চার কেজি ডিটারজেন্টের বিপুল দাম দেখে চেক আউটের সময় যখন কার্ট থেকে সরিয়ে দিতে চাই, স্ক্রিনের প্রান্ত থেকে স্প্রিংয়ের মতো একটা মেসেজ উড়ে আসে। বলে, ‘চার কেজি না হয় নিলেন না, তাহলে এক কেজি নিন।’ প্রবল আক্রোশে ক্রস চিহ্নে ক্লিক করার পরে ফের আসে, ‘তাহলে এই দেখুন একই ধরণের প্রোডাক্ট। সিমিলার আইটেম।’ অবাক হয়ে দেখি, সেগুলোর দাম কম। কিনতে বাধ্য হই।
ডিটারজেন্ট, আটা, বডি লোশনে যা হয়, সেই ম্যাজিক অ্যালগোরিদম আঁকশি বাড়িয়ে ধরে নিয়েছে দু মলাটের মধ্যে বন্দি থাকা অক্ষরকেও। সদ্য প্রকাশিত ইংরিজি বেস্টসেলারটিকে শপিং কার্টে ধরব ধরব করেও যখন অবশেষে বন্দি করতে পারি না, একটা বইয়ের জন্য ৮৯৯ টাকা খরচ করে ফেললে মাসের বাকি দিনগুলো কী করে চলবে তার ভাবনা যখন কপাল কুঁচকে দেয়, ওয়েবসাইটের আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স তখন বলে ওঠে— হার্ডকভার না হয় হোক। আছে তো ই-বুক। কিন্ডল এডিশন। মাত্র ৪৯৯। বই শপিংয়ের এমন অভিজ্ঞতার পরে আমার এক কবিবন্ধু বলেছিল, ‘স্ক্রিন থেকে যেন একটা গান উড়ে এল জানিস। তোমাকে বুঝি না প্রিয়, বোঝ না তুমি আমায়। ই-বুকটা নিয়ে দেখ সেভিংস কোথায়! পর্দায় জ্বলজ্বল করছিল, কিন্ডল এডিশন-উই রেকমেন্ড। ইউ সেভ ৪০০ টাকা মোর।’
আমাদের কি তবে মন মজেছে ই-বুকে? এই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেই দেখি ঝটপট তৈরি হয়ে যায় বহু আমরা-ওরার দল। এক পক্ষের লোকজন অন্য দলের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই বড় ইতস্তত করেন। সাবেকি বইপ্রেমীরা বলেন, ‘সাদা পাতায় ছাপা কালো অক্ষরের আবার কোনও বিকল্প হয় নাকি? আধুনিক বাইনারি যাপনে ই-মেল অবধি তাও মানা গেল। এই ই-বুকটা আবার কী জিনিস ভায়া? বই হল গিয়ে মলাটবন্দি ঐশ্বর্য্য। অক্ষরে অক্ষরে সেখানে তৈরি হয় অক্ষৌহিনী সেনা। এই অনুভূতিমালার কোনও ডিজিটাল সংস্করণ হতেই পারে না।’ নেতাজির দিল্লি চলো অভিযানের স্ট্যাচুর মতো হাত উঁচিয়ে তাঁরা ই-বইকে বলেন, ‘নিপাত যাও। তফাত যাও। সব ঝুট হ্যায়। আমার সাধের বইয়ের আলমারির সঙ্গে পাল্লা দেবে এক হলুদ রঙের তুচ্ছ ফোল্ডার? ছোঃ।’ এবার আর ধৈর্য্য রাখতে পারেন না বাইনারি বইপ্রেমীরা। বয়সের গড়ে তাঁরা সাবেকি বইপ্রেমীদের তুলনায় বেশ নবীন। সেই কারণেই হয়তো গলার স্বর কিছুটা হলেও নামানো। তাঁরা ধীরে ধীরে বলেন, ‘যদি বারণ কর তবে গাহিব না। তবে বলে রাখি, আগামী দিনের বই পড়ার অভ্যেস কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে সাত কিংবা এগারো ইঞ্চির পর্দাতেই। রিডিং মোড বলে অপশনটা কি দেওয়া হয়েছে সাধে?’ আর দু’পক্ষের ঝগড়ার সিনেমা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছলে নির্দল প্রার্থীরা আড়মোড়া ভেঙে, একটু গলা খাঁকারি দিয়ে ফোড়ন কেটে বলছেন, ‘বৃথা এ কোলাহল, হলাহল। বই পড়ার অভ্যেসটাই যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, বলি, সেদিকে খেয়াল আছে কারও?’ মুচকি হেসে, পাশ ফিরে তাঁরা ঘুমিয়ে পড়ছেন ফের।
নিজের বই প্রকাশের ঘটনাকে প্রসব যন্ত্রণার সঙ্গে তুলনা করে আমার এক গল্পকার বান্ধবী বলেছিল, ‘হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সি-সেকশন অস্ত্রোপচারের পরে যদি আমার আলিঙ্গনপ্রয়াসী হাতে একটা ছোট্ট চিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়, কেমন হয় বল তো?’ অবাক চোখে তাকিয়েছিলাম। তেমনই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি আন্তর্জালের দুনিয়ায় পাওয়া বিভিন্ন পরিসংখ্যানের দিকে। হিসাব বলছে, সারা দুনিয়ায় গড়ে প্রতি বছর যে পরিমাণ নতুন বই প্রকাশিত হয়, তার সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ। এগুলো অবশ্য সবই প্রকাশিত হয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে। এর সঙ্গে যদি নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে ছাপানো বইকেও যোগ করতে হয়, অর্থাৎ যে উদ্যোগকে আমরা সাধারণত সেল্ফ পাবলিশিং বলে জানি, তাহলে বছরভর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছাড়ায় ৪০ লক্ষ। গুগল বুকসের একটি পরিসংখ্যান বলছে, ১৪৪০ সালে গুটেনবার্গ সাহেবের ছাপাখানার দ্বার উন্মোচনের পর থেকে সারা পৃথিবীতে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৩ কোটি, সেল্ফ পাবলিশিংয়ের বই বাদ দিয়ে। গুটি গুটি পায়ে যাত্রা শুরু করলেও রকেটগতিতে উত্থান হয়েছে ই-বুকের। বছর কয়েক আগের অন্য একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রকাশিত ই-বুকের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষের কাছাকাছি। ঊর্ধ্বগতির হিসেবে এক বছর তার আগের বছরকে দশ গোল দেয়। ই-বুকের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে রঙবেরঙের তথ্য মেলে। কারও দাবি, গত পাঁচ বছরে ই-বইয়ের বৃদ্ধি হয়েছে ২৬৭ শতাংশ। ওয়েবের অন্য ঠিকানা এই তথ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে জানান দেয়, যতটা বেড়েছি ভেবেছিলে, আমার বৃদ্ধি আরও অনেক বেশি। পাঁচ বছরে ই-বইয়ের সংখ্যায় ৪১৯ শতাংশ বেড়েছি আমি। হিসেব রাখতে জানতে হয়!
সাবেকি বই এবং ই-বইয়ের আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি করার উপকরণ আমাদের চারপাশে মজুত থাকলেও ভারতীয় বাজারের কেমন গতিবিধি, তা জানতে বড় বেগ পেতে হয়। বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনের দরজায় কড়া নেড়েও কোনও বিশ্বাসযোগ্য রসদ মেলে না। বাংলা প্রকাশনার বেশ কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে সবার প্রথমেই যে রিঅ্যাকশন পেয়েছি, তার সারমর্ম হল, ‘ওইসব পিডিএফ টিডিএফ বাংলা বাজারে চলবে না ভাই। আমরা আজও বই বলতে দু’মলাটের মধ্যে ছাপানো পাতাকেই বুঝি। ওটাই বুঝব। এ ছাড়া বইয়ের কোনও বিকল্প ছিল না। অদূর ভবিষ্যতেও হবে না।’ চিরাচরিত বই আর ই-বইয়ের বিশ্বসংসারের পরিসংখ্যান বাতলে আলোচনা খানিক প্রলম্বিত করতে চেয়েছিলাম। কোনও লাভ হয়নি। এক প্রকাশকের থেকে উল্টে শুনেছিলাম, ‘বইমেলায় এলে আমাদের স্টলে এসে ক্যাটালগটা নিয়ে যাবেন। তার পাতার সংখ্যা কিন্তু প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। ই-বইটইয়ের ক্ষেত্রে বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। বুঝলেন?’
প্রবীণ লেখকদের কথা জানি না। তবে ২৫ থেকে ৩৫ কিংবা ৪০ বছরের বন্ধনীতে যে লেখকরা পড়েন, বাংলাতেই লেখালিখি করাটাকে যাঁরা তৃপ্ত চুমুকের মতো মনে করেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু শুধু সেলুলোজের পাতায় বই হয়ে বন্দি হতে নারাজ। খুচরো বিপণন সংস্থায় কর্মরত আমার এক কবিবন্ধুকে এ প্রসঙ্গে আওড়াতে শুনেছিলাম, ‘এমনি এমনি সবকিছু তো ওমনি হল না।’ বললাম, ‘বুঝিয়ে বল্।’ আমি কান পেতে রই। নিজের ভিজিটিং কার্ডটা বের করে দেখাল। দেখি তাতে লেখা, প্রোকিওরমেন্ট ম্যানেজার, ওমনিচ্যানেল। বলল, ‘ওমনির মানে কী জানিস? অফলাইনে যেমন আছি, ঠিক তেমন আছি অনলাইনেও। একে বলা হয় ওমনিপ্রেজেন্স। দু’লাইনেই সমানভাবে পা ফেলতে না জানলে যে বেলাইন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। লেখার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।’ জানতে পেরেছিলাম, বই যদি কারও মেধার সন্তান হয় এবং ওই সন্তানের গায়ে যদি প্রোডাক্টের তকমা দিই, তা হলে প্রোডাক্টটিকে বইয়ের আলমারি আর বাইনারি আলমারি দু জায়গাতেই চলনশীল করার জন্য ভাবা জরুরি, আগামী দিনের কথা ভেবে। আমার কপালে একটা মৃদু টোকা দিয়ে ও বলছিল, ‘পেল্লায় গ্রামোফোন রেকর্ড যা করত, আজ টিপের মতো বাফারিং চিহ্নও সেই একই কাজ করে। বদলকে ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই।’
নতুন বইয়ের কিন্ডল এডিশন কিংবা ই-বুক প্রকাশ করার ব্যাপারটা যদি প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলানো হয়, তা হলে বলা যায়, বাংলা ভাষায় কাজ করা বেশ কিছু প্রকাশক এই পথে সামিল হয়েছেন। অনেক নতুন বইয়ের শুধুমাত্র ই-বুক সংস্করণ হয়েছে, হয়তো পরীক্ষামূলকভাবে। দেড়শ দুশ পাতার বইয়ের দাম তিরিশ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। হিসেবটা খুব সোজা। ই-বুক তৈরি করার খরচ, যাকে আমরা প্রোডাকশন কস্ট বলে জানি, তা হল নামমাত্র। আশায় বুক বেঁধে এই বিপুল বেঁচে যাওয়া অর্থের সিংহভাগ প্রকাশকরা খরচ করেছিলেন অনলাইন বিপণনে। প্রাপ্তি যতটা হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি হোঁচট খেয়েছেন তাঁরা। এমনই এক নবীন প্রকাশক বলছিলেন, ‘ইগলের ডানা মেলার মতো ক্রেডিট কার্ডটা হাঁকিয়ে ওটিটিতে আমরা মাসে তিনশ টাকা ভরে ফেলতে পারি অবলীলায়, কিন্তু তিরিশ টাকা খরচ করে একটা বই ডাউনলোড করতে আমাদের রক্ত ঝরে খুব।’ জানতে পেরেছিলাম, প্রকাশ পাওয়ার এক মাসের মধ্যে কোনও ই-বুকের মোট ডাউনলোডের সংখ্যা দশও পেরোয়নি। নতুনভাবে কিছু ভাবতে চাওয়া, করতে চাওয়া মানুষদের কাছে এমন পরিসংখ্যান পিছন থেকে কলার চেপে ধরে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
বই পড়ার হাল হকিকত এবং ভূত ভবিষ্যত নিয়ে মাথা ঘামানো মানুষদের মতে দুটোর একটা সাধু মিশেল বড় জরুরি আজকের দিনে। ফেসবুকে বেশ কিছু বাংলা বইপ্রেমীদের গ্রুপ আছে। প্রতিটিরই সদস্যসংখ্যা লক্ষাধিক। সেখানে দিন-রাত বই নিয়ে আলোচনা চলে। চলে তর্ক বিতর্কও। দিনকয়েক আগে দেখলাম, ফেলে আসা বছরে কী কী বই পড়েছেন, ডায়েরির পাতায় তার তালিকা লিখে, ফোটো তুলে শেয়ার করেছেন বেশ কয়েকজন। কোনটা খুব ভাল লেগেছে আর কোনটা তেমন ভাল লাগেনি, তা নিয়ে কমেন্টের বন্যা বয়। আঙুল দিয়ে স্ক্রিনে নৌকা চালানোর সময় প্রায়ই দেখি, ‘পিডিএফটা হবে?’ উত্তর আসে, ‘ইনবক্স করেছি। দেখে নেবেন।’ ফিরতি কমেন্টে আসে থাম্বস আপ চিহ্ন। এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখেন প্রকাশকমহল। বইয়ের পিডিএফ মানে রয়্যালটির খাতায় শূন্যতা। পিডিএফ বাড়লে আরও বেশি মানুষের কাছে বই পৌঁছয় হয়তো। কিন্তু লেখক ও প্রকাশকরা এর বিনিময়ে কিছু পান না। আর ই-বুক না থাকলে বহু মানুষ বই কেনার আগে দশ বার ভাবেন। বৃহত্তর স্বার্থে আখেরে কোনটা ভাল আর কোনটাই বা মন্দ তা নিয়ে রায় দেওয়া বেশ মুশকিল। দাড়িপাল্লার কাঁটাটা পেন্ডুলামের মতো দোল খায়। উত্তর মেলে না।
ই-বইয়ের অবৈধ চালাচালি বন্ধ করার জন্য প্রযুক্তির কিন্তু অভাব নেই। বহুজাতিক প্রকাশকরা, অনলাইন বিপণিরা এমনভাবে ই-বুক তৈরি করছেন, যার ফলে যে ব্যক্তি পয়সা দিচ্ছেন, বইয়ের কপিটি তাঁর ডিভাইসেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই নয়া প্রযুক্তির হাত ধরতে চাইলে হয়তো প্রকাশকদের খরচও বাড়ে। বাংলা বইয়ের দুনিয়ায় এমন প্রযুক্তিকে উলু দিয়ে বরণ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি অনেক।
অক্ষরে অক্ষরে মিশে থাকে বেঁচে থাকার অক্সিজেন। দু’দশক পরের কথা আপাতত থাক। পাতা না পর্দা— কে হবে আমাদের পরমাত্মীয় সে প্রশ্ন সময়ের গর্ভেই এখন শ্বাস ফেলুক স্বস্তিতে। বই দীর্ঘজীবি হোক।
ছবি সৌজন্য: Pexels, Wired, Wikimedia,
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।