একজনের পরনে লম্বা বিদেশি ধাঁচের গাউন, লেসের কাজ হাতে গলায়। মাথায় শক্ত করে বাঁধা খোঁপা, পায়ে মোজা জুতো। মুখখানিতে মেখে আছে এক চিরস্থায়ী বিষাদ। আর একজনের মুখে সে বিষাদ নেই কিন্তু। যদিও যুদ্ধ করেছে সেও বড় কম নয়। আঁটোসাঁটো করে পরা শাড়ি, লম্বা হাতা ব্লাউজ। সেই ব্লাউজের গলায়, হাতেও লেস– তবে ধরন খানিক দেশী। সময়টা উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক, ১৮৬০ এর দশক। একজন জন্ম নিয়েছেন দেরাদুনে, অন্যজন ভাগলপুরে। বাংলার মাটি তাঁদের জন্মস্থান নয়, বাল্যের ক্রীড়াক্ষেত্র নয়, কিন্তু যৌবনের সার্থক কর্মভূমি। এতটাই সার্থক যে বাংলার ইতিহাস, তাঁদের ছাড়া শ্বাস নিতে পারবে না। লক্ষণীয়, বাংলার নারীজাগরণের ইতিহাস শুধু নয়। যে আগুন ছাড়া, যে প্রজ্বলন ছাড়া উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের পথচলা থমকে যেত, সেই আলো সেই আগুনের গল্প।
শুধু পার্থক্য একটাই– একজনের জীবন, তার যুদ্ধ অবজ্ঞার ইতিহাস, না জানানোর প্রথা থেকে অনেকটাই মুক্ত। আমরা তাঁর নাম জানি, তার কথা বলি, ভাবি। আর একজন, একই সময়ের অংশ হয়েও একই পতাকার বাহক হয়েও কেমন যেন গ্রহণের ছায়ায় ঢাকা। কার গ্রহণ? নাকি এ আমাদের কষ্টকল্পনা? ইতিহাসের সমাপতন? সে কথা জানার আগে, বোঝার আগে পরিচয় পর্ব সেরে ফেলা যাক্। যে বিদেশি গাউন পরা মেয়েটিকে দিয়ে আমাদের ইতিহাসকথন শুরু, তাঁকে ইতিহাস চেনে চন্দ্রমুখী বসু নামে। জন্ম ১৮৬০, জন্মস্থান দেরাদুন। পিতার নাম ভুবনমোহন বসু। বাঙালী পরিবারটি, সেই যুগে অতদূরের পাহাড়ঘেরা জায়গায় বসবাস করেন কেন? তাও পরিবার সমেত? শস্যশ্যামলা সবুজ বাংলাদেশ কি তাদের হাতছানি দেয় না কোনমতেই? সে গল্প আবারও মিশে যাবে আমাদের অন্য এক আগুন মেয়ের গল্পের সঙ্গে।
যাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে সে যদি চন্দ্রমুখী হয়, অন্যজন কে? চন্দ্রমুখীর বাবা ভুবনমোহন বসুকে যেমন বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হয় দেরাদুনে, অন্যজনের বাবাকেও হতে হয় সমাজচ্যুত। দু’জনেরই প্রতিবাদ ছিল হিন্দুধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। ভুবনমোহন প্রতিবাদে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন, এবং তাঁর সমসাময়িক ব্রজকিশোর বসু গ্রহণ করেন ব্রাহ্মধর্ম। ব্রজকিশোর বসুর সঙ্গে পরিচয় হয়নি আমাদের, তিনি কাদম্বিনীর পিতা। কাদম্বিনী বসু, পরে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। আমাদের ইতিহাস কথনের সেই অন্য মেয়েটি। তাঁরও জন্ম, বেড়ে ওঠা বাংলার বাইরে ভাগলপুরে। ইতিহাসের এই দুই শাখানদের তাহলে দেখা হয় কোথায়? কীভাবেই বা একজনের ঢেউ অতিক্রম করে আর একজনকে? নাকি করে না? জানার জন্য চোখ ফেরাই ইতিহাসের দূরবিনে।
১৮৭০-এর দশকে দেরাদুন থেকে কলকাতায় আসেন চন্দ্রমুখী। ইচ্ছে, প্রথাগত ভাবে এফএ পরীক্ষা দিয়ে শংসাপত্র অর্জন। মনে রাখা ভালো, মেয়েদের প্রথাগত শিক্ষা, পরীক্ষা দিতে পারা ও তার শংসাপত্র অর্জন ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত ও অপ্রচলিত পথ। ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের ফলে নারীশিক্ষার সূচনা হলেও, তা অনেকক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত মুক্তমনা পরিবারগুলিরস অন্দরমহলেই আবদ্ধ ছিল। প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোধ হচ্ছিল না তা নয়। তাই প্রথাগত শিক্ষা, পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা ছিল এক দুস্তর পারাবার। কিন্তু সেই যে দু’জন আগুন মেয়ে– তারা কী করে পার করল সেই কঠিন বাধা? পারল কি আদৌ?
চন্দ্রমুখী এসে দাঁড়ান বেথুন স্কুলের দোরগোড়ায়– যদি বেথুনসাহেবের সেই স্কুলে ভর্তি হওয়া যায়, তাহলেই একমাত্র হতে পারে অসাধ্যসাধন। কিন্তু বাধ সাধল নিয়ম। তৎকালীন বেথুন স্কুলের প্রথা ছিল শুধুমাত্র হিন্দু ও ব্রাহ্ম ছাত্রীই শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে। এদিকে পিতার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের কারণে চন্দ্রমুখীর ধর্মপরিচয় খ্রিস্টান। তাই বেথুন ইস্কুলে পড়া হল না চন্দ্রমুখীর। যদিও ইতিহাসের চাকা ঘুরে এসে প্রত্যুত্তর দেয় চন্দ্রমুখীর এই অপমানের। এই কলেজই সসম্মানে অধ্যক্ষার পদে গ্রহণ করে চন্দ্রমুখী বসুকে। সমগ্র ভারতে শুধু নয়, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রথম মহিলা অধ্যক্ষা চন্দ্রমুখী।
আমরা তাঁর নাম জানি, তার কথা বলি, ভাবি। আর একজন, একই সময়ের অংশ হয়েও একই পতাকার বাহক হয়েও কেমন যেন গ্রহণের ছায়ায় ঢাকা। কার গ্রহণ? নাকি এ আমাদের কষ্টকল্পনা? ইতিহাসের সমাপতন? সে কথা জানার আগে, বোঝার আগে পরিচয় পর্ব সেরে ফেলা যাক্। যে বিদেশি গাউন পরা মেয়েটিকে দিয়ে আমাদের ইতিহাসকথন শুরু, তাঁকে ইতিহাস চেনে চন্দ্রমুখী বসু নামে। জন্ম ১৮৬০, জন্মস্থান দেরাদুন। পিতার নাম ভুবনমোহন বসু।
১৮৭৪ থেকে ১৮৮৮ – কীভাবে ঘুরল ইতিহাসের চাকা? আর ঠিক সেই সময়েই কী করছিলেন কাদম্বিনী? বেথুনস্কুলে শিক্ষার সুযোগ না পেয়ে চন্দ্রমুখী ভর্তি হলেন আলেক্সান্ডার ডাফের ফ্রি চার্চ ইনস্টিটিউশনে, যা পরে হয় স্কটিশ চার্চ স্কুল। সেখান থেকে একত্র পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলেন তিনি। কিন্তু আবারও বাধ সাধল নিয়মের শেকল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জানাল, তাদের সেই অর্থে কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, যাতে কোনও মহিলা এফএ পরীক্ষায় প্রথাগতভাবে বসতে পারেন। তাও, চন্দ্রমুখী বসুর অনুরোধ তাঁরা প্রত্যাখ্যান করছেন না। ‘স্পেশাল ক্যান্ডিডেট’ হয়ে এফএ পরীক্ষা দিতে পারেন চন্দ্রমুখী। তাই হল। ১৮৭৬ সালে ‘স্পেশাল ক্যান্ডিডেট’ হয়ে এফএ পরীক্ষা পাশ করলেন চন্দ্রমুখী। কিন্তু বিশেষ অনুমতিতে পরীক্ষা দেওয়ার ফলে তাঁর নাম সফল পরীক্ষার্থীদের তালিকায় প্রকাশ করল না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঠিক এই সময়ে কী করছিলেন কাদম্বিনী? তাঁর বয়সও তো তখন মাত্র ১৫! ভাগলপুর থেকে কলকাতায় এসেছে ঠিক চন্দ্রমুখীরই মতো ইচ্ছে নিয়ে। বাড়িতে বসে বসে পড়াশোনা নয়, রীতিমত ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চান তিনিও। ঠিক চন্দ্রমুখীর মতোই। তবে যুদ্ধ করার জন্য দু’বছর অতিরিক্ত সময় পেলেন কাদম্বিনী। সঙ্গেই ছিল দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো সহযোদ্ধার সহযোগিতা। তাই এবার হল যুদ্ধজয়। ১৮৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমতি দিতে বাধ্য হল। প্রথম এফ এ পরীক্ষার্থিনী হয়ে একই সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে নামলেন কাদম্বিনী। প্রথম হলেন পরীক্ষায়, এবং তাঁর নাম সফল পরিক্ষার্থীদের তালিকায় প্রকাশিত হল– যদিও স্বর্ণপদক কাদম্বিনীকে দিতে সম্মত হয় না বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ। ইতিহাস জানল, এফ এ বা স্নাতকস্তরের প্রবেশিকায় প্রথম উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থিনী কাদম্বিনী। ইতিহাস যা জানল না, কাদম্বিনীর দু’বছর আগেই এই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন চন্দ্রমুখী ।

প্রায় অন্তরালে, ১৯৪৪ সালে দেহরাদুনেই জীবনাবসান হয় চন্দ্রমুখী বসুর। অন্তরাল, তবে তা ছিল স্বেচ্ছা অন্তরাল। নানা ঘাত-প্রতিঘাত অনেকটাই জীবনীশক্তি কেড়ে নিয়েছিল চন্দ্রমুখীর। যদিও পরে বেথুন কলেজ থেকে কাদম্বিনীর সহপাঠিনী হয়েই অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে স্নাতক উত্তীর্ণ হন তিনি– ১৮৮২ সালে। কাদম্বিনী এরপর মেডিকেল শিক্ষার পথে যান, যে কীর্তির কথা আমাদের কম জানা নয়। যে কথা আমরা জানি না তা হল, স্নাতকোত্তর স্তরে চন্দ্রমুখীর বিশেষ যোগ্যতার খবর। ১৮৮৪ সালে চন্দ্রমুখী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা হিসেবে। ১৮৮৬ সালে বেথুন কলেজে অধ্যাপিকার পদে নিযুক্ত হন তিনি– বেথুন কলেজ তখনও বেথুন স্কুলের অংশ। ১৮৮৮ সালে পৃথক বেথুন কলেজ স্থাপিত হয়, এবং তার প্রথম অধ্যক্ষা হন চন্দ্রমুখী। তবে ১৮৯১ সালে অসুস্থতার কারণে অবসর নেন তিনি– ফিরে যান দেরাদুনে।
ইতিহাস কিছু জানে, কিছু মনে রাখে, কিছু কথা বলেও না। তবে সে ইতিহাস সংশোধিত হয়। ২০১৩ সালে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সম্মান গ্রহণ করার জন্য চন্দ্রমুখী ছিলেন না এই পৃথিবীতে। এভাবেই নদী থেকে শাখানদীতে মিশে কিছুটা লিখিত, কিছুটা অলিখিত হয়ে থেকে যায় আমাদের এই আগুন কথা। অনেক সময় এই আগুন কথায় ঢেউয়ের গুনতি হয়। কার ঢেউ বেশি, কার ঢেউ কম– এমন সব অকারণ অবান্তর গণনা। চন্দ্রমুখী বসু না কাদম্বিনী গাঙ্গুলি কার কৃতিত্ব বেশি, কারই বা কম – এমন তূল্যমূল্য সব আলোচনা। যে কথা কেউ বলে না, বলতে চায় না, তা হল আগুন মেয়েদের গল্প বলতে চায় না কেউ। যদিও বা বলে, তাতে নানান ভেজাল নুড়ি পাথর এসে মেশে – তাতে আগুন কম পড়ে যায় অনেকখানি। চন্দ্রমুখী বসু অথবা কাদম্বিনী গাঙ্গুলি– চন্দ্রমুখী বসু এবং কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। এবং আরও অনেক অনেক জন। এবং আনন্দীবাঈ, এবং রুকমাবাঈ, এবং কামিনী রায়…
স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বছরে এইটুকু ফিরিয়ে দেওয়া– খুব বেশি চাওয়া কি?
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।