দাদুর কথা একটু বেশি করেই বলতে হয়, কারণ তাঁর কাছ থেকে অনাবিল স্নেহ পেয়েছি। বাবার দিকের আত্মীয়স্বজনের সম্ভাষণে মিষ্টত্বের কিছু অভাব বোধ করতাম। রাঙাকাকার মুখে শুনেছি, খুলনা জেলার লোকজন নাকি এমনই হয়। রাখঢাক নেই কথার। তবে মা মনে করতেন, বাবা সেজ ছেলে বলে আমাদের ভাগে ভালবাসা কম পড়েছে। কারণ ন’কাকার মেয়ে, ছোটকাকার মেয়ে পুজোয় জামাকাপড় উপহার পেত, ছোটপিসির ছেলেও পেত, আমরা কখনও পেতাম না।
আমাদের পুজোয় নতুন জামা দিতেন দাদু। মামারবাড়ি ছিল তখনকার বেহালার নিরিবিলিতে। অশোক সিনেমার স্টপে নেমে উল্টোদিকের গলি দিয়ে ভিতরে, বাঁ হাতে পড়ত প্লাস্টিক কারখানার রাঙা দেওয়াল। বাড়িটি দাদুরই বানানো। নাম দিয়েছিলেন, “বিজন বিপিন বিমলা নিলয়”। নামটা বুঝিনি যতক্ষণ না মা বলে দিলেন, বিপিন ও বিমলা দাদুর মা ও বাবা। দাদু পড়াতেন চেতলা বয়েজ় স্কুলে। সেখান থেকে হেঁটে আসতেন আমাদের হাজরা রোডের বাড়িতে, তারপর আশুতোষ কলেজের পিছনের গলি থেকে সাত নম্বর একতলা বাস ধরতেন।
এগারোটা কি বারোটা নাগাদ দাদুর বিশাল ছাতা দমকলের মাঠের ওধারের ফুটপাথে দেখা যেত জানলা দিয়ে। ‘মা, দাদু আসছে’, চেঁচিয়ে বলার অপেক্ষা। কখনও দাদু আসতেন বিকেলের দিকে। বাড়িতে যা আছে তাই খেতে দেওয়া হত তাঁকে। দাদু মাথায় লম্বা ছিলেন না, কিন্তু সবল, বলিষ্ঠ চেহারা ছিল। যৌবনে ব্যায়াম করতেন, কুস্তির চর্চা করতেন।
মামারবাড়ি ছিল তখনকার বেহালার নিরিবিলিতে। অশোক সিনেমার স্টপে নেমে উল্টোদিকের গলি দিয়ে ভিতরে, বাঁ হাতে পড়ত প্লাস্টিক কারখানার রাঙা দেওয়াল। বাড়িটি দাদুরই বানানো। নাম দিয়েছিলেন, “বিজন বিপিন বিমলা নিলয়”।
দাদু আসবেন আন্দাজ করেই মা বানিয়ে রাখতেন পুলিপিঠে, পায়েস কিংবা কড়াইশুঁটির কচুরি। ‘তোদের বাড়িতে যখনই আসি কিছু না কিছু ভাল খেয়ে যাই।’ মায়ের হাতে প্লেট দিয়ে দাদু বলতেন। কোনও কোনওদিন জানতে চাইতেন, ‘হ্যাঁরে দীপু (মায়ের ছোটবেলার নাম ছিল দীপ্তি বা দীপু, সেটা মা নিজেই বদলে করেছিলেন নমিতা), অনিল (বাবার নাম) কত বেতন পায়?’ যেন ভাল খাবারের সঙ্গে বেতনের একটা সম্পর্ক আছে।
দাদু আমাকে বড়ই স্নেহ করতেন। আর আমিও দাদুকে খুব ভালবাসতাম। অনেকটা ব্যক্তিস্বার্থেরই কারণে। পিতামহ বা ঠাকুরদা চলে গেছেন খুব ছোটবেলায়, তাঁর স্মৃতি ঝাপসা অনেকটাই। শেষ বয়সে তিনি ও ঠাকুরমা থাকতেন ছোটকাকার শিয়ালদহের হায়াৎ খাঁ লেন বলে এক গলির বাসায়, সেটা বেড়ানোর পক্ষে খুব মন ভাল করা ছিল না।
মামারবাড়ি যেতে ভাল লাগত। বেহালা চলে যেতাম কালীপুজোয়, রাতে থাকতাম। চোদ্দো প্রদীপের বিকেল থেকে, কালীপুজার দিন বাজি কিনে রাতের বেলা ছাদে ফোটানোর বিকট মজা। পরেরদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ি। দুই দাদা,আমি, দুই মাসি লম্বা টানা তক্তপোশে শুয়ে অনেক রাতপর্যন্ত গল্প, হাসাহাসি। বিয়ের পর মামা চলে গেলেন মামিমাকে নিয়ে রাউরকেলায়।
সারা বছর আমি পথ চেয়ে থাকতাম, কখন কালীপুজোর আগের দিন দাদু গঙ্গাজল নিতে আদিগঙ্গায় আসবেন আর আমাদের তিন ভাইবোনকে সঙ্গে করে সাত নম্বর বাসে চাপিয়ে নিয়ে যাবেন বেহালা। চোদ্দো শাক দিয়ে মাখা রঙিন ভাত আর মাছ খেয়ে অধীর আগ্রহে বারবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতাম। বাবা এসে একটু ভয় ধরিয়ে দিতেন, ‘দাদু না এলে কিন্তু আমি পৌঁছে দিতে যাব না, মনে রেখ।’
চোদ্দো প্রদীপের বিকেল থেকে, কালীপুজার দিন বাজি কিনে রাতের বেলা ছাদে ফোটানোর বিকট মজা। পরেরদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ি। দুই দাদা,আমি, দুই মাসি লম্বা টানা তক্তপোশে শুয়ে অনেক রাতপর্যন্ত গল্প, হাসাহাসি।
কালীপুজো ছাড়াও মায়ের সঙ্গে মামারবাড়ি যাওয়ার একটা মজা ছিল। ওখানে নাকি ভাল মিষ্টি পাওয়া যায় না। তাই মা বাপের বাড়ি যাবার আগে নিজেদের পাড়া থেকে গাঙ্গুরামের চমচম আর উজ্জ্বলা সিনেমা হলের উল্টেদিকের ঘুপচি দোকানের চানাচুর আনিয়ে রাখতেন। আমি গিয়েই তাক থেকে বই টেনে নিয়ে পড়তে বসতাম। মামারবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, বিভূতিভূষণের বই দেখতাম না, দেশ বা সন্দেশ পত্রিকাও না। প্রাইজে পাওয়া বা দোকানে কেনা অন্যরকমের বই। শিবরাম চক্রবর্তী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, আশাপূর্ণা দেবী, ঠাকুরদাদার থলে (যা আমাদের বাড়ির ঠাকুরমার ঝুলি থেকে অন্য স্বাদের) ছিল। আর থাকত বাঁধানো পুজোবার্ষিকী, অনেক বছরের। এছাড়াও ছিল সচিত্র গোপাল ভাঁড় আর কোনও বোকা জামাইয়ের গল্প, যার ভাষা মায়ের মাপ অনুযায়ী শালীন নয়। ওখানে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে নিতাম, কারণ এসব আমাদের বাড়িতে কদাপি ঢুকবে না জানা ছিল।
তখনও সামনের প্লাস্টিক কারখানার খালি জমিতে অজস্র গাছপালা ছিল, বড় বড় নারকেল, কলা বাগান, অন্য বড় গাছ, পুকুর ছিল ওই জমিতে। মামাবাড়ির একেবারে পিছনেই ছিল সবুজ পানায় ঢাকা পুকুর। শীতের রাতে ওখান থেকে হিম উঠে আসত। লেপের মধ্যেও ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বড় তক্তপোশের বিছানায় এক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম।
দাদুকে আরও একটা কারণেও আমার পছন্দ হত। একমাত্র দাদুই আমাকে বলতেন, কবিতার খাতা আনো, নতুন কবিতা শোনাও। কোনও কারণে ক্লাস ফোরে মাথায় ভূত চাপল ইংরিজিতে কবিতা লেখার। বাংলা মিডিয়ামের ক্লাস ফোরের ছাত্রীর ইংরাজি কবিতা কেমন হবে বোঝাই যায়, কিন্তু বাঙালির রক্তে যে মাইকেল মধুসূদন! সেই সব ইংরিজি লেখা ডায়েরি দাদু নিয়ে গিয়ে পড়াতেন তাঁর এক ছাত্রের বাবাকে।
কয়েকটি বাড়িতে টিউশন পড়াতেন দাদু, সংসার চালানোর জন্য বাংলা ও ভূগোলের শিক্ষকের পক্ষে গৃহশিক্ষকতা জরুরি ছিল। দাদুর উৎসাহে আমি নিজের লেখা বাংলা কবিতা ইংরিজিতে অনুবাদ করতে লাগলাম। ভাগ্যিস ওই কলঙ্কিত ডায়রিগুলি পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে। তাই আমার অতীত আর আমাকে তাড়া করে বেড়াতে পারে না।
কালীপুজো ছাড়াও মায়ের সঙ্গে মামারবাড়ি যাওয়ার একটা মজা ছিল। ওখানে নাকি ভাল মিষ্টি পাওয়া যায় না। তাই মা বাপের বাড়ি যাবার আগে নিজেদের পাড়া থেকে গাঙ্গুরামের চমচম আর উজ্জ্বলা সিনেমা হলের উল্টেদিকের ঘুপচি দোকানের চানাচুর আনিয়ে রাখতেন।
দাদুর সঙ্গে আমার অনেক রকম মজার খেলা ছিল। একবার কী একটা কবিতায় এমত বাক্য প্রয়োগ “I am higher than a mountain, more transparent than a fountain” দেখে যারপরনাই মেতে উঠলেন দাদু। কালীপুজোর কাল নয়। তবু মাকে বললেন, ওকে দুদিনের জন্য নিয়ে যাব দীপু, জামাকাপড় গুছিয়ে দে। আমাকে বলা হল ডায়রি সঙ্গে নিতে।
সন্ধের ভিড় ঠাসাঠাসি সাত নম্বর বাস। পিছনের গেটের কাছে সিটে আমি। দাদু বসার জায়গা পাননি। সামনের দিকে দাঁড়িয়ে। হাতে কবিতার ডায়েরি। ভিড় ঠেলে উল্টো বাগে আমার দিকে চলে আসছেন ঠেলেঠুলে, পা মাড়িয়ে । লোকে চেঁচাচ্ছে, দাদা কোথায় চললেন! দাদু আমাকে প্রশান্ত মুখে বলছেন, আচ্ছা এই যে তুমি এই ইংরিজিটা করেছ, এর চেয়ে ভাল তো হত এই শব্দটা! এরকম দু’বার করার পর জনচাপে দাদুকে আমার সিটের সামনেই দাঁড়াতে হল বাধ্য হয়ে।
তখন কি জানি, দাদুর মাথায় কী বুদ্ধি খেলা করছে! এক স্টপ আগে নামা হল। অশোকায় নামলে নাকি চেনা লোক দেখে ফেলবে। প্ল্যান হল, বাড়ি গিয়ে আমি নীচে দাঁড়িয়ে থাকব। দাদু আমাকে লুকিয়ে রেখে একা দোতলায় যাবেন। ব্যাগ হাতে কয়লার ঘর যেটা সিঁড়ির মুখে, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মনে ঈষৎ উৎকণ্ঠা। শুনছি, দাদু দিদিমাকে বলছেন, ‘একটি ছোট মেয়ে, জানো বাসস্টপে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, ওকে বাড়ি নিয়ে এলাম।’ দিদিমা রাগ করছেন, ‘কেন নিয়ে এলে, এখন আমি কী করি? কোথায় সে?’ এইসব গন্ডগোলের মধ্যে ছোটমাসি নীচে নেমে আমাকে দেখতে পেয়ে খুশিতে আটখানা।
স্বাধীনতা-উত্তর দেশে, ভূমিহীন মধ্যবিত্তের তখন একমাত্র অবলম্বন, মেধা। স্কুলের রেজ়াল্ট হল মেধার মাপদণ্ড। মাসতুতো পিসতুতো খুড়তুতো ভাইবোনেদের মধ্যে সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগে থাকত, আমাদের চেয়ে মায়েরাই বেশি ভাবিত হয়ে পড়তেন এই নিয়ে। মাসিরা যদিও দাদাদের বয়সী, দাদু-দিদিমা আমাদের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতার জায়গা রাখেননি। বড় মাসিমার মেয়েরাও পড়াশুনায় খুব ভাল। কিন্তু তারা আমাদের পরীক্ষার ফল নিয়ে বেশি কৌতূহল দেখাত। মা সেটা একেবারে পছন্দ করতেন না। আবার পিসতুতো ভাইয়ের রেজ়াল্টের চাপ এসে পড়ত মূলত আমার ছোড়দার উপর।
অশোকায় নামলে নাকি চেনা লোক দেখে ফেলবে। প্ল্যান হল, বাড়ি গিয়ে আমি নীচে দাঁড়িয়ে থাকব। দাদু আমাকে লুকিয়ে রেখে একা দোতলায় যাবেন। ব্যাগ হাতে কয়লার ঘর যেটা সিঁড়ির মুখে, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
আমি আর বড়দা ক্লাসে ফার্স্ট হতাম। ছোড়দা থাকত প্রথম সাতজনের মধ্যে। পিসির ছেলে তার স্কুলেই পড়ত, কোনওভাবে সে রেজাল্টে একটু এগিয়ে গেলে মায়ের হাতে ছোড়দার লাঞ্ছনার শেষ থাকত না। নিজের পছন্দে বাড়ির অমতে বর পছন্দ করার সিদ্ধান্ত মাকে দীর্ঘকাল এই আশঙ্কায় রেখেছিল, যদি ছেলে মেয়েরা মানুষ না হয়! আমাদের ডাক নাম দেওয়া হয়নি, জন্মদিনও করা হত না। পাছে আমরা আদরে বিগড়ে যাই। মা এত লোকাপবাদ কাতর ছিলেন যে, তার প্রতিক্রিয়ায় আমার অল্প বয়সেই যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে বীতরাগ জন্মে গিয়েছিল। ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে পরীক্ষায় প্রশ্ন ছেড়ে আসতাম, তাও নিজের ফার্স্ট হওয়া আটকাতে পারিনি। পরীক্ষা ব্যবস্থাটাই এমন ছিল।
আমার হায়ার সেকেন্ডারির আগের বছর দাদু চলে যান। যাওয়ার বয়স হয়নি। আকস্মিক কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। তাঁর সুদৃঢ় শরীর স্বাস্থ্য সত্ত্বেও স্কুল তাঁকে রিটায়ারমেন্টের পর আবার নিয়োগ করল না, এর অভাবনীয়তা তাঁকে অন্তরে বিষণ্ণ রাখত। বসতবাড়ি তো ছিল। কিন্তু,ছোটমাসির তখনও বিয়ে হয়নি। আয় কমে গিয়েছিল, অল্প পেনশনে আগের মতো মাছমাংস কিনতে পারতেন না, শাকসবজিতে অনভ্যস্ত পাকযন্ত্র মাঝেসাঝেই বিকল হত। শেষ যেবার আমাদের বাড়ি আসেন, মাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘দীপু তোর মেয়ের নাম কাগজে বেরবে দেখিস। অনেক ছাত্র পড়িয়েছি,আমি জানি।’
নিজের ভবিষ্যদ্বাণীর সাফল্য দেখার জন্য অবশ্য অপেক্ষা করতে পারেননি দাদু। তবে, কাগজে আমার নিজের নাম ও ছবি অনেকটাই ভিজে উঠেছিল চোখের জলে।
কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।
aapnar lekha baddo kaday. kato ki je mone pore jay. khub valo thakben. Pronam.
বড় মনকাড়া লেখা