আগের পর্বের লিংক:

[লপসি ও লপ্সিকার জন্য বিপ্লব], [বাঙালি পুরুষ যখন রাঁধুনি], [মাছের মাংসের কারি]

অন্য সমাজের কথা জানি না, তবে বঙ্গসমাজে রান্নার অনেক ক্ষমতা। ক্ষমতা আসলে রান্নার নয়, ক্ষমতা রান্নাঘরের অধিকারিণীর। তিনি যৌথ পরিবারের অন্দরের পরিচালক– বঙ্কিমের ভাষায় তাঁকে ঝুনো নারকেল বলা চলে, তার ওপরে দাঁত ফোটানোর জো নেই। 

আসলে উনিশ শতকে বাঙালি মেয়েদের হাতে বাইরের কর্তৃত্ব আর কতটুকু! তাই অন্দরে কর্তৃত্বের অধিকার নিয়ে মেয়েমহলে নানা টানাপড়েন। ভাঁড়ার, রান্নাঘর এসব যেন এক-একটা দুর্গ। কার দখলে থাকবে তা নিয়ে কত কথা, ছোট কথা– সে কথায় ক্ষমতা প্রদর্শনের হীনত্ব যেমন আছে, তেমনি একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে যিনি ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন তিনিও আসলে নিতান্তই বেচারা! বঙ্কিমের সাহিত্যে অন্দরের কর্তৃত্বময়ী বাঙালিনীদের নিয়ে উপমার মধ্যে যে কৌতুক রয়েছে, তাকে নির্দোষ বলা যাবে না। সন্দেহ নেই, একেলে নারীবাদীরা এর মধ্যে আপত্তিকর নানা ইশারা খুঁজে পাবেন। নারীবাদীদের যুক্তি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে বঙ্গসমাজের অন্দরমহলের কথা বুঝতে গেলে, রান্নাঘরের ক্ষমতার রূপ-স্বরূপের ইতিহাস জানতে গেলে, এই সব ইশারায় কান পাততে হবে, শুনতে হবে রান্নাবান্না নিয়ে মেয়েদের কথোপকথন।  

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ কেরি, সংকলন করেছিলেন মুখের বাংলার নমুনা। সে বইয়ের নাম ‘কথোপকথন’। বঙ্গসমাজের নানা শ্রেণির মানুষের সংলাপে ভরা সে বইতে মেয়েদের কথোপকথনও ঠাঁই পেয়েছিল। সে কথাবার্তায় ঘর-সংসার আর রান্নাবান্নার নানা আখ্যান-ব্যাখ্যান। 

‘আসোগো ঠাকুরঝি নাতে যাই।
ওগো দিদি কালি তোরা কি রাধেছিলি।
আমরা মাচ আর কলাইর ডাইল আর বাগুন ছেঁচকি করেছিলাম।
তোরদের কি হইয়াছিল।
আমদের জামাই কাল আসিয়াছে রামমুনিকে নীতে। তাইতে শাকের ঘণ্ট সুক্তনি আর বড়া বাগুণ ভাজা মুগের ডাইল ইলসা মাচের ভাজা ঝোল ডিমের বড়া আর পাকা কলার অম্ল হইয়াছিল।’

অর্থাৎ মেয়েকে জামাই নিতে এসেছে, তাকে খাতির করে নানা পদ খাওয়ানো হয়েছে। কথা অবশ্য সেখানেই থেমে গেল না। কে গতর খাটিয়ে রান্না করেছে, কথা উঠল তা নিয়েও। মেয়েমহলে রান্নাঘরের আধিপত্য যাঁর হাতে, তিনি নিজে গতর তেমন খাটান না, অন্যদের খাটিয়ে নেন। ছেলের বউদের কাজ করিয়েই শাশুড়ির আনন্দ। বউদের মধ্যে যে কাজ করতে চায় না, সে শাশুড়ির মুখ ঝামটার শিকার। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে তার নামে নিন্দা করতে শাশুড়ির মন-মুখ আনচান করে। কেরির সংকলনে শাশুড়ি তাই করেছে। 

‘সকল কাজি বড় বউ করে ছোট বৌডা বড় হিজলদাগুড়া অঙ্গ লাড়ে না আর সদায় তাঁর ঝকরা কি করিব বুন সহিতে হয় যদি কিছু বলি তবে লোকে বলিবে দেখ এ মাগী বৌদের দেখিতে পারে না।’ 

বুঝতে অসুবিধে হয় না বউ-শাশুড়ি কোন্দলে মাঝে-মাঝে শাশুড়িকেও কথা না শুনিয়ে চুপ করে যেতে হয়। ‘হিজলদাগুড়া’ অঙ্গ না-নাড়া ছোট বউকে সবসময় কথা শোনানো যায় না। কারণ সামাজিক চাপ– মেয়েমহলে মুখরা বলে পরিচিতি প্রাপ্তি শাশুড়ির পক্ষে খুব সুখকর নয়। 

 

আরও পড়ুন: মন্দার মুখোপাধ্যায়ের কলমে: সর-পর

 

কেরির সংলাপ-সংকলনে যা মেয়েদের মুখের ভাষার নমুনা, ঈশ্বর গুপ্তের পদ্যে তা স্মরণযোগ্য সরস পদ। বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তকে খাঁটি বাঙালি কবি বলে চিহ্নিত করেছিলেন– ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্য-বাহিত ভাব ও ভাষা নেই। একদিক থেকে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার জগৎ তাই বাঙালি সমাজের ছোটখাটো বিষয়কে প্রকাশ করেছে। এসেছে মেয়েদের রান্নাঘরের কথাবার্তার প্রসঙ্গ– ছবির মতো সেই সব বিবরণ। কথা দিয়ে ছবি বুনেছেন তিনি। ঈশ্বর গুপ্ত কাব্যতত্ত্ব নিয়ে সচরাচর মাথা না-ঘামালেও ‘কবি’ নামের একটি কবিতায় লিখেছিলেন, 

চারু বিশ্ব করি দৃশ্য চিত্রকর কবি।
স্বভাবের পটে লেখে স্বভাবের ছবি।।
কিবা দৃশ্য কি অদৃশ্য সকলি প্রকট।
অলিখিত কিছু নাই কবির নিকট।।

রান্নাঘরের বাঙালিনীদের কথার পেছনে যে মনটি রয়েছে, সেই মন সামাজিক অনুদারতার চাপে ঈর্ষাকুটিল, সংকীর্ণ। সেই সংকীর্ণতার চলচ্ছবি ঈশ্বর গুপ্তের পদ্য। প্রকট কথা আর অপ্রকট মন দুই তাঁর পদ্যের বিষয়।

ইংরেজরা এদেশে এল। বাঙালির সামনে খুলে গেল নতুন-নতুন উৎসবের দোকানপাট। সাহেবদের উৎসব দিনমাফিক, ঘড়িধরা। সে উৎসবের আনন্দ বাড়ির বাইরে সামাজিক পরিসরে– গির্জায়, ক্লাবে, হোটেলে। কখনও আবার বাড়ির ডাইনিং রুমে। সে উৎসবে বাঙালি নেটিভদের প্রবেশাধিকার নেই। তবে খাওয়া-দাওয়ার আমোদ আহ্লাদের নতুন নতুন শব্দ কানে আসে। বাংলা ভাষা অনুকার কিম্বা ধ্বন্যাত্মক শব্দে সমৃদ্ধ। ঈশ্বর গুপ্ত ইংরাজি নববর্ষের উৎসবে সাহেবদের কাঁটাচামচে দিয়ে কাচের পাত্তরে নানারকম খানাপিনার ছবি কেবল ধ্বন্যাত্মক শব্দ দিয়েই এঁকে ফেলেন।

সাহেবের ঘরে ঘরে কারিগুরি নানা।
ধরিয়াছে টেবিলেতে অপরূপ খানা।।
বেরিবেষ্ট সেরিটেষ্ট মেরিরেষ্ট যাতে।
আগে ভাগে দেন গিয়া শ্রীমতীর হাতে।।
কট্‌ কট্‌ কটাকট্‌ টক্‌ টক্‌  টক্‌।
ঠুন্‌ ঠুন্‌ ঠুন্‌ ঠুন্‌ ঢক্‌ ঢক্‌ ঢক্‌।।
চুপু চুপু চুপ্‌ চুপ্‌ চপ্‌ চপ্‌ চপ্‌ চপ্‌।
সুপু সুপু সুপ্‌ সুপ্‌ সুপ্‌ সপ্‌ সপ্‌ সপ্‌।।
ঠকাস্‌ ঠকাস্‌ ঠক্‌ ফস্‌ ফস্‌ ফস্‌।
কস্‌ কস্‌ টস্‌ টস্‌ ঘস্‌ ঘস্‌ ঘস্‌।।
হিপ্‌ হিপ্‌ হুর্‌ রে ডাকে হোল ক্লাস।
ডিয়ার ম্যাডাম ইউ টেক্‌ দিস্‌ গ্লাস।।
সুখের সখের খানা হলে সমাধান।
তারা রারা রারা রারা সুমধুর গান।।

সাহেবদের খাওয়া, টেবল ম্যানার্স, পারস্পরিক আলিঙ্গন, চুম্বন, করমর্দন সবই ধরা পড়ছে এই ধ্বন্যাত্মক শব্দাবলিতে। এই খাওয়ায় উৎসবের আনন্দই মুখ্য– সমৃদ্ধি আছে বলে ঈর্ষা-মলিনতার টানাটানি নেই– অন্তত ঈশ্বর গুপ্তের পদ্যে তা ধরা পড়েনি। এরই বিপরীতে তিনি এঁকেছেন বাঙালির পৌষ-পার্বণের ছবি। সেখানে মহিলামহলের মুখরতা, মালিন্য ধরা পড়েছে কথায় কথায়।

দুঃখ কমবেশি সব মেয়েদেরই আছে। নিজের দুঃখ ও অপ্রাপ্তি ঢাকার জন্য অপরকে খোঁটা দেওয়া বাঙালিনীদের স্বভাব। বিশেষ করে উৎসবের দিনে রান্না খারাপ হলে বাড়ির বউকে শাশুড়ি যেভাবে কথা শোনান, তার মধ্যে তীব্র হিংস্রতা আছে। দোষের মধ্যে পায়েসের তলা ধরে গিয়েছিল। ব্যাস! শাশুড়ির মুখ তো নয় যেন আগ্নেয়গিরির লাভা!

হ্যাঁলো বউ কি করলি দেখে মন চটে।
এই রান্না শিখেছিস মায়ের নিকটে?
সাত জন্ম ভাত বিনা যদি মরি দুখে।
তথাচ এমন রান্না নাহি দিই মুখে।

রান্না ধরে গেছে বলে মেয়েটির বাপের বাড়ি তুলে গালাগাল দেওয়া হল। বলে দেওয়া হল না খেতে পেয়ে মরে গেলেও তার রান্না মুখে তোলা যাবে না। এই গঞ্জনা শুনে বধূর মুখ ‘সলিলে ভাসিয়া যায় চক্ষু ছলছল।’ কবিতায় আর একটি মেয়ের কথাও আছে। ভাল রান্না করেছে সে। তাই কাঁদতে হল না, দেমাক দেখাতে পারল।

ভাগ্যফলে রান্না সব ভাল হয় যাঁর।
ঠ্যাকারেতে মাটীতে পা নাহি পড়ে তাঁর।।

নিজের গর্ব প্রকাশ করে নথ নেড়ে উৎসব বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে প্রশংসাবাক্য শোনার জন্য সে নানা কথা বলে। তার বাচনভঙ্গির সঙ্গে অঙ্গভঙ্গির ছবিও তুলে ধরেন গুপ্তকবি। 

‘হ্যাঁগা দিদি এই শাক রাঁধিয়াছি রেতে।
মাথা খাও সত্যি বল ভাল লাগে খেতে?’
‘দিব্বি দিস কেন বোন্‌ হেন কথা কয়ে?
ষাট্‌ ষাট্‌ বেঁচে থাক জন্ম এয়ো হয়ে।।
পুরুষেরা ভাল সব বলিয়াছে খেয়ে।
ভাল রান্না রেঁধেছিস ধন্য তুই মেয়ে।।’

মেয়েকে জামাই নিতে এসেছে, তাকে খাতির করে নানা পদ খাওয়ানো হয়েছে। কথা অবশ্য সেখানেই থেমে গেল না। কে গতর খাটিয়ে রান্না করেছে, কথা উঠল তা নিয়েও। মেয়েমহলে রান্নাঘরের আধিপত্য যাঁর হাতে, তিনি নিজে গতর তেমন খাটান না, অন্যদের খাটিয়ে নেন। ছেলের বউদের কাজ করিয়েই শাশুড়ির আনন্দ। বউদের মধ্যে যে কাজ করতে চায় না, সে শাশুড়ির মুখ ঝামটার শিকার। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে তার নামে নিন্দা করতে শাশুড়ির মন-মুখ আনচান করে। 

পুরুষেরা রান্নার গুণ গাইলে তবে নারীজন্ম সার্থক। পুরুষের মন গলাতেই মেয়েদের রান্না আর খাওয়ানো– আদরের আতিশয্য। একান্নবর্তী পরিবার থেকে নিজের কত্তাকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদর করে খাওয়ানো ছাড়া আর কী উপায়? আদর করে খাওয়ানোর ছবিটি রঙ্গময়।

‘মাথা খাও খাও’ বলি পাতে দেয় পিটে।
না খাইলে বাঁকামুখে পিটে দেয় পিটে।।’ 

মুখ বাঁকিয়ে পিঠে চারুকিল দেওয়ার কারণ কী? একান্নবর্তী পরিবারের বাইরে নিজের ছোটো সংসার গড়ার স্বপ্নে বউটি বিভোর। গুপ্তকবির সাবধানবাণী ঘরভাঙার বিরুদ্ধে উচ্চারিত। 

‘কামিনী-কুহকে পড়ি খায় যেই হাবা।
নিজে সেই হাবা নয় হাবা তার বাবা।।’

বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন ঈশ্বর গুপ্তের মতো খাঁটি বাঙালি কবি আর চাই না। বাঙালির অন্দরমহলের ‘খাঁটি সংকীর্ণতাও’ দূর করতে চেয়েছিলেন বঙ্কিম। সে সংকীর্ণতা অবশ্য দূর হওয়া কঠিন। রান্নাকে ঘিরে বাঙালির অন্দরমহলের ‘ছোটত্ব’ মেয়েদের মধ্যে আজও উঁকি মারে। অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার বেদনা থেকে একে অপরের ওপর বিষবাক্য প্রয়োগ করেন তাঁরা। রান্নার স্বাদ মধুর, কিন্তু বাক্যবাণ তো মধুর নয়– ছোট মনে আর ছোট ঘরে সেই বিষবাক্যরাজি টগবগ করে ফুটতে থাকে। 

বিশ্বজিৎ রায়ের জন্ম ১৯৭৮-এ, কলকাতায়। রামকৃষ্ণ মিশন পুরুলিয়ায় স্কুলজীবন কাটিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশুনো। উভয় পর্যায়েই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। বর্তমানে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন। এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যজগতে সুপরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ: স্বদেশে সমকালে’, ‘সচলতার গান’, ‘সব প্রবন্ধ রাজনৈতিক’। এর বাইরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মুক্তগদ্যের বই ‘ঘটিপুরুষ’, ‘অন্দরবেলা’ ও ‘ইস্কুলগাথা’ এবং পদ্যের বই ‘বিচ্ছেদ প্রস্তাব’ ও ‘গেরস্থালির পদ্য’। ‘ঘটিপুরুষ’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন নীলাঞ্জনা সেন স্মৃতি পুরস্কার।

2 Responses

  1. অপূর্ব। অদ্ভুত। এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যেটা অনেকেরই মাথায় আসবে না। সম্পূর্ণ ‌‌‌‌‌‌অজানা এক বিষয় বস্তু কে তুলে ধরেছেন,স্যার। ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *