থেকে একটা কঠিন প্রত্যয়ী গলা ভেসে এল।   

“অসুখবিসুখ আহ্লাদ  সব নিয়েই জীবন, ছোটু। মরার আগেই মরে যেতে নেই। কতো দেখলাম।”   

“তোমাকে বড্ড ছুঁতে ইচ্ছে করছে মা!”   

“এই তো, নিজের বুকে হাত রাখ। আমি ওখানেই আছি সবসময়। তোরাই তো আমার ফাগুন রে।  যা ওঠ, চা বানা।”   

 পর্দা সরিয়ে জানলা দিয়ে আকাশ দেখল সুজয়।  ভোরের লাল সূর্য। দূরে  সমুদ্রে  পালতোলা জাহাজের সারি চলমান। গাঙচিলের দল উড়ছে দলে দলে।   

এখনই শ্রেয়াকে ফোন করবে সুজয়। বসন্তদিন আসবেই।  তার পায়ের আওয়াজ শুনে ফেলেছে সুজয়। লাল আলতা পরা পায়ের নূপুরধ্বনি।  গুজরীপঞ্চম।    

পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।

7 Responses

  1. মনে হচ্ছে আমিই পরীক্ষা পাশ করেছি। আমি তোকে লিখতে বলেছিলাম একদা। কত যে ম্যাচিওর করেছিস… কী গভীর লেখা, বলে বোঝাতে পারছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *