‘রবিরাগে’র দ্বিতীয় পর্বে রবীন্দ্র-গানে খাম্বাজের প্রয়োগ ও রবীন্দ্র-ভাবনায় প্রাপ্ত খাম্বাজের রূপ নিয়ে কিছু কথা বলেছি। খাম্বাজের যে যে প্রকারগুলি উল্লেখ করেছিলাম, তার মধ্যে ছিল খাম্বাজ, মাজ-খাম্বাজ, গারা-খাম্বাজ ও খাম্বাজ-বাহার। খাম্বাজ, মাজ-খাম্বাজ ও গারা-খাম্বাজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। মাজ-খাম্বাজের প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মাইহারের যন্ত্রসংগীত ঘরানার আদান-প্রদান নিয়েও আলোচনা করেছি একটি আলাদা পর্বে।
আজ এই পর্বের আলোচনা খাম্বাজ-বাহার নিয়ে। এই পর্বটি ইচ্ছে করেই ছোট রাখব, যেহেতু প্রায় মাসাধিক বিরতির পর আবার লিখছি।
বসন্ত এবং বাহার রাগে রবীন্দ্রনাথের গান আমরা পাই। বসন্তের বিভিন্ন প্রকারেও রবীন্দ্রনাথের গান পাই।
বসন্তের প্রচলিত–অপ্রচলিত প্রকারগুলি একটু দেখা যাক, কেমন!
বসন্ত – হ্মা ধা র্সা নি ধা পা হ্মা গা, হ্মা গা রে সা, সা সা মা, মা হ্মা মা গা, হ্মা ধা নি র্সা।
আদি বসন্ত – গা মা ধা নি র্সা নি ধা মা, গা মা গারে সা, ধা্ নি্ সা মা
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা উচিৎ, যাকে বলছি আদি বসন্ত, সেই রাগই দাক্ষিণাত্যে বসন্ত বলে পরিচিত। উত্তর ভারতে শুদ্ধ সোহিনী বলে একটি রাগ রয়েছে, খুব যে গাওয়া বা বাজানো হয়, এমন নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘প্রথম আদি তব শক্তি’ গানটি ওই রাগেই বাঁধা। গানটি বাইজু বাওরার একটি ধ্রুপদ থেকে প্রতিগৃহীত।
শুদ্ধ বসন্ত – ধা্ নি্ সা গা মা, গা মা ধা হ্মা ধা, নি নি র্সা, র্সা নি ধা, হ্মা ধা হ্মা মা গা, গা মা গারে সা
বসন্ত পঞ্চম – ধা্ নি্ সা গা মা, গা মা ধা নি র্সা নি ধা মা, পামাপা মা, গা মা রে সা

‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের ‘রাজভবনের সমাদর সম্মান ছেড়ে’ গানটি যদি মনে করেন, দেখবেন, গানে প্রাপ্ত স্বরসংগতির সঙ্গে মিল রয়েছে বসন্ত পঞ্চমের চলনের; অর্থাৎ সমগ্র গানটিই বসন্ত পঞ্চম রাগে বাঁধা। গানের স্বরলিপিতে সরাসরি না গিয়ে যদি গানের স্বরসমষ্টিগুলিকে ভেঙে দেখি, তবে এমন হবে –
নি র্সা র্গা র্রে র্সা, নি র্সা র্রে র্সা নি ধা, পা, পা মা গা পা মা
মা মা পা গা, মা ধা নি র্সা
আদি বসন্তে পঞ্চমের ব্যবহার করলেই বসন্ত পঞ্চম হয়, এমন সামান্যীকরণ করা অসংগত নয়, কারণ, তেমনটাই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, বসন্ত পঞ্চমে পঞ্চমের গুরুত্বের কোনও ব্যাখ্যা তা থেকে পাওয়া যায় না। বসন্ত পঞ্চমে পঞ্চমের তাৎপর্য তখনই বোঝা যাবে, যখন দেখব, পঞ্চমের প্রয়োগের ধরণ কেমন। খতিয়ে দেখলে, এবং অবশ্যই রবিশংকরের বাদন অনুসরণ করলে পঞ্চমের প্রয়োগে লক্ষ্য করব বিশেষ মনোযোগ। কখনই পঞ্চমের স্বাধীন অস্তিত্ব চোখে পড়ে না— সবসময়ই পঞ্চম ধৈবত ও মধ্যমের মাঝে। মাজ-খাম্বাজের কথা মনে করুন; আমি লিখেছিলাম, গান্ধার ও পঞ্চমের প্রাধান্য পুরোপুরি নির্ধারিত হচ্ছে মধ্যম ও ধৈবতের দ্বারা। এক্ষেত্রে গান্ধারের ব্যবহার ভিন্ন। মধ্যমে যখন অবস্থানের প্রশ্ন আসে, অনেক সময়ে পঞ্চম কণ-যুক্ত মধ্যম দেখি, যার আধার গান্ধার। পঞ্চম একটি ভিন্ন স্বর হিসেবে একটি স্বরসমষ্টিতে এসে পড়ে, কিন্তু, পঞ্চমে স্থায়ী অবস্থান শিল্পীর পক্ষে সম্ভব নয়; এমনকি পঞ্চমে সরাসরি আসাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। পঞ্চমে সবসময়েই, অন্তত বেশিরভাগ সময়েই; তিনি উপনীত হতে পারেন তখনই, যখন স্বরসমষ্টি অবরোহণ-স্বরূপ হয়; এবং, পঞ্চমে অবস্থানের সময় কখনই মধ্যম বা ধৈবতের চেয়ে বেশি নয়।
আলোচ্য রবীন্দ্র-গানে দেখব, যে জায়গায় পাচ্ছি, ‘সমাদর সম্মান ছেড়ে এল আমাদের সখি’, সেখানে ‘ছেড়ে’, এই দুই ধ্বনির অবস্থান পঞ্চমে। যতগুলি মাত্রা ‘সমাদর সম্মান’-এ, অর্থাৎ ধৈবত-কেন্দ্রিক স্বরসমষ্টিতে, এবং ‘এল আমাদের সখি’তে, অর্থাৎ মধ্যম কেন্দ্রিক স্বরসমষ্টিতে, তার তুলনায় ‘ছেড়ে’তে মাত্রাসংখ্যা কম— দুই মাত্রা। যে স্বরসমষ্টিতে ‘ছেড়ে’ অবস্থিত, তা অবরোহন-কেন্দ্রিক। গান্ধারের আধারে পঞ্চম কণ-যুক্ত মধ্যমও গানটিতে খুবই প্রকট; ‘এল আমাদের সখি’ বা ‘দিক নিরখি’তে তেমনই পাব। সমগ্র গানটিতেই দেখব, আরোহণ-কেন্দ্রিক স্বরসমষ্টিতে পঞ্চম নেই, সেখানে গা মা ধা নি র্সা, এমনই হতে থাকে।

আরও একটি রবীন্দ্র-গান যদি ধরি, ‘আজি দক্ষিণ পবনে’, সেখানেও এই একই ব্যাপার লক্ষ্য করব। এই গানটি কিন্তু সম্পূর্ণত বসন্ত পঞ্চমে নয়। কিন্তু, গানটির যতটুকু অংশ বসন্ত পঞ্চমে, তাতে দেখব, ‘দোলা লাগিল বনে বনে’তে পঞ্চম অবস্থিত আবারও একটি অবরোহণ-কেন্দ্রিক স্বরসমষ্টিতে, এবং আবারও সেই গান্ধারের আধারে পঞ্চম কণ-যুক্ত মধ্যম।
এই গান্ধারের আধারে পঞ্চম কণ-যুক্ত মধ্যমের প্রসঙ্গেই আসি রবীন্দ্রনাথের বাহার রাগের একটি গানে। ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’ গানটিতে সঞ্চারীতে আমরা দেখি সুরের চলন দিক পরিবর্তন করে বসন্ত পঞ্চমের দিকে চলেছে, ‘সুদূর দিগন্তে’-র কাছে সেই বিশেষ চলন পাব। কিন্তু, বাকি গানটিতে যদি বাহারের রূপ খুঁজি, তাহলে সেখানে, বা রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য বাহার রাগাশ্রিত গানে যে রূপ পাব, দেখব, তার সঙ্গে প্রচলিত বাহারের খুব পার্থক্য নেই। যেটুকু পার্থক্য, তা গানের খাতিরে।
বাহারের রাগ রূপ – ধা নি র্সা নি পা, মা পা গা মা নি ধা, ধা নি র্সা নি পা, মা পা গা মা রে রে সা।
আপাতভাবে মনে হতে পারে মল্লারের সঙ্গে এই রাগের মিল আছে, কিন্তু রসিক শ্রোতা-মাত্রেই পার্থক্য ধরতে পারবেন।
রবীন্দ্রনাথের বাহার রাগের যে গানগুলি, তাতেও আমরা দেখব, স্বরসমষ্টিগুলি বাহারের উপরোক্ত রূপেরই প্রকারান্তর। যা একটু বেশি দেখি, তা— মা নি ধা নি র্সা; যা খাম্বাজেও দেখি; কিন্তু, আবারও শুদ্ধ নিষাদে কতক্ষণ অবস্থান, তার ওপর নির্ভর করে তফাৎ। তত্ত্বের খাতিরে এটুকু বলা যায়, বাহারে হয়ত নিষাদের দৈর্ঘ্য খাম্বাজের চেয়ে একচুল কম। তবুও, না শুনলে, বা না শিখলে এটি বোঝা সত্যিই অসম্ভব।

খাম্বাজের পূর্বাঙ্গ, আর বাহারের উত্তরাঙ্গ একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানে এসেছে। এই বিশেষ মেলবন্ধনকেই বলছি খাম্বাজ-বাহার। যে গানগুলিতে খাম্বাজ-বাহার লক্ষ্য করি, তার মধ্যে দুটি গানের কথা উল্লেখ করব লেখার শেষে— ‘ঝরো-ঝরো ঝরো-ঝরো ঝরে রঙের ঝর্না’ এবং ‘আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে’।
পূর্বাঙ্গের খাম্বাজ এবং উত্তরাঙ্গের বাহার যোগ করে খাম্বাজ-বাহারের যে রূপ রবীন্দ্রনাথের গান থেকেই পাই, তা হল এই – মা মা/মা পা ধা মা গা/মা ধা পা ধা/গা মা নি ধা, নি র্সা/মা ধা নি র্সা র্রে নি র্সা নি ধা/পা ধাপা মা গা মা
খাম্বাজের অংশে রবীন্দ্র-ভাবনা অনুযায়ীই গান্ধার ও পঞ্চমের প্রাধান্য পুরোপুরি নির্ধারিত হচ্ছে মধ্যম ও ধৈবতের দ্বারা। কিন্তু উত্তরাঙ্গে যখন বাহার এসে পড়ছে, তখন নিষাদের অবস্থানে পরিবর্তন ঘটছে। ‘ঝরো-ঝরো’তে ‘ঝরে রঙের’ জায়গায় স্পষ্ট পাব খাম্বাজ; মা পা ধা পা মা গা খাম্বাজের মূল স্বরসমষ্টিগুলির একটি। ‘ঝরনা’তেও মা ধা পা ধা পাই, যা খাম্বাজ, কিন্তু যেই ‘আয় আয় আয়’তে ধৈবত থেকে নিষাদে সুরের গতি বাঁক নেয়, বাহার স্পষ্ট হতে থাকে। আপাতভাবে শুনতে খাম্বাজের মতনই মনে হবে, কিন্তু, আবারও বলি, শোনার অভ্যেস থাকলে, শেখা থাকলে, পার্থক্য ঠিক ধরা যাবে। তুলনায়, ‘আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে’তে বাহারকে ধরা সহজ। ‘কেমন করে যায় যে ডেকে’তে মা নি ধা নি নি র্সা আঙ্গিকে যে স্বরসমষ্টি তাতে নিষাদের প্রয়োগে খাম্বাজের চেয়ে বাহারের আভাস পাওয়া যায় বেশি। একথা উল্লেখ্য, দুটি গানেই তার-সপ্তকে কোমল গান্ধারের ব্যবহার গান দুটিতে বাহারের উপস্থিতি স্পষ্টতর করে তোলে। ‘ঝরো-ঝরো’তে ‘বসন্ত পঞ্চমের রাগে’ বা ‘আজ নবীন মেঘের সুরে’ ‘সে পথ গেছে নিরুদ্দেশে’ যদি দেখা যায়, আমরা পাব—
নি র্সা র্রে র্সা র্রে র্মার্গা
ধা নি র্সা র্মা র্গা
সুভদ্রকল্যাণ বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র। বাংলা ও ইংরাজি উভয় ভাষাতেই তাঁর লেখা সংগীত ও সাহিত্য বিষয়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বহু বিশিষ্টজনের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছেন, সেগুলিও প্রকাশিত ও সমাদৃত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশ পেয়েছে। মূলত ইংরাজি ভাষায় কবিতা লেখেন সুভদ্রকল্যাণ। তাঁর আরেকটি পরিচয় রাগসঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। সংগীতশিক্ষা করেছেন আচার্য শঙ্কর ঘোষ, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, ডঃ রাজিব চক্রবর্তী প্রমুখ গুরুর কাছে। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা।